মঙ্গলবার | ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:৩৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
মজন্তালির বংশধর : নন্দিনী অধিকারী অপ্রতিরোধ্য আরাকান আর্মি রাখাইন পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা সংকট : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (অষ্টম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন স্বর্গলোকে মহাত্মা ও গুরুদেবের সাক্ষাৎকার : সন্দীপন বিশ্বাস বই ছাপানো নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড : সাইফুর রহমান শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘শান্তিগন্ধা’ বিজেপির প্রভাবেই কি নির্বাচন কমিশনের আচমকা ভোট বৃদ্ধি : তপন মল্লিক চৌধুরী শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষষ্ঠ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নগ্ন নৃত্যে বাংলায় বৃষ্টির ব্রত – পুণ্যিপুকুর, হুদুম দেও, ব্যাঙের বিয়ে : রিঙ্কি সামন্ত শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন বিজন প্রাণের প্রাঙ্গণে : সন্দীপন বিশ্বাস বিভূতিভূষণের পান্ডুলিপি — ‘পথের পাঁচালী’ : সবিতেন্দ্রনাথ রায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্থ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (শেষ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের বিদেশি ফটোগ্রাফার : দিলীপ মজুমদার দর্শকের অগোচরে শুটিং-এর গল্প : রিঙ্কি সামন্ত রশ্মির নাম সত্যজিৎ “রে” … : যীশু নন্দী হুগলিতে মাধ্যমিকে চতুর্থ ও দশম উল্লেখযোগ্য ফলাফলে নজর কাড়ল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (তৃতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (ষষ্ঠ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের স্প্যানিশ ফ্লু হয়, পেরুযাত্রার সময় : অসিত দাস গাইনোকলজি ও গাইনি-ক্যান্সারে রোবোটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারীর ভূমিকা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ছোটগল্পকার আলাউদ্দীন আল আজাদ : আবু জাফর রেহমান শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (পঞ্চম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাতি ফোলালেও আম জনতাকে ভোট কেন্দ্রে টানতে পারেননি : তপন মল্লিক চৌধুরী আলুর দামে রাশ টানতে না পারলে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’

আন্তন চেখভ / ৬৭ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সাত সকাল থেকে আকাশ ঢেকে রয়েছে বর্ষার মেঘে, দিনটি স্থির শান্ত, শীতল এবং বিষণ্ণ, কুহেলিকায় ভরা অস্পষ্ট সেই দিনগুলির একটি, যখন মেঘগুলি ক্রমান্বয়ে নেমে আসতে থাকে ক্ষেতের ওপর আর মনে হয় এই এক্ষনি বৃষ্টি হবে, কিন্তু বৃষ্টি আসে না। পশু চিকিৎসক ইভান ইভানিচ এবং হাই স্কুলের শিক্ষক বুবুরকিন হে’টে হে’টে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তবু মাঠ মনে হচ্ছে সীমাহীন। বহু দূরে মিরনোসিৎস্কয়ে গ্রামের হাওয়া-কলের আভাস মাত্র তাঁদের নজরে পড়ে, আর ডানদিকে গ্রাম সীমানার বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত এক সারি নীচু পাহাড়ের মতো যেটাকে মনে হয়, দুজনেই জানেন এই পাহাড় সারি আসলে নদীর তীর, আর সেটা ছাড়িয়ে মাঠ প্রান্তর, সবুজে উইলো গাছ, বাগান-বাড়ি। তাঁরা জানেন একটি পাহাড়চূড়ায় উঠলে দেখা যাবে সেই একই সীমাহীন প্রান্তর আর টেলিগ্রাফ পোষ্টগুলি, আর দূরে শুয়োপোকার মতো মন্থরগতি ট্রেন; আবহাওয়া উজ্জ্বল থাকলে শহরটাও দেখা যাবে। এই শান্ত দিনটিতে সমগ্র প্রকৃতি যেন মমতাময়ী ও ধ্যানমগ্না হয়ে রয়েছে। সহসা ইভান ইভানিচ এবং বুবুরকিন এই প্রান্তরের প্রতি একটি অনুরাগের আবেগ বোধ করলেন, ভাবলেন, তাঁদের দেশ কত বিশাল আর কত সুন্দর।

বুবুরকিন বললেন, ‘মোড়ল প্রকোফির চালাঘরে আগের বার যখন ছিলাম তখন তুমি বলেছিলে যে একটা গল্প বলবে।’

‘হ্যাঁ, আমার ভাইয়ের কাহিনী বলতে চেয়েছিলাম।’

ইভান ইভানিচ একটি দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে গল্প বলার আগে পাইপ ধরিয়ে নিলেন, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বৃষ্টি এল। পাঁচ মিনিট পরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল, কখন যে তা থামবে কেউ বলতে পারে না। ইভান ইভানিচ আর বুবুরকিন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন চিন্তায় ডুবে গিয়ে। কুকুরগুলির দেহ সিক্ত হয়ে গেছে, ল্যাজ নামিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে রইল তাঁদের দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে ।

বুবুরকিন বললেন, ‘আশ্রয় খুঁজে বার করতে হয়। চলো আলেখিনের বাড়ি যাই। এই তো কাছে।’

‘তাই চলো।’

পাশ ফিরে তাঁরা সোজা ফসল-কাটা ক্ষেতের ওপর দিয়ে হেঁটে চললেন, তারপর ডানদিকে বে’কে সড়কে এসে পৌঁছলেন। একটু পরেই চোখে পড়ল পপলার গাছের সারি, ফলের বাগান, আর খামার বাড়িগুলির লাল ছাদ। নদী ঝকঝক করছে। একটি প্রসারিত জলাশুয়ের বিস্তার, একটি হাওয়া-কল, আর শাদা একটি চান করার চালাঘর। এ হচ্ছে সোফিনো, এখানে থাকেন আলেখিন।

মিলটা চলছে, তার পাখার শব্দ বৃষ্টির আওয়াজকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, সমস্ত বাঁধটা কাঁপছে থরথর করে। ঘোড়াগুলি ভিজে চুপসে কতকগুলো গাড়ির কাছে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর লোকজন কাঁধে মাথায় বস্তা নিয়ে ইতস্তত চলাফেরা করছে। ভিজে স্যাঁতসেতে, কর্দমাক্ত, বিষণ্ণ পরিবেশ, জলটাকে মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা আর অশুভ। ইভান ইভানিচ এবং বুরকিনের জলে ভিজে কাদাময়লায় এবং দৈহিক অস্বস্তিতে বিশ্রী লাগছিল। তাঁদের জুতো কাদায় একেবারে মাখামাখি হয়ে গেছে। এইভাবে মিল-বাঁধ ছাড়িয়ে যখন তাঁরা মালিকের খামার বাড়ির ঊর্ধ্বমুখী পথ ধরে এগুলেন তখন যেন পরস্পরের প্রতি বিরক্তি বোধ করে ওঁরা একেবারে নীরব হয়ে গেলেন।

একটা খামার থেকে তুষ-ঝাড়ার শব্দ আসছে। তার দোর খোলা। ভেতর থেকে রাশি রাশি ধূলো উড়ে আসছে। দোরগোড়ায় আলেখিন স্বয়ং দাঁড়িয়ে। বছর চল্লিশেক বয়সের হৃষ্টপুষ্ট লম্বা লোকটি, মাথায় লম্বা চুল, দেখতে বরং জমিদারের চেয়ে অধ্যাপক কিংবা শিল্পীর মতো। গায়ে তাঁর সাদা সার্ট, না কাচলে আর নয়, একটা দড়ি দিয়ে বেল্টের মতো করে সার্টটি বাঁধা, পরনে লম্বা ড্রয়ার, তার ওপর পাৎলুন নেই। তাঁর বুটও কাদায় ও খড়ে ভরা। ধূলোয় চোখ নাক কালো। ইভান ইভানিচ এবং বুবুরকিনকে চিনতে পারলেন তিনি, মনে হল ওঁদের দেখে খুশি হয়েছেন।

মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘বাড়িতে উঠুন মশায়েরা। আমি এই এক্ষনি আসছি।’

বড়ো দোতলা বাড়ি। একতলায় থাকেন আলেখিন। দুখানা ঘর, তার সিলিং খিলানওয়ালা, ঘরের জানালাগুলি খুব ছোটো ছোটো, পূর্বে এ ঘরে থাকত নায়েব গোমস্তারা। ঘরে সাজসজ্জা আসবাবপত্র সাদাসিধে, রাই-রুটি, সস্তা ভদকা আর ঘোড়ার সাজের গন্ধে ভরা। অতিথি অভ্যাগতের আগমন না হলে আলেখিন ওপর তলার ঘরে প্রায় ঢোকেনই না। ইভান ইভানিচ এবং বুবুরকিনকে স্বাগত জানাল একটি চাকরাণী, তরুণী মেয়েটি এমন সুন্দরী যে ওঁরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে পড়লেন চুপ করে এবং দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

হলঘরে তাঁদের কাছে এসে আলেখিন বললেন, ‘বন্ধু, এখানে আপনাদের দেখে আমি যে কী খুশি হয়েছি তা ধারণাও করতে পারবেন না! এমন অপ্রত্যাশিত!’ তারপর চাকরাণীর দিকে ফিরে বললেন, ‘পেলাগেয়া, ভদ্রলোকদের শুকনো কাপড়চোপড় দাও। আমারও পোষাক বদলানো দরকার। কিন্তু আগে আমার চান করা চাই, মনে হচ্ছে সেই বসন্তকালের পরে আর চানই করিনি। আপনারাও যাবেন নাকি, চান করে নেবেন? ইতিমধ্যে এরা সব ব্যবস্থা করে দেবে।’

সুন্দরী পেলাগেয়াকে ভারি নম্র এবং রুচিশীলা দেখাচ্ছে। সে তাঁদের গা মোছবার চাদর আর সাবান এনে দিল, তারপর আলেখিন আর তাঁর অতিথিরা চললেন চানঘরের দিকে। জামাকাপড় খুলে আলেখিন বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেকদিন চান করিনি। আপনারা এই যে চমৎকার চানের জায়গাটি দেখছেন এটি তৈরি করেছিলেন আমার বাবা, কিন্তু আমি কেমন করে যেন চান করার সময়ই পাই নে।’

সিঁড়ির ওপরে বসে লম্বা চুল আর ঘাড়ে সাবান লাগালেন তিনি, তাঁর চারদিকে জলটা বাদামী হয়ে উঠল।

গৃহকর্তার মাথার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে ইভান ইভানিচ বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি নিশ্চয় … .

‘চান করেছি সে বহুদিন হয়ে গেল …’ একটু লজ্জা পেয়ে আলেখিন বললেন আবার, তারপর আবার সারা গায়ে সাবান লাগালেন, এবার জলটা হয়ে উঠল ঘন নীল, কালির মতো।

চালার তলা থেকে বেরিয়ে ইভান ইভানিচ সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে, বৃষ্টির মধ্যে সাঁতার কাটতে লাগলেন হাত ছড়িয়ে দিয়ে, চতুর্দিকে তাঁর তরঙ্গ সৃষ্টি হতে লাগল, আর শাদা কুমুদ ফুলগুলি সেই ঢেউয়ে লাগল দুলতে। সাঁতরে একেবারে নদীর মাঝখানে চলে গেলেন তিনি, তারপর ডুব দিয়ে একমূহূর্ত পরে অন্য আর এক জায়গায় ভেসে উঠলেন এবং আরো সাঁতার কেটে চললেন। বার বার ডুব দিয়ে নদীর নীচে মাটি ছুঁতে চেষ্টা করতে লাগলেন। আমোদ পেয়ে বার বার বলতে লাগলেন, ‘হে ঈশ্বর … ‘আহ্ ভগবান …’ সাঁতরে তিনি কলের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে কয়েকজন কিষানের সঙ্গে দুটো কথা বলে ফিরলেন। কিন্তু নদীর মাঝামাঝি এসে বৃষ্টি ধারার দিকে মুখ রেখে চিৎ হয়ে ভাসতে লাগলেন ইভান ইভানিচ। বুবুরকিন এবং আলেখিন জামাকাপড় পরে বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তিনি সাঁতার কেটে আর ডুব দিয়েই চললেন।

আর বার বার বলতে লাগলেন, ‘ঈশ্বর! ঈশ্বর! ওগো ভগবান!’

বুবুরকিন চেঁচিয়ে বললেন তাঁকে, ‘এই চলে এসো!’

ওঁরা ফিরে এলেন বাড়িতে। তারপর ওপর তলায় বড়ো বৈঠকখানায় আলো জ্বালানো হল। বুরকিন আর ইভান ইভানিচ রেশমের ড্রেসিং গাউন আর গরম চটি পরে বসলেন আর্ম চেয়ারে, আর আলেখিন চান করার পর চুল আঁচড়ে নতুন ফ্রককোট পরে পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের উষ্ণতা, পরিচ্ছন্নতা, শুকনো পোষাক আর আরামের চটির স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করতে করতে।

এদিকে রূপসী পেলাগেয়া মমতার হাসিতে মুখে ভরিয়ে চা আর খাবারের ট্রে নিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে এল কার্পেটের ওপর দিয়ে। ইভান ইভানিচ শুরু করলেন তাঁর গল্প, আর মনে হতে লাগল যেন বুরকিন আর আলেখিন নয়, সোনা বাঁধানো ফ্রেম থেকে প্রাচীন মহিলা, তরুণী এবং সৈনিক মহোদয়েরাও সে গল্প শুনেছেন। তাদের দৃষ্টি শান্ত ও কঠোর।

‘আমরা ছিলাম দুই ভাই,’ ইভান ইভানিচ শুরু করলেন। ‘আমি ইভান ইভানিচ আর আমার চেয়ে দু বছরের ছোটো আমার ভাই নিকলাই ইভানিচ। আমি গেলাম লেখাপড়া শিখতে, হলাম পশুচিকিৎসক; কিন্তু নিকলাই মাত্র উনিশ বছর বয়সে এক সরকারী অফিসে চাকরীতে লাগল।

বাবা চিমসা- হিমালাইস্কি একটা স্কুলে শিক্ষালাভ করেছিলেন, স্কুলটা ছিল সৈনিক প্রাইভেটদের ছেলেদের জন্য; পরে অবশ্য তিনি অফিসার র্যা ঙ্কে প্রমোশন পান, তাঁকে বংশানুক্রমিক নোবল করা হয় এবং ছোটো একটি জমিদারি দেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যুর পর দেনার দায়ে সে সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়েছে, কিন্তু আমাদের ছেলেবেলাটা অন্তত কাটতে পেরেছে পল্লীর অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে। সেখানে আমরা কিষান ছেলেদের মতো মাঠে বনে ঘুরে বেড়াতুম, ঘোড়া চরাতে যেতুম, লাইম গাছের গা থেকে ছাল ছাড়িয়ে নিতুম, মাছ ধরতুম, এই ধরনের নানা কাজ করে বেড়াতুম। যে লোক জীবনে একবার পার্চ ধরেছে কিংবা চোখ ভরে দেখেছে শরৎকালের মেঘমুক্ত শীতল দিনে গ্রামের ওপর বহু উঁচু দিয়ে গরম দেশে উড়ে যাওয়া থ্রাশ পাখিদের, শহরের জীবনে সে আর খাপ খাবে না, সারা বাকী জীবন ধরে সে কেবল পল্লীর জীবন কামনা করবে। সরকারী অফিসে বসে আমার ভাইয়ের মন খারাপ হয়ে যেত। বছরের পর বছর কেটে যায়, সে কিন্তু প্রতিদিন একই জায়গায় গিয়ে বসে, একই দলিলপত্র লিখে চলে, আর সব সময় একই চিন্তা থাকে মাথায় — কেমন করে ফিরে যাওয়া যায় গ্রামে। তার এই স্পৃহা ক্রমে ক্রমে একটি দৃঢ় নির্দিষ্ট অভিপ্রায়ের রূপ নিল, স্বপ্ন হয়ে উঠল কোনো একটি নদীর ধারে কিংবা হ্রদের পারে একটি ছোট্ট ভূসম্পত্তি কেনা।

আমার ভাইটি ছিল ভারি বিনম্র সুশীল প্রকৃতির ছেলে; তাকে আমি ভালোবাসতাম, কিন্তু তার নিজের ভূসম্পত্তির মধ্যে সারা জীবন আবদ্ধ করে রাখার বাসনার প্রতি কোনো সহানুভূতি আমার ছিল না। লোকে বলে মানুষের প্রয়োজন মোটে চার হাত ভূমি। কিন্তু এই চার হাত জমি প্রয়োজন হয় শবের, মানুষের নয়। এখন আবার লোকে বলতে শুরু করেছে, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যে জমির জন্য লালায়িত হয়ে উঠেছে এবং ভূসম্পত্তি সংগ্রহের চেষ্টা করছে এটি খুব ভালো লক্ষণ। তবু এই সকল ভূসম্পত্তি তো সেই চার হাত ভূমি ছাড়া আর কিছুই নয়। শহর থেকে, সংগ্রাম থেকে, জীবনের কলরব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া, পরিত্রাণ পেয়ে ভূসম্পত্তির মধ্যে মাথা লুকোনো, এ তো জীবন নয়, এ হল অহমিকা, অলসতা, এ এক ধরনের বৈরাগ্য। কিন্তু সে বৈরাগ্যের মধ্যে কোনো প্রত্যয় নেই। মানুষের প্রয়োজন মাত্র চার হাত জমি নয়, মাত্র একটি ভূসম্পত্তিতে তার প্রয়োজন মেটে না, তার চাই সারা পৃথিবীটা, প্রকৃতির সর্বস্ব চাই তার, যাতে সে তার নিজের ক্ষমতা ও আত্মার স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করতে পারে।

আফিসের ডেস্কে বসে আমার ভাই নিকলাই স্বপ্ন দেখত তার নিজের বাড়ির বাঁধাকপি দিয়ে তৈরি সুপ খাবে যার বাস ছড়িয়ে পড়বে তার নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণ জুড়ে, স্বপ্ন দেখত বাড়ির বাইরে গিয়ে আহার করবে সবুজ ঘাসের ওপর; রোদে শুয়ে নিদ্রা দেবার স্বপ্ন দেখত, স্বপ্ন দেখত বাড়ির ফটকের বাইরে একটি বেঞ্চির ওপর সে বসে থাকবে ঘন্টার পর ঘণ্টা, আর তাকিয়ে থাকবে মাঠ আর বনের দিকে। কৃষি বিজ্ঞানের বই আর ক্যালেণ্ডারে ছাপা নানারকম পরামর্শে সে আনন্দ পেত, সেগুলি ছিল তার প্রিয় পারমার্থিক তৃপ্তির বস্তু। খবরের কাগজ পড়তেও সে ভালোবাসত, কিন্তু খবরের কাগজে পড়ত সে বিজ্ঞাপন, যাতে ছাপা থাকত এই এত একর চাষযোগ্য ও মেঠো জমি বিক্রি হবে, সঙ্গে লাগোয়া বসতবাটি, একটি নদী, একটি ফলের বাগান, একটি হাওয়া-কল আর পুকুরগুলি, যাতে জল আসে ঝরণা থেকে। তার মাথায় ভরা ছিল বাগানের পথ, ফুল ফল, তৈরি পাখির বাসা, মাছ ভর্তি পুকুর, আর এই রকম সব জিনিসের স্বপ্ন। যেমন যেমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ত তেমন তেমন বদল হত তার স্বপ্ন, কিন্তু কী জানি কেন তার কল্পনায় গুজবেরির ঝোপগুলো সর্বদাই লেগে থাকত। মনে মনে এমন কোনো ভূসম্পত্তি বা মনোরম নিভৃত কোণ সে কল্পনাতেই আনতে পারত না যেখানে গুজবেরির ঝোপ নেই।

সে বলত, “পল্লী জীবনের নানা সুবিধা রয়েছে। বারান্দায় গিয়ে বোসো, চা খাও বসে বসে, চোখে দেখো তোমারই হাঁসগুলি ভেসে চলেছে পকুরে, আর সব কিছুতে এমন চমৎকার গন্ধটি জড়ানো, আর … আর ঝোপের মধ্যে পেকে উঠেছে গুজবেরি।”

সে তার ভূসম্পত্তির নকসা আঁকত, সব নকসাতেই দেখা যেত একই বৈশিষ্ট্য : ক) মূল বসতবাটি, খ) চাকরবাকরদের ঘরদোর, গ) সবজি বাগান, ঘ) গুজবেরির ঝোপ। সে থাকত অত্যন্ত হিসেব করে, কখনো পেট ভরে পানাহার করত না, ভিখিরীর মতো সাজপোষাক করত, আর এইভাবে ব্যাঙ্কে টাকা জমাত। ভয়ানক কৃপণ হয়ে উঠল সে। তার দিকে আমি তাকাতে পারতাম না, আর যখনই সামান্য কিছু টাকাকড়ি পাঠাতুম তাকে কিংবা কোনো একটা উৎসব উপলক্ষে কোনো উপহার পাঠাতুম, সে তাও জমিয়ে রাখত। মানুষের মাথায় একটা কোনো ধারণা ঢুকে গেলে তাকে দিয়ে আর কিছু করানো যায় না।

আরো কাটল কয়েকবছর। তাকে পাঠানো হল অন্য প্রদেশে আর এক সরকারী আফিসে। বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেল। তখনো সে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন পড়ে, আর টাকা জমায়। শেষে একদিন শুনতে পেলাম সে বিয়ে করেছে। সেই একই উদ্দেশ্যে, গুজবেরির ঝোপওয়ালা একটি ভূসম্পত্তি কেনবার জন্য সে বিয়ে করল এক কুরূপা বয়স্কা বিধবাকে, মহিলার প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা ছিল না। বিয়ে করেছিল কারণ তার কিছু টাকাকড়ি ছিল। বিয়ের পরেও বরাবরের মতোই মিতব্যয়ী জীবন যাপন করে চলল নিকলাই, বউকে আধপেটা খাইয়ে আর বউ-এর টাকা ব্যাঙ্কে তার নিজের নামে জমা করে নিয়ে। মেয়েটির প্রথম পক্ষের স্বামী ছিলেন পোষ্টমাষ্টার, মিষ্টি রুটি আর ফলেব মদ খেতে সে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় স্বামীর কাছে এসে পর্যাপ্ত কালো রুটিও সে খেতে পেত না। এ রকম সংসারে পড়ে সে নির্জীব হয়ে পড়ল, তিন বছর পরে তার আত্মা বিলীন হয়ে গেল ভগবানে। আমার ভাই অবশ্য স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য নিজেকে বিন্দুমাত্র দায়ী মনে করল না। টাকা ভদকার মতোই মানুষকে খামখেয়ালী করে তোলে। আমাদের শহরটিতে ছিল এক বণিক, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সে একবাটি মধু চেয়েছিল। সেই মধু দিয়ে তার সমস্ত ব্যাঙ্ক নোট এবং লটারীর টিকেট খেয়ে ফেলেছিল, যাতে আর কেউ সে সব না পায়। আমি একদিন রেলস্টেশনে একপাল গরু ভেড়া পরীক্ষা করে দেখছিলাম, এমন সময় এক ব্যাপারী পড়ে গেল এঞ্জিনের তলায়, পা-টা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রক্তে মাখা লোকটিকে ধরাধরি করে আমরা নিয়ে এলাম হাসপাতালে, ভয়ঙ্কর দৃশ্য ; কিন্তু লোকটা তার পা খুঁজে দিতে বারবার অনুরোধ করল, কেবল তার দুশ্চিন্তা — বাটে বিশটা রুবল ছিল, সে ভয় পাচ্ছিল ও টাকা বুঝি তার হারিয়ে যাবে।’ বুরকিন বললেন: ‘গল্পের সূত্র হারিয়ে যাচ্ছে তোমার।’

একটু থেমে ইভান ইভানিচ আবার বলে চললেন, ‘স্ত্রী মারা যাবার পর আমার ভাই ভূসম্পত্তির খোঁজখবর করতে শুরু করল। পাঁচ বছর ধরে লোকে একটা জিনিষ অবশ্যই খুঁজে বেড়াতে পারে তারপর শেষে একটা ভুল হয়ে যায়, এমন কিছু কিনে বসে যা এতদিনের কল্পনার সঙ্গে একেবারে মেলে না। আমার ভাই নিকলাই তিনশ একরের একটি ভূসম্পত্তি কিনল, তাতে বসতবাটি, চাকরবাকরদের থাকবার জায়গা, একটি বাগান সবই আছে, সেই সঙ্গে রয়েছে একটি বন্ধকনামা, তার টাকা এক এজেন্ট মারফৎ দিতে হবে। কিন্তু তাতে না আছে ফলের বাগান, না গুজবেরির ঝোপ, না পুকুরে সাঁতার কাটা হাঁস। একটা নদী ছিল, কিন্তু তার জল একেবারে কফির মতো কালো, কারণ ভূসম্পত্তির একদিকে ছিল ইটখোলা আর অন্যদিকে একটা হাড় পোড়ানোর কারখানা। কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে আমার ভাই নিকলাই ইভানিচ দুডজন গুজবেরি ঝোপের ফরমাশ দিল এবং জমিদারের মতো সেখানে স্থায়ী হয়ে বসল।

গতবছর তার কাছে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সেখানে তার কেমন চলছে দেখে আসব। চিঠিতে সে আমাকে ঠিকানা দিয়েছিল ‘চুমারোক্লভা পুশতোশ বা হিমালাইস্কয়ে’। হিমালাইস্কেতে এলুম বিকেলে। ভয়ানক গরম। চারদিকে খাল, বেড়া, ফারগাছের সারি, প্রাঙ্গণে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া এবং গাড়ি রাখবার জায়গা পাওয়া শক্ত। আমি ঢুকতেই বেরিয়ে এল লালচে রঙের একটা মোটা কুকুর, শূওরের সঙ্গে তার অদ্ভুত সাদৃশ্য। ওটাকে দেখে মনে হচ্ছিল অমন অলস না হলে সে বোধ হয় ঘেউ ঘেউ করে উঠত। রাঁধনীটাও মোটা এবং শূওরের মতো রসুইঘর থেকে সে খালি পায়ে বেরিয়ে এসে বলল যে, গৃহকর্তা খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করছেন। ভাই-এর ঘরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম সে বসে আছে বিছানার ওপর, হাঁটুদুটো কম্বলে ঢাকা। বার্ধক্য এসেছে তার, মোটা থলথলে হয়ে উঠেছে। তার গাল, নাক, ঠোঁট কেমন বাইরে দিয়ে ঠেলে উঠেছে — আমার মনে হচ্ছিল এই বুঝি কম্বলের মধ্যে সে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠবে।

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আমরা কাঁদলাম, হর্ষ বিষাদে মেশানো সে অশ্রু, কাঁদলুম এই জন্য যে, এককালে আমরাও তরুণ ছিলাম, কিন্তু এখন আমাদের চুল পেকে গেছে, ধীরে ধীরে মরণের পথে এগিয়ে চলেছি। সে এরপর জামাকাপড় পরে নিল এবং আমাকে তার ভূসম্পত্তি দেখাতে নিয়ে চলল।

আমি শুধোলাম, “এখানে চলছে কেমন?”

“বেশ কাটছে, ভগবানের দয়ায় বেশ সুখে আছি।”

সে আর সেই দরিদ্র ভীরু কেরাণীটি নেই, সে এখন সত্যিকারের মালিক, একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। স্থায়ী হয়ে সে বসেছে, সোৎসাহে পল্লীজীবনের মধ্যে প্রবেশ করছে। প্রচুর খায়দায়, স্নানাগারে চান করে শরীরে বেশ মাংস হয়েছে তার। ইতিমধ্যেই গ্রাম্য সমাজ, ইটখোলা এবং হাড় পোড়ানো কলের সঙ্গে সে মামলায় জড়িয়েছে, আর চাষীরা ‘হুজুর’ না

বলে সম্বোধন করলে সে রাগ করে। ধর্ম কর্ম সে করে আড়ম্বরে, ভদ্রলোকের মতো, জমক দেখানো সৎকাজের মধ্যে কোনো রকম সরলতা নেই। কী তার সৎকাজ? চাষীদের সর্বরোগের চিকিৎসা করে সে সোডা আর ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে, তার নামকরণের দিনে এক বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উৎসব অনুষ্ঠান করায়, তারপর আধ হাঁড়ি ভদকা বিলিয়ে মনে করে বুঝি এটাই ঠিক কাজ । সে যে কী সাংঘাতিক আধ হাঁড়ি ভদকা বিতরণ! তার জমিতে ভেড়া চরিয়েছে বলে আজ স্থুলবপু জমিদার জেমস্তভোর কর্তার সামনে চাষীদের টেনে নিয়ে যায় আর কাল আমোদের দিনে সে তাদের বিলিয়ে দেয় আধ হাঁড়ি ভদকা। তারা তাই খায় আর চেঁচিয়ে জয়ধ্বনি দেয়, তারপর মাতাল হয়ে গেলে তার সামনে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দেয়।

যে কোনো রাশিয়ানের অবস্থা একটু ফিরলেই, একটু তৃপ্তি কিংবা কুঁড়েমি দেখা দিলেই তার মধ্যে সৃষ্টি হয় আত্মসন্তুষ্ট ঔদ্ধত্য। সরকারী চাকরীতে থাকার সময় নিকলাই ইভানিচ নিজস্ব কোনো মত পোষণ করতেও ভয় পেত, কিন্তু এখন সে সব সময় দারুণ প্রভুত্বের ভঙ্গীতে বচন দিয়ে চলছে: “শিক্ষা নিশ্চয় আবশ্যক, কিন্তু লোকে এখনো তার জন্য প্রস্তুত হয় নি”, “বেত্রাঘাত সাধারণত অন্যায়, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কল্যাণকর এবং অপরিহার্য।”

সে বলে, “আমি লোক চিনি, তাদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করতে হয় জানি। লোকে আমাকে ভালোবাসে, আমার শুধু কড়ে আঙুলটি তোলার সঙ্গে সঙ্গে যা চাই সবাই তা করবে।” আর বুঝলেন, এই সব কথা সে বলে বেশ একটি বিজ্ঞ এবং ক্ষমাশীল হাসির সঙ্গে। বার বার সে বলে একটা কথা : ‘আমরা যারা সম্ভ্রান্ত’ অথবা ‘ভদ্রলোক হিসেবে বলতে গেলে’, এই সব বলে আর বোধ হয় একদম ভুলে যায় যে আমাদের পিতামহ ছিলেন চাষী এবং আমাদের বাবা একজন সাধারণ সৈনিক। আমাদের পদবী — চিমশা-হিমালাইস্কি — আসলে অতি অদ্ভুত, কিন্তু এখন নিকলাই-এর কাছে এই পদবীই একটি গালভরা, একটি বিশিষ্ট শ্রুতিমধুর নাম।

কিন্তু তার কথা আমি বলতে চাইছি না, বলতে চাইছি নিজেরই কথা। ভাই-এর পল্লীভবনে ওই কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে আমার মধ্যে যে পরিবর্তন দেখা দিল তাই বর্ণনা করতে চাই। সন্ধ্যাবেলা আমরা চা খাচ্ছিলাম, এমন সময় রাঁধুনী এক প্লেটভর্তি গুজবেরি এনে দিল আমাদের। ফলগুলো টাকা দিয়ে কেনা হয়নি, এ আমার ভাইয়ের বাগানেরই জিনিষ, সে যে গুজবেরির ঝোপ লাগিয়েছিল এগুলো তারই প্রথম ফল। নিকলাই ইভানি হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ল, তারপর জল-ভরা চোখে চুপচাপ ফলগুলির দিকে অন্তত এক মিনিট তাকিয়ে রইল।

আবেগে রুদ্ধবাক হয়ে একটিমাত্র গুজবেরি মুখে ফেলে দিয়ে আমার দিকে বিজয়ীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, যেন একটি শিশু শেষ পর্যন্ত তার দীর্ঘ আকাংক্ষিত খেলনাটি হাত করতে পেরেছে। সে বলল : “চমৎকার!”

তারপর সে খেতে লাগল লোভীর মতো, আর বার বার বলতে লাগল : “ভারি চমৎকার, খেয়ে দেখো।”

ফলগুলি শক্ত আর টক, কিন্তু পুশকিন যে বলেছেন: ‘যে-মিথ্যে আমাদের উৎফুল্ল করে হাজারটা ধ্রুব সত্যের চেয়ে তা প্রিয়তর’, সেইরকম ব্যাপার। চোখের সামনে দেখলাম সত্যিকারের সুখী একটি মানুষ, যার প্রিয়তম আকাংক্ষা পূর্ণ হয়েছে, যে জীবনের লক্ষ্য সাধন করেছে, যা চেয়েছিল তা পেয়েছে, পেয়ে নিজের বরাত নিয়ে আর নিজেকে নিয়ে তৃপ্তি লাভ করেছে। মানুষের সুখ সম্পর্কে আমার যে অনুভূতি তা বরাবরই একটু বিষাদের আভাস মাখা। সুখী একটি মানুষের মুখোমুখি বসে আমার মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল, সে-বিষণ্ণতা প্রায় নৈরাশ্যেরই মতো। মনের এই ভাবটি সব থেকে জোরালো হয়ে দেখা দিল রাত্রিতে। ভাই-এর শয়নকক্ষের পাশের ঘরটিতে আমাকে শুতে দেওয়া হয়েছে, শুয়ে শুয়ে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম সে অস্থিরভাবে হেঁটে চলেছে, একটু পর পরই উঠছে আর প্লেট থেকে একটি করে গুজবেরি নিয়ে আসছে। মনে মনে বললুম, ক’জন লোকই বা তৃপ্ত, সুখী!

কী সাংঘাতিক অভিভূতকারী শক্তি! একবার চিন্তা করে দেখুন এই জীবনের কথা — প্রবলের রূঢ়তা আর আলস্য, দুর্বলের অজ্ঞতা আর পাশবিকতা, চতুর্দিকে অসহ্য দারিদ্র্য, আবদ্ধ সঙ্কীর্ণ বাড়িঘর, অধঃপতন, মাতলামি ভণ্ডামি, মিথ্যাচার কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হয় সে সব গৃহকোণে, সে সব পথেঘাটে কত শান্তি আর শৃংখলা বিরাজ করছে। কোনো শহরের পঞ্চাশ হাজার অধিবাসীর মধ্যে এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে চীৎকার করে উঠে সশব্দে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করবে। আমরা তাদেরই দেখি যারা খাবার কিনতে যায় বাজারে, যারা দিনের বেলা খায়দায় আর রাতে ঘুমোয়, যারা বকবক করে সময় কাটায়, বিয়ে করে, বড়ো হয়, কবরে নিয়ে যায় নিজেদের মৃত আত্মীয়স্বজনদের। কিন্তু যারা দুঃখভোগ করে তাদের কথা আমরা নিও না, তাদের দেখিও না, জীবনের ভয়ঙ্কর ব্যাপারগুলি সর্বদাই ঘটে দৃশ্যের অন্তরালে। সবই স্থির, শান্ত, কেবল যে সংখ্যাতত্ত্ব মূক, তাই প্রতিবাদ জানায় : এতগুলো লোক পাগল হয়ে গেছে, এত পিপে মদ পান করা হয়েছে, এতগুলি শিশু পুষ্টির অভাবে মারা গেছে … আর ঠিক এসবই যেন ঘটবার কথা। যেন সুখী যারা তারাই কেবল জীবন উপভোগ করতে পারে, কারণ দুঃখীরা নীরবে তাদের বোঝা বহন করে, এই নীরবতা না থাকলে সুখভোগ সম্ভব হত না। এ যেন একরকম সার্বজনীন সংবেশন।

প্রত্যেকটি তৃপ্ত সুখী মানুষের দ্বারের পেছনে হাতুড়ী হাতে একটা লোক দাঁড়িয়ে থাকা উচিত; বারবার আঘাত করে সে কেবল স্মরণ করিয়ে দেবে, পৃথিবীতে দুঃখী মানুষ আছে, স্মরণ করিয়ে দেবে সুখী মানুষ আজ যতই সুখী থাকুক, কয়েক দিন আগেই হোক পরেই হোক জীবন তার অনাবৃত নখর প্রদর্শন করবেই, তার বিপর্যয় ঘটবেই আসবে পীড়া, দারিদ্র্য, ক্ষয়ক্ষতি, আর তখন কেউ তা দেখবে শুনবে না, যেমন আজ সে অন্যের দুর্ভাগ্য দেখছে না বা অন্যের দুঃখের কথা শুনছে না। কিন্তু হাতুড়ী হাতে এমন কোনো লোক নেই। সুখী মানুষ জীবন যাপন করে চলেছে, অ্যাসপেন তরুর পত্ররাশিতে বাতাসের কম্পনের মতো ভাগ্যের তুচ্ছ উত্থান-পতন তাকে আলগোছে ছুঁয়ে যাচ্ছে মাত্র ; সবই আছে ঠিক।’

ইভান ইভানিচ উঠে দাঁড়ালেন, দাঁড়িয়ে বলে চললেন, ‘সেই রাত্রিতে আমি বুঝলাম, আমিও সুখী এবং তৃপ্ত। আমিও শিকার করতে গিয়ে, কিংবা ডিনার টেবিলে বসে জীবন যাপনের, পূজো আর্চার, লোকজনকে চালিয়ে ঠিক পথে নেবার উপদেশ দিতাম। আমিও বলেছি যে, জ্ঞান ছাড়া আলো দেখা দিতে পারে না, বলেছি শিক্ষাদান আবশ্যক, কিন্তু বলেছি যৎসামান্য লিখতে পড়তে শেখাই সাধারণ লোকের পক্ষে যথেষ্ট। বলেছি, স্বাধীনতা আশীর্বাদ। বাতাস ছাড়া যেমন চলে না তেমনি স্বাধীনতা ছাড়াও চলে না, তবে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। হ্যাঁ, একথাই বলেছি, কিন্তু এখন আমি প্রশ্ন করি : কেন? কীসের জন্য অপেক্ষা করব?’ বলে ইভান ইভানিচ বুরকিনের দিকে সক্রোধে তাকালেন। ‘আমি জিজ্ঞেস করছি, কীসের নামে অপেক্ষা করব আমরা? বিবেচনা করার আছে কী? লোকে বলে, অত তাড়াতাড়ি কোরো না, বলে প্রত্যেকটি ভাবধারা বাস্তবে পরিণতি লাভ করে ক্রমে ক্রমে, আপন সময় মতো। কিন্তু এসব কথা যারা বলে কারা তারা? তাদের কথা যে ন্যায় তার প্রমাণ কোথায়?

বস্তুর প্রাকৃতিক নিয়মের কথা বলবে, ঘটনাবলীর যুক্তি ধারার কথা বলবে, কিন্তু আমি, একজন চিন্তাশীল জীবন্ত ব্যক্তি, একটা পরিখা যখন লাফিয়ে পার হয়ে যেতে পারি কিংবা তার ওপর দিয়ে একটি সেতু গড়ে তুলতে পারি তখন কেন, কোন নিয়মে, কোন যুক্তিবিজ্ঞানের জন্য আমি তার পারে দাঁড়িয়ে থাকব আর অপেক্ষা করব কবে পরিখাটা ধীরে ধীরে আগাছায় ভরাট হয়ে ওঠে কিংবা পঙ্কে বুজে যায়? আবার জিজ্ঞাসা করি, কীসের নামে আমরা অপেক্ষা করব? অপেক্ষা! যখন বাঁচবার সামর্থ্যটুকু নেই অথচ বাঁচবার সাধ আছে আর বাঁচতে হবেই, তখন অপেক্ষা করার কথা বলার অর্থ কী?

পরদিন খুব সকালে ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, আর তারপর থেকে শহরের জীবন আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। শান্তি আর স্তব্ধতা আমার মেজাজে যেন ভার হয়ে চেপে বসে, জানালার দিকে তাকাতে ভয় করে, কারণ চায়ের টেবিল ঘিরে বসে থাকা একটি সুখী পরিবারকে দেখার চেয়ে আজকাল আমার কাছে আর কোনো বিষণ্ণতর দৃশ্য নেই। আমি বুড়ো হয়ে গেছি, লড়াই-এর জন্য আর উপযুক্ত নই, এমন কি ঘৃণা বোধ করতেও আমি অসমর্থ। কেবল অন্তরে অন্তরে কষ্ট ভোগ করতে পারি, আর কূপিত বিরক্ত হয়ে পড়ি। রাত্রিতে চিন্তার স্রোতে আমার মাথা জ্বলে যায়, ঘুমুতে পারি না … উঃ, শুধু, যদি তরুণ হতাম!” উত্তেজিত হয়ে ইভান ইভানিচ পায়চারি করতে করতে বার বার বলতে লাগলেন: ‘এখনো যদি যুবক থাকতাম!”

হঠাৎ তিনি আলেখিনের কাছে গিয়ে প্রথমে তাঁর একটি হাত, পরে অন্যটি টিপতে লাগলেন। অনুনয়ের সরে তিনি বললেন, ‘পাভেল কনস্তান্তিনিচ। আপনি যেন উদাসীন হয়ে যাবেন না, আপনি যেন আপনার বিবেককে নিদ্রায় অসাড় করে ফেলবেন না! যতদিন এখনো তরুণ, সবল, কর্মঠ আছেন ততদিন ভালো কাজে বিরক্ত হবেন না। সুখ বলে কোনো জিনিস নেই, থাকা উচিতও নয়, কিন্তু জীবনে যদি কোনো অর্থ বা লক্ষ্য থেকে থাকে তাহলে সেই তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য নিজের সুখের মধ্যে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় মহত্তর কিছুর মধ্যে, উন্নততর কিছুর মধ্যে। আপনি ভালো করুন, কল্যাণ করুন।’

কথাগুলি ইভান ইভানিচ বললেন একটি সকরণ অনুনয়ের হাসি হেসে, যেন তিনি নিজের জন্য কিছু প্রার্থনা করছেন। তারপর তারা তিনজন পরস্পরের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা হয়ে আর্মচেয়ারে বসে রইলেন অনেকক্ষণ, কেউ কোনো কথা বললেন না। ইভান ইভানিচের কাহিনী বুরকিন বা আলেখিন কাউকেই সন্তুষ্ট করেনি। দেয়ালে টাঙ্গানো সেনাপতি এবং সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ছবিগুলো যেন আঁধারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, সোনালী ফ্লেম থেকে ওঁরা যখন এদিকে তাকিয়ে রয়েছেন তখন ভালো লাগে না এক গরীব কেরাণীর গল্প শুনতে যে গুজবেরি খায়। তার চেয়ে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক হত মার্জিত লোকদের, মহিলাদের গল্প শোনা। আর তাছাড়া তাঁরা যে সেই বৈঠকখানাটায় বসে আছেন সেই ঘটনাটিই যে-কোনো গল্পের চেয়ে ভালো। এ বৈঠকখানার সবকিছ– পটি-বাঁধা দীপাধার, আর্ম চেয়ার, মেঝের ওপর বিছানো গালিচা সবকিছু প্রমাণ করছে যে ফ্রেমের মধ্য থেকে তাকিয়ে-থাকা ওই নারী ও পুরুষেরা এককালে এখানে চলে ফিরে বেড়িয়েছেন, চেয়ারে উপবেশন করেছেন, চা পান করেছেন এখন যেখানে সুন্দরী পেলাগেয়া ইতস্ততঃ নিঃশব্দে চলাফেরা করছে।

বেজায় ঘুম পেয়েছে আলেখিনের। ভোর তিনটের সময় উঠতে হয়েছে তাঁকে, উঠে বাড়ির কাজকর্ম করতে হয়েছে, এখন আর চোখ খুলে রাখতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু উঠে ঘুমুতে যেতেও পারছিলেন না, যদি তাঁর চলে যাবার পর অতিথিদের কোনো একজন চমৎকার কিছু বলেন এই ভয়ে ৷ এইমাত্র ইভান ইভানিচ যা বললেন তা খুব ন্যায্য কিনা কিংবা খুব জ্ঞানগর্ভ কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না আলেখিন, তাঁর অতিথিরা শস্য, খড়, আলকাতরা প্রভৃতি ছাড়াও আর আর সব বিষয়ে কথা বলছিলেন, এমন সব বিষয় যার সঙ্গে আলেখিনের দৈনন্দিন জীবনের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এইটি আলেখিনের ভালো লাগছিল, আর তিনি চাইছিলেন ওঁরা গল্প করে যান।

বুরকিন উঠে বললেন, ‘আচ্ছা, এবার শুতে যাবার সময় হল। শুভরাত্রি।’ আলেখিন শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলেন একতলায় তাঁর নিজের কক্ষে, ওপরে রইলেন অতিথিরা। রাত্রি যাপনের জন্য তাঁদের দেওয়া হল প্রকাণ্ড একখানা ঘর, তাতে রয়েছে খোদাই কাজ করা বহু প্রাচীন দুখানা কাঠের খাট, আর এক কোণে হাতির দাঁতের একটি ক্রুশ। পেলাগেয়া সুন্দরী তাঁদের শয্যা প্রস্তুত করে দিল, প্রশস্ত, শীতল বিছানাটি থেকে সদ্য-কাচা চাদর প্রভৃতির মনোরম গন্ধ পাওয়া যেতে লাগল।

নীরবে জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লেন ইভান ইভানিচ।

‘ঈশ্বর আমাদের, পাপীতাপীদের, কৃপা করুন’, এই বলে তিনি চাদরে মাথা ঢেকে দিলেন। টেবিলে তিনি তাঁর পাইপটি রেখেছিলেন। তা থেকে বাসি তামাকের কড়া গন্ধ আসছিল আর সেই দূর্গন্ধটা কোথা থেকে আসছে তাই ভেবে ভেবে অনেকক্ষণ বুরকিনের চোখে ঘুম এল না।

সারা রাত্রি জানালার শার্সিতে বৃষ্টির শব্দ হতে থাকল।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন