বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য মাসে অনেকগুলি ব্রত পালিত হয় বৃষ্টির প্রার্থনায়। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণবঙ্গ, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, অসমের শিলচর, গোয়ালপাড়া, বাংলাদেশের ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, খুলনা ইত্যাদি স্থানভেদে এই ব্রতগুলি আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। গ্রীষ্ণের তীব্র দাবদাহ আর বৃষ্টি না হলে বৃষ্টির কামনায় পুণ্যিপুকুর, হুদুম দেও, বসুধারা ব্রত, নোড়া পোঁতা, তালতলার শিন্নি, মেঘরানী, ব্যাঙের বিয়ে, কুলোতোলা ইত্যাদি নানারকম ব্রত পালিত হতো। যে ব্রতকথাগুলি আজ বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি, বাঙালির সমাজজীবন, বাংলার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
প্রবল গরমে পুড়ছে কলকাতা-সহ রাজ্য। পুরনো ষাট বছরের রেকর্ড ছুঁয়ে রেকর্ড ভাঙার দিকে যাচ্ছে কলকাতা, সল্টলেক, ব্যারাকপুর। শহরের তাপমাত্রা কমার কোন লক্ষণ না দেখিয়ে, দুর্বার গতিতে ক্রমাগত উঠেই চলেছে তাপমাত্রা। শহরবাসীকে রেহাই দিতে যে প্রাকৃতিক প্রলেপের প্রয়োজন, সেই বৃষ্টির আশা এখনো সুদূরপরাহত বলেই মনে করছেন দেশবাসীরা। বৃষ্টির অভাবে এপ্রিলের গরম শহরের যে একের পর এক রেকর্ড ভাঙচুর করে চলেছে, সেটা নাকি ‘ট্রেলার’ মাত্র, ‘পিকচার অভি বাকি হ্যায়’ বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শরীর গরম, মেজাজ গরম তবু গরমের চরম আতিশয্যের মাঝেও বাঙালি খোঁজে শীতল অনুভূতি, কামনা করে বৃষ্টির। বৃষ্টির দেবতা বরুণদেবকে খুশি করার জন্য বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নানান ব্রতকথা ও লোকাচার প্রচলিত আছে। পুন্যিপুকুর, বসুধারা, হাট-ঘুরণী, কুলো নামানো, ব্যাঙের বিয়ে, কাকের বিয়া, ইঁদুরের বিয়া, বদনাপোতা, মেঘরানীর ব্রত (বাংলাদেশ)। এদের মধ্যে একটি প্রাচীন জনপ্রিয় প্রথা হল ব্যাঙের বিয়ে যা সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আদি লোকাচারের অংশ হিসেবে সনাতন বা ইসলাম ধর্মীয় পরিচয়ের অনেক মানুষই এই আচারে অংশগ্রহণ করেন।
আসামে এই আচারটি ‘ভেকুলী বিয়া’ নামে পরিচিত, যেখানে উভচর দম্পতি ঐতিহ্যবাহী অসমিয়া পোশাক পরে এবং সমস্ত প্রথাগত অসমিয়া আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে বিয়ে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করা হয়। উত্তরপ্রদেশের সোনেভদ্র, গোরখপুর এবং বারাণসীর মতো জায়গাগুলিতে এই বিবাহগুলি পরিচালনা করে সমগ্র সম্প্রদায়।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকে, বিশেষ করে উডুপিতে (Udupi) বৃষ্টির দেবতাকে প্রার্থনা ও নৈবেদ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি আরও গম্ভীর স্বরে রূপে দেখা যায়।
ত্রিপুরাতে বৃষ্টির কামনায় ব্যাঙকে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় নিম্নোক্ত ছড়া বলে বৃষ্টির আগমন কামনা করা হয় —
শিকক্যা ভরা দই,
মটকা ভরা খই,
যম রাজার মা মরেছে,
পানি পাইয়াম কই।
কালা মেঘ, ধলা মেঘা, বালল্যা মেঘার ভাই ।
এক ফোঁড়া পানি দে রে মেঘে ভিজজ্যা যাই।।
দুদিন আগেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাবড়া কুমড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের টুনিঘাটা এলাকায় কিম্বা মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় বৃষ্টি নামাতে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হলো। এই বিয়ে উপলক্ষে গোটা গ্রামের মানুষ পাত পেড়ে খেলেন একসঙ্গে। ছাতনাতলায় ব্যাঙ পাত্রপাত্রীর মাথায় সিঁদুর দিলেন পুরোহিত। বরযাত্রী ও কন্যাপক্ষ বিয়ে শেষে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করলেন। বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন স্থানীয় যুবকেরা।
একটি পুরুষ ব্যাঙ ও নারী ব্যাঙ জোগাড় করে ছাতনা তলায় বসিয়ে রীতিমতো মালা বদল গায়ে হলুদ দিয়ে ব্যাঙের বিয়ে পর্ব করা হয়। এই বিয়েতে লাগে কচি আমপাতা ও জামপাতা এবং মন্ত্র হিসেবে লোকছড়া শোনানো হয়।
ব্যাঙ বেঙ্গীর বিয়ে কুলো মাথায় দিয়ে।
ব্যাঙ যাবে জল আনতে ছাতা মাথায় দিয়ে।।
….জল আসবে ঝমঝমিয়ে মাঠ ভাসান দিয়ে।।
কোন কোন গ্রামে ব্যাঙ বেঙ্গীকে পালকিতে চড়িয়ে বাজনা বাজিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়। পালকি বাহকের ভূমিকা গ্রহণ করে চাষিরা। শেষে ব্যাঙ দুটোকে পুকুর পাড়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অনেকেই ব্যাঙের বিয়ের পর বাড়ির উঠানের এক প্রান্তে প্রতিকী ধানের ক্ষেত বানিয়ে ধানের বীজ ছড়ায়।
ব্যাঙের বিয়ে দিলে যে বৃষ্টি আসবে সেরখম নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না তবু আশায় বাঁচে চাষা। খনার বচন বলে‘ ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন শীঘ্র হবে বৃষ্টি জানো’… সেই প্রত্যাশায় এই আয়োজন। আর জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।
কুলো নামানো ব্রত: বৃষ্টির কামনায় উত্তরবঙ্গের নারীরা কুলো নামানো ব্রতের অনুষ্ঠান করে। বৈশাখের প্রচণ্ড রোদে যখন গাছপালা,পুকুর-নদীর জল শুকিয়ে যায় তখন চাষের কথা ভেবে কৃষক পরিবারের মেয়েরা এই ব্রত পালন করে। ব্রতিনীদের বিশ্বাস, গেরস্থের উঠোনে কুলো নামিয়ে রেখে প্রার্থনা করলে আকাশে মেঘ করে বৃষ্টি হবে – আর তাতেই ফসল হবে। বৃষ্টির আনয়নে এই বাঁশের তৈরি কুলো এই ব্রতের অন্যতম উপকরণ।
কোন গৃহস্থ বাড়ির উঠানে মধ্যিখানে একটি পিঁড়িতে একটি কুলো বসিয়ে তার ওপর থাকে একটি ছোট্ট ঘট স্থাপন করা হয়। ঘটের পাশে থাকে কিছু ফুল দূর্বা ধান ও শস্য। ব্রতীনিরা এই কুলটিকে মাথায় করে নিয়ে গৃহস্থ বাড়ির উঠানে নামিয়ে রেখে কুলকে ঘিরে নাচ গান গাইতে থাকে।
“হ্যাদে লো বুন মেঘারানী / হাত পা ধুইয়্যা ফ্যালাও পানি / ছোট ভুঁইতে চিনচিনানি / বড় ভুঁইতে হাঁটুপানি / মেঘারানীর ঘরখানি পাথরের মাঝে / হেই বৃষ্টি নামলো ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে / কাল্যা মেঘ ধল্যা মেঘ বাড়ি আছনি / গোলায় আছে বীজ ধান বুনতে পারো নি / হ্যাদেরে কালামেঘ আস্য রে আস্য”।
বাড়ির গৃহিনী তখন এক ঘটি জল এনে সেখানে রাখে এবং ঘটের জল চারিদিকে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ব্রতিনীরা কুলো মাথায় দিয়ে যায় অন্য গৃহস্থের বাড়ি, সেখানেও একইভাবে অনুষ্ঠান চলে। এটি একটি প্রাচীন যাদুকরিয়া বাঙালি হিন্দু নারীর এই তুলনায় ব্রতই হলো মুসলিম সমাজের কুলো ঘট ব্রত।
বৃষ্টি নামানো ও বৃষ্টি বারণের ব্রত: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ব্রত প্রচলিত আছে। প্রচন্ড দাবদাহে যখন বৃষ্টির দেখা মেলে না তখন গ্রামের যুবকেরা, কুমারী মেয়েরা লোকের বাড়ি গিয়ে যে চালের খুদ ও ডাল সংগ্রহ করে। একে ‘খুদ মাগন’ বলে। যে বাড়িতে এরা যায় সেই বাড়ির সকলে সমবেত হয়ে মেয়ে ও পুরুষের গায়ে জলে ছিটে দেয় লোকবিশ্বাস যে মাগন প্রার্থীদের গায়ে জল ছিটালে বৃষ্টি তাড়াতাড়ি আসবে। এই সময় গীতও পরিবেশিত হয়।
এরপর মেয়েরা ছোট্ট একটি চৌবাচ্চা ধরনের জলাশয় উঠোনের এক কোণে খুঁড়ে তাতে জল ঢালে। দুটো ব্যাঙকে নারী ও পুরুষ চিহ্নিত করে তাদের বিয়ে দেয়া হয়। তারপর বৃদ্ধ ও কুমারীমেয়েরা নৃত্য গীতদের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টিকে আবাহন করে।
উত্তর পূর্বাঞ্চলে কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কোচ রাজবংশীরা। প্রকৃতির রোষ থেকে কৃষি জমি রক্ষা করতে বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি নামানোর জন্য ‘মেঘপরব’ বা ‘হুদুমদেও’ উৎসব পালিত হয়। হুদুক চুকা বা ‘হুদুম দেও’ হলেন জলের দেবতা। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে রাজবংশী মেয়েরা বিশেষ করে বিধবা মহিলারা বিবস্ত্রা হয়ে লোকালয়ের বাইরে গিয়ে শূন্য মাঠের মধ্যে কলাগাছ পুঁতে রাত্রিবেলা এই দেবতার পূজা করেন। এই অনুষ্ঠানে পুরুষদের যোগ দেওয়ার কিম্বা দেখা উভয়ই নিষেধ। এই ব্রতের বিভিন্ন গানের মধ্যে দিয়ে গ্রামের সাদামাটা গল্প কাহিনী ও বিভিন্ন ধরনের ঘটনা উঠে এসেছে। এই ব্রতটি সম্পূর্ণভাবে উর্বরতাবাদের সঙ্গে যুক্ত, শস্যজন্মের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের যোগ তুলনীয়। আবার নাচ গানের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির নামানো এটি একটি যাদুক্রিয়া বা সুপ্রাচীন সংস্কার।
বৃষ্টির কামনায় দেশে বহু রকমের ব্রত প্রচলিত আছে। চৈত্র ও বৈশাখের কাঠফাটা রোদে মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির, ‘প্রখর দারুন অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন’-এ শীতল অনুভূতি পেতে মানুষ কামনা করে বৃষ্টির। আর সেই কামনাই রূপ নেয় উৎসবে। পালিত হতে থাকে যুগ যুগ ধরে নানান ব্রত।
‘হ্যাদেরে কালামেঘ আস্যরে আস্য’– অপূর্ব লেখা ও গান। কলমের জোর আছে। আশীর্বাদ করি আরো যেন লিখতে পারো।
খুউব খুশি হলাম তোমার কমেন্ট পেয়ে। থ্যাঙ্ক ইউ।
বাঃ ! লোকাচার, লোকসংস্কৃতি নিয়ে অনেক অজানা তথ্য পেলাম। ঋদ্ধ হলাম।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে