যে শাহরিয়ার নিজের অপরাধের কথা অন্তরালে রেখে রেণুবালার প্রণয় প্রত্যাশা করে ব্যর্থ হয়েছে, যে শাহরিয়ার রবিন হয়ে রুহিনাকে বিবাহ করেছে সেখানেও প্রতারণার জন্যেই যেনো এ রকম পরিণতি এসেছ। আর কাহারী ও হারাধন, দু’প্রান্তের দুই যন্ত্রণাকাতর মানুষ একজন উৎসমূল খুঁজতে দহনদগ্ধ, অন্যজন অস্তিত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিরুচি বজায় রাখার জন্যে সচেষ্ট হয়ে শেষে ব্যর্থ হয়েছে সমাজের নিষ্ঠুর ক্ষতের কাছে।
শাহরিয়ার ক্লান্ত, ব্যর্থ, ক্লিষ্ট হয়ে সাত বছর পরে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেছে। যে ঢাকা শ্বাসরুদ্ধকর মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অপেক্ষমান। সে কি ভালোবাসার জন্যে খুন করেছিলো, না খুন করে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছিলো? শামান্তাকে খুন করার সময় নিশ্চয় তার ভালোবাসা শূন্যের কোঠায় ছিলো নতুবা, সহনশীলতা যে ভালোবাসায় থাকা স্বাভাবিক ছিলো সেখানে কেনো অসহিষ্ণু হয়ে উযেছিলো? একি ঈর্ষার জ্বলজ্যান্ত রূপ! যে ঈর্ষা রাধাকান্তের মধ্যে শাহরিয়ার দেখেছিলো মনিপুরিদের সমাজে। কিন্তু শাহরিয়ার ঢাকায় ফিরে। কারণ, “পালাবে কোথায় মানুষকে ফিরে আসতে হয় নিজের বুকের খাঁচায়। প্রতিনিয়ত বন্দী এই জীবটি ক্ষমতার দম্ভে মাতে; আসলে প্রচণ্ড অসহায়, নিজের নীলকণ্ঠ বিবেকের কাছে সূতোয় বাধা পুতুল। তাই নিজের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়াই সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে নির্মম এবং অসাধ্য’’ (পৃ. ১৭৫)।
কারণ শাহরিয়ার খুনি এবং কাহারীর খুনের দর্শক। কিন্তু ঢাকায় তমিজউদ্দীনের মতো ব্যক্তিরা খুন করে জেল থেকে মুক্ত হয় নেতাদের সহায়তায়। তবে তার কোনো বিবেক নেই কারণ সে মদ খায়, জুয়া খেলে, বেশ্যা বাড়ি যায়। শাহরিয়ার তো শিল্পী, একজন বিবেকবান মানুষ।
ভালোবাসার জন্যে ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে খুন করেছে শামান্তাকে। এ জন্য ফিরে আসতে চেয়েছে সেই বোধের কাছে যেখান থেকে জীবনের শুরু যে প্রবহমানতা মানুষের শুভ।
এই শুভ কামনায় মানবিকতার জন্যেই শাহরিয়ার আমাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করে। কিন্তু আজন্মের মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে শাহরিয়ার মুক্ত মানুষ হতে পারেনি বলে সেলিনা হোসেন নায়কের পরিণতি জেলে প্রবেশের মধ্যে দিয়ে উপনাাস সমাপ্ত করেছেন। এ যেনো ঔপন্যাসিকের আজন্ম মূল্যবোধ থেকে উদ্ভব হয়েছে। ঔপন্যাসিক তাকে সমাজে প্রশ্রয় দেননি কারণ —
“এভাবে সবাই এড়াতে চাইলে তো যার যা খুশি করার অধিকার লাকতো। এমন নৈরাজ্য সমাজ সহ্য করবে কেন?’’ (পৃ. ২)।
নিজের সমাজের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন ঔপন্যাসিক। তবে মানবিকতা এই আত্মসমর্পণের পেছনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে শাহরিয়ারের সাত বছরের অভিজ্ঞতার বিবরণ ঘটনা ও অন্যান্য চরিত্রসমূহের সমবায়ে।
সর্বজ্ঞ ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেলিনা হোসেন শাহরিয়ারের নির্মূল জীবনের নানা দ্বন্দ্ব জটিল কাহিনীকে উন্মোচন করেছেন “খুন ও ভালোবাসা’’ উপন্যাসে। শাহরিয়ারের চেতনাপ্রবাহের সজেগ বিচিত্র স্থানিক ভূগোল ও প্রকৃতি গীতময়, কাব্যিক, চিত্রল পরিচর্যায় উপন্যাসের অবয়বে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন —
“সামনের খোলা মাঠ হা হা করে। দূরে অন্ধকার, কিছুই স্পষ্ট নয়। আশপাশ তারস্বরে শেয়াল ডাকে, ওর একটুও ভয় করে না। বিড়বিড়িয়ে বলে, আমি আর পালিয়ে থাকতে পারছি না; আমার আত্মসমর্পণ প্রয়োজন, বলতে চাই, আমি এসেছি, তোমরা আমাকে শাস্তি দাও’’ (পৃ. ১৭)।
এই অংশে শাহরিয়ারের শামান্তা হত্যার স্মৃতি স্মরণে এলে যে অপরাধবোধের যন্ত্রণা তাকে প্রকাশ করার জন্যে ‘হা হা মাঠ’ এবং ‘শেয়ালের তারস্বরে’ চিৎকার ব্যবহার পরিচর্যার একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা।
অন্যদিকে সর্দারের জন্যে সাংনুকে মরতে হয়েছিলো আর সেই ভীষণ কণ্ঠের কলা শাহরিয়ার শোনার পর তার ভেতরের কণ্ঠ লুসাই পাহাড় মুছে যাওয়া ও অন্যান্য চিত্রকল্পে প্রকাশিত হয়েছে।
মূলত সেলিনা হোসেন সৎ প্রবত্তির জয় এবং অসৎ প্রবৃত্তির পরাজয় রূপায়ণ করতে গিয়ে সচেতন শিল্প অভিপ্রায়ে শাহরিয়ারের জীবনের সংকট মুহূর্তের চিত্র এঁকেছেন। মানুষে যখন চেতনে এলোমেলো হয়ে ভয়ানক কিছু করে ফেলে তখন তাকে আইনের কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। সুস্থ জীবন প্রত্যাশী শাহরিয়ার যেমন চেয়েছিল শামান্তাকে ঘিরে স্বপ্নময় গৃহ, তেমনি তার ঈর্ষা বহ্নি যা এই চরিত্রের অন্যতম দুর্বলতা তা তাকে ক্ষয়িত করেছে। পলে ওলেলোর মতো শাহরিয়ার প্রবৃত্তির কাছে হেরে গেছে কিন্তু মানবিকতায় সহানুভূহতি অর্জন করেছে তার সংবেদনশীল শিল্পিসত্তার জন্যে। চরিত্র রূপায়ণে “খুন ও ভালোবাসা’’ এখানেই সার্থক হয়ে উঠেছে।
নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনে যে অপ্রাপ্তি ও অপূর্ণতাজনিত বিচ্ছিন্নতাবোধ, যন্ত্রণা ও দগ্ধ জীবন লেকে উত্তীর্ণ হতে না পেরে যে পরিস্থিতিজাত শূন্যতা আক্রান্ত মানুষ তার অন্তরে রক্তক্ষরণ ও যন্ত্রণাবোধ থেকে আত্মহননের ও আত্মবিনষ্টির অনিবার্য সত্যে উপনীত হয়, তারই শিল্পরূপ সেলিনা হোসেনের “ক্ষরণ’’ (১৯৮৮)। এখানে “পদশব্দে’’র মতোই ব্যক্তির অন্তর্গত চেতনাস্রোতের রক্তাক্ত পথ পরিক্রমায় উপন্যাসের কাঠমো নির্মিত। ব্যক্তি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার সূত্রে যন্ত্রণা অনুভব করে না। নিতান্তই পারিবারিক আবেষ্টনে পারস্পরিক অসম-জোয়ালের ভিত্তি নাগরিক জীবনে যে সন্দেহ-সংশয় ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব তারই দিগন্তহীন কাতরতায় দগ্ধ হয় নিজের বিষাদময় জীবনের পরিবৃত্তে।
এ জন্য কেন্দ্রীয় চরিত্র ইশতিয়াক যার স্ত্রী আধুনিকা ডেজী ও সন্তান রোমেলকে নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন নির্বাহের কলা সেখানে তাকে দগ্ধ হতে হয় অতীতের বেদনাময় স্মৃতি রোমস্থনে। বাল্যকালে পিতৃহীন (পিতার মৃত্যু দুর্ঘটনাক্রমে হলেও তার মা পিতার মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করেছিল) মা’র নিরাসক্ত চোখের দৃষ্টিতে মানুষ ইশতিয়াক আজ নিজের সংসারে ক্রমে রোমেলের মা’র সঙ্গে নিজের মা’র সাদৃশ্য খুঁজে গ্লানি লাঘব করতে চায়। কিন্তু রোমেলের বন্ধু নিশুর মা’র সঙ্গে নিজের মা’র তুলনা করে মাতৃস্নেহ বঞ্ছিত বুভুক্ষ হৃদয়ে কাতরতা প্রকাশ করে —
“… নিশুর মা’কে আমি কোনদিন ভুলব না। তার মৃত্যুর তারিখে কবরে যাবো, মিলাদ পড়াবো। নিশুর মা’কে না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না মা কেমন। ভাবতাম মায়েরা বুঝি আমার মায়ের মতো’’ (পৃ. ৯)।
রোমেলের মাতৃধাররায় ও বিশ্বাসে আঙ্গন মরেছে তার মা’র আচরণ থেকেই। এজন্য ইশতিয়াক রোমেলের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করতে চায়। আর এজন্য নিজের জীবনে তার মা’র স্মৃতি বড় উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে।
“আমি তেইশ বছরের ইশতিয়াক, আঠারো বছর বয়সে মা’র কাছে এক ভয়ানক গল্প শুনেছিলাম। তারপর থেকে জেনেছিলাম আমি মা’র শক্র’’। মা ইশতিয়াককে ক্ষমা করতে পারেনি, কিন্তু সন্তানের মঙ্গলাকাক্সক্ষা তাকে তাড়িত করেছে। দ্বিতীয় বিবাহে অসম্মত হয়েছেন এবং নির্বিকারচিত্তে সন্তান পালনের দায়িত্ব বহন করে গেছেন। কিন্তু ইশতিয়াককে হৃদয় খুঁড়ে বেদনার দীর্ঘশ্বাসকে জাগরুক রাখতে হলো। কারণ — “আমি আর মা’র মুখের দিকে তাকাবার সাহস পাই না। বাবার মৃত্যুর সমস্ত দায়ভার এভাবে এভাবে কাঁধে নিতে হবে ভাবিনি। দৌড়ে নিজের ঘরে আসি। সারারাত আমার কান্নার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যায়। কেবলই মনে হয় মাথার ভেতর বিষ পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। আমি চিৎকার করছি। কোনো কিছুতেই আমার চিৎকার লামছে না। সেদিন মুহূর্তের মধ্যে মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তারপর ভোজালির পেঁচের সঙ্গে সে বন্ধন শিথিল হয়ে যায় সেটা আর কোনো দিনই আন্তরিক হয় না’’ (পৃ. ২৩)।
গৃহে মা’র সংস্পর্শ বিষণ্ণতায় নিমগ্ন করলে সে বন্ধুদের সাহচর্যে উৎফুল্ল হতে চায়। এজন্য টিটুলের প্রেমিকা রুপু সম্পর্কে তার অভিব্যক্তি —
“কিন্তু রুপুকে আমার ভালো লাগে, ওর সঙ্গ পেলে বর্তে যাই। অবশ্য ভালোবাসি কি না বুঝতে পারি না।’’ [ক্রমশ]