শুক্রবার | ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ২:৫৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (প্রথম পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান : শৌনক দত্ত বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ত্রয়দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নন্দিনী অধিকারীর ছোটগল্প ‘শুভ মাতৃদিবস’ গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফ্লোরেন্স থেকে রাধানগর রেনেসাঁস ও রামমোহন’-এর মোড়ক উন্মোচন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১-এ কথা দিয়েও স্পেনে গেলেন না কেন রবীন্দ্রনাথ : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ : তারাপদ রায় ও তার অন্ত নাই গো নাই : প্রব্রাজিকা বেদরূপপ্রাণা পেজফোরনিউজ-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন কাশ্মীরে বিজেপির প্রার্থী নেই, মোদীর সফরও বাতিল উপত্যকা ও লাদাখে : তপন মল্লিক চৌধুরী অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে অক্ষয় হোক সম্পদ সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি : রিঙ্কি সামন্ত শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (একাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথরা কি কবিয়ালের বংশধর? : অসিত দাস নিমাই ভট্টাচার্য-এর বড়োগল্প ‘প্রাইভেট প্রাকটিশ’ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে নজর কাড়ল আরামবাগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দশম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আমার রবীন্দ্রনাথ : লুৎফর রহমান রিটন রবীন্দ্র সাহিত্যের নতুন প্রান্ত : মিল্টন বিশ্বাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

রশ্মির নাম সত্যজিৎ “রে” … : যীশু নন্দী

যীশু নন্দী / ৭৮ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪

“আপনার কাছে কোনো স্ক্রিপ্ট নেই?” — প্রযোজক সহ টিমের বাকীদের কাছ থেকে উড়ে আসা এই প্রশ্নে খানিকটা আকাশ থেকে পড়লেন পরিচালক। তিনি জানতেনই না যে সিনেমার পরিচালনা করার আগে একটা স্ক্রিপ্ট বানাতে হয়।

— “সিনেমায় স্ক্রিপ্ট বানাতে হয় নাকি? সবই তো আমার মাথার মধ্যেই আছে। আচ্ছা তোমাদের কারোর কাছে চিরকূট হবে?” — তারপর সেই জোগাড় করা চিরকূটে সিনেমার যে দৃশ্যগুলির শ্যুটিং হবে অর্থাৎ যে দৃশ্যগুলি তাঁর মাথায় সুসজ্জিত ভাবে আঁকা আছে সেগুলো চিরকূটটাতে এঁকে এঁকে বুঝিয়ে দিতেন। আর এভাবেই শ্যুটিং হয়েছিল একটা গোটা সিনেমার। কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই, শুধু চিরকূটের মাধ্যমে এঁকে এঁকেই। সিনেমাটির নাম “পথের পাঁচালি আর পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়।

“ও কি এক্ষুনি চুল কেটে আসলো?” — রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ে তখন বসেছে “পথের পাঁচালি”-এর জন্য বছর ছয়েকের “অপু” খোঁজার আসর। অডিশন দিতে একের পর এক আসছে যাচ্ছে, কিন্তু পরিচালকের কাউকেই পছন্দ হচ্ছেনা। তারপরে একটি বাচ্ছা ছেলে এল অডিশনে, কিন্তু তার গায়ে পাউডারে ভরতি। অনুসন্ধিৎসু পরিচালকের চোখ এড়ায়নি ব্যাপারটা। বুঝেই ফেললেন এ সদ্য সেলুন থেকে এসেছে। তৎক্ষণাত ছেলেটির বাবাকে প্রশ্নটা ছুঁড়লেন। সেই প্রশ্নের সামনে ছেলেটির বাবা আর সত্যটা গোপন করতে পারেননি। আসলে ও ছেলে ছিলনা। ওর নাম “টিয়া”, একজন মেয়ে, অডিশন হচ্ছে শুনে তার বাবা চুল কাটিয়ে রায়সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলেন। — ধরা পড়ে গেলেন। অবশ্য এর কিছুদিন পরে, পাশের এক বাড়ির ছাদে বছর ছয়েকের সুবীর ব্যানার্জিকে দেখে পছন্দ হয় স্ত্রী বিজয়াদেবীর। মানিকবাবুকে সেটা বলতে মানিকবাবু ডেকে পাঠান ছেলেটাকে এবং তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই পছন্দ হয়ে যায় মানিকবাবুর অর্থাৎ সত্যজিত রায়ের। এভাবেই নির্বাচিত হয় “পথের পাঁচালি”র “অপু”। (তথ্যসূত্রঃ- সত্যজিত রায়ের “একেই বলে শ্যূটিং”।

সিনেমার যে অংশটা শ্যুটিং হবে তার সারাংশ মোটামুটি এই যে অপু তার দিদিকে কাশবনের ভিতর খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু কিছুতেই যেন ছয় বছরের অপুর মধ্যে হন্যে হয়ে খোঁজার ভাবমূর্তিটা ফুটে উঠছিলনা। টোটকা বার করে ফেললেন স্বয়ং সত্যজিত রায়। অপুর হেঁটে যাওয়া পথে এলোমেলোভাবে নুড়ি বিছিয়ে দিলেন। আর সাপোর্টিং স্টাফদের নির্দেশ দিলেন কাশবনের ভিতর এদিক ওদিক লুকিয়ে থেকে অপুর নাম ধরে আস্তে আস্তে ডাকতে, ঠিক সেই সময় যে সময়ে অপুর দিদিকে খোঁজার দৃশ্য শ্যুট হবে। এরপর শুরু হলো শ্যুটিং। পথে বিছানো নুড়ির দরুন অপুর চলার পথটা সরল মসৃণ হলোনা, বেশ কিছুটা এলোমেলো, কাউকে খোঁজার সময় ঠিক যেরকম হয়। আর কাশবন থেকে এদিক ওদিক থেকে নামডাকের ফলে অপু এদিক ওদিক তাকাতে থাকে — হন্যে হয়ে খোঁজার সময় বিস্মিত অনুসন্ধিতসু চোখ যেমন হয় ঠিক সেরকম। কিন্তু এতো গেল প্রথম দিনের কথা। দশ দিন পর টিম-সহ ফিরে এসে দেখলেন সব কাশ উধাও। কারণ কাশফুল গোরুর খাদ্য। আবার অপেক্ষা করতে হলো পরের বছর অবধি। কারণ শরৎকাল না হলে কাশফুল ফুটবেই বা কেনো। সিনেমাতে “ভুলো” নামের কুকুরটিকে দেখানো হয়েছে। তাকে নিয়েও কম ঝক্কি তো ছিলনা। শ্যুটিং এর মাঝেই মারা যায় কুকুরটা। অনেক কষ্টে খুঁজে পাওয়া গেল হুবহু একই রকমের দেখতে একটা কুকুর। কিন্তু সে সহজে পোষ মানবেই বা কেন। তখন সিনেমার একটা দৃশ্য শ্যুট করতে হতো যে, অপু দুর্গার পিছন পিছন ওই কুকুরটাও যাবে। কিন্তু নতুন কুকুরকে দিয়ে কিছুতেই নিখুঁতভাবে শ্যুটিংটা হচ্ছেনা। রিল নষ্ট হচ্ছে। হাজার ফুট রিলের দাম দেড়শো টাকা। গরীব পরিচালকের দশটা টাকা ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে।এগারোবার হয়ে গেল কুকুরটা নড়ছেই না। এক্ষেত্রেও টোটকা দিলেন পরিচালক স্বয়ং। দুর্গার পিছন করা হাতের মুঠোয় ঢুকিয়ে দিলেন ক্ষীরের সন্দেশ। আর সেই সন্দেশটা দেখে কুকুরটা ঠিক তাদের পিছন পিছন চলে গেলো। আপনারা “মগজাস্ত্রটা” শুধুমাত্র ফেলুদাতে দেখেছিলেন, কিন্তু আসলে সেই অস্ত্রটা ছিল রায়সাহেবের পেটেন্ট নেওয়া, যা তিনি দেখিয়ে এসেছেন “পথের পাঁচালি” থেকে “আগন্তুক” অবধি। পথের পাঁচালির ঝক্কির লিস্ট অনেক বড়ো। শুধু “ভুলো” নয়, শ্যুটিং এর মাঝে মৃত্যু হয়েছিল চিনিবাস ময়রার চরিত্রাভিনেতারও। কিন্তু সেক্ষেত্রেও নতুন অভিনেতা এবং নতুন কুকুর দিয়ে এতো নিখুঁতভাবে পরিচালনা করেছিলেন, আজ অবধি কেউ ধরতে পারেনি যে দুজন আলাদা মানুষ একটি চরিত্রে গোটা সিনেমাজুড়ে অভিনয় করে গেছেন।

***

“আমাকে ওই চরিত্রটি দিন না” — চিত্রনাট্যটা শুনে কৃষক গাইয়ের চরিত্রটি খুব পছন্দ হলো কেরিয়ারের চূড়ান্ত শিখরে থাকা এক নায়কের। কিন্তু সেই প্রস্তাবে একেবারেই রাজি হলেন না রায়বাবু। নায়কটির অভিনয় তাঁর নিজের খুবই প্রিয়, কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণ চোখ তাঁর মনকে বারবার বলছিল এই চরিত্রটা ওর জন্য নয়। তিনি বললেন — “শোনো, তোমার মধ্যে কোনোভাবেই কৃষক সন্তানের ছায়া নেই। তাই এটা তোমাকে দিয়ে হবেনা”। অনেক অনুনয় বিনয় করা নায়কটির নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর পাঠটির নাম “গুপী গাইন বাঘা বাইন” সিনেমার “গুপী”-এর চরিত্র। তারপর সিনেমাতে তপেন চ্যাটার্জির অভিনয় দেখে সৌমিত্রবাবু স্বীকার করেছিলেন কতটা নিখুঁত ছিলেন রায়বাবু।

***

ক্রিং ক্রিং করে ফোন বাজল ঘরের মধ্যে। সন্দীপ রায় তুললেন ফোনটা। বাবাকে বললেন একজন অভিনেতাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে জেলে। সঙ্গে সঙ্গে সেদিন সত্যজিত রায় ছুটেছিলেন থানায় এবং নিজে উকিল ডেকে জামিন করিয়েছিলেন রায়বাবু। গ্রেপ্তার হওয়া সেই অভিনেতার নাম ছিল ভারতবর্ষের কালজ্বয়ী অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব — উৎপল দত্ত। আসলে ইন্ডাস্ট্রিকে তিনি দেখতেন পরিবার হিসাবে আর ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতারা তাঁর কখনও বন্ধু, কখনও বা সন্তানসম।

***

গুপী গাইন বাঘা বাইন এর জন্য বাঘ আনা হয়েছিল ভরত সার্কাস থেকে। সার্কাসের মাস্টার বলেছিলেন শ্যুটিং-এর সময় বাঘের উপর একটা সরু তার শিকল দিয়ে বাঁধা থাকবে। কিন্তু রায়বাবু বলে উঠলেন — তারটা বাঘের গলায় সরাসরি বাঁধলে বাঘের লোমগুলো কিছুটা হলেও তো বসে যাবে। তাই তার কথামতো একটা নকল ছাল পড়ানো হলো বাঘের ওপর। আর তারওপর বাঁধা হলো সরু তার। যাতে লোম বসে যাবার নগন্য খুঁতটাও না থাকে। কতটা নিখুঁত হলে, একজন মানুষের ভাবনায় এটা আসে।

***

হাল্লারাজার সেনাদের নিয়ে শ্যুটিংটার জন্য সেনা হিসাবে উটের মালিকদেরই সাজানো হয়েছিল। কিন্তু প্রথমে তাদের বোম্বে থেকে আনা রঙীন পোষাক পরানো যায়নি। কারণ তাদের বেশীরভাগই ছিলেন মুসলিম এবং তারা দাবী করছিল সাদা পোশাকেই শ্যুট করাতে হবে তাদের। এক্ষেত্রেও মুশকিল আসান হলেন পরিচালক। একজনকে দিয়ে চোঙে করে উটমালিকদের উদ্দেশ্যে বলা করালেন — “ভাইয়ো… তোমরা এখন আর উটমালিক নও। তোমরা এই সিনেমার এক একজন মূল্যবান অভিনেতা। তোমরা এক একটা সৈন্য…”। অনাকাঙ্ক্ষিত এই প্রশংসা পেয়ে উটমালিকরা তারপর রাজি হয়ে যায় রঙিন পোশাক পড়তে। এরপরেও অবশ্য আরেকটা ঝক্কি এসেছিল। হাল্লারাজার সেনাদের শেষ দৃশ্যে ছিল উপর থেকে মিষ্টির হাঁড়ি পড়বে আর সেগুলো খেতে পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করবে সেনারা। কিন্তু সেখানেও লাগল গন্ডগোল। উটমালিকদের বেশীরভাগ মুসলমান হলেও, অনেক হিন্দুও ছিল। তারা মুসলিমদের সাথে একই হাঁড়িতে মিষ্টি খেতে রাজি হলোনা। পরিচালক ঠিক করলেন হিন্দু আর মুসলিমদের জন্য আলাদা মিষ্টির হাঁড়ি রাখা হবে। কিন্তু যতই হোক, দুই সারিতে আলাদাভাবে মিষ্টি খেলে পাগলের মতো মিষ্টির দিকে দৌড়ের ভাব প্রকাশ হয়না। তাই বুদ্ধি করে রায়বাবু সৈন্যের প্রথম সারিতে নিজের টিমেরই কিছু লোকজনকে সৈন্যের সাজে বসিয়ে দিলেন এবং নির্দেশমতো তারাই হন্যে হয়ে মিষ্টির দিকে ছুটে গেল। (তথ্যসূত্রঃ সত্যজিৎ রায়ের “একেই বলে শ্যুটিং”)

***

সিনেমার নায়ক লক্ষ্য করেছিলেন, ব্রাহ্মণদের বেশীরভাগই দাঁড়িগোঁফ কামানো হয়। তাই মানিকবাবুকে বলেছিলেন সিনেমাতে গোঁফটা রাখলে হয়তো ভালো লাগবেনা। কিন্তু পরিচালকের কথায় গোঁফটি রাখতেই হলো। পরে নায়ক নিজের সিনেমাটা দেখে বুঝলেন রায়সাহেবের সিদ্ধান্তটা কতটা সঠিক ছিল। সিনেমার নাম “অশনি সংকেত”। নায়ক সত্যজিতের সেই মানসপুত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিত-সৌমিত্র জুটির শেষ ছবি ছিল শাখা-প্রশাখা। শুটিং শুরুর আগে পরিচালক সত্যজিৎ রায় সৌমিত্র চ্যাটার্জিকে বলেছিলেন, সিনেমাতে সৌমিত্র অভিনিত চরিত্রটির ২৫টা ডায়লগও নেই, কাজেই তিনি ছবিটা করবেন কিনা। পরে একটি ইন্টারভিউতে সৌমিত্রবাবু বলেছিলেন — “ছাতার মতো একটি ঘরে মানিকদা যদি ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেও বলতো, তাহলেও আমি থাকতাম।”

ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল আরেকজন নায়কের ক্ষেত্রেও। গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পরিচিত একজনকে দেখতে পেয়ে বলেছিলেন — “মানিকদাকে বলিস না, চাকরের রোল দিলেও করব”। কিন্তু সেটা আর করা হয়নি। তার দু-দিন পরেই অমরত্বের জগতে স্থায়ী অধিবাসী হয়ে যান সেই অভিনেতা। “নায়ক” আর “চিড়িয়াখানা” এর পর তৃতীয় সিনেমাটা যে আর আসলনা। নায়কের নাম উত্তমকুমার।

তিনি কখনও জহুরী, প্রথম সাক্ষাতে সৌমিত্রকে দেখেই মনে মনে তৈরি করে ফেলেন “অপুর সংসার” এর চিত্রনাট্য। আবার কখনও অভিনয় নিকড়ে বার করার চাবিকাঠি। ফেলুদা করার সময় সৌমিত্রবাবুকে একটি ডায়েরি পড়তে দেন। ডায়েরি হাতে নিয়ে সৌমিত্র উঠতে যাবেন, এমন সময় তাকে বলে উঠলেন — “শোনো, এমনি পড়লে হবেনা, গোয়ান্দার মতো করে পড়বে। তবেই ফেলু মিত্তির হয়ে উঠবে। Read between the lines”। তিনি এতটাই নিখুঁত ছিলেন, পথের পাঁচালি শ্যুট করতে লেগেছিল আড়াইটা বছর। তিনি নিজেই ফেলু, নিজেই অপু, নিজেই আগন্তুক। একটা গোটা সিনেমা যেটা পাল্টে দিয়েছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের চালচিত্র। পল্লীজীবনের ছোটো কোণাগুলো যে বিশ্বায়নের এক একটা নকশা হতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ “পথের পাঁচালি”। পঞ্চাশের মধ্য দশকে ডুবতে থাকা বাংলা সিনেমাতে কাদামাটির প্রতিমা লেপণ করেছিলেন তিনি। আর আমরা এখন সেই প্রতিমায় রঙ লেপ্টাচ্ছি মাত্র। অপুর রেলযাত্রা দিয়ে বাংলা সিনেমার যে বিশ্বায়ন শুরু হয়েছিল তার চক্রটা পূর্ণ হয় “আগন্তুক” দিয়ে। আর সেই চক্রের পরিধিতে আবর্তন করে পল্লীজীবনের পাঁচালি থেকে “মহানগর”, নারীর একাকিত্বের “চারুলতা” থেকে নারীহীন অনুসন্ধিতসু পুরুষালি “ফেলু মিত্তির”। সেই চক্রের ২৪টা স্পোকে লেগে থাকে ৩৭টা সিনেমা। আর কেন্দ্রে থেকে যান একজন সত্যজিৎ রায়। সে চক্র বোধকরি অশোক চক্রই।

শেষ কথাটা বলতে বোধহয় ভুলে গেলাম। অভিনেতা কৌশিক ব্যানার্জি তখন এসেছেন সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি। বাংলাদেশের কমার্শিয়াল সিনেমা “বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না” তে অভিনয় করেছিলেন কৌশিকবাবু। সত্যজিত রায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন — “শুনছি বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না নামের একটা সিনেমা হিট হয়েছে। তুমিও তো আছো শুনলাম।” — এতো বড়ো একজন পরিচালকের সামনে সাপুড়েদের নিয়ে করা একটা নিতান্তই কমার্শিয়াল সিনেমার কথা কিভাবে বলবেন এটা ভেবে আমতা আমতা করছেন কৌশিকবাবু। তিনি বলেন — “হ্যাঁ আমি করেছি। নিতান্তই কমার্শিয়াল সিনেমা। খুব একটা মানসম্মত নয়।” উত্তরে রায়বাবু বলেছিলেন — “শোনো কৌশিক, এতো মানুষ যখন সিনেমাটা দেখছে, তখন নিশ্চয়ই তার মধ্যে স্পেশাল কিছু আছে। সেই স্পেশালটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করো।” সত্যিইতো, সবকিছুর মধ্যে স্পেশাল কিছুটা খুঁজে বারকরা যে আঁখি জোড়ার কাজ, সেই আঁখি অস্কার পাবেনাতো কে পাবে বলুন। আজ আমরা কত সহজেই সিনেমার খারাপ নিয়ে স্যোশাল মিডিয়া ট্রল মিমস বানাতে থাকি। কিন্তু ওই যে, সত্যজিৎ রায়েরা শতাব্দীতে একবারই আসেন। আর এভাবেই তো এক আলোকমায়াবী রশ্মি পঞ্চাশের দশক থেকে ভারতের সুবিশাল আকাশে এঁকে দিল বিশ্বায়নের পথগুলি।

রশ্মির নাম “রে”

রশ্মির নাম “সত্যজিৎ রে”।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন