তেরো.
শান্তিনিকেতনের প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের প্রতি আমার মা খুব অনুকূল ছিলেন। জীবনে কত জায়গাতেই তো মুসলমান বলে হেনস্তার পাত্র হয়েছেন! তাই ওঁদের বাসায় আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন — এই বাড়িতে মুসলমান বলে কোনো মানুষকে ছোট করা হয় না। সত্যি সত্যি ওঁদের বাড়িতে কারও কাছে কোনো অবহেলা পাইনি।
ভুবনডাঙার সুনুদা সুন্দর গান গাইতেন। এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের মাসতুতো ভাই বলে শুনেছিলাম। গানের এমন পাগল যে ওঁদের বাড়ির কাছেই ছোট্ট একটা বাড়িতে তাঁকে গান শোনাতে যেতে হতো আমাকে। মাঝেমধ্যে ভুবনডাঙা থেকে বেশ দূরে আমার স্কলার্স ব্লকের ঘরেও চলে আসতেন উনি রিকশা নিয়ে। এত ক্ষীণদৃষ্টি ছিলেন যে সকালের দিকে ছাড়া ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়ানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। স্বাস্থ্যও ছিল খুব খারাপ।
আর প্রভাতবাবুদের বাড়িতে যেকোনো উপলক্ষে আমার গান গাইতেই হতো। প্রায়ই, কারও — না — কারও জন্মদিন থাকলেই আমার নিমন্ত্রণ ছিল বাঁধা। শেষ পর্যন্ত প্রভাতবাবুর মৃত্যুর পরেও পারিবারিক সমাবেশে ওঁর প্রিয়গান ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়, গাইতে হয়েছিল।
প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী সুধাদির মৃত্যুর পরে বাড়ির ভেতরেই প্রার্থনার আয়োজন হয়েছিল। ‘এখন আমার সময় হলো’ গেয়েছিলাম। সেখানে ওঁদের এক বয়স্ক আত্মীয়া সেদিন বায়না জানিয়ে গেলেন, তাঁর মৃত্যুতেও যেন আমি ওই গানখানি গাই। এর বাড়ির সকলে আমাকে জানত না। মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি গান গাইতে গেলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হয়েছিল। আমিও যেমন বোকাসোকা!
এর অনেক দিন পরে প্রসেনজিৎ সিংহের এক দিদি আরতিদি আমাকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পরে তুমি অবশ্যই এখন আমার সময় হলো’ গাইবে। তখন তাঁর আশি বছর পেরিয়ে গেছে। বললাম। আমি তখন কোথায় থাকব তার কি ঠিক আছে? বললেন, খবর শুনলে যেখানে থাকো, সেখান থেকেই এদিকে (শান্তিনিকেতনের দিকে) মুখ করে গাইবে। বড় মন খারাপ হয়েছিল শুনে। এত দিনে উনি নিশ্চয়ই বেঁচে নেই আর, কে জানে!
চোদ্দ.
আমার প্রথম পর্ব এমএর দুই বান্ধবীর সঙ্গে প্রথম প্রথম এদিক-ওদিক বেড়াতে যেতাম বিকেল বেলায়। উষা আর মণিকা। ফ্যাকাশে ফরসা মণিকা চুপচাপ সঙ্গ দিত — মুখে রা করত না। আর উষার মুখে ফুটত খই। মনে হতো শান্তিনিকেতনে আসবার আগে কিছু বিষয়ে বইপত্র ঘেঁটে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে এসেছিল। ক্ষিতিমোহন সেন দাদুর মন্দিরে উপাসনা পরিচালনার কথা বলত। কথায় কথায় উনি কেমন রস করতেন, বলত সেসব। চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন সালে আমরা যখন শান্তিনিকেতনে গেছি, তখন ক্ষিতিমোহন সেন শয্যাশায়ী। তাঁকে দেখতে চললাম একদিন। শেষ বিকেলে প্রায়-অন্ধকার বাইরের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছেন। বাবার শিক্ষা ছিল, বয়স্ক মানুষ দেখলেই পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে। আমি প্রণাম করতে যেতেই উষা আমাকে ধরে ফেলল। শুয়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে হয় না। মৃত্যুর পরেই নাকি শয়ান অবস্থার মানুষকে প্রণাম করা চলে। থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। ওদের নিয়ম-টিয়মগুলো তো আমরা কিছু জানি না!
আমি মানুষের কানে ফুঁ দিয়ে মজা করতাম। একবার কে যেন আমাকে হাত চেপে ধরে শাসন করেছিল–খবরদার কানে ফুঁ দেবে না। আমাদের মন্ত্রগুরুরাই শুধু কানে ফুঁ দেবার অধিকারী। পরে অন্যরা আমার ঘাবড়ে — যাওয়া দেখে বলেছিল — ধ্যাৎ, সব কথা বিশ্বাস করো কেন? মজা করেছে।
ক্ষিতিমোহন সেন বাস্তবিকই খুব অসুস্থ ছিলেন। প্রায় কথা বলেননি আমাদের সঙ্গে। উষা-মণিকা একদিন নন্দলাল বসুর বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। সকাল দশটার মতন বাজে তখন। বাইরের ঘরে বসে ছবি আঁকছিলেন তিনি। আমাদের দু-চার কথা জিজ্ঞেস করে পাশের বসবার ঘরে আলতামিরা গুহার ছবিসুদ্ধ বই দিয়ে বসিয়ে ছবি আঁকতে চলে গেলেন। উষা গেছে কথা বলবে আর শুনবে বলে — ওর কি এতে পোষায়! খুব হতাশ হলো।
উষা সরদার একদিন আমাদের নিয়ে চলল শ্যামবাটির দিকে। পোস্টাপিসের পরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে দুটো কাঠগোলাপের গাছ ডালপালা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটি পাতাও অবশিষ্ট নেই গাছে। আর মাথার ওপরে দু — এক গোছ ফুল ফুটে আছে। উষা বলে কী–দ্যাখো দ্যাখো, গাছ দুটো কেমন ন্যাড়া মাথায় রিবন বেঁধেছে। এমন তুলনা শুনে হাসতে হাসতে মরি–উষা নির্বিকার!
অনেক পরে মুর্শিদাবাদে উষা-মণিকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। দুই বন্ধু মিলে বাড়ি করেছে। উষার বোনের সঙ্গে (যদ্দুর মনে হয়) মণিকার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। কুটুম্বিতা পাতানোও হয়েছে এইভাবে। তখন চাকরি থেকে অবসর নেবার সময় হয়ে এসেছে ওদের। [ক্রমশ]