চার.
আমার এমএ পড়বার সময়ে শান্তিনিকেতনের শিক্ষা আর বিদ্যাভবনে ‘সাহিত্যিকা’ নামে একটি আসরের আয়োজন হতো। নামটা নাকি রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। শিক্ষার্থীদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি পাঠের ব্যবস্থা ছিল। একদিন লাইব্রেরির রিডিং রুমে বসে কী একটা পড়ছিলাম। বেঁটেখাটো একটি ছেলে এসে ধরল আপনি নিশ্চয়ই কবিতা লেখেন, এবারকার সাহিত্যিকায় একটা কবিতা পড়ুন। ওরে বাপরে! এমন নাছোড়বান্দা! কবিতা লিখেছি অল্প বয়সে। অনার্স ক্লাসে কবিতার ওপরে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। বলে, তাহলে সেই লেখাটিই পড়ুন! অগত্যা হার মানতে হলো। বিষয় ছিল কবিতার ভাব আর আঙ্গিকের পরস্পর সম্পর্ক। ভাষা আর ছন্দ পালটে দিলে নিহিত ব্যঞ্জনা চোট খেয়ে যায়। ক্লাসে সৈয়দ আলী আহসান স্যার করে দেখিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদনের ‘একাকিনী শোকাকুলা অশোককাননে/ কাঁদেন রাঘববাঞ্ছ’র অংশবিশেষ। যেমন, ‘অশোককাননে কাঁদিছেন একাকিনী/ শোকাকুল — প্রাণা রাঘববাঞ্ছা যিনি’। নেশা ধরে গেল। স্বরবৃত্তে বদলে ফেললাম, ‘অশোকবনে কাঁদছে দুখে রাঘব — বধূ সীতা/ একলা বসে আঁধারে সে, আকুল শোকান্বিতা’। রবীন্দ্রনাথের সেই জেদ করে ‘যুদ্ধ যখন সাঙ্গ হল বীরবাহু বীর যবে/ বিপুল বীর্য দেখিয়ে হঠাৎ গেলেন মৃত্যুপুরে’ লিখবার মতন। তাই কি মধুসূদনের ‘সম্মুখ সমরে পড়ি/ বীর — চূড়ামণি বীরবাহু/ চলি যবে গেলা যমপুরে’র সেই দৃপ্ত ভাব আসে! আলী আহসান সাহেব যেমন, তাঁর অনুসরণে আমিও তেমনি দেখাতে চেষ্টা করছিলাম–ও হয় না।
সভায় আলোচক ছিলেন কবি-অধ্যাপক অশোকবিজয় রাহা। তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। সভাপতি ছিলেন প্রবোধচন্দ্র সেন। তিনি আরও কী কী কারণে পরিবর্তন হলে ব্যঞ্জনা মার খেয়ে যেতে পারে সংযতভাবে বুঝিয়ে বললেন। অশোকদার অকুণ্ঠ অনর্গল প্রশংসার পরে কাকাবাবুর ওই লাগাম টেনে ধরাতে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসে আরকি! পরদিন লেখাটি কোথাও ছাপবার জন্যে চাইলেন কাকাবাবু। দিতে বেশ দেরি করেছিলাম, মনে আছে। কাকাবাবু অবশ্য লেখাটা হারিয়ে ফেলে অনেক বেশি দেরি করেছিলেন ছাপাতে। তত দিনে আমি চলে এসেছি শান্তিনিকেতন থেকে। অনেক পরে কলকাতার ধ্রুপদী পত্রিকায় কাকাবাবুর পরিচিতিসুদ্ধ ছাপা হয়েছিল।
পাঁচ.
আমি এমএ পড়বার সময়ে শ্রীভবন চালাতেন দুজন সুধাদি। কালো সুধাদি আর সাদা সুধাদি। ছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন, বা বেশি রকম বকাবকি করতেন, তা-ও নয়। স্কুলের ছোট ক্লাসের ওরা ছিল সাদা সুধাদির অধীন। বাকি স্কুলের ওপর দিকের ক্লাস, শিক্ষাভবন, সংগীতভবন, কলাভবন, বিদ্যাভবনের কর্তৃত্ব কালো সুধাদির। স্কুলের মেয়েদের সঙ্গেই বেশি ভাব ছিল বলে সাদা সুধাদির দিকে খুব নজর রাখতাম। উনি বেশ জমিদারিভাবে এদিকে-ওদিকে দুটো পেঁপেগাছ, কুমড়োর মাচা ইত্যাদি করতেন। হোস্টেল ভবনে ঢুকবার গলির কোণে একটা কোটা রাখা থাকত। দেখলাম গাছের পেঁপেতে রং ধরছে। নষ্টামি বুদ্ধি গজাল। সুধাদির সামনেই তার কোটাখানা নিয়ে। গিয়ে গোটা দুই আধপাকা পেঁপে পেড়ে নিলাম। উনি বললেন না কিছু, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন শুধু। আর একদিন মাঝারি সাইজের একটা মিষ্টিকুমড়ো ছিঁড়ে নেওয়া হলো। উনি হয়তো ভাবতেন, মেয়েটার লোভ তো কম নয়! ছোটদের নিয়ে কাঁচাপাকা ওই পেঁপে খেয়ে কী এমন লোভের নিবৃত্তি হলো! শুভ্রা ছিল ডে-স্কলার। অধ্যাপকের মেয়ে, বাড়িতে থেকে পড়ে। কুমড়োটা বাড়িতে নিয়ে গেল–ছোঁকা বেঁধে আনবে, সবাই তা-ই খাবে। কী যে প্রাপ্তি হয়েছিল। ওসব করে কে জানে। ছোটদের নেতৃত্ব দিতে হলে কিছু কিছু সরদারি করতে হয় অবশ্য। নেতাগিরি ভোগ করা গেল অন্তত। সুধাদি নিশ্চয়ই বিষনজরে দেখতেন আমাকে। সেটাই স্বাভাবিক।
এমএ ক্লাসের সেমিনারে প্রমথ চৌধুরীর ওপরে লিখতে হয়েছিল আমাকে। ভুলুদারা সব খবর রাখতেন। আমাকে বললেন ঋতুপত্র নামে পত্রিকা বার করছেন, তাতে ছাপবার জন্যে দিতে হবে লেখাটা। প্রমথ চৌধুরী নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবেন্দ্ৰসিংহ রায় বই লিখেছিলেন। সেটিই আমার প্রধান অবলম্বন ছিল। পত্রিকাতে আমার প্রবন্ধ পড়ে সবাই খুব প্রশংসা করলেন। বলা হলো, লেখাতে কোনো মেয়েলি ছাপ নেই। অর্থাৎ প্রকাশভঙ্গি বলিষ্ঠ। জীবেন্দ্ৰসিংহ রায়ও লেখাটি পছন্দ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসে তিনি আমার খোঁজ করেছিলেন। বিভাগে আমাকে কোনো মূল্য দেওয়া হতো না। অধ্যাপক জীবেন্দ্ৰসিংহ রায় উপাচার্যকে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনারে আমাকে আমন্ত্রণ করিয়েছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অমন লেখা লিখে আমি কেন নিজেকে এমন লুকিয়ে রাখলাম। ওই প্রশ্নের জবাব আমি দেব কী বলে! বিভাগীয় প্রধান যে বিরূপ ছিলেন আমার প্রতি! থাক সেসব বাজে কথা।
উনিশ শ চুয়ান্ন সালের শেষ দিকে বিশ্বভারতীর শিক্ষাভবন এক্সকারশনে যাচ্ছিল। পৌষমেলার পরে বিভিন্ন ভবন শিক্ষাসফরে বার হতো। বিদ্যাভবনে কোনো নড়াচড়া ছিল না। কেকাদের সঙ্গে আমিও যাব বলে অধ্যক্ষ সুধীরদার কাছে গিয়ে বায়না ধরলাম। উনিও রাজি হলেন। কেবল বললেন, মন্দির-টন্দিরে যাব তো, তোমাকে একটা অন্য নাম দিতে হবে। ঠিক আছে, তোমার নাম হোক ‘সংযুক্তা’। মুসলমান নামটা আড়াল করা হলো আরকি।
জুতো খুলে মন্দিরে ঢুকতে হতো। আমি অবশ্য বেশি ভেতরে প্রতিমার কাছ পর্যন্ত যেতাম না। সেই সময়ে রেজিস্ট্রার রঞ্জিতদার স্ত্রী কল্যাণীদির জেদ দেখেছিলাম। উনি মন্দিরে যেতেন না, জুতো খুলতে হবে বলে। বাইরে পায়চারি করতেন। তাঁর সঙ্গে এইটুকুন মেয়ে প্রমিতা গিয়েছিল। এত দিনে কবেই সে প্রমিতা মল্লিক নামে বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হয়েছে।
শিক্ষাভবনের দলে ভুলুদা, বিশ্বজিৎরাও গিয়েছিলেন। মজা হতো গানের সময়ে। বাসে উঠে ওঁরা যে গান ধরতেন আমিও তা গাইতাম। আসলে অনেক রবীন্দ্রসংগীত জানা ছিল আমার। এক গান শেষ না হতেই অন্য গান ধরতেন ওঁরা। সে গান আমিও জানি কি না দেখতেন। আমাকে ঠেকানো কঠিন ছিল। হার মানতেন ওঁরা অবাক হয়ে। শান্তিনিকেতনের বাইরে থেকেও অত গান জানে কেউ ভেবে অবাক হতেন। ‘ও আমার চাঁদের আলো’, ‘ও চাঁদ, তোমায় দোলা দেবে কে’–একের পর এক গান। ভুবনেশ্বরের উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, পরে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, কোনারক, চিলকা হ্রদ–কত যে ঘুরেছিলাম আমরা। আর গান গেয়েছিলাম। গানের পর গান গাইবার এই অভ্যাসটা আমার ছিল বরাবর। ভুবনেশ্বরে মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় নেমন্তন্ন খেয়েছিলাম। ওঁর স্ত্রী মালতীদি শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। এককালে। কটক রেডিও স্টেশনের ডিরেক্টর ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, ভুবনেশ্বরে মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় তাঁকে দেখেছিলাম। কটকে গিয়ে চা পর্বে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে সদলে। পূর্ববঙ্গের মেয়ে বলে আমার কাছে পল্লিগীতি শুনতে চেয়েছিলেন মুজতবা আলী। ‘সখী, তারে বল ক্যানে বাঁশরি বাজায়’ গেয়েছিলাম বলে ভুলুদাদের সে কী রাগ! শান্তিনিকেতনের মেয়ে পল্লিগীতি গাইবে কেন?
ভুলুদা বিশ্বজিৎদাদের ওই এক রকমের গোঁড়ামি ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে লেখা গীতি-আলেখ্য ‘রূপান্তরের গান’ হচ্ছিল একবার কলাভবনের এলাকায় খোলামঞ্চে। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো থেকে নিয়ে অনেক গণসংগীত ছিল তাতে। এসব কী গান হচ্ছে শান্তিনিকেতনে — মহা আপত্তি তাঁদের। ভুলুদা অবশ্য সেই সময়ে ছিলেন না। অথচ লাইব্রেরির বারান্দায় নির্মলেন্দু চৌধুরীর গানও তো হয়েছে। তিনি তো পল্লিগীতিই গেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের আমলে সাহেবদের অদ্ভুত উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীতও তো হয়েছে আশ্রমে। তার বেলা? এসব আপত্তির কোনো মানে বুঝি না। বুঝি, রবীন্দ্রনাথের অন্তত ও রকমের অদ্ভুত গোঁড়ামি ছিল না।
হ্যাঁ, খানিক আগে সেমিনারের কথা লিখছিলাম। আমাদের ক্লাসে জীবন চৌধুরী নামে বর্ধমানের একটি ছেলে ছিল। আমরা পাঁচজন ছিলাম — আমি, মলয়া গঙ্গোপাধ্যায়, আদিত্য, পৃথ্বীন্দ্র আর জীবন। আমরা সেমিনারের আগে নিজেরা এক জায়গায় বসে প্রবন্ধটি শুনে সে বিষয়ে সবাই আলোচনা করতাম। মজার ব্যাপার এই, কাকাবাবুর সামনে আসল সেমিনারের সময়ে জীবন চৌধুরী একাই সবার মতামতগুলো বলে ফেলত! আমরা এ ওর মুখ দেখতাম। কাকাবাবু তো আর অতশত জানতেন না — সেমিনারে জীবনই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে গেল ওই করে।
শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ ছিল আমার পরম আকর্ষণের জায়গা। চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন সালে ওখানে ঢুকবার ব্যাপারে তত কড়াকড়ি ছিল না। ফাইল হাতে নিয়ে যখন তখন ঢুকে পড়তাম। প্রথম দিন ‘উদয়ন’ ভবনের বৈঠকখানায় ঢুকে রোমাঞ্চ হলো। বিশেষ ধরনের হাতলওয়ালা একটা চেয়ারে ‘শূন্য চৌকি’ কবিতাটি ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা ছিল। নিচে বসে বার দুই কবিতাখানি পড়লাম। শীতলপাটিতে ঢাকা দেয়ালের ঘরে সব আসবাবই কেমন অন্য ধরনের। মুগ্ধ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। ভিতর দিকের বাগানে সরু সরু বাঁধানো পথ দিয়ে ঘুরে এক ছোট জলাশয়ে ঢুকে পড়লাম। জলের মাঝখানে খানিকটা জায়গা বাঁধানো। দু-একটি চেয়ার রাখা আছে, টেবিলও আছে একটা। সবই মেঝের সঙ্গে আটকানো। জলে মস্ত বড় দুটি লাল শাপলা ফুটে রয়েছে। অত বড় শাপলা দেখিনি আগে। পাথরের স্ল্যাব লাগানো পথ বেয়ে বেরিয়ে এসে বাগানের পথে খানিক পায়চারি করলাম। একেকটা ঝোপ থেকে মিষ্টি ফুলগন্ধ এসে বিবশ করে দেয়। উদয়ন ভবন থেকে যে পথে বেরিয়ে এসেছি, সেটি গুহাঘরের দুয়ার। গুহাঘরটি রথিঠাকুরের ছোট্ট দোতলা। দোতলায় চামড়ার আর কাঠের কাজের অসম্পূর্ণ কিছু নমুনা। রথিঠাকুর নাকি ওসব কাজে খুব দক্ষ ছিলেন।
বাগানে একটি অশোক ফুলের গাছ লাল হয়ে ছিল। সদর ঘাটের ইডেন স্কুলের বাগানে অশোক ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিষয়ে একটি লেখার বেশ খানিকটা অশোকগাছের নিচের বেঞ্চিতে বসে লিখেছিলাম। মাঝারি লম্বা একটা গাছে নতুন এক ফুল দেখছিলাম। বাচ্চাদের দুধের বোতল পরিষ্কার করবার ব্রাশের মতন দেখতে। নামও অস্ট্রেলিয়ান বটুল ব্রাশ। রংটা লাল। উত্তরায়ণে আরও একটি নতুন ফুল দেখেছিলাম। নীল রঙের। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম ‘নীলমণিলতা’। সোনাঝুরি নামটাও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। শান্তিনিকেতনেই প্রথম দেখি। উদয়নবাড়ির পুব দিকে আরও কটা বাড়ি রয়েছে। মাটির বাড়িটির নাম শ্যামলী’। বাইরের দেয়ালে কিছু ভাস্কর্য ছিল কালো আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া। তার পাশে আর একটি ছোট একতলা, ‘পুনশ্চ’। এর পরে ছোট্ট দোতলা ‘কোনারক’। ওই সব ছোট ছোট ঘরে রবীন্দ্রনাথকে ধরত কেমন করে, অবাক লাগে। শেষ বাড়িটার শোবার জায়গা ছিল। সিমেন্ট করা। আর মেঝেতে একটা উঁচু ধাপ তো আবার নিচু। সমতল নয়। অমন কেন বুঝতাম না।
টেনিস কোর্টের লাগোয়া বড় বড় গোলাপের এক বাগান ছিল। বিশেষ যত্ন ছিল না বাগানটির সেই সময়ে। প্রাঙ্গণে দুটো ময়ূর ঘুরে বেড়াত। সারসও ছিল। গ্যারেজে রাখা ছিল একটা কালো রঙের মোটরগাড়ি। এখনকার উত্তরায়ণ বাড়ির প্রাঙ্গণে অনেকগুলো ইউক্যালিপটাস গাছ আছে। পরের দিকে ওখানে ঢুকতে ব্যাগ জমা রেখে যেতে হতো গেটের কাছে একটা ঘরে। আরও পরে রবীন্দ্রভবনে পড়াশোনা করতে যেতে আর একটা ঘরে নির্দিষ্ট বক্সে যার যার এটা-ওটা তালা দিয়ে রেখে যেতে হতো। ভবনের জিনিসের সুরক্ষার জন্যে ওসব বন্দোবস্ত। এত কিছুর পরেও তো নোবেল পুরস্কারটি চুরি হয়ে গেল!
আশ্রমে ঢুকবার পুব দিকের ফটকের কাছেই শান্তিনিকেতনের মন্দির। ফটকে লেখা আছে আশ্রম এলাকায় কোনো প্রতিমা পূজা হবে না। এখানকার উপাসনা চলে ব্রাহ্মমতে। উপনিষদ থেকে নির্বাচিত কিছু মন্ত্র পাঠ আর গান দিয়ে এই উপাসনা। কিছু মন্ত্র পাঠ হয় সমস্বরে। মন্দিরে জমায়েত হবার জন্যে মন্দিরের ঘণ্টা থেকে চারটি চারটি ঘণ্টা পড়ে। আচার্য নিজে সেই ঘণ্টা বাজান। বাইরে তিন দিকের সিঁড়ির কাছে জুতো রেখে বারান্দা আর সিঁড়িতে বসেন সবাই। সপ্তাহে ছদিন ভোরের বৈতালিকের মতো একেক বুধবারে একেক ভবনের ওপরে গানের দায়িত্ব পড়ে। বুধবার শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন।
মন্দির থেকে পুব দিকে রতনপল্লির রাস্তা ধরে চলে গেলে ওখানকার শ্মশান। ওখানে থাকতে একবার শ্রীভবনের শোভনার মৃত্যু উপলক্ষে শ্মশানে যাওয়া হয়েছিল। হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট সুধাদি আমাকে শ্মশানে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন। মুসলমানের শ্মশানযাত্রায় বোধ হয় বাধা আছে।
শ্মশানের পথে গেটের দুপাশে বড় বড় দুটি বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া লাগানো বাড়ি ছিল শুভ্রাংশুদার। যে শুভ্রাংশুদা মজা করবার জন্যে ল্যাংড়া আমকে প্রতিবন্ধী আম বলতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে রেকর্ডিং করবার জন্যে ছাত্র ওয়াদুদ আর বোন ফাহমিদাকে নিয়ে একবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম। ফাহমিদার ট্রেনার হবেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার বাচ্চুদি, আর ওয়াদুদের সুভাষ চৌধুরী। সেই সময়টায় সুভাষ শান্তিনিকেতনে করা নিজের বাড়িতে বাস করছিল। দুপুরবেলা মোহরদির বাসায় খেলাম আমরা। সন্ধের পরে শুভ্রাংশুদার বাসায় গেলাম দেখা করতে। উনি রাতে ওঁর বাড়িতেই খেয়ে নিতে বললেন। বললাম, রাতে থাকবার জন্যে ইন্টারন্যাশনাল গেস্টহাউসে ফোন করে বলে দিন। উনি গল্প করছেন তো করছেন — ফোনটোন করেন না। অস্থির হয়ে উঠেছি রাতের ব্যবস্থাটা অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে বলে। শেষ পর্যন্ত বললেন, কী দরকার অত হাঙ্গামা করবার — এখানে শুয়ে পড়লেই হয়! যেন সেই উটের গল্প — মুখ বাড়িয়ে খবর নিচ্ছিলাম, তারপর খাওয়াদাওয়া, শেষে শোয়া! এরপরে পুরো বাড়ির দখল নিয়ে ওঁদের বার করে দিলেই হয়! এমন মজলিশি লোক, গল্প পেলেই হলো! মজা করবার জন্যে ছেলেটাকে বাড়িতে ডাকতেন ‘গদাই’ বলে! [ক্রমশ]
কাঠ কাঠ লেখা।