রবিবার | ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:১৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (তৃতীয় পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী বসিরহাটে নুনের হাট, শ্যামবাজার নুনের বাজার : অসিত দাস মুর্শিদাবাদের আমকথা (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত জেন অস্টিন নারী স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ : মনোজিৎকুমার দাস ইসবার ইন্ডিয়া জোটকা সরকার, আমরা একাই একশো — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (শেষ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন মুর্শিদাবাদের আমকথা (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (দ্বিতীয় পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (শেষ পর্ব) : জামিল সৈয়দ কবি কুসুমকুমারী দাশ ও পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ : বিজয়া দেব হুগলির লোকসভা ভোটে গ্রামীন এলাকায় ১৭১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (প্রথম পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান : শৌনক দত্ত বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ত্রয়দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নন্দিনী অধিকারীর ছোটগল্প ‘শুভ মাতৃদিবস’ গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফ্লোরেন্স থেকে রাধানগর রেনেসাঁস ও রামমোহন’-এর মোড়ক উন্মোচন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১-এ কথা দিয়েও স্পেনে গেলেন না কেন রবীন্দ্রনাথ : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ : তারাপদ রায় ও তার অন্ত নাই গো নাই : প্রব্রাজিকা বেদরূপপ্রাণা
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘শান্তিগন্ধা’

সৌমেন দেবনাথ / ৮৭ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ৫ মে, ২০২৪

মানুষের বুকে আশার পাহাড়। একবুক আশা নিয়ে স্বপ্ন গাঁথে। স্বপ্ন দেখে সুন্দর একটা জীবনের। জীবন জুড়ে সুখের আশা করে। সুখের আশায় পরিশ্রম করে। সুখ-শান্তির প্রত্যাশায় চেষ্টার কমতি রাখে না। প্রত্যাশার সাথে পরিশ্রম করে আর পরিশ্রমে একনিষ্ঠতা রাখে। সুখের সমীরণে শিহরিত হতে সাধনা লাগে তা ভালো জানে প্রত্যয়। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবে, করে সঞ্চয়। সঞ্চয় মানেই সম্পদ। সঞ্চয়ে সুখ। সঞ্চয় প্রশান্তি আনে। অবশ্য নির্দিষ্ট রোজগারের মানুষের সঞ্চয় করা কষ্টকর বিষয়। নিজের দুই পায়ের তলের মাটি শক্ত হতে হতে পিতা-মাতার পায়ের শক্তি হ্রাস পায়। পরিবারের একজন রোজগার শিখতে শিখতে অনেকজনের রোজগার করার শক্তি কমে যায়। নিয়তি এমনই, বাস্তবতা নির্মম। কিন্তু প্রত্যয়ের ভেতর প্রত্যয়দ্বীপ্ততা আছে। একারণে পরিবারের সবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যায়, সবার মন রক্ষার চেষ্টা করে। সবার চোখে ভালো থাকতে চায় বলে কারও কোনো কথায় কষ্ট পায় না। সবার মন রক্ষা করে চলতে চায় বলে নিজের মনের উপর পাথর চেপেছে।

সান্ত্বনাদানকারী হিসেবে সবসময় বাবা পাশে থেকেছেন। প্রত্যয়ের চিন্তিত মুখ দেখে বাবা বলেন, ভালো দিন আসে না, ভালো দিনের আশা করে করে আমরা খারাপ দিন পার করি।

বাবার কথা শুনে প্রত্যয় বলে, পেরে উঠি না, বাবা; কিন্তু আমি তো না পারা দলের সদস্য ছিলাম না। হারেনি যে সে কেন মনোবলহারা আজ?

বাবা বলেন, সবার জন্য সুখ কিনতে চাওয়া মানুষকে সবাই দুঃখ দেয়, বাবা।

প্রত্যয় বলে, নিজের স্বপ্ন নিজেকেই দেখতে হয়, মানুষই মানুষের স্বপ্ন ভাঙে।

বাবা বলেন, প্রাপ্তি দিয়ে কী হবে, বাবা; সুখী মানুষের তালিকায় যদি নাম না উঠে! জীবনব্যাপি চেষ্টা করেছি তোমার জীবন চলার পথ যেন সহজ হয়, তোমার চিন্তার কারণ কিংবা পথ রুদ্ধ করার আমি কে?

বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে প্রত্যয়। শব্দহীনতার চাদর আচ্ছাদিত করে ফেলে তাকে। চাওয়া মাত্রই বাবার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস বা টাকা না পেলে কত ভুলই না বুঝতো। কত নিষ্ঠুরই না আখ্যা দিতো বাবাকে। মা আসেন৷ ছেলের নিষ্প্রভতা প্রায়ই লক্ষ্য করেন। হাসতে থাকা ছেলেটা হাসে না, শুধুই ভাবে। ভাবনায় ফেলে মাকে। মাও সান্ত্বনাদান করতে বলেন, না পাওয়া ভুলে পাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা জীবন বাস্তবতা। তুমি ভালো থাকার চেষ্টা করো দেখবে সবাইকে ভালো রাখতে পারবে, বাবা।

ভেতরের যন্ত্রণা ব্যক্ত করতে পারে না প্রত্যয়। সে বলতে পারে না একজন সঠিক মানুষ জীবনে এলে জীবনে তিক্ততার কোনো অধ্যায় থাকে না। যে হৃদয় বোঝে না, তার কাছে গিয়ে সুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। উচ্চারণ করে প্রত্যয় বলে, সব শিখিয়েছো, মা; কেন শেখাওনি বাস্তবতা সবসময় নির্মম?

মা বলেন, অতিরিক্ত আশা হতাশার কারণ। অতিরিক্ত প্রত্যাশা করো না, বাস্তবতাও সহজ হয়ে যাবে। টেকে যারা জেতে তারা। ধৈর্য ধরো, অনুত্তমও উত্তম হয়ে যাবে।

নিজের ঘরে আসলো প্রত্যয়। যে ঘরে ঢুকলেই তার প্রশান্তির ঘুম আসতো, সে ঘরে আগের সেই প্রশান্তি নেই, শান্তি আছে। যে ঘরে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখতো, সে ঘরে ঘুমালে এখন স্বপ্ন দেখে না। যদিও কষ্টে ঘুম আসে তো ঘুমের ঘরে দেখে দুঃস্বপ্ন। কত স্বপ্ন ছিলো তার জীবনে যে মানুষটা আসবে কানের কাছে মুখ রেখে গুণগুণিয়ে গান শোনাবে। গুণগুণ গান সে শোনে না, শোনে গনগনে আওয়াজ। এক মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নবিভোর হতে চাওয়া মন তার একেবারে নিষ্প্রাণ। মায়াভরা মুখ দেখে কী লাভ, যদি মায়া বোঝার কেউ না হয় সে।

অভাবে থেকেছে, অনটনে থেকেছে; কিন্তু সম্মান বিসর্জন দেয়নি। সেই সম্মানে আঘাত করে কথা বললে সহ্য হওয়ার কথা না। অস্ত্রের আঘাত সহ্য করা যায়, কিন্তু কথার আঘাত সহ্য করা যায় না। একা থেকেছে সে, কিন্তু কখনোই নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগতো না। যে নিজেকে একা ভাবে সে সবাইকে একাকিত্বের কথা বলে বেড়ায়, কিন্তু যে আসলেই একা সে কাউকেই কিছু বলে না। প্রত্যয়ও কাউকেই কিছু বলে না, চুপ থাকে, সহ্য করে আর অবাক হয়। অবাক হওয়ার কত কিছু এখনো বাকি আছে কে জানে!

শান্তির নিরাসক্ততা দেখে প্রত্যয় বলে, অনাদরে সম্পর্কে মরিচা পড়ে। অদূরকে দূরবোধ করতে নেই।

শান্তি বলে, আমাকে অযথা ভুল বোঝো। তুমি আমাকে ভুল বোঝো যা আমাকে বিস্মিত করে৷ তুমি তোমার মতো করে আমাকে পেতে চাও, কিন্তু আমি তো তোমার মতো বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেইনি। স্বপ্নে সব কিছু নিজের মতো করে চাইতে নেই, সব তোমার মন মতো হবে না। সব তোমার হবে না। তুমি যেমন অনুরূপ পাবে না।

এমন প্রতিউত্তর শুনে প্রত্যয় চুপ হয়ে থাকে। প্রিয় মানুষের কথা শুনে মুগ্ধ হতে চাওয়া মন চুপসে যায়। মুখের কথা শুনে যে মনের ভাষা বোঝে সে প্রিয় মানুষ। আবার যে মুখের কথা শুনে মনের ভাষা বোঝে সে চির অভাগা। যার কাছে নিজের অবস্থান নেই তার কাছে কখনোই প্রিয় হওয়া যায় না। জীবনে সে চায়নি কষ্ট দেওয়ার মানুষ জীবনে আসুক, অথচ জীবন জুড়ে সেই কষ্ট দেওয়ার মানুষটিই। বোঝে না সে, বুঝতে পারে সে। অথচ না বুঝতে জানা একজন মানুষের সাথে তার জীবন বাঁধা। সে চাইতো মান থাকবে, কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়া থাকবে না। অথচ মান করতে পারে না, খুঁনশুটি করতে পারে না; নিজেদের মধ্যে হয় শুধু দ্বন্দ্ব, কথার ঝড়। জীবনে একজন মানুষ চেয়েছিলো সে যাকে দেখার মতো আনন্দ আর কোনো কিছুতে থাকবে না; কিন্তু বাস্তবে পেলো সে যাকে তাকে দেখলে আনন্দ আরও দূরে সরে যায়। যে মানুষটা একান্তই নিজের, তার সাথে কথা বলে আনন্দ না পেলে আর কারও সাথে কথা বলে আনন্দ পাওয়া সম্ভব না। যার সাথে কথা বলার লোভ সংবরণ করা যায় না, তার সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা হয় না। শান্তি আবার বলে, তোমার সাথে জীবন চলা কঠিন, কঠিন হবে জীবন চলার পথ।

প্রত্যয় বলে, কঠিন পথ সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যায়।

শান্তি বলে, তুমি ধোয়াশা, তুমি তোমাকেই আমার কাছে পরিষ্কার করো না। একান্ত কাছের মানুষের কাছে একান্ত কথা বলো না। তোমার সঞ্চয় কতো আমাকে জানাও। তোমাকে নষ্ট করতে, তোমার সঞ্চয় নষ্ট করতে তোমার জীবনে আমি আসিনি।

প্রত্যয় নিশ্চুপ হয়ে যায়। কষ্টের সঞ্চয় ভ্রষ্ট নারীর জ্ঞাতে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। নতুন এক জীবন জীবনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে জীবনে নতুন আর কিছু ঘটেনি। যাকে পেয়ে সুখী হবে সে, তাকে পেয়ে জীবনে সুখের দেখা পায়নি। শান্তি কান্না করে দিয়ে বলে, আমার কাছে সব গোপন করো তুমি।

শান্তির কান্না করা দেখে প্রত্যয় বলে, আবেগ বেশি যাদের, বাস্তবতা জানার গুণ কম তাদের।

শান্তি বলে, আমি তোমার একান্ত আপন।

প্রত্যয় বলে, আপন হওয়ার নাটক সবাই পারে।

শান্তি বলে, তুমি আমাকে খারাপ ভাবো কেন? তুমি কেন এমন?

প্রত্যয় বলে, যে যেমন তার সাথে তেমন।

শান্তি বলে, যে যেমন তার সাথে তেমন ভালো মানুষের গুণ না। আমার ভুল আমাকেই ধরিয়ে দেবে। আমার ভুল অন্যের কাছে বলবে কেন? ঘরের কথা পরে জানলে মজা নেয়। একদিন আক্ষেপ করে কারা জানো? যারা প্রিয়জনকে কষ্ট দেয়।

প্রত্যয় বলে, তোমাকে যেমন ভেবেছিলাম, তুমি তেমন না।

শান্তি বলে, অন্যের বিশ্লেষণ তারাই করে, যারা নিজের বিশ্লেষণ করতে পারে না।

প্রত্যয় আর কথা বলে না। কথারা হারিয়ে যায় কথার মতো কথা কানে না এলে। কত কথা ছিলো বলবে সে, অথচ কথারা আজ কেঁদে মরে নিভৃতে। কষ্ট পেয়ে বড়ো হয়েছে, কষ্ট দেওয়ার মানুষের অভাব ছিলো না জীবনে; কিন্তু কে জানতো ভালোবাসা দেওয়ার মানুষটিও ভালোবাসা দিতে এত কার্পণ্য করবে! মাছ চিনতে ভুল করলে সমস্যা নেই, ধান চিনতে ভুল করলেও সমস্যা নেই; কিন্তু মানুষ চিনতে ভুল করলে ভীষণ সমস্যা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। রাতে ঘুমানোর সময় শান্তি বললো, তুমি আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে সন্তুষ্ট না!

প্রত্যয় বলে, অনুভূতি ঠিক থাকলে সম্পর্ক ঠিক থাকে। সম্পর্কের মধ্যে লাগাতার অর্থ প্রার্থনা সম্পর্ককে বিষাক্রান্ত করে।

শান্তি বলে, শহরকেন্দ্রীক জীবন পরবর্তী প্রজন্মের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

একথা শুনতেই প্রত্যয় ঘর থেকে বাইরে চলে গেলো। মন ভালো করার মানুষটি মন খারাপ করার মানুষ হবে ও ভাবতেও পারেনি। চার প্রজন্মের ভিটেমাটি ছেড়ে সে কেন শহরমুখী হবে ভেবে পায় না। জমানো অর্থ খোয়ানোর বুদ্ধি সতেজ বুদ্ধি নয়। কেন মানুষ জীবনে জড়ায় জীবন নষ্ট করতে? যে কথা হৃদয়ে আঘাত করে, সে কথা কেউ শুনতে চায় না। যে কথা হৃদয়ে আঘাত করে, সে কথা কেউ ভোলে না। প্রত্যয় প্রত্যয়হারা হয়ে বাইরে চলে যায়। ভাবে, ভুল মানুষের সাথে কারও দেখা না হোক। নির্বাক বসে থাকে, কাউকে কিছু বলে না। নিজের দুঃখ-কষ্ট নিজের কাছে রাখতে হয়, প্রকাশ করতে নেই। ভালো থাকা সহজ, ভালো রাখা কঠিন। এখন ভালো থাকাও কঠিন, ভালো রাখাও কঠিন। নিজে নিজে ভাবে, সামান্য ফুল পেয়ে খুশি হওয়ার মানুষ এখন আর নেই। অলংকার একটি পেলে আর একটি পাওয়ার প্রার্থনা জাগে। স্বার্থের পৃথিবীতে সবাই প্রত্যাশী, কেউ সহযোগী না।

কর্মক্ষেত্রে প্রিয় সহকর্মী বন্ধুর সাথে প্রত্যয়ের কথা হয়। কর্মক্ষেত্রে কাজের কথার পাশাপাশি জীবনের কথাও উঠে আসে। প্রত্যয় বলে, কারও কাছে কখনো কিছু চাই না, কারও কাছে কখনো কিছু প্রত্যাশা করি না; যাদের দায়িত্ব আমার কাঁধে সবার জন্য চেষ্টা করি ভালো কিছু করার। অথচ সবার মন পাই না। জীবনসঙ্গী কেন ভুলবে মোহে, জীবনসঙ্গী ভুলবে মায়ায়। মোহে হারিয়ে যায়, অথচ হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো মায়ায়। বোঝাতে পারি না তাকে, বুঝতে পারি না তাকে।

সমাজ বলে, ভালো নেই যারা তারা অন্যকে ভালো থাকতে দেয় না। শুধুই গন্ধ বিলাবে এমন মাধবীলতা এখন আর অুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রত্যয় বলে, সোনা ভেবে নিয়েছিলাম বরে, দূর দিয়ে চলে এখন সে; দূর-দূরান্তের সে। প্রিয় জিনিস কখনো নিজের হয় না।

সমাজ বলে, স্বপ্নে সব কিছু চাইতে নেই। ভাবনায় শুধু সৌন্দর্যপ্রতাপ আনতে নেই। সব স্বপ্নের মতো হবে না, মনের মতো সব মিলবেও না। সব তোমার হবেও না।

প্রত্যয় বলে, মায়াতে আটকে গিয়েছিলাম বলে সুখ পাই না। প্রত্যাশা করি ভালোবাসার, সম্মুখীন হই তিক্ততার। যদি কেউ আমার সঞ্চয় নষ্ট করতে চায়, যদি চারপুরুষের ভিটেমাটি নষ্ট করতে চায়, তার থেকে ভালোবাসা উবে যায়। জানেন তো, নিজের পা না থাকলে হাঁটতে কেউ হাত ধরে না!

সমাজ বলে, মায়ের মতো কাউকে দুঃখ দেইনি, মায়ের কথা কখনোই শুনিনি; কিন্তু মায়ের মতো কেউ ভালোও বাসেনি। আর বাকি সবাই আপনাকে ভুল বোঝার জন্য প্রস্তুত, তোমার পরিস্থিতি বোঝার কেউ নেই।

প্রত্যয় মাকে ভাবনায় এনে স্থির হয়ে যায়। আর সমাজের কথাতে মাথা হ্যাঁ-হেলুনি দিয়ে বলে, মন ভালো করার দায়িত্ব নিজের, মন খারাপ করার দায়িত্ব সবার।

দিনশেষে বাড়ি ফেরে প্রত্যয়, মনে মনে ভাবে এক গ্লাস জল এনে দেবে শান্তি। মনের ভাবনা মনেই থাকে, নিজে নিয়ে জল খায়। কিছুই করলো না, দুটো বড়ো কথাও বললো না, অথচ সে খারাপ হয়ে গিয়েছে। শত্রু হওয়া সহজ, প্রিয় হওয়া খুব কঠিন। মাঝে মাঝে ভাবে প্রতি কথার কড়া উত্তর দেবে, সমুচিত জবাব দেবে; পারে না। প্রিয়জনের কাছে কেউ শক্তিশালী নয়। সারাদিন পরিশ্রম করে তার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয় না শান্তি, অথচ পকেটের স্বাস্থ্যের দিকে শকুন নজর। মামাতো বোন রাজন্যা ফোন করেছে। ভীষণ আনন্দিত সে। উৎফুল্লচিত্তে বললো, তোর দাদাবাবু ব্রেসলেট গড়ে দিয়েছেন। ছোটোবেলা থেকেই ব্রেসলেটের খুব শখ ছিলো আমার।

শান্তি বলে, গতমাসে না দাদাবাবু তোকে গলার হার গড়ে দিলেন? এমাসে আবার ব্রেসলেট গড়ে দিলো? কী কপালরে তোর!

এটুকু আলাপ শুনেই প্রত্যয় ঘরে আর থাকতে পারলো না। না খেয়েই বাইরে চলে গেলো। ভুল সিদ্ধান্ত জীবনকে বিষাক্ত করে। কৃতকর্মের জন্য আফসোস করতে চায় না সে, কিন্তু আক্ষেপ এসেই যায়। ভাবে কেবল, একজন বুঝতে জানা মানুষ কেন জীবনে এলো না? ভালোর কদর সারাজীবন করেছে, ভালো তাই পেলো না সে। রাগ করার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও রাগ করতে পারে না সে। ঘরে ফেরার নেশা আর পেয়ে বসে না। তবুও ঘরে ফিরতে হয়। শান্তি প্রত্যয়কে দেখেই বললো, অযোগ্যদের হাতে হাতুড়ি দিলে পাত শেষ। অযোগ্য বরের হাতে কনে দিলে কনে শেষ।

উত্তরে কিছুই বলে না প্রত্যয়। ছোটোবেলা থেকে জেনেছে কথা কম বললে সমস্যা অর্ধেক শেষ। কথা কম বলেও তো তার সমস্যার সমাধান হয় না। শান্তি আবার বলে, মামাবাড়ির ওখানে একজন লোক বিশ লাখ টাকা খরচ করে বিবাহ করেছেন। অথচ তুমি বিবাহ করেছো সময় না নিয়ে, হুটহাট।

প্রত্যয় চুপ থাকে। কথা বলতে শক্তি লাগে না, শক্তি লাগে চুপ থাকতে। জবাব জানে, কিন্তু জবাব দেয় না। সবসময় জবাব দিতে হয় না, সময় জবাব দেয়। শান্তি বলে, আমার এক বান্ধবীর বিবাহ হয়েছে আমাদের বিবাহের পাঁচ মাস আগে। কী দারুণ দারুণ শাড়ি পরে ফেসবুকে ছবি দেয়!

প্রত্যয় এবার রাগতচিত্তে বললো, আত্মপ্রচার দোষের না। করো না কেন? তোমার প্রত্যেকটি শাড়ির দাম দেড়-দুই হাজার টাকা। পরে ছবি তুলে প্রচার করো না কেন? পাঙাস মাছ রান্না করে সেই ছবি তোমার বৌদি প্রত্যহ পোস্ট করে, অথচ তুমি ফলুই মাছের ছবিও পোস্ট করো না। অন্যের জীবনাচরণ দেখে হাপিত্যেশ করতে নেই।

শান্তি বলে, দিন বদলায় দুঃখ বদলায় না।

প্রত্যয় বলে, যারা খারাপ ভাবে তারা খারাপ থাকে। অন্যর সুখের কাটাছেঁড়া করলে নিজের সুখ হয় না। নিজের সুখ নিজের কাছে।

শান্তি বলে, তোমার ঘরে এসে কিছুই পাইনি। ভেতরের হাহাকার কাউকে বোঝানো যায় না।

প্রত্যয় বলে, না পাওয়া সব কিছু সুন্দর। অত পাওয়ার আশা করাও ভালো না। নিজেকে না সাজিয়ে নিজেকে তৈরি করো।

শান্তি রেগে গেলো, বললো, চাহিদা পূরণ করতে পারো না। দায়িত্ব নিয়েছো কেন? কস্মিনকালের ছোট্ট টেলিভিশন, টিনের ঘর; আমার বড়ো বোনের তিনতলা বাড়ি।

প্রত্যয় সহ্য করতে পারে না অবিবেকসম্পন্ন নারীর কথা, অন্যের ভালো থাকায় তার আক্ষেপ জন্মে কেন? এক চোখে বিশাল স্বপ্ন, অন্য চোখে বাস্তব জ্ঞানের লেশটুকুও নেই। আক্ষেপ করে প্রত্যয় বলে, তুমি ভুল পথে বিচরণ করছো, শান্তি।

শান্তি বলে, ভুল পথে বিচরণ করলেও ভালো, ভুল মানুষের সাথে না চললেই ভালো।

প্রত্যয় বলে, দোষে-গুণে মানুষ; সঠিক মানুষ পাবে না। মানুষ হতে এসে জীবন শেষ হয়ে যায়, মানুষ হওয়া হয় না। তোমার সুখের জন্য আমার আপ্রাণ চেষ্টা আছে, তবুও তোমার চোখে সুখের আভাস পেলাম না।

শান্তি বলে, পরিশ্রম করে তুমি কিছু করতে পারবে না।তোমার অর্থ নেই। যার অর্থ নেই, তার কেউ নেই।

প্রত্যয় বলে, তোমাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেও তোমাকে আমি পেলাম না। আমার শখের নারী হয়ে উঠলে না।

শান্তি বলে, নারীকে শুধু শখের জন্যে ভাবলে হয় না, তাকে সাজিয়ে রাখতে হয়, তাকেও সম্মান দিতে হয়। কোথাও যেতে হলে কারও না কারও কাছ থেকে আমাকে গহনা খুঁজতে যেতে হয়, যা আমার জন্য সম্মানহানীকর।

প্রত্যয় আশ্চর্য হয়, কত গহনা লাগে একজন মানুষের!

পরেরদিন কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে প্রত্যয়। প্রত্যয় ভাবতে ভাবতে যায়, টাকা-কড়ি অঢেল যার সে সুখী নয়। সংসারে যে সুখী সেই আসল সুখী। সুখী হওয়ার জন্য পরিশ্রম করে, অথচ সুখী হতে পারে না। কাছের মানুষ বিবেকহীন হলে সুখ অধরায় থেকে যায়। প্রিয় হতে পয়সা লাগে, অঢেল পয়সা। সামান্য রোজগারের পয়সা খাওয়া-দাওয়াতেই লেগে যায়।

প্রত্যয়ের বিমর্ষ মুখ দেখে সমাজ বলে, প্রিয় মানুষ যে সে দূরে থাকবে, কিন্তু পিছু ছাড়বে না। কিন্তু এই সমাজে প্রিয় মানুষ পাওয়া কঠিন।

প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস কাটে। সমাজ বলে, যে আপনাকে ভালোবাসবে সে আপনাকে ছায়া দেবে, মায়া দেবে, জ্বালাবে; কিন্তু চোখের আড়াল করবে না।

প্রত্যয় বলে, কাছের মানুষই স্বপ্ন ভেঙে দেয়। আর তার কাছেই খুব ঠুনকো আমি।

সমাজ বলে, হাজার অভিযোগ, অনুযোগ, অভিমান, চাওয়া-পাওয়া থাকলেও কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে না পারায় জীবনের আনন্দ।

প্রত্যয় বলে, সামান্যটুকুতে সুখী যারা তারা সামান্যটুকুও পায় না। অথচ কেউ কেউ অধিক পেয়েও না পাওয়ার হাহাকারে মরে।

সমাজ দুঃখ প্রকাশ করে বলে, নরম মনের মানুষকে কষ্ট দেওয়া সহজ। নরম মাটি পেলে বিড়ালও আঁচড় মারে৷ নরম মনের মানুষের কষ্ট বেশি। নরম মনের মানুষের দুশ্চিন্তাও বেশি।

প্রত্যয় বলে, দুশ্চিন্তা শান্তির অন্তরায়। শান্তি বোঝে না। অশান্তির কারণ হতে চায়, খুশির কারণ হতে চায় না।

এ কথা শুনে সমাজ শক্ত কথা বলে ফেললো, স্বার্থপর মানুষ নিজের বেলা ষোলো আনা বোঝে, অন্যের বেলা কানাকড়িও বোঝে না।

প্রত্যয় কাজে মন দেয়। সমাজ তবুও বলে, বিবেকবান মানুষ সহ্য করতে পারে না, বিবেকহীন মানুষ বচসা করতে পিছপা হয় না।

প্রত্যয় বলে, কত শ্রম দেই সংসারের জন্য। কোনো মূল্যই পাই না।

সমাজ বলে, মূল্য সংসারে নেই। সাঁতার শেখানোর মানুষটিকেই তাই আমরা ভুলে যাই।

প্রত্যয় হাসে। বড়ো কষ্টের হাসি। অজস্র দুঃখ লুকানোর জন্য একটি হাসিই যথেষ্ট নয়। কাজে মন দিলেও মন বসে না। ঘরের অশান্তি সবখানে পড়ে। সবাইকে বুঝতে চায় সে, কেউ বোঝে না তাকে।

বাড়ির পথ ধরে প্রত্যয়। বাড়ি ফেরার নেশা আগের মতো নেই। শান্তির মুখের প্রতিটি কথা মনে ঘা দেয়, চোখে জল আসতে চায়। পুরুষ বলে চোখের জলও হার মানে তার কাছে। কান্না করায় পরিস্থিতিও হেসে সামলে নেয় সে। মনে ধরা মানুষ ভাগ্যে ধরে না। জীবনটা কল্পনাতেই বেশি সুন্দর ছিলো, বাস্তবে বড্ড ভিন্ন। শান্তি জীবনে এসে শান্তি বিলাবে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখতে সুন্দর ছিলো, চোখের শান্তি পেয়েছিলো। এখন বোঝে চোখের শান্তির চেয়ে মনের শান্তি বেশি দরকার।

বাড়ি ফিরলো, মন বিষণ্ন। নিজের মতো চলে, অন্যকে না বুঝিয়ে নিজেই নিজেকে বোঝায় সে। নিজেই নিজের কাছে অজানা-অচেনা; না আনন্দে থামে, না দুঃখে কাঁদে। সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ায় শান্তি। প্রত্যয় বিরক্তিভরে বলে, ভালোবাসা না থাকলে একসাথে থাকা যায় না।

শান্তি বলে, ভালোবাসার মানুষটার প্রতি দায়িত্ব বোঝো না। আর আমিও কখনো তোমার উপর বোঝো না।

প্রত্যয় বলে, আমায় যদি বুঝতে আমায় তবে কেঁদে কেঁদে চাইতে।

শান্তি বলে, ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবেছি আর তাতেই তুমি ক্ষুব্ধ আমার উপর। তোমার ক্ষতি করতে তোমার জীবনে আমি আসিনি। তোমার জীবনে আসার পর আমার প্রচুর ভালোলাগাকে বিসর্জন দিয়েছি। আমি তোমার কাছে কিছু চাই, তুমিই বলো তোমার কাছে ছাড়া আমি কার কাছে চাইবো?

শান্তির আবেগ-প্রবণ কথাতে আজ আর প্রত্যয় ভুললো না। এমন আবেগতাড়িত কথা বলে বলে শান্তি তাকে ঋণগ্রস্ত করে ফেলেছে। পথ বদলে প্রত্যয় চলে গেলো। শান্তিও আগের মতো রাগ প্রকাশ করলো না। কেন যেন মানুষটাকে আজ আর বকতে ইচ্ছা হলো না। মানুষটার জন্য চোখে এই প্রথম জল এলো। খুব করে সে বুঝতে পারলো সবসময় কিছু না কিছু চাইতে নেই, তাতে সম্পর্কের বুনট নষ্ট হয়। একজন মানুষ কিছুই চায় না, অন্যজনের লাগামহীন চাওয়া সম্পর্কে অভারসাম্যতা আনে। চাইলেই পাওয়ার আশা করা সবক্ষেত্রে ঠিক না, চাইলেই না পাওয়া হতাশারও কারণ না। সম্পর্কে সতেজতার ভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে সর্বদায় চাওয়ার মাত্রা কমিয়ে দিতে হয়।

মুড়াপাড়া, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন