শুক্রবার | ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:১০
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (প্রথম পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান : শৌনক দত্ত বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ত্রয়দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নন্দিনী অধিকারীর ছোটগল্প ‘শুভ মাতৃদিবস’ গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফ্লোরেন্স থেকে রাধানগর রেনেসাঁস ও রামমোহন’-এর মোড়ক উন্মোচন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১-এ কথা দিয়েও স্পেনে গেলেন না কেন রবীন্দ্রনাথ : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ : তারাপদ রায় ও তার অন্ত নাই গো নাই : প্রব্রাজিকা বেদরূপপ্রাণা পেজফোরনিউজ-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন কাশ্মীরে বিজেপির প্রার্থী নেই, মোদীর সফরও বাতিল উপত্যকা ও লাদাখে : তপন মল্লিক চৌধুরী অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে অক্ষয় হোক সম্পদ সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি : রিঙ্কি সামন্ত শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (একাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথরা কি কবিয়ালের বংশধর? : অসিত দাস নিমাই ভট্টাচার্য-এর বড়োগল্প ‘প্রাইভেট প্রাকটিশ’ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে নজর কাড়ল আরামবাগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দশম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আমার রবীন্দ্রনাথ : লুৎফর রহমান রিটন রবীন্দ্র সাহিত্যের নতুন প্রান্ত : মিল্টন বিশ্বাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন

সন্‌জীদা খাতুন / ২৩১ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

দুই.

ভোরে ঘুম ভাঙলে নানা রকম ঘণ্টা শুনতে পাই। কোনোটা কিচেন থেকে চা খেতে যাবার ডাক, কোনোটা লাইব্রেরির বারান্দায় বৈতালিক গায়কদের গানের প্রস্তুতি। বৈতালিক অর্থ বন্দনা বা স্তুতির গান। এই উপাসনা দিয়েই দিনের কাজ শুরু হতো। ওদিকে ঘণ্টার শব্দে বিভিন্ন ভবন থেকে লাইন বেঁধে বৈতালিকের জমায়েত শুরু হয়ে গেছে। চা খেতাম না, বৈতালিকেও যেতাম না। বরং একতলা ঘরের জানালায় পাঠভবনের মেয়েদের উঁকিঝুঁকি, গুনগুন গান শুরু হতো। স্কুলের ওপরদিককার শিক্ষার্থীরা আমাদের একতলা ব্লকের বাথরুম ব্যবহার করত। যাবার পথে মিনুদিকে সম্ভাষণ না করলে চলত না ওদের। সেভেন, এইট, নাইন, টেন-এর গানপাগল মেয়ে এরা। সেভেনের শ্যামলী খাস্তগীর, এইটের রমা, নাইনের ইন্দ্রাণী, মহাশ্বেতা আরও সব কারা। নতুন গান শিখলে শোনাত, গাইতে হতো মিনুদিকেও। প্রিয় গানের ফরমাশ হতো তো! আমি এমএ দ্বিতীয় পর্বের ছাত্রী। ওদের সঙ্গে কলকল করে গল্প চলত। কোথায় ভেসে যেত বয়সের বাধা। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি ফেরার জন্য কী মন খারাপ! ছুটির পরে একবার নিউমার্কেট থেকে কাঁচের ছোট্ট ছোট্ট অনেক কুকুর নিয়ে গেলাম ওদের জন্যে। সে যে কী খুশি সবাই! ক্লাসে গিয়ে সবগুলো কুকুরকে খোয়াইয়ের ওপর নানাভাবে সাজাত। সাদা-কালো, বাদামি সাদা কত রকমের রং সেগুলোর। সাদা দুরকম–জলের মতো স্বচ্ছ আর দুধসাদা। কাঁচের বলতে পোরসেলিনের। আসলে শ্রীভবনের দিনগুলো বড় মধুর ছিল।

খোয়াইয়ের পথে

কলেজ অর্থাৎ আইএ, বিএ ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গেও ছিল বেজায় ভাব। বিকেলে আমার সঙ্গে কে বেড়াতে যাবে, তাই নিয়ে শুরু হয়ে যেত মান-অভিমান। পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়ে পড়ত মাঝেমধ্যে। কবজা করবার প্রতিযোগিতা মূলের ভালোবাসাকে আচ্ছন্ন করে ফেলত। তখন পারুলডাঙা, লালবাঁধ, খোয়াইয়ের পথে গান গাইতে গাইতে ঘুরতে কী যে ভালো লাগত। কেকাই নিষ্ঠুরভাবে অন্যদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে বেড়াতে যেত। গান গাইতেও ছিল অক্লান্ত। আমাকেও থামতে দিত না একদম। গানের ঝোঁকে দূরে দূরে চলে গিয়ে সন্ধের আগে শ্রীভবনে ফিরবার জন্যে হাইফাই করে বড় রাস্তা ধরে প্রায় দৌড় লাগিয়ে আসতে হতো।

সন্ধ্যায় হোস্টেলের প্রাঙ্গণে পাঠভবন (স্কুল) থেকে শিক্ষাভবন (তখনকার কলেজ) পর্যন্ত ছাত্রীদের লাইন করে দাঁড়াতে হতো। বড় সুধাদি সবার নাম ডেকে উপস্থিতি নিশ্চিত করতেন। কেকা কলেজে বিএ পড়ে বলে সমাবেশে তাকে হাজির থাকতে হতো। সে জন্যেই দ্রুত ফিরে আসবার চেষ্টা দুজনের। বিদ্যাভবন অর্থাৎ অনার্স, এমএ ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সমাবেশে যোগ দিতে হতো না।

সমাবেশ শেষে ঘরে ফিরতাম একটা, দুটো শিউলিগাছের পাশ দিয়ে। তখনই জেনেছিলাম সন্ধ্যাবেলার আধফোটা শিউলি ফুলের গন্ধই সবচেয়ে সুন্দর।

আমাদের একতলা দুটো ব্লকের মাঝখানে ছিল একটা সোনাঝুরিগাছ। সোনারঙের ঝুরি পড়ে তলাটা ছেয়ে থাকত। একটু দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ব্লকের গায়ে সোনাঝুরির বাঁকা বাঁকা পাতার ছায়া দুলত। বারান্দার আলো নিভিয়ে রেখে ওই আলোছায়া দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। সত্যি, দিনগুলি বেশ ছিল।

পাঠভবন

তিন.

একবার রাজা নাটকে সুদর্শনার ভূমিকায় অভিনয় করবার জন্যে কেকার ডাক পড়ল। অনার্স ক্লাসে রাজা আমাদের পাঠ্য ছিল। আমার প্রিয় নাটক। সুদর্শনার বেশ লম্বা আর কাব্যধর্মী কিছু সংলাপ তো আমার মুখস্থই ছিল। জানতে পেরে কেকা আমার কাছে এগুলো শুনতে চায়। আমিও পরমানন্দে বলি। মহড়ায় শান্তিদেব ঘোষ নিজে হাজির থেকে সংলাপগুলো প্রম্পট করে কেকাদের সাহায্য করতেন। রোজ কেকার সঙ্গে মহড়াতে যাই, মেতে আছি। একদিন শান্তিদা কী কাজে কলকাতা গেলেন। কেকার তো পার্ট মুখস্থ হয়নি। প্রম্পট করা না হলে কী করে মহড়া দেবে। বললাম, আমি নাহয় একটু একটু বলে দেব, চলো। কেকার পার্ট প্রম্পট করলাম আমি। ভুলুদারা (শান্তিদেব ঘোষের ভাই শুভময় ঘোষ) আমার বিষয়ে কৌতূহলী হলেন। নাটক করেছি কি না জিজ্ঞেস করলেন। ঢাকা বেতারে আমি নাটক করতাম। ভুলুদারা শুনেছেন, মনে করতে পারলেন। রাজা নাটক হয়ে গেলে আর এক নাটকের তাল তুললেন ভুলুদা, অমিতদারা। একটা বৈঠক ডাকলেন ওঁরা। বিকেলে নাটকের মহড়ায় যাই। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান দেখি, এইসব করে সত্যেন দত্ত নিয়ে থিসিসটা শুরু করা হচ্ছে না। নিজেকে শাসন করে ভুলুদাদের বৈঠকে গরহাজির থাকলাম। শুনলাম ওঁরা আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। কেকা বলেছে, থিসিস লিখবার কাজ শুরু করব বলে বৈঠকে যাইনি। এবার শেষরক্ষা হবে। ক্ষান্তমণির চরিত্রের জন্যে আমার কথা ভেবেছিলেন ওঁরা। নাটক করবার ইচ্ছেও মনের মধ্যে টগবগ করছে আমার। শেষ পর্যন্ত কী করে ঠিকই জুটে গেলাম ক্ষান্তমণির চরিত্র অভিনয়ে।

ক্ষান্তমণির স্বামী চন্দ্রকান্ত হয়েছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক বিশ্বনাথদা। সব চরিত্রের কথা মনে নেই এখন। কেকা হয়েছিল কমল, শিখা গুহ ইন্দু, গদাই ভুলুদা, গদাইয়ের বাবা অমিতদা (অমিতাভ চৌধুরী)…এই সব। গোটা দুই গানও গেয়েছিলাম আড়াল থেকে।

নাটকের পরে একদিন মাংস রান্না করে খাইয়েছিলাম অমিতদাদের। কী ঘোড়ার ডিম রেঁধেছিলাম কে জানে। সবাই মহাখুশি। অমিতদা বললেন ডিংস রান্না করতে পারো? সে আবার কী? পরে শুনেছিলাম, ডিমের চারপাশে মাংসের কিমা জড়িয়ে ভেজে ও রান্না করতে হয়। ডিংস নাম অমিতদার দেওয়া। মজা করবার ওস্তাদ তো! ছেলের নাম ‘অনির্বাণ। ওকে নিয়ে ছড়া লিখেছিলেন —

হাতে লৈয়া ধনুর্বাণ

আইলেন বাবু অনির্বাণ।

নাটকের পর থেকে আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘এই যে ক্ষান্তমণি। এসো, এসো, মঙ্গল হোক’। কলকাতায় রিজেন্ট পার্কের কাছে কোথায় থাকতেন, বাসায় গেছি। নেমন্তন্ন করে খাইয়েছেন। খুব স্নেহ করতেন আমাকে। ওঁর ফ্ল্যাটের কাছেই থাকতেন অমিতা ঠাকুর। তাঁর কাছেও গিয়েছি রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদলিখবার সময়ে কিছু প্রশ্ন নিয়ে। গান শুনতে চেয়েছিলেন, অমিতা সেন খুকুর রেকর্ডে গাওয়া ‘যে ছিল আমার স্বপনচারিণী’ শুনিয়েছি। অমিতা সেনের স্টাইলটা আয়ত্ত করতে পেরেছি, বলেছিলেন খুশি হয়ে।

অমিয়া ঠাকুর

সুভাষ চৌধুরীর সঙ্গে অমিয়া ঠাকুরের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। উনি গান শুনিয়েছিলেন অসাধারণ। সুভাষের এসরাজের সঙ্গে গান গাইতে উনি পছন্দ করতেন। আর একটা বৈঠকে ওঁর গান শুনবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ গেয়েছিলেন। ব্যাকুলতা কাকে বলে সর্বান্তঃকরণে উপলব্ধি করেছিলাম সুরের নিপুণ গভীর মোচড়ে। এমন গান জীবনে আর শুনব না।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বপন যদি ভাঙিলে’ শুনেছিলাম একবার পৌষমেলার সময়ে ছাতিমতলার উপাসনায়। ওঁর গান ছিল প্রথমেই। আমি ওখানে পৌঁছে তখনো বসতে পারিনি, ‘ভাঙিলে’র টানের সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ দিয়ে দরদর করে জল ঝরে পড়ল! কী লাবণ্যময় যে সে — উচ্চারণ!

আর একবার এমএ ক্লাসে পড়বার সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলাম। শান্তিদেব ঘোষ মঞ্চ থেকে গান ধরলেন ‘ওহে জীবনবল্লভ, ওহে সাধনদুর্লভ’। কাজ করব কী, আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এ গান শেষ করে আবার ধরলেন ‘ওই আসনতলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব’। কীর্তনের আবেদনে চারপাশ ভুলে গেলাম।

এই সব অভিজ্ঞতা জীবনের অমূল্য সম্পদ।

নীলিমা সেন অর্থাৎ বাচ্চুদির গানের ভক্ত ছিলাম আমি বরাবর। রেকর্ডে তার গাওয়া ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি’ কিংবা আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে এসব গান গাইতাম তো বটেই, শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁকে দেখে সমগ্র মানুষটিকে বেজায় ভালো লেগে গেল। নিরিবিলি শান্ত স্বভাব, ঘরোয়া সহজভাব। কাকাবাবু একদিন তাঁকে বললেন, বাচ্চু, একটি গান শোনাও। চৌকির প্রান্তে কোনোমতে ঝুলে বসেছিলেন। বললাম, বাচ্চুদি, ঠিক হয়ে বসে নিন — গান গাইতে সুবিধা হবে। কাকাবাবু আমাকে বললেন, ও গান গেয়েই ঠিক সুবিধা করে নেবে। আশ্চর্য! ওই রকম ঝুলে বসেই উনি গান ধরলেন, ‘অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে। কণায় কণায় বেঁটে’ বলবার সময়ে প্রতিটি কণার কথা স্পষ্ট ফুটে উঠল। অবলীলাক্রমে গেয়ে গেলেন গানখানি। কারুকাজ আর তানে ভরা গানটি গেয়ে গেলেন বিনা আয়াসে।

নীলিমা সেন

আদর্শের ব্যাপারে আবার ছিলেন একেবারে অনড়। একবার মায়া সেনের বিলেতপ্রবাসী ছোট ভাই বিলেতে একদল শিল্পী নিয়ে যাবার আয়োজন করেছিলেন। সেই সময়ে বাচ্চুদির ওপরে দায়িত্ব পড়েছিল ‘শ্যামা’-র গান রেকর্ডিং করে নিয়ে যাবার। মায়াদির আরও এক ছোট ভাই ছিলেন কলকাতায়। রেকর্ডিংয়ের সময়ে তিনি গানের গ্যাপ মিউজিক কম্পোজ করতে শুরু করলেন। তাঁর নির্বাচিত যন্ত্রগুলোও গানের সঙ্গে মানানসই মনে হচ্ছিল না বাচ্চুদির। বাচ্চুদির আপত্তিতে ছেলেটি ভ্রূক্ষেপ করছিল না। বাচ্চুদি রেকর্ডিংয়ের দায়িত্ব ছেড়ে সরে গেলেন নীরবে। পরের পয়সায় বিলেত ঘুরে আসার সুযোগ বাচুদির কাছে তুচ্ছ হলো। প্রয়োজনে এ রকম ক্ষেত্রে তাকে খুব দৃঢ় হতে দেখেছি।

শ্রীভবন হোস্টেলে একদিন কলাভবনের একতলার ঘর থেকে ‘রহি রহি আনন্দতরঙ্গ জাগে’ গানটি ভেসে আসতে লাগল। ভজনের মতো ভক্তির ভাবে ভরা সে — গান কে গাইছেন, জানবার জন্যে খেপে উঠলাম। ছুটলাম সেদিকে। চোরের মতো চুপি চুপি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি দুহাতে মন্দিরা নিয়ে বাজাতে বাজাতে মধ্যবয়সী এক মহিলা বিভোর হয়ে গাইছেন ছন্দে ছন্দে। কলাভবনের শিক্ষিকা উমাদির ঘর ওটা। উনি অরবিন্দ নিলয় — এর ভক্তিমতী সদস্য। পরে খবর নিয়ে জানলাম, দক্ষিণ ভারতীয় রবীন্দ্রশিষ্য শ্রীমতী সাবিত্রী গোবিন্দ গান গেয়ে উপাসনা করছিলেন। ওঁর পাশে চোখ বুজে হাত জোড় করে বসে যোগ দিয়েছিলেন উমাদি। ওই গান আর কারও গলায় কখনো ভালো লাগবে না আমার।

উমাদিকে চিনতাম ক্ষমাদির সূত্রে। ক্ষমা সেন নাম ছিল বিয়ের আগে। রোজ বেলা এগারোটা-বারোটা নাগাদ ক্লাসের কাজ শেষ করে সাইকেল চালিয়ে উমাদির কাছে আসতেন তিনি। শান্তিনিকেতনে মেয়েদের সাইকেল চালানোর দৃশ্য ছিল দেখবার মতো। ছেলেদের চেয়ে আলাদাভাবে তৈরি সাইকেল। এতে মেয়েদের শাড়ি পরে চালাবার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। রোদ আড়াল করবার জন্যে বিশেষ ধরনের টোকা মাথায় দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসতেন ক্ষমাদি। ছন্দোময় ছিল তাঁর চালানোর ভঙ্গি।

নরম স্বভাবের ক্ষমাদি ভারি মিষ্টি করে গান গাইতেন। চেহারা চালচলন মিলিয়ে ভালোবাসবার মতন মানুষ। আমি তাঁর ছিমছাম করে সাজানো বাসাতেও যেতাম। পাঠভবনের শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকা আর সেলাই করার ক্লাস নিতেন। গল্প শুনেছি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কথা না শুনে বেয়াড়াপনা করলে উনি নাকি ভ্যাঁ করে কেঁদে দিতেন। বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন কিনা!

ক্ষমাদির বিয়ে হলো লাইব্রেরির কর্মী চৈতিদার সঙ্গে। উনিও আরেক ভালো মানুষ। আশ্রমে কেউ কোথাও গান গাইবে জানতে পেলেই এসরাজটি সঙ্গে নিয়ে উনি হাজির সংগত করতে। আমার গানের সঙ্গেও বাজিয়েছিলেন মনে আছে। বিয়ের পরে পূর্বপল্লীতে ভারি সুন্দর একটা বাড়ি করেছিলেন ওঁরা। তেমনি সুন্দর ঘরদুয়ারের সাজসজ্জা। কলাভবনের ছাত্রীর বাড়ি বলে কথা!

ক্ষিতীশ রায়ের মেয়ে মিষ্টুনি খোলা গলায় গান গেয়ে গেয়ে পথ চলত শান্তিনিকেতনে। পথঘাট গানের সুরে ভরে উঠত। চমৎকার লাগত। পরে এক ইংরেজকে বিয়ে করে শান্তিনিকেতন ছেড়ে গিয়েছিল সে। এরাই আসলে আশ্রমজীবনের সম্পদ। আকাশে বাতাসে গান ছড়িয়ে না গেলে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমের আর কী মানে থাকল!

মিষ্টুনির ছোট বোন শর্মিলার (টুকু) ও সহজে গান গেয়ে উঠবার ওই ধরনটা ছিল। অবশ্য আমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসবার পরে ও বড় হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে শান্তিনিকেতনের গানের দলে ঢাকায় এলে তাকে দেখেছি। তখন রীতিমতো ভালো গাইয়ে সে। এ ও অবশ্য এক ফরাসি নাগরিককে বিয়ে করে ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল। এখন শর্মিলা রায়কে পোমো নামে সবাই চেনে। গান নিয়ে যথেষ্ট পড়ালেখা করে সুনাম করেছে সে।

গানের প্রসঙ্গে প্রথম দিকেই সুভাষ চৌধুরীর নাম করেছি এসরাজ — বাজিয়ে হিসেবে। আমি যখন শান্তিনিকেতনে এমএ পড়ছি, তখন সুভাষ সংগীতভবনের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ফিসফাস শুনতাম চতুর্থ বর্ষের সুপূর্ণা ঠাকুরের সঙ্গে নাকি তার ভাব। সুপূর্ণা ছিল ডে স্কলার। অর্থাৎ হোস্টেলে নয়, বাসায় থেকে পড়ত সে। বাসাতে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গান শিখত সে। চমৎকার গাইত বাস্তবিক। তার ‘আজি দক্ষিণ পবনে’ গান কানে বাজে এখনো। ওদিকে সুভাষের গান শুনিনি কখোনো। এক বছরের এমএ ক্লাসের পড়া শেষ করে ফিরে আসবার আগে একদিন সুভাষ আমাকে কো-অপে চা খেতে ডাকল। কো-অপ হচ্ছে কো-অপারেটিভ সোসাইটির দোকান। চা খাবার ব্যবস্থাও ছিল পাশে খড়ের গোল ছাউনির নিচে। চায়ের পরে সুভাষ বলল — মিনুদি, আজ আমি আপনাকে গান শোনাব। অবাক হলাম। তবে একটা ফাঁকিবাজি গান ধরল, ‘বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে’। এইটুকুনি গান, শুরু না হতেই শেষ হয়ে যায়। সেই প্রথম আর সেই শেষ তার গান শুনি। পাতলা গলা, পুরুষকণ্ঠের গাম্ভীর্য নেই কোনো। পরে রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ হয়ে সে এসরাজ বাজিয়ে, গান শিখিয়েই জীবন পার করল। সুভাষের মতো দক্ষ শিক্ষক কলকাতাতে আর ছিল না। বলতে বলতে গানের কথায় ভুলে লেখাপড়া বা অন্যসব কথা ফেলে কোথায় চলে গেছি। ফিরে যাই আবার। [ক্রমশ]


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন”

  1. আপনার গানের মতই লেখা, কি ভালোই যে লাগলো পড়তে! আপনার গলাএ ‘গানের ভেলায় বেলা অবেলায় প্রাণের আশা…….এমনটি আর কোথাও শুনলাম না! ভালো থাকবেন, পরের পর্বের অপেক্ষায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন