কিন্তু রুপু’র তো ঘর আছে। তাকে সেখানে ফিরতে হয়। ইশতিয়াকের ঘর আছে অথচ “সাদা রঙের দু’কামরার বাড়িটা যে নিঃসঙ্গ’’ কিন্তু বাড়ি ফিরতে হয়। মা’র আদেশ অর্পিত হয় “বন্ধুদের সঙ্গে বেশি আড্ডা চলবে না।’’ শীতল অনুভূতি নিয়ে ইশতিয়াক তখন শিল্পী টিটুলের রঙতুলির বিশৃঙ্খল জীবনের প্রতি অনুরক্ত হতে চায়। তথচ সামাজিক বন্ধন অতি পোক্ত। মামা সেখানে বিবাহ প্রস্তাব পেশ করে। মা প্রত্যাখান করেন। ইশতিয়াকের মাকে ভীষণ স্বার্থপর, হিংসুটে এবং ভয়াবহ মনে হলো। “কিন্তু বাবা মারা যাবার পর তোমাকে নিয়ে আমার কষ্ট করতে হয়েছে’’ এ কথায় কান্না গলিয়ে ওঠে তাই বন্ধু টিটুলকে বলে —
“আমার জীবনে একটা গল্প আছে টিটুল। সেই গ্লানি আমাকে প্রতি মুহূর্তে রক্তাক্ত করে।’’
ইশতিয়াকের নিঃসঙ্গ যন্ত্রণাকাতর জীবনের বিপোরিত নিস্তরঙ্গ রুপু-টিটুলের পারস্পরিক সম্পর্ক ও জীবন অন্বেষণ রূপায়ণের মধ্যে দিয়ে লেখক দুই বিপরীত পরিস্থিতিতে ব্যক্তির জীবনাকাঙ্ক্ষাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ইশতিয়াক জীবন অনুসন্ধানে দেখতে পায় রুপুর কাছে প্রেমাকাঙ্ক্ষা কতটা শূন্যতার সামিল। কারণ, রুপু তো টিটুলের প্রতি সমর্পিত। বিশ্বাসের পাথরে ধস নেমেছে। এজন্য মা’র মুখোমুখি হয় ভয়শূন্য হয়ে। কারর, হয় তাকে মা’র গোয়ার্তুমি ক্ষমা করতে হবে নতুবা মাকে হত্যা করতে হবে। শেষে সে ক্ষমাশীল হতে চেষ্টা করে। ইতোমধ্যে টিটুল স্কলারশিপ নিয়ে গ্রীসে চলে গেল। আর রুপু অন্য একজনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো। ইশতিয়াকের মনোজগতে অনিকেত সংকেত প্রবাহিত হয় —
“আমি কোথা যাবো? আমার সেই শীতার্ত গুহায়? যে গুহা এক মহিলার জেদ আর প্রতিশোধের ভয়ানক আকোশে হিম’’ (পৃ. ৫৪)।
শূন্যতায় মুহ্যমান ইশতিয়াক কিন্তু আশাহত হয় না —
“এখনো আমার জন্য কেউ আছে, নিশ্চয় কেউ না কেউ আছে, তাকে আমি দেখিনি সেও আমাকে না, তবু আমার জন্য সে আছে। মুযি ভরা মহুয়া নিয়ে আমি পায়চারি করি। এখন আমার কিছুই খারাপ লাগছে না’’ (পৃ. ৫৫)।
ইশতিয়াক নিজের পথ অন্বেষণ করে নেয়। পরীক্ষায় পাস করে লাহোরে ট্রেনিং-এর সময় ডেজীর সঙ্গে পরিচয়সূত্রে ঘনিষ্ঠতা ও বিবাহ। কিন্তু তাতেও কি নাগরিক জীবনে সমস্ত প্রাপ্তির পূর্ণতা আসে? প্রশ্নদীর্ণ হয়ে সে বলে —
“আমাদের ওড়া শেষ-আমরা মাটিতে নেমেছি। সে জন্য দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, কেউ কারো কাছে পৌঁছুতে পারছি না। তাই আর একটি ভাজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের পুরোটায় আর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এখন ভাঙনে আর ভয় পাই না’’।
ভাঙন থেকে স্ত্রী-স্বামী সম্পর্কের যে সংকট তার মধ্যবিন্দু স্পর্শ করে পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে একটি অনুকাহিনীর মধ্যদিয়ে। যা রোমেলের মানসিক বিন্যশের প্রান্ত স্পর্শ করার জন্য উপন্যাসে প্রয়োজনীয় করে তোলা হয়েছে।
রোমেলের বন্ধু নিশু খুন করেছে অলোককে। কারণ বন্ধু অলোকের বোন পিংকিকে নিশু ভালোবাসত কিন্তু অলোক সে সম্পর্ক অস্বীকার করে খুলনায় চাচার বাড়ি পাযিয়ে পিংকিকে ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিবাহ দেবার দিন সাতেকের মধ্যে খুন হতে হয় তাকে। এরপর নিশু আত্মরক্ষার জন্য প্রথমে বড় আপার ননদ নীলার বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করে “চারদিনে ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ এবং বিধ্বস্ত’’ হয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনাটি লেখক নিশুর একটি গল্প যা রোমেলকে পাঠিয়েছিল তার ভেতর দিয়ে উদঘাটন করেছেন। নিশুর সবুজ জীবনের প্রতি তৃষ্ণা এবং মা’র প্রতি আলোবাসা ইশতিয়াকের বাল্যযৌবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইশতিয়াক জেদি মা’র জন্য করুণাবোধ করেছে ভালোবাসতে পারেনি, কিন্তু নিশু বিধবা মা’র জন্য প্রচণ্ড আবেগ অনুভব করেছে।
নিশুর জীবনের নৈরাশ্য রোমেলকে আত্মখননে অনুপ্রাণিত করে। মা-বাবার সম্পর্ক যেহানে গভীর শূন্যতাময়; যেখানে বাবা অসহায়, ছেলের প্রতি সচেতন কেউ নেই গৃহে, সেখানে রোমেল ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সুস্থ জীবন থেকে। অসুস্থ প্রবৃত্তি তাকে নিঃশেষ জীবনের পথে নিয়ে যায়।
স্ত্রী ডেজীর পারিবারিক সংশ্রম ত্যাগ ও ইশতিয়াকের বন্মু রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং রোমেলের নেশাসক্ত পথে আত্মবিনাশ প্রচেষ্টা যুগপৎ ইশতিয়াককে দুর্দান্ত অসহায় ও অস্থির করে তোলে। জীবনের জটিল সমস্যার আস্তরণকে আরো মোটা দাগে নির্মাণের জন্য লেখক তাদের পাশের বাসায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সমজেদ-মেহেরে সুখের জীবন প্রণালী উন্মোচন করে সমান্তরালভাবে বিশে¬ষণ করার চেষ্টা করেছেন আধুনিক মানুষের অপ্রাপ্তিজনিত হাহাকারের মর্মান্তিক রূপটিকে।
“ভালোবেসে বিয়ে করার পরও ডেজী ওর মনের মতো হয়নি।’’ অফিস কামায় করে ইশতিয়াক সংসারের অন্তহনি সমস্যার সমাধান করতে সচেষ্ট হয়। রোমেলকে বন্ধু করার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু সে জানে — “এই সংসারে তিনজন মানুষ একদম একা, কারো সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ নেই।’’ রোমেলকে নেশা করে ফিরতে দেখে ইশতিয়াক তার প্রতিবাদ করে কিন্তু রোমেলের কাছ থেকে “আমি এসবের মধ্যে বাঁচতে শিখেছি’’ শুনে বিস্ময়াভূত হয়ে যায়। — “ইশতিয়াকের মনে হয় বাবার ওপর ওর দীর্ঘদিনের রাগ। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রোমেল কতকাল ধরে হৃদয়ের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগছে? হায় ঈশ্বর এই ছোট ছাদের নীচে কত কি যে ঘটে যায়। ইশতিয়াক ছেলের রাগে নিজের মধ্যে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে। কিছুটা রূঢ়কণ্ঠে ছেলেকে শাসন করে’’ (পৃ. ৯৪)। কিন্তু রোমেলের কণ্ঠ “তুমি আমাকে কিছুতেই ফেরাতে পারবে না কিছুতেই না।’’ পিতৃত্বের পরাজয় ও পারস্পরিক সম্পর্কের নগ্নতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
ক্লান্ত হতাশ জীবন টেনে যাওয়ার কোন সদর্থক দিক নেই। এজন্য মেহের-সমজেদের ক্লান্তিহীন সুখের জীবনের সঙ্গে নিজের সংসারের তুলনা করে ডেজীর স্বার্থপরতাকে দায়ী করেছে ইশতিয়াক। ইশতিয়াকের অতীত জীবনের চলনবিলে বালিহাঁস শিকারের ঘটনা নিঃসঙ্গ, শূন্যগৃহে স্মৃতিপটে এনে ভয়ানক পরিস্থিতিকে ইঙ্গিত করে।
“বউ ঘরে নেই, ছেলে পালিয়ে গেছে, মাসুদকে ডাকলে সাড়া দেবেনা; ওর হাতে দোনলা বন্দুক, ও শুধু ট্রিগার টেপার অপেক্ষায় আছে। সাঁই করে ছুটে আসবে বুলেট। রক্তাক্ত বালিহাঁস ও নিজে’’ (পৃ. ১০৯)।
বন্দুকের গুলি যে কাকে বিদ্ধ করবে তা লেখকের অগোচর। কারণ ইশতিয়াকের মানসিক পরিস্থিতি এখনও পর্যবেক্ষণের অপেক্ষা রাখে। অন্যদিকে এখনও তাদের অনেক ঘটনাই অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। এ জন্য ঔপন্যাসিক রোমেলের লিখিত ডায়েরীর আঠারোটি অনুচ্ছেদে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশগুলো পাঠক ইশতিয়াকের প্রতিক্রিয়াসহ তুলে ধরেছেন। ডায়েরী তার গ্লানি বিষাদ এবং অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। অন্ধকার খুঁড়ে খুঁড়ে অগ্রসর কি আলোকিত ভোরের জন্যে নাকি বিনাশের গহ্বরে প্রবেশের জন্যে? এজন্য হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়া এবং সামনের ফ্ল্যাটে বন্দুক তাক করা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে না।
ইশতিয়াক যন্ত্রণা লাঘব করার জন্যে প্রাচীন সুখের নীড় চূর্ণ করে। এখন থাকল নিজের অবস্থান। সেটাও এতদিনে ধে গেছে। অতএব জীবিত থাকা নিরর্থক। তাই আত্মহত্যা করতে হয় তাকে। কিন্তু রোমেল? কি করবে তৃতীয় প্রজন্মের এই সন্তান দীন মোহাম্মদের দোকানে নেশা করতে গিয়েছে কারণ, সে তো জানে —
বাবা তবু আমাকে চড় মারে। সেটা আমার জন্য সান্ত্বনা। আমি দুঃখ পাই না। মা’র কাছ থেকে আমার কিছু পাওয়া নেই, আমার ঘর নেই, আমার শিক্ষা নেই, নিশ্চয়তা নেই।’’
অস্তিত্বের এই বিপন্ন অবস্থায় তার জীবনে কেউ থাকল না। তারও মৃত্যু হলো একপ্রকারে। এভাবে মৃত্যু ধ্বংসের ভেতর দিয়ে স্বাভাবিক জীবন বিচ্যুতগ্রহের বাসিন্দাদের কাহিনী সমাপ্ত হয়।
আত্মকথন ও চেতনাপ্রবাহের প্রাধান্যে উপন্যাসের অবয়ব সংস্থান সংগঠিত হয়েছে সরল প্লটে। এ ক্ষেত্রে ঘটনার জটিলতা নয়, চরিত্রের অন্তর্জগতের সংকট সমস্যা উন্মোচনই মূল বিবেচ্য বিষয়। এজন্য সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ কখনও ইশতিয়াক, রোমেল এবং নিশুর দৃষ্টিকোণে পরিবৃত্ত হয়ে উঠেছে। ইশতিয়াকের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের জন্য যাবতীয় ঘটনার বিন্যাস এবং অন্যান্য চরিত্রের অন্তর্নিহিত সংকট উন্মোচনে লেখকের প্রচেষ্টা পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বর্ণনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী পরিচর্যা প্রাধান্য পেলেও কখনও কখনও চরিত্রের আত্মস্বরূপ উন্মোচনে পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যময় পরিচর্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে দেখা যায়। যেমন নিুোক্ত অংশে চরিত্রের অবচেতনের বিক্ষোভ উদঘাটনের প্রতীকী পরিচর্যায় দৃশ্যময় ব্যঞ্জনা —
“চাঁদ হেলে গিয়ে মহুয়া গাছের আড়ালে পড়েছে, ঘরে আলো আঁধারী। আমি বিছানায় আছি। বিশাল একটা মাকড়সা দেয়াল জুড়ে পা ছড়িয়ে আছে। ভীষণ নির্জনতা আমার চারপাশে। সে মুহূর্তে আমার মনে হয় মা’র সঙ্গে এহন আমার ইঁদুর-বেড়াল খেলা। মা এক অতিকায় বেড়াল; আমি নেংটি ইঁদুর। মা’র ভয়ে প্রাণপরে দৌড়াচ্ছি; মা ইচ্ছে করলে খপ করে আমাকে ধরে ফেলতে পারেন। কিন্তু ধরছেন না এবং মারছেন না। কেবল আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন।’’
মূলত সেলিনা হোসেন নাগরিক জীবনের নানাবিধ সংকটকে ব্যক্তির বহুমাত্রিক চেতনার সংস্পর্শে দৃশ্যমান করতে চেয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তি তো শুধু গণ্ডিবদ্ধ পরিবারের সংকটের চূড়ান্তসীমায় এভাবে ক্ষয়ে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। সচেতন শিক্ষিত নাগরিক জীবনযন্ত্রণার মূলে থাকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাস্রোত। লেখক সযত্নে তা থেকে দূরে সরে নির্জলা মনস্তাত্বিকমূলক উপন্যাসের অবয়ব নির্মাণ করেছেন। তবে লেখক সংহত বিবরণ ও একঘেঁয়েমী কাহিনীসূত্র সংগ্রথিত না করে নাগরিক বৃত্তের জীবনদগ্ধ উপন্যাস উপহার দিতে পেরেছেন বলে আমার বিশ্বাস।
সহায়ক গ্রন্থ —
১। সেলিনা হোসেন, পদশব্দ, ১৩৯০, চট্টগ্রাম, বইঘর।
২। সেলিনা হোসেন, মগ্নচৈতন্যে শিস, ১৯৭৯, প্র. সমিক প্রকাশনী, ঢাকা।
৩। সেলিনা হোসেন, ক্ষরণ, ১৯৮৮, পল্লব পাবলিশার্স, ঢাকা।
৪। সেলিনা হোসেন, খুন ও ভালোবাসা, ১৯৯০, সৃজন প্রকাশনী।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com