ছবি শুটিং করার ব্যাপারটা খুব একটা সহজ নয়। দু’ঘণ্টা অর্থাৎ ১২০ মিনিটের একটি ছবি শুটিং করতে সময় লাগে কমপক্ষে ৪০ দিন। তাহলে গড়পড়তা হিসেবে হল একটা গোটা দিনে অর্থাৎ ৮ ঘণ্টার কাজের ফলে যেটুকু ছবি উঠলো পর্দায় সেটির দায়িত্ব হল মাত্র তিন মিনিট। শুটিংয়ের পর মাস খানিক সময় লাগে সম্পাদনা, রিরেকর্ডিং ইত্যাদি কাজে। এই সময় ব্যয়ের পাশাপাশি তাল রেখে চলে চিত্রকর্মীদের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম।
দর্শক যখন সিনেমায় হলে বসে ছবি দেখেন তখন চিত্র নির্মাণের পিছনে এক যে বিশাল মেহনতের ব্যাপার থাকে সেটা কেউই টের পান না। আর টের না পাওয়াটাই খুবই স্বাভাবিক। অনেক কাটখড় পুড়িয়ে, বিস্তার সময় অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে, চিত্র নির্মাতা যা দাঁড় করালেন সেটা নিয়েই দর্শকের কারবার। আপাতদৃষ্টিতে যা তুচ্ছ বা সহজ বা অনাড়ম্বর লাগলেও, তার পিছনে যে কত রকম ঝুঁকি থাকে সে কথা দর্শক জানবে কি করে! শুটিং পর্বের কাজেই সব চেয়ে বেশি ঝামেলা আর পরিশ্রম। এই কাজটা অনেক সময় স্টুডিওর ভিতর না হয়ে হয় বাইরে, প্রাকৃতিক পরিবেশে।
বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ, যার হাত ধরে বাংলা সিনেমা প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছিল সেই বিরল প্রতিভার মানুষ ছিলেন সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্র নির্মাতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিশিষ্ট লেখক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং শিল্প নির্দেশক। আজ সত্যজিৎ রায়ের ১০৩ তম জন্মদিনে তাঁরই শুটিং চলাকালীন কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করি। যাতে দর্শক অন্তত বুঝতে পারবেন কত মেহনত করে, নানান বিপরীত পরিস্থিতি সম্মুখীন হয়ে তাঁকে ছবি তৈরি করতে হয়েছিলো।
সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা কী ভাবে বিচ্ছুরিত হয়েছিল তাঁর সিলভার স্ক্রিনে সেই গল্প বলার চেষ্টা করবো।
‘তিন কন্যা’র ‘সমাপ্তি’ ছবির একটি দৃশ্য। বিএ পাস করা অমূল্য পাত্রী দেখে বাড়ি ফিরছে। বই পড়তে আর প্রকৃতি দেখতে ভালবাসা অমূল্যর, ভারী বর্ষার নদীর মতো আবেগে ভরা মন। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল গেঁয়ো পথ দিয়ে যাবার সময় নায়িকা মৃন্ময়ীর সঙ্গে পাত্রের প্রথম সাক্ষাৎ।
নিমতিতা গ্রামের একটি রাস্তায় শুটিংয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে শুটিং করতে হবে। বর্ষার শেষাশেষি অতএব প্রকৃতির খামখেয়ালির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সমস্যা হলো খামখেয়ালির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে চরম উৎকন্ঠার স্বীকার হলো পুরো টিম। নিয়ম মত এ সময় পথঘাটের কি অবস্থা হয় তা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল সকলেরই।
দু-চার বছর আগেই এখানে ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং এই গ্রামেই হয়েছিল। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সত্যজিতের টিমকে অবাক করলো। সপ্তাহকাল অনাবৃষ্টির ফলে পথঘাট ফেটে চৌচির হয়ে আছে। হাতে মাত্র একদিন সময়, পরের দিন দৃশ্যটি তুলতে না পারলে অপরিমেয় ক্ষতি। সারারাত সবাই বৃষ্টির আশায় এবং বৃষ্টি না হওয়ার আশঙ্কায় জেগে বসে রইল।
পরের দিনও মেঘের কোন চিহ্ন নেই। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত কিছু বালতি, ঝারি ও জলের পাইপ নিয়ে রাস্তায় নির্বাচিত অংশের কাছাকাছি একটি পুকুরে থেকে জল তুলে রাস্তায় ঢেলে কাদা সৃষ্টি করার জন্য একটি হাস্যকর প্রচেষ্টা চলল। বালতি বালতি জল ফাটলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো। দিনের পর দিন এইভাবে জল ঢেলে গেলেও কাদা সৃষ্টি হবে এমন বোধ হওয়ার কারন নেই। দু-চার ঘন্টা পরিশ্রমের পর হাল ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে আকাশের নৈর্ঋত কোণ থেকে একটা মৃদু গর্জন কানে ভেসে এলো। এই গর্জনের আধা ঘন্টার মধ্যে শুরু হলো প্রলয়ংকারী বর্ষণ। বর্ষার মধ্যে কর্দম সৃষ্টি ও শট নেওয়ার কাজ–দুটোই শেষ হয়ে গেল। আপাতদৃষ্টিতে কাজটা খুব সহজ বলে মনে হলেও, এই দৃশ্য যে কি ভয়ংকর সংকটের সৃষ্টি করেছিল — তা কেবল সত্যজিৎ রায় ও তার টিম সেদিন বুঝতে পেরেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পটির শেষের অংশটি একেবারে নিজের মতো সৃজন করে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এখানেই তার স্বকীয়তা। তাই হয়তো ‘সমাপ্তি’ সিনেমাটি রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেয়েছিল।
এবার বলি অপরাজিত সিনেমাটির শুটিং এর একটি দৃশ্যের কথা। অপরাজিত অপু ত্রয়ীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। এটি ১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনায় মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত পথের পাঁচালী উপন্যাসের শেষ এক-পঞ্চমাংশ এবং অপরাজিত উপন্যাসের প্রারম্ভিক এক-তৃতীয়াংশের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
ছবিটির একটি দৃশ্যে হরিহরের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পরমুহূর্তেই কাশির ঘাট থেকে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে ভোরের আকাশে চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে। ঘাটে বসে থাকতে থাকতে পায়রাগুলোকে বহুবার এইভাবে উড়তে দেখেছেন সত্যজিৎ কিন্তু এটির কোন নির্দিষ্ট কারণ বা সময় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কি এই দৃশ্য টেক করতে ক্যামেরা খাটিয়ে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন গতি নেই!
এই হাজার পায়রার কিছু বসে থাকা ঘাটের বুরজে, আর কিছু থাকে ঘাট সংলগ্ন দালানগুলির কার্নিশে ও ঘুলঘুলিতে। পরীক্ষা করে দেখা গেল পটকা জাতীয় কিছুর সাহায্যে একটা জোড় শব্দ করলেই পায়রাগুলো আকাশে উড়ে মিনিটখানেক ওইভাবে ঘুরে আবার জায়গায় ফিরে আসে।
পটকা সংগ্রহ করা হলো, ভোর পাঁচটায় ক্যামেরার মুখ আকাশের দিকে করে পটকার ল্যাজে অগ্নিসংযোগ করা হলো। যথারীতি বিস্ফোরণের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পায়রা গুলি তাদের বিচিত্র গগন পরিক্রমণ করা শুরু করে দিল। এদিকে ক্যামেরায় যে অচল সেটা আর দেখা হয়নি। আলোকচিত্র সহকারি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। অগ্নিসংযোগের উত্তেজনায় ক্যামেরাটি তিনি ব্যাটারির সঙ্গে সংযুক্তই করেননি।
এদিকে পূবের আকাশে সূর্যের প্রথম আলোর আভাস দেখা গেছে, রোদ উঠে গেলে শর্টের মুড নষ্ট হয়ে যাবে। সকলে প্রমাদ গুনলো। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ব্যাটারির তার লাগিয়ে দেখা গেল পায়রাগুলি তাদের জায়গায় আবার ফিরে এসেছে।
এক মিনিট তাদের বিশ্রামের সময় দিয়ে পটকায় আগুন দেয়া হলো। কপাল জোরে এই দ্বিতীয় চেষ্টাতেই চমৎকারভাবে শটটি হয়ে গেল। শর্টটি হবার পরে সত্যিজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘মানুষ বা শিক্ষিত জানোয়ারের পক্ষে অভিনয়ের এমন হুবহু পুনরাবৃত্তি সম্ভব হতো না।’
সত্যজিৎ রায়ের আদম্য ইচ্ছা, জেদ এবং নিষ্ঠা ফুটে উঠেছিলো এই ছবিতে। ফলস্বরূপ ছবিটি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে, যার মধ্যে আছে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের স্বর্ণ সিংহ পুরস্কার।
তথ্য ঋণ সত্যজিৎ রায়ের লেখা দর্শকের অগোচরে উইকিমিডিয়া এবং অন্যান্য।
অসাধারণ প্রয়াস সার্থক, কত অজনাকে হোলো জানা, শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল, কোন হীরক রাজার দেশে মানিক হারিয়ে গেল?