চিলোকোঠায় রক্ত তুলি ক্যানভাস এবং বইয়ের জগতে যার একদিন সময় কাটত নির্বিঘ্নে সে এখন পলাতক জীবন যাপন করছে। কিন্তু সে উপলব্ধি করে সচেতনভাবে সে খুন করেনি; হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়েছিলো, তার এই অনুতপ্ত হৃদয় আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে —
“মানুষের জীবনে এমন সর্বনাশ পরিবেশ আসেন কেন? কেন নিজের ভবিষ্যৎ ন্ধকার করে তার বর্তমান? ও যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে, যে কাজের সঙ্গে আমার মগজ ক্রিয়াশীল ছিলো না, তার জন্য কি আমার দায় আছে? কিন্তু আমি তো একজনের জীবন নষ্ট করেছি, সে দায়িত্ব আমাকে বহন করতেই হবে। আমি কেমন করে এড়াবো? একি এড়ানো যায়? নাকি এড়ানো উচিত? (পৃ. ২)।
মাধবপুরে দীননাথের আশ্রয়ে সে নতুন জন্ম প্রত্যাশা করেছে রাস উৎসবের শেষে স্থানীয় স্কুলের ড্রয়িং মাষ্টারের চাকরি পাবার পরে ক্লাসের রেণুবালাকে নিয়ে শাহরিয়ার স্বপ্ন দেখে, শামান্তার সঙ্গে মিলাতে চায়। কিন্তু মনিপুরিদের বিয়ের অনুষ্ঠান চমৎকার লাগলেও দীননাথের গ্রামে রাধাকান্তের মতো যুবকরা কৈফিয়ত চায় —
“তুমি সব সময় রেণুবালার দিকে তাকিয়ে থাকো কেনো?’’
শাহরিয়ার তার ভালোলাগার কথা জানালে অনর্থ ঘটে। অবশেষে দীননাথের ব্যবস্থায় তাকে শ্রীমঙ্গলের জুরিন চা বাগানে আনারস পাহারার কাজে নিযুক্ত কাহারীর সাহচর্যে টিলার ওপর কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিতে হয়।
কাহারীর কাহিনীর সূত্রপাত নাটকীয়ভাবে। পাঁচদিনের কাহারীকে কোলে নিয়ে পাত্র খোলা চা বাগান থেকে যে সুভাষ একদা জুরিন চা বাগানে রমজান আলীর আনারস বাগান পাহারা দিতে চলে এসেছিলো সেই সুভাষ আসলে ওর প্রকৃত পিতা নয়। তাহলে তার বাবা মা কারা? সুভাষের মৃত্যু তাকে আত্মসত্তার অনুসন্ধানের পথে বের হতে ভেতর থেকে ধাক্কা দেয় —
“আনারস বাগানের ওপর ছোট্ট কুঁড়েঘর সুভাষ ওকে দিয়ে গেছে, দিয়ে গেছে আনারস বাগান পাহারা দেবার চাকরি, আর দিয়েছে একটা শব্দ। জানিয়ে দিয়েছে যে, ও বেজন্মা’’ (পৃ. ৩৭)।
যে প্রকৃতির সৌন্দর্য, পাহাড়ী ঝরনা, আনারসসের ফুল একদা তাকে পাগল করে তুলতো তা এখন পরাবাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়ে যায় —
“কাহারী আনারসের কচি ফুলের মালায় সৌন্দর্যের বদলে এখন ওর বাবার হৃৎপিণ্ড দেখতে পায়। সে হৃৎপিণ্ড খুবলে খাবার জন্যে ওর বুকে আকণ্ঠ পিপাসা।’’
আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে কাহারী সোনাইর মাঝে আশ্রয় নেয় কিন্তু ভালোবাসার কথাও এক সময় বৃশ্চিক দংশন হয়ে ওঠে। তখন পাত্র খোলা চা বাগানে সুভাষ-ঝুমুরির সম্পর্কের কথা মনে পড়ে। সুভাষ গল্পচ্ছলে বিঅিন্ন সময় ঝুমুরির সম্পর্কের কথা কাহারীর কাছে প্রকাশ করেছিলো। ঝুমুরি সুভাষের সঙ্গে প্রতারণা করে “একজনের প্রলোভনে পড়ে পেটে বাচ্চা’’ ধরেছিল। তারপর সেই সন্তান পদ্মপুকুর পাড়ে ফেলে দিয়েছিলো।
কাহারী বুঝে বিশাল প্রকৃতি ছাড়া তার কেউ নেই। তবু শাহরিয়ারকে ত্যাগ করতে চায় না ও। চুটিয়া ময়নার জীবন ধারণ নিরীক্ষণ করে ওর “মা অমন ব্যস্ত হয়ে বাসা বানানো ছাড়াই বাচ্চা ফুটিয়েছিলো’’ মা বাবা সুভাষ সোনাই সকলের ওপর ঘৃণা প্রবলতর হয়ে ওঠে। বিক্ষিপ্ত কাহারী শাহরিয়ারকে হাসিয়া পল্লীতে নোংগক্রেম নাচের উৎসবে নিয়ে যায়। পাহাড়ের পাদদেশে প্রকৃতির অপূর্বতায় মুগ্ধ হয়ে শাহরিয়ার গতজীবনের অনুশোচনা ভুলতে চায় —
“চারদিকে পাহাড়, মাঝখানে সমতল। পাখি ডাকছে অবিরাম। কাছাকাছি কোথাও ঝরনার জল পড়েছে। সে শব্দ ওকে আনমনা করে দেয়। নিজের ওপর মমতা হয় ওর। শামান্তাকে খুন করার পর কতদিন ভেবেছিলো নিজেকে শেষ করে দেবো, এই গ্লানির বোঝা রয়ে বেড়ানো কষ্ট। এখন ভাবছে, এ জীবনে এত কিছু দেখার আছে, কেন নিজেকে ধ্বংস করবে? কেন সব দেখে, সব জেনে নিজেকে পরিপূর্ণ করে তুলবে না’’ (পৃ. ৫৭)।
শাহরিয়ার আনারস কাটা কাজে নিযুক্ত হয়। অন্যদিকে সোনাই কাহারীকে অবলম্বন করে লাকতে চায়। কিন্তু কাহারীর অশান্ত অস্থির যন্ত্রণা তাকেও স্পর্শ করে, বিহবল করে তোলে —
“কাহারীর মতো আর কাউকে ভালো লাগে না, ওকে ওর সব কিছু উজাড় করে দিতে ইচ্ছ করে, ও না চাইলেও করে’’ (পৃ. ৬০)।
কাহীর কান্না তাকে সজল করে ফেলে ও কাহারীকে আশ্রয় দেয়। অথচ কাহারী ভাবে —
“সোনাই একটা কুত্তী হবে। বাচ্চা ফেলে চলে যাবে অনেক দূরে। সেখানে নতুন করে সংসার পাতবে। সেই সংসারে অনেক ছেলে মেয়ে হবে। তখন ও ভুলে যাবে পথের ধারে ফেলে দেখা প্রথম ছেলেটির কথা’’ (পৃ. ৬৩)।
এই বিশ্বাসহনিতা, সন্দেহ প্রবণতা যেন শাহরিয়ারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়ে যায়। সে সন্দোহবশত শামান্তাকে খুন করেছিলো অকপটে, তাই প্রকৃতির মাঝে নতুন জীবনবোধে উজ্জীবিত হলেও শামান্তাকে ভুলতে পারে না। তার এই উন্মুলিত অবস্থা যেন কাহারীর বেজন্মা হবার সমান্তরাল ঘটনায় পরিণত হয়। এ জন্যে একসময় কাহারি সোনাইর স্নিগ্ধ সম্পর্ক ওকে ঈর্ষাপারায়ণ করে তোলে। সে কাহারীর ছবি শেষ করার উৎসাহ হারায়।
কাহারী-সোনাই কাহিনীতে কানাই চরিত্রের সাক্ষাৎ লাভ করি। পাত্রখোলা লেকে জ্বরিনে এসে উন্মুলিত কানাই কাহারীর আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কানাই ঝুমুরীর নাম উচ্চারণ করলে এবং তার সঙ্গে সম্পর্কের কথা প্রকাশ করলে কাহারী নাটকীয়ভাবে তার জন্ম রহস্যের অজ্ঞাত তথ্য পেয়ে যায়। তহন নির্বিত্ত, নিমূল কাহারী বিভ্রান্ত কিন্তু জাগ্রত চেতনা শাণিত হয়ে ওঠে —
“সুভাষ মেয়েমানুষ এনে ঘর থেকে বের করে দিলে আমি ঘুমানোর জায়গা চাইনি; ঘরে কোনো দিন খাবার না থাকলে আমি খাবার চাইনি; কাপড় না ছেড়ে পর্যন্ত কাপড় কিনিনি। হাতে পয়সা না থাকলে আমি কারো কাছে চেয়ে বিড়ি খাইনি। একটা জিনিসই চেয়েছিলাম, তা ভালোবাসা এবং একটা জিনিসই মাথায় গেঁথে রেখেছি তা খুন। আমি একটা খুন করতে চাই’’ (পূ. ৮৫)।
কানাইকে কাহারী নির্মমআবে খুন করে তার পরিদিনই শাহরিয়ার জুরিন ত্যাগ করে; কারণ তার মনে হয় —
“শামান্তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ও পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। এই জীবনে ওর আর কি-ই বা চাইবার আছে’’। (পৃ. ৮৭)।
শ্রীমঙ্গল ষ্টেশনে বিশ বাইশ বছরের চটপটে তুচেকের সঙ্গে পরিচয় হয় শাহরিয়ারের। লুসাই পাহাড়ের পাদদেশে সাজেক ভ্যালিতে এক শীতের বিকেলে পদার্পণ করে সে। খ্রিষ্টান লুসাইদের গ্রামের চীফের আশ্রয়ের সে অতিথিরূপে আশ্রয় পায় তাদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে। সাজেক ভ্যালি সেলিনা হোসেনের পরিচিত পরিমণ্ডল, এ জন্যে সেহানকার জীবনযাত্রা প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূর্ব চিত্রগুলো উপন্যাসে আবেগের ঝরনা ধারা প্রবাহিত করেছে। কারর তাঁর স্বীকারোক্তি —
“সাজেক ভ্যালির বিস্তৃত কমলালেবুর বাগান হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাস পাঠের আনন্দ দিয়েছিলো। পাহাড়ের পাদদেশে ঘর বানিয়ে বাস করা মানুষগুলোর ঘর গেরাস্তি কত শিল্পিত তার নির্মাণ বুঝি আমাদের মতো শহুরে লোকের এক পুরুষে সম্ভব নয়’’ (স্বদেশে পরবাসী, পৃ. ১২)।
এই অপূর্ব পরিবেশে একজন শিল্পী নিজেকে খুঁজে পায়। অতীতের গ্লানি মুছে যায় মানুষের সহজ সুন্দর হৃদ্যতায়। শাহরিয়ার যে নবজন্মের প্রত্যাশা করেছিলো তা যেনো এই সাজেক ভ্যালিতে এসে পূরণ হয়। তার শিল্পিসত্তার উন্মোচনও একই সঙ্গে উপন্যাসের মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। কমলালেবুর বাগানে রুহিনাকে দেখে তার জীবন পিপাসা উদ্বেলিত হয়।
বাল্যে পিতৃমাতৃহীন নানীর হাতে মানুষ শাহরিয়ার যৌবনে শামান্তাকে খুন করেছে। শাহরিয়ারের গন্তব্যহীন জীবন যেনো নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। সাজেক ভ্যালিতে রুহিনাকে বিয়ে করে স্থির হয়। অথচ রুহিনার মৃত্যু তাকে আবার পথে নামায়। এরই মধ্যে হারাধনের কাহিনী পর্বে নাসির ও শাহরিয়ার গোমতীতে মাছ ধরার সময় হারাধন বুড়োর গলিত লাশ দেখতে পায়। একই সঙ্গে নমিতারও। ঔপন্যাসিক এই অংশটি অতি সংক্ষেপে ইজিগতে বর্ণনা করেছেন। শাহরিয়ার যে অপরাধবোধ লালন করে ছিন্নমূল হয়ে ক্রমাগত পরিক্রমণ করেছিলো, তার যেনো সমাপ্তি এসে গেছে। মানুষের নিষ্ঠুরতা-সহৃদয়তা-হিংসা-ক্রোধ সবই সে দেখেছে। অপরাধী শাহরিয়ারের প্রেক্ষণে যেনো ঔপন্যাসিক বাংলাদেশের সমগ্র অবস্থাকে ধরতে চেয়েছেন। [ক্রমশ]