ঘোষেদের বাড়িতে অনেকদিন ধরেই আলাপ আলোচনা, জল্পনা কল্পনা। এবারে গরমের ছুটিতে উটকামন্ড না কালিম্পং? সুন্দরী মটকা মেরে খাটের নিচে পড়ে থাকে, তবে কান খাড়া থাকে এদের আলোচনায়। শুনতে শুনতে দু-একটা মশাও মারে। খাটের নিচটায় খুব মশা। পারুলটা খুব ফাঁকিবাজ হয়েছে। ভালো করে ঝাঁটও দেয়না আজকাল! যত মশার আড্ডা এখানে।
মশা থাকলেও এই গরমে এদের একতলা ঘরের খাটের নিচটাতেই সবচেয়ে আরাম।এই গরমে কে আর রোদে রোদে ঘুরে পাড়া বেড়ায়? এপাশ আর ওপাশে গড়িয়ে খালি ল্যাদ আর ল্যাদ ।
তবে এরা পারেও বটে। এই গরমে আলমারি থেকে টেনে টেনে সোয়েটার, টুপি, মোজা সব বা’র করছে! মেয়েটাতো একবার লম্বা একটা কোট পরে আয়নার সামনে ঘুরেফিরে দেখেও নিল। শখ বলিহারি।
ঠান্ডা খেতে এরা উটকামন্ড বা কালিম্পং যে কোনো একটা বিদঘুটে নামের জায়গায় যাক না কেন? সে তো এরা প্রতিবছর যায়। তবে এবছরের ঘোষেদের ঠান্ডা খেতে যাওয়ার কথা শুনে সুন্দরীর চক্ষু চড়কগাছ। ঘোষের ছেলে রিন্টু বায়না ধরেছে এবার ঠাকুমাও যাবে আমাদের সঙ্গে। তার মানে বাড়ি তালাবন্ধ থাকবে? কি খারাপ প্ল্যান এদের! আমি কোথায় যাব?
আগে ছেলে-বৌ-নাতি-নাতনি কোথাও গেলে বুড়ি ঠাকমা বাড়ি পাহারা দিত। সে পাহারার ওপরে রাতে পাহারাদারী করত পারুল। ঘোষবাড়ির কুড়ি বছরের পুরনো ঝি।
সেসময়টায় সুন্দরীর সামান্য একটু খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে হত। কারণ ঘোষ বাড়িতে তখন কোনো আঁশগন্ধ নেই। সুন্দরী সারাবাড়ি শুঁকে শুঁকে একটা মাছের কাঁটা অবধি খুঁজে পেত না। মনের দুঃখে দু-একটা টিকটিকি খেয়ে সধবার নিয়মরক্ষা করত।
ঠাকুমা অবশ্য তখন দুধের সাগরে ভাসত। একার সংসারে দুধের ভাগে কোনো টানাটানি নেই। সকালে বুড়ি ঘন দুধের চা খায়। জলখাবারে ছানা। দুপুরে দইভাত। রাতে খই-দুধ। এর মাঝে ইচ্ছে হলে বড় এক জামবাটি দুধ চুমুক দিয়ে নিঃশেষ করে। এই দুগ্ধপ্রীতির কারণেই নাকি ঠাকুমার ডাক নাম দুধু। নাতি নাতনি ঠাট্টা করে বলে, “তোমার বাবা মা আর নাম পেলো না ঠাম্মা।”
বুড়ি কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “চুপ কর তো ডেঁপো ছেলেপিলে। আমি গয়লাদের মেয়ে। ও নাম আমায় দিব্যি মানিয়ে যায়। আমার মত দুধ খেয়ে হজম করে তোরা দেখা দিকিনি!”
বাড়িতে সেই দুধবন্যার সময় সুন্দরীর অবশ্য কপাল খুলত। মাছ না পাওয়ার দুঃখ অনেকটা তার লাঘব হত। ঠাকমা সকাল বিকেল দু-বাটি ঘন দুধ সুন্দরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলত, “খা রে সুন্দরী”। সুন্দরী দুধ খেয়ে সামনের পা দিয়ে গোঁফ মুছতে মুছতে ভাবত, এও মন্দ কি! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুধখাওয়া ঢলঢলে মুখখানা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যেত। সুন্দরী নাম এবার আমার সার্থক!
শেষপর্যন্ত এবারের গরমে ঘোষেরা সপরিবারে কালিম্পঙে চলেই গেল। তারপর থেকেই সুন্দরীর হাড়হাভাতে দশা। দুধ মাছ তো দূরের কথা গরমে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে তার অমন নধর চেহারাখানা অর্ধেক হয়ে গেছে। সাদা লোমে কালি পড়ে গেছে। ঘোষেদের বাড়ির দরজা বন্ধ। রোজ সকালে তাদের তালাবন্ধ দরজার সামনে সুন্দরী একবার করে চক্কর কেটে আসে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “গরমের দুপুরে এদের লাল ঠান্ডা মেঝেতে গুটলি পাকিয়ে আরামের ঘুম আমার আর এবার হল না। অন্য কোথায় যাব? এই গরমে লোকজনের মেজাজ এমনিতেই যা আগুন হয়ে আছে! কোনো ভরসা নেই। নতুন কোনো বাড়িতে ঢুকলে দুদ্দাড়িয়ে তারা তাড়িয়ে দেবে।”
মাঠের পূবকোনে মেহগনি গাছের ছায়ায় বসে অর্ধনিমীলিতচোখে সুন্দরী এইসব কথা ভাবছিল। লম্বায় গাছটা পাশের ছ’তলা ফ্ল্যাটবাড়ির সমান সমান হবে। ডালে ডালে পাতায় পাতায় গাছটা বেশ ঝাঁকড়া হয়ে আছে। সকালবেলা ওখানে পাখিদের চেঁচামেচির চোটে ঘুম ভেঙে যায় সুন্দরীর।
“আচ্ছা, ঐ গাছটা বেয়ে ওপরে উঠলে হয় না? পাতার ছায়ায় ছায়ায় বসে বেশ হাওয়া খাওয়া যাবে। পাতার আড়ালে থেকে দু-একটা টিকটিকি, পাখিটাখিও ধরা যেতে পারে তো! গাছ বাওয়ার অভ্যেস অবশ্য অনেককাল নেই। তাতে কি! পাঁচিল বেয়ে তো দোতলা-তিনতলায় আরামসে উঠে যাই। এটাও পারব।”
গুটিগুটি পায়ে মেহগনির শক্ত ডাল বেয়ে দিব্যি ওপরে উঠে গেল সুন্দরী।
“আহ্ কি সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে এখানে। কি খোলামেলা। পাতাগুলো যেন ছাতা হয়ে রোদ্দুরকে আড়াল করে আছে। ওদের নরম আঙুলে বিলি কাটছে আমার পিঠে।
আরে, ঐ ডালের কুষ্কুন্ডি কাকটা আবার আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে ক ক করে চেঁচাচ্ছে কেন? অ, বুঝেছি সংসার পেতেছেন ওরা ওখানে। তাহলে তো আর খাবার অভাব হবেনা। এক একদিন এক একটা ছানা!”
এতকিছু পেয়েও কোথাও যেন বিষাদ ছেয়ে গেল সুন্দরীর মনে। খানিক ঈর্ষাও। তার এমন সংসার আর কোনোদিন হল না। গতবছর চারটে বাচ্ছা বিইয়েছিল সুন্দরী। ঐ ঘোষেদের বাড়ির সিঁড়ির নিচে। তিনটে মেনি আর একটা হুলো। ঘোষের ছেলেমেয়ে দয়া করে সেখানে চটের বিছানা পেতে দিয়েছিল।
সুন্দরীর দীর্ঘশ্বাস পড়ল, “না ছিল আমার এমন সুন্দর নিজস্ব বাসা। না ঐরকম কাকবাবার মত কেয়ারিং বর। সে খালি ফূর্তি করেই খালাস। উল্টে তক্কে তক্কে ছিল কখন আমার একমাত্র ছেলেটাকে মেরে দেবে। একদিন আমি একটু পাড়া বেড়াতে গেছি, অমনি সঙ্গে সঙ্গে …. যাক সেসব কথা মনে করে আর লাভ কি! মেয়েগুলোও একটু লায়েক হতেই কোথায় ঘুরছে, লাইন মারছে কে জানে। যা খুশি করুক গে। আমার চোখের সামনে এই কালো কুচ্ছিত কাকগুলোর সংসার আমি আর দেখতে পারছি না। দাঁড়া না, তোদের সাধের সংসার সব ঘুচিয়ে দেব।”
এইসব ভাবতে ভাবতে যেই না গাছের ডালে সুন্দরী একটু লম্বা হয়েছে,অমনি নিচে চায়ের দোকানের লাল্টুটা চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
— আরে দেখে যাও গো বেড়ালটা কোথায় চড়েছে! ওমা ওতো ওখান থেকে পড়ে গেলে মরে যাবে! দেখবি আয় কাজু, বকাই।
— কোথায় কোথায় গো!
— ঐ তো মগডালের একটু নিচে। দেখতে পাচ্ছিস না?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখেছি। ঐ তো ল্যাজ নাড়ছে।
সকালে চতুরঙ্গ ফ্ল্যাটের নিচে সবজিপাতি সাজিয়ে বসে চুঁচড়োর মাসি। সে পিক টাইমে তার খদ্দের ফেলে সুন্দরীকে দেখতে দৌড়ে এল।
বলাইজ্যাঠা সদ্য সদ্য ছানি কাটিয়েছে। তার চোখে কালো চশমা। সে বেচারি বিশেষ ঠাওর করতে পারল না।
সুন্দরী ভাবল, “ঢং, চাওয়ালা লাল্টুটা কখনো একটা বিস্কুট আমাকে দেয় না। উল্টে দোকানের পাশে ঘুরঘুর করলে গায়ে গরম জল ছুঁড়ে ভাগায়। এখন এত দরদ কিসের!”
মোড়ের মাথায় ভোটের গরমাগরম সভা চলছিল। বেশ ভীড়। কে এক জনদরদী নেতা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। দেখতে দেখতে সেই সভা ফাঁকা। বৃক্ষারোহী বিরোধী বেড়াল বেশি ভীড় টেনে নিল। পাড়ার কাউন্সিলর দলবল নিয়ে এসে গাছতলায় দাঁড়িয়ে বললেন, এর একটা বিহিত করা দরকার। দলের সবাই মাথা নেড়ে বলল, সত্যিই তো বেড়ালটা ঐভাবে বেঘোরে মারা যাবে, এমন তো হয় না। কাউন্সিলর তাঁর খাস চেলাকে বললেন, সমীর দমকলের নম্বর লাগা।
সমীর ফোন করার দশ মিনিটের মধ্যে টুং টুং ঘন্টা বাজিয়ে দমকল হাজির। মাথায় টুপি পরা দমকলকর্মীরা জলকামান হাঁকালো। সে দৃশ্য দেখতে গরম ভুলে গোটা পাড়া একজোট। ফোয়ারার জলে হৈ হৈ করে স্নান সেরে নিল ঘেমো গায়ের মাঠের গোটা ফুটবল টিম।
সুন্দরী ভাবল পাড়ার লোককে এমন ঐক্যবদ্ধ হতে আগে তো কখনো দেখিনি। এরা তো কথায় কথায় ঝগড়া করে। ফ্ল্যাটের দোতলা থেকে দু-ফোঁটা জল গায়ে পড়ল কি না পড়ল ঢ্যাঙা মানিক বাপ-মা তুলে গালাগালি দেয়।
সুন্দরী ম্যাও ম্যাও করে খানিক ব্যঙ্গ করল এদের। ঝিকুর মা বলল, ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে। কেমন ডাকছে দেখেছ। সুন্দরী সেকথা শুনে আরো দু’বার মিয়াও মিয়াও করল। বেড়ালী ভাষায় তার অর্থ, “ঢঙ!”
এরই মধ্যে পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির সদস্যরা মাথায় সাদা টুপি হাতে ব্যানার নিয়ে গাছের তলায় জড়ো হয়েছে। ব্যানারে লেখা নানা শ্লোগান। ‘এ পৃথিবীতে আমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে’, ‘আমরা কি বিলুপ্তির পথে চলেছি!’ একজন ভুল করে পথকুকুরের জন্যে লেখা ব্যানার নিয়ে চলে এসেছে। তাতে লেখা আছে, “তোমরা আমায় ভালোবাসা দাও। আমি তোমাদের সুরক্ষা দেব”। একটা ব্যানারে এরই মধ্যে একটা ছবি আঁকা হয়ে গেছে। গাছের ওপরে বেড়াল। তলায় লেখা, ‘আমাকে বাঁচাও’।
এইসব নাটক দেখে সুন্দরী গাছের ডালে বসে মজা লোটে আর হ্যা হ্যা করে হাসে, “আরিব্বাস্ রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলাম আমি!
মোটর সাইকেলে দিনপ্রতিদিন চ্যানেলের রিপোর্টার এসেও পৌঁছে গেছে। সঙ্গে ফোটোগ্রাফার। সে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে গাছে চড়া সুন্দরীর ছবি নিতে চেষ্টা করছে। সাংবাদিকটি কাউন্সিলারের বাইট নিল, “আপনি আপনার মহল্লার রাস্তার কুকুর বেড়ালের যত্নের ব্যাপারে কি কি পরিকল্পনা নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো প্রোজেক্ট আছে কি?” কাউন্সিলর স্মার্টলি জবাব দিতে চেষ্টা করছেন, “এবার থেকে আমরা পথকুকুর, বেড়ালের রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থা নেব। আমাদের পৌরপ্রধানের সঙ্গে খুব শিগগিরই একটি বিশেষ মিটিং ডাকছি। এদের জন্যে আলাদা ফান্ডিং করতে হবে”।
পাড়ার লোকেদের গুলতানির আর শেষ নেই। বেড়াল নামাতে গাছ না কাটতে হয়! নিমাই দাদু এপাড়ায় অনেকদিন আছেন। তিনি বললেন এটা মেহগনি, এটা কি আজকের গাছ? এর কত দাম জানিস? একটা বেড়ালের জন্যে এই গাছ কাটা হবে! ও যেমন উঠেছে, ঠিক নেমে আসবে। যত সব সার্কাস!”
মেহগনি গাছে চড়া সুন্দরীও ঠিক এই কথাই ভাবছিল। সে অতি উচ্চ-বংশের। মজন্তালি সরকারের বংশধর! তার ভাবনাচিন্তা, দূরদর্শিতা সাধারণ মানুষের বোঝার কম্মো নয়।
সব নাটক যথারীতি একসময় থেমে গেল। গরমে ক্লান্ত মানুষজন ধীরে ধীরে ধৈর্য হারালো। ঘোষেরাও দুদিন পরে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে কালিম্পং থেকে ফিরে এল। গাছের ডাল থেকে সুন্দরী সব লক্ষ্য করছিল। গুটি গুটি পায়ে গাছ থেকে নামতে নামতে ভাবল, আর কোথায়ই বা যাব? ঘোষেরা ছাড়া আমার কি অন্য গতি আছে? খেতেপরতে দেয়। আমাকে তাড়ায় না। তা, মাঝেমধ্যে ওদেরও তো একটু হাওয়াবদল করতে হবে! ওদের ওপর অভিমান করে বিশেষ লাভ হবে না।
ঘোষেরা দরজার তালা খুলতে না খুলতেই সুন্দরী তাদের পায়ে পায়ে লেজ নাড়তে নাড়তে ওদের সঙ্গে ঘরে ঢুকল। ঘোষগিন্নী বলল, ওমা সুন্দরী যে! এতদিন কোথায় ছিলিস রে! এত রোগা হয়ে গেছিস কেন? খেতে পাস নি বুঝি!