১৮৬৩ সাল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন বারো। তাঁর উপনয়নের কিছু আগের ঘটনা। কিশোর রবীন্দ্র এই প্রথম মুখোমুখী হলেন ক্যামেরার। না, তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ আর সত্যপ্রসাদ। এই তিনজনের গ্রুপ ফটো। কে ধরেছিলেন ক্যামেরা, তা জানা যায় না। তখন কলকাতায় বোর্ন অ্যাণ্ড শেফার্ড আর এস.সি.সেনের স্টুডিয়ো ছিল। তাঁদের কেউ হয়তো তুলেছিলেন ফটো। তরুণ ও যুবক রবীন্দ্রনাথের ফটো খুব বেশি নেই। তাঁর ফটোর প্রাচুর্য দেখা গেল ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে।
রবীন্দ্রনাথের ফটোর আর্কাইভ আছে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে। এই আর্কাইভ গড়ে উঠেছিল কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের উদ্যোগে। ১৯৫০ সালে। এতে আছে রবীন্দ্রনাথের ১৬,৯৪৩টি ফটো। আছে ১০২টি ছবির অ্যালবাম। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ৫টি মহাদেশের ৩০টি দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময়ে বহু বিদেশি ফটোগ্রাফার তাঁর ছবি তোলেন। এই বিদেশি ফটোগ্রাফারদের মধ্যে দু-একজনের কথা আমরা আলোচনা করব।
জার্মানিতে জন্ম এমন এক ব্রিটিশ ফটোগ্রাফারের নাম ই. ও. হোপ্পে (১৮৭৮-১৯৭২)। জার্মানির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। মিউনিখ, প্যারিস, ভিয়েনার নামকরা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। বছর দশেক কাজও করেছেন ব্যাঙ্কে। তারপরে চলে আসেন লণ্ডনে। বিয়ে করেন বন্ধুর বোনকে। এই লণ্ডনে শুরু হয় ফটোগ্রাফিচর্চা। হেনরি জেমস, রুডইয়ার্ড কিপলিং, জন ম্যাশফিল্ড, আনা পাভলোভা, ভায়োলেট হান্ট, উইলিয়াম নিকলসন, আলবার্ট আইনস্টাইন, বেনিটো মুসোলিনি, রবার্ট ফ্রস্ট, আলডাস হাক্সলি, বার্নাড শ এর ছবি তুলেছিলেন হোপ্পে।
তিনি ভারতে আসেন ১৯২৯ সালে। তখন ফটোগ্রাফার হিসেবে তাঁর নামডাক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, অসিত হালদার, অমিয় চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী এবং শান্তিনিকেতন আশ্রমের ছাত্র-ছাত্রীদের বহু ছবি তুলেছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক বিদ্যালয়ের ছবিগুলি একত্রিত করে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘আ পোয়েট’স স্কুল : রবীন্দ্রনাথ টেগোর’স শান্তিনিকেতন’। এডওয়ার্ড কার্টিস আমারিকার বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। নেটিভ আমেরিকানদের যে সব ছবি তিনি তুলেছিলেন সেগুলি বহু আলোচিত। নোবেল পুরস্কার পাবার পর রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা গেলে কার্টিস সিয়াটেলে তাঁর স্টুডিয়োয় রবীন্দ্রনাথের এক চমৎকার ছবি তোলেন। সেই ছবিতে রবীন্দ্রনাথ কালো কালিতে তাঁর নাম সই করে দিয়েছিলেন। সুইশ ফটোগ্রাফার রেমণ্ড বার্নিয়ার চিন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান ও আমেরিকা ঘুরে ১৯৩৮ সালে ভারতে এসেছিলেন। ভারতের মন্দির স্থাপত্যের অনবদ্য ছবি তুলেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের কয়েকটি ছবি তোলেন তিনি ও তাঁর বন্ধু ফরাসি ফটোগ্রাফার অ্যালেন ড্যানিলিউ। আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে মিরালরিওতে কাটিয়েছিলেন দু’মাস। প্লাতা নদীর তীরে মিরালরিওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। কবির এই নিভৃত যাপনের বেশ কয়েকটি ফটো আছে। ওকাম্পো হয়তো ফটোগ্রাফার ভাড়া করে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁর নামের সন্ধান আমরা পাই নি।
রবীন্দ্রনাথের রঙিন ছবি সর্বপ্রথম তোলেন ফরাসিদেশের আর্লবার্ট কান। আলবার্ট কান (১৮৬৯-১৯৪২) এক বিচিত্র মানুষ। ১৯০৮ সালে তিনি তাঁর এক সঙ্গীকে নিয়ে বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন। তখন তাঁর মাথায় আসে এই সব ছবি নিয়ে ফ্রান্সে একটি ‘আর্কাইভস অব দ্য প্ল্যানেট’ তৈরি করার কথা। এ ব্যাপারে ছবি সংগ্রহের জন্য রজার ডুমা, পল ক্যাস্টেলানু, অগাস্টি লিয়ন, স্টিফেন পাশেট, লুসিয়েন লি সেন্ট প্রভৃতি ফটোগ্রাফারদের উৎসাহিত করে তোলেন। এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কারপ্রাপক রবীন্দ্রনাথের ছবি তোলার কথাও ভাবতে থাকেন তিনি। ১৯২১ ও ১৯৩০ সালে দুবার তিনি রবীন্দ্রনাথকে বাগানবাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর সাদা ও গোলাপি ফুলে ভরা সবুজ বাগানে আলখাল্লা পরিহিত রবীন্দ্রনাথের ছবিটি আসাধারণ সুন্দর।