এগার.
শ্যামলী খাস্তগীরের রান্নাতেও টকের প্রাধান্য দেখেছি। ভারতবর্ষের সকল প্রান্তের খাদ্যই তার কাছে আদরণীয় ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় বহু রান্নাও সে করত, যাতে টকের প্রাধান্য। আমি সে সব খাবারের রসিক ছিলাম না বলে ওর বাড়িতে সাহেবদের দাওয়াতের ডাক থাকলে নানা ছুতোতে পালাতে হতো আমাকে। সাহেবরা দেখেছি। ঢের নির্বিকার। আসলে বোধ হয় বেজায় ভদ্র, না হয় টকটক রান্নার দিকে তাদেরও আকর্ষণ ছিল। শ্যামলী ইডলি রাধত, রাজমাও।
মানুষের অভ্যাস তার রুচিকে যে কী রকম বদলে দিতে পারে, দেখেছি অশোকবিজয় রাহার মধ্যে। উনি ছিলেন বেজায় আবেগপ্রবণ মানুষ, বলেছি আগে। আমার কবিতার ভাব আর আঙ্গিকের পরস্পর সম্বন্ধ’ নিয়ে উচ্ছ্বাসবশে কত কী যে বলেছিলেন। সেই অশোকদাই কিনা বিসর্জন কাব্যনাট্যটি নিয়ে বলেছিলেন, ‘ওতে কী রকম একটা পাঁঠা পাঁঠা গন্ধ’! জয়সিংহের আত্মদানের ঘটনাটি যে কতটা ভাববিহ্বল–সে কথা মোটে মানলেন না! বলিপ্রথা ওঁর কাছে এত স্বাভাবিক আর পাঁঠা খাওয়ার ব্যাপারটি এত সহজ যে আমাদের কথা মানলেন না কিছুতেই।
অথচ এই কবিটিই কী আন্তরিকভাবে লিখেছিলেন, ‘চমকে উঠি–আরে! আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে! যা নিয়ে ছেলেরা ওঁর পেছনে লাগত। শৈলেশ্বর বাগ নামের এক শিক্ষার্থী তাঁর কাছে গিয়ে বলেছিল, অশোকদা, আমি একটা কবিতা লিখেছি— ‘অশোকবিজয় রাহা/আ — হা!’ বাস্তবিক ওই কবিতার লক্ষ ছিল তার আসল স্বভাব! অশোকদাও অবশ্য তাকে ছেড়ে দেননি। একদিন পথের মধ্যে ডেকে বললেন, ‘শোনো হে, আমিও একখান কবিতা লিখেছি। সেটা হলো— ‘শৈলেশ্বর বাগ/ভাগ’।
গুরু-শিষ্যের মধ্যে এমন অনেক কাণ্ড চলত শান্তিনিকেতনে। যেমন বালক প্রমথনাথ বিশী একদিন মাস্টার মশাইকে সতর্ক করে বলতে গেলেন–আশ্রমে কিন্তু মারধর করবার নিয়ম নেই। মাস্টার মশাই তখন তাঁকে কান ধরে আশ্রমের মাটি থেকে উঠিয়ে আর একবার শাসন করে আশ্রমের মাটিতে নামিয়ে দিলেন। আর একটা গল্প শুনেছি, শিল্পী মুকুল দের কন্যা মঞ্জরী একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখে চিরকুমারী খিটখিটে স্বভাবের নলিনীদি মেয়েদের একে একে দাঁড় করিয়ে প্রতিজ্ঞা করাচ্ছেন, ‘আমি জীবনে কখনো বিবাহ করিব না।’ মঞ্জরীর পালা এলে ও উঠে দাঁড়িয়ে গড়গড় করে বলল, ‘আমি জীবনে সুযোগ পাওয়ামাত্র বিবাহ করিব’।
বারো.
বাংলাদেশে সবাই আমাকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী আর ছায়ানটের শিক্ষক-সংগঠক বলে খুব জানলেও শান্তিনিকেতনে অদ্ভুত সব পরিস্থিতিতে পড়তে হতো আমাকে। গবেষণা করতে গিয়েছি রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ নিয়ে। শুনে সুরজিৎ সিংহ বললেন, ‘আপনি কি গান জানেন?’ শুনে হতবাক হয়ে থাকলাম। সামলে নিয়ে বললাম, তা জানি। ততক্ষণে উপাচার্যের বাড়ির ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা সিংহ বেরিয়ে এসে আমার নাম শুনেই বললেন, ‘ও, আপনি তো গান করেন’! তখন মনে একটু বল-ভরসা এল!
আর একবার উপাচার্য অম্লান দত্তের বাসায় গিয়ে পরিচয় হলো লন্ডনপ্রবাসী এক দম্পতির সঙ্গে। ওঁরা উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার ছাত্র ইকবালের গানের কথা বলছেন। ইকবালের স্ত্রী সাকীর নজরুলগীতির কথাও বলছেন। আমি মহা খুশি হয়ে বললাম ইকবাল আমার প্রিয় ছাত্র। অমনি তাদের উচ্ছ্বাস থেমে গেল। সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন দুজনে। বললাম ওরা তো দুজনেই ছায়ানটের ছাত্রছাত্রী। হ্যাঁ, ছায়ানটেই তো গান শিখেছে ওরা। অর্থাৎ তাতে কি বোঝায় যে আমি ছায়ানটের শিক্ষক হতে পারি! বললাম, আমি ছায়ানটের অধ্যক্ষ। তাতে সন্দেহ বেড়ে গেল আরও। আসলে দোষ তো আমার পোশাক-আশাকের! যে রকম সাদাসিধে হয়ে চলি তাতে কে ভাববে যে আমি নামী শিক্ষক হতে পারি! মানুষকে ইমপ্রেস করতে হলে তেমন শাড়ি-জামা পরতে হবে না? একে তো চেহারাটাই আনইমপ্রেসিভ। তো এই ছিল আমার দশা! [ক্রমশ]