নয়.
শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর ব্যবস্থায় বাসা না পেলে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করা কঠিন হতো। প্রসেনজিৎ সিংহ একবার, আর, আরেকবার শ্যামলী খাস্তগীর আমাকে বাড়িতে রেখে কাজ করবার সুযোগ করে দিয়েছিল। শ্যামলীর বাবা সুধীর খাস্তগীরের ‘পলাশ’ বাড়িতে দীর্ঘকাল ছিলাম একবার। দোতলাতে বাথরুমসুদ্ধ একটা বড়সড় কামরাতে দিব্যি আরামে থাকতাম। লেখার কাজে অখণ্ড মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল। আর গানের চর্চার পরিবেশও ছিল দারুণ। প্রত্যেক সন্ধ্যায় গানের মজলিশ বসত।
শ্যামলীর বাড়ির কোনাকুনি লাগোয়া একতলা বাড়িতে থাকতেন পণ্ডিত সুখময় ভট্টাচার্য। একবার শঙ্খ ঘোষ শান্তিনিকেতনে ওঁর সঙ্গে কী কাজে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমি সঙ্গ ধরলাম, পণ্ডিত মশাইয়ের বাড়ি যাব ওঁর সঙ্গে। কী রকম সংস্কার আছে না আছে জানা নেই। চললাম ভয়ে ভয়ে।
আমি শ্যামলীর বাড়ির দোতলায় থাকি শুনে সুখময় বাবু একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। রোজ ভোরে সীমানা বেড়ার গাছ থেকে পূজার জন্যে বনটগর তুলতে গিয়ে আমার গলা সাধার সুর শোনেন উনি। সে নাকি ভারি মধুর! গানের কথা তো আর থামাতে পারেন না! কবে দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া কী গান শুনেছিলেন, আবার শুনবার সাধ। ভালোমতো জানা না থাকলেও গাইতে হলো। যদিও উনি গানের সঙ্গে সঙ্গে অনর্গল স্মৃতিচারণা করে চললেন।
কথায় কথায় শুনলাম, পণ্ডিত মশাই নিজ সংসারের কাজ নিজে হাতে করেন। গরুর যাবতীয় সেবা তো বটেই, স্ত্রীর সন্তান প্রসবের সব কাজ পর্যন্ত নিজে করেছেন। সিলেটে পারিবারিক টোলের শিক্ষাদীক্ষা কেমন কঠিন ছিল, শুনেছি তখন। পাঁচ বছরের শিশুকেই সংস্কৃত ভাষায় সংস্কৃত শ্লোকের পাদপূরণ করতে হতো। অর্থাৎ পাঁচ বছর বয়সেই সংস্কৃত ছন্দ মেলাতে হতো। তাহলে ভাষার পাঠ তো তার অনেক আগেই আয়ত্ত করতে হয়েছে!
আমি সেই সময়ে জন স্টুয়ার্ট মিলের জীবনবৃত্ত নামে একটি বই পড়ছিলাম। তাতে তিন বছর বয়সেই স্টুয়ার্ট মিল গ্রিক ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন পড়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল। বুঝে নিলাম সেকালের সংস্কৃত টোলের শিক্ষাও ওই রকমের আয়াসসাধ্য ছিল।
হোস্টেলে কার ঘরে যেন রেডিও
হোস্টেলে কার ঘরে যেন রেডিও বাজত। বসন্তের শুরুতে রাগসংগীতের সুরে মনকে বড় ব্যাকুল করত। কখনো হয়তো রবীন্দ্রসংগীতই শোনা যেত ‘মন যে বলে, চিনি চিনি যে — গন্ধ বয় এই সমীরে/ কে ওরে কয় বিদেশিনী চৈত্ররাতের চামেলিরে’। গানটা জানা না থাকলে একেবারে পাগল পাগল দশা হতো। হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মশাইয়ের মেয়ে পূরবীদিকে পাকড়াও করে গানটা শিখে নিস্তার মিলত। পূরবীদির গান ভালোবাসতাম, জানতেন বলে আমাকে গান শোনাতেন — শেখাতেন খুশি হয়ে। বিয়ের পরে কলকাতায় বাস করতে গিয়ে পূরবীদির গান ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেল। শরীরটাও কেমন ভেঙে পড়ল। হীরেন দত্ত মশাইয়ের থ্রি কমরেডস — এর অনুবাদ তিন সঙ্গী আমাদের খুব প্রিয় বই ছিল সে সময়ে।
‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে/ আমার মনে’ গানটি আমি পূরবীদির গলায় কতবার যে শুনেছি, তার হিসাব নেই। বাউল সুরের গানখানিতে শ্রুতির ব্যবহার যে তিনি কী দক্ষতার সঙ্গে করতেন, কী বলব! ও গান আয়ত্ত করবার চেষ্টাও আমি করিনি। বারবার শুনে শুনে আঁজলা ভরে বুকের ভেতর ভরে নিয়েছি। এমএ পড়বার দিনগুলোতে পূরবীদি ছিলেন আমার আদর্শ গায়িকা।
‘ধ্বনি থেকে কবিতা নিয়ে কাজ করবার সময়ে অনেক দিন আমি শ্যামলীর দোতলাতে ছিলাম। লেখা নিয়ে আলোচনাতে ওর দারুণ আগ্রহ ছিল। শিবনারায়ণ রায় ওর বাড়ির কাছাকাছি একটা বাড়িতে থাকতেন। একদিন ঢাকার শিখা গোষ্ঠীর লেখার কথা বলতে গিয়ে উনি ‘নাস্তিকের ধর্ম’ নামের এক প্রবন্ধ নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বললেন, এ লেখার লেখকের কথা কেউ আলোচনা করে না। ইনি নাকি তাঁরই আবিষ্কার। লেখকের নাম জিজ্ঞেস করে শুনেই শ্যামলী আমার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। আমি তো প্রবন্ধের নাম শুনেই বুঝে গেছি উনি কার লেখার কথা বলছেন। উঠে যাবার সময়ে শ্যামলী তাকে বলল, আপনি যার কথা বলছেন তিনি মিনুদির বাবা। উনি থতমত খেয়ে গেলেন। তাঁর ‘আবিষ্কার’ অন্যদের পরিচিত এমনকি স্বয়ং ‘পিতা’ শুনে ওই দশা হলো।
শ্যামলীর স্বভাব ছিল শান্তিনিকেতনে কাজ করতে আসা বিদেশিদের দিকে নজর রাখা — কার কী অসুবিধা হচ্ছে। জার্মান গবেষক মার্টিন ক্যাম্পশেনের দিকে ওর নজর ছিল। এই ভদ্রলোককে আমার একটু কড়া মেজাজের বলে মনে হতো। একদিন কে যেন আমাকে গান গাইতে অনুরোধ করেছিল। মনে পড়ছে না। লিখবার কাজে ব্যস্ত থাকলে আমি অন্যদিকে মন দিতে পারি না। কথাটা শুনে মার্টিন ক্যাম্পশেন বাঁকাভাবে কিছু বললেন। আমি বিরক্ত হয়ে ‘তোমরা যা বলো তাই বলল, আমার লাগে না মনে’ গানখানি ধরলাম। এ গানের সুর আমাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। বাউল সুরের শ্রুতির কাজভরা গানটিতে আমি ভেসে গেলাম। তখন মার্টিন ক্যাম্পশেন মাথা নেড়ে নেড়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে লাগলেন। গান শেষ করে কারও দিকে না চেয়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বিরূপ ভাবটি সুরের ধারা দিয়ে ধুয়ে দিয়েছি বলে মনটা ভালো লাগল।
এমএ পড়বার সময়ে শান্তিনিকেতনে আমার লোকাল গার্জিয়ান হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। বাবার বন্ধু। আমাকে হোস্টেলে তুলে দিয়ে মা অন্নদাশঙ্করের বাড়িতে রাত্রি যাপন করলেন। প্রত্যেক বিকেলে অন্নদাশঙ্কর-লীলা রায়ের বাসায় আমার চায়ের দাওয়াত ছিল। কিন্তু বিদেশি ছাত্ররা আসত আর ইংরেজিতে বাতচিত হতো বলে কিছুদিনের ভেতরেই চম্পট দিলাম। ওঁরা ভাবতেন আমার খবরাখবর জানবার জন্যে বিকেলের সমাবেশটা ভালো ছিল। কিন্তু সহজ হতে পারলাম না কিছুতেই। ওঁদের মেয়ে জয়াকে খুব ভালো লাগত। ব্যবহার ছিল ভারি সহজ।
আমি শান্তিনিকেতনে যাবার বছরখানেকের মধ্যেই নাজিক নামে এক ইজিপশিয়ান এসে উঠল আমারই ব্লকে। এইবার ইংরেজি বলা থেকে পালানো গেল না আর। আর দেখলাম, ইংরেজিতে কথা বলা তেমন অসুবিধাজনক নয়। নাজিককে নিয়ে সারা শান্তিনিকেতনে চোখ টেপাটিপি! ও দাড়ি শেভ করে নিয়মিত। প্রশ্ন করে জানলাম, ওদের দেশে মেয়েদের দাড়ি গজানোটা বিশেষ সৌন্দর্যের পরিচায়ক। আমাদের ধারণা আর সংস্কার কি ও কথা মানে? হাসি তো পাবেই।
ওর স্বভাবটা কিন্তু ভারি নম্র ছিল। চাহনিটাও কোমল। মুসলমান বলে আমার ওপরে ওর একটা বিশেষ অধিকার বোধ ছিল। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কলেমা জানো? হ্যাঁ, বলে গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করলাম। ও আমার হাত চেপে ধরে বলল, তুমি তো আরবি উচ্চারণ করতেই জানো না! আমার সঙ্গে সঙ্গে কলেমা বলল। বাপরে! একেবারে অন্য রকম উচ্চারণে কলেমা পড়ে গেল। তাই নকল করে করে বলে ওর হাত থেকে ছাড়া পেলাম। বলে, এত দিন তো মুসলমানই হওনি তুমি!
পরে শুনেছি আরবির প্রাদেশিক উচ্চারণ সর্বত্র এক রকম নয়। তাই একেক এলাকায় একেক উচ্চারণে কলেমা পড়া হয়। কেমন করে অন্য এলাকার কাউকে তুষ্ট করব।
আরেক বিপদ হয়েছিল, একদিন নাজিক ওর ঘরে আমাকে খেতে বলল। আমাদের মতন সে কিচেনে খেত না। রান্নার খুব ঘটাপটা দেখলাম। খেতে বসে আমার দফারফা! টক খেতে পারি না। সে টমেটোর ভেতরে চাল পুরে সেদ্ধ করে কী এক টকটক ডেলিকেসি তৈরি করেছে। পাকা টমেটোর লালটু চেহারা দেখতে অবশ্য অতি চমৎকার ছিল। মাছ খাই না। মাছেরও বিচিত্র সব ডেলিকেসি! সেদ্ধ না কাঁচা মাছ কে জানে, তাতে গন্ধরাজ লেবুর প্রচুর নির্যাস। কিছু খেতে না পেরে বমি ঠেকিয়ে কোনোমতে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কঠিন সব রান্না করে আমাকে চমক দিতে চেয়েছিল সে। ভীষণ রেগে গেল আমার কাণ্ড দেখে। আমার খাদ্যরুচি তাকে পুরোদস্তুর হতাশ করেছিল। [ক্রমশ]