সোমবার | ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৩৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘বিকাশের বিয়ে’ গরমের সময়ে চোখের যত্ন না নিলে অন্ধত্ব এবং ক্যানসারের ঝুঁকিও থাকে : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও মৃৎশিল্পী : দীপাঞ্জন দে

দীপাঞ্জন দে / ৬৫৬০ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২২

“পুতুল খেলার কৃষ্ণনগর। যেন কোন খেয়ালি শিশুর খেলা শেষের ভাঙা খেলাঘর” — সালটি ১৯২৭-২৮, কৃষ্ণনগরে অবস্থানকালে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিখ্যাত ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে কথাগুলি লিখেছিলেন। কৃষ্ণনগর — নামটি উচ্চারিত হলেই প্রথম স্মরণে আসে সেখানকার মাটির পুতুলের কথা। দেশ-বিদেশের একাধিক গবেষক বিভিন্ন সময়ে কৃষ্ণনগরে ছুটে এসেছেন শুধুমাত্র মৃৎশিল্পের টানে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, দেশের বাইরেও কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং শিল্পীসমাজকে নিয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের কারিগরি দক্ষতা সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের তৈরি ভাস্কর্য সাত সমুদ্র তেরো নদী অতিক্রম করে দূর দূরান্তে পাড়ি দিয়েছে। কৃষ্ণনগরের ভাস্কর্য নিদর্শন সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা তাদের কারিগরি দক্ষতায় যেন এক শৈল্পিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন — কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের তৈরি ভাস্কর্য কোথায় না নেই!

কুমোরদের উৎপত্তি সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনী এবং প্রচলিত লোকশ্রুতিগুলি বেশ মজাদার। ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত বলে অনুমান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কুম্ভকারদের জন্মবৃত্তান্ত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, দেবকুলে ম্লান ঐতিহ্যের অধিকারী বিশ্বকর্মা ও আর্যকন্যা ঘৃতাচীর মিলনে জন্ম হয়েছিল কুম্ভকারদের। তারা ‘নবশান’ গোষ্ঠীর অন্তর্গত। ঘৃতাচীর গর্ভে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ৯ সন্তানের জন্ম দেন। এরা হলেন — মালাকার, কর্মকার, কাংস্যকার, শঙ্খকার, কুম্ভকার, তন্তুবায়, সূত্রধর, স্বর্ণকার ও চিত্রকর। সুতরাং পুরাণমতে কুম্ভকারেরা হলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার সন্তান। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ঘৃতাচীর উপাখ্যানে রয়েছে —

“মালাকার কাংস্যকার তাঁতি স্বর্ণকার

কর্মকার শঙ্খকার আর সূত্রধর

কুম্ভকার চিত্রকর এই নয় জন

বিশ্বকর্মার ঔরসেতে লভিল জীবন।”

বাংলার পালদের (কুম্ভকারদের) উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি লোকশ্রুতি হলো— একদা শিব-পার্বতীর বিবাহে দুটি কুম্ভের (মতান্তরে আই হাঁড়ি) প্রয়োজন হয়েছিল। সেই সময় শিব নিজের রুদ্রাক্ষ মালা থেকে দুটি রুদ্রাক্ষ ছিঁড়ে একটি পুরুষ ও একটি নারী তৈরি করেছিলেন। তারাই শিব-পার্বতীর বিবাহের কুম্ভ তৈরি করে দিয়েছিলেন। আর তাদের থেকেই জন্ম নিয়েছিল কুম্ভকার সম্প্রদায়। লোকমুখে প্রচলিত যে, শিবের সৃষ্টি করা প্রথম কুম্ভকারের নাম ছিল রুদ্রপাল। আর তিনিই কুম্ভকারদের আদিপিতা। সে কারণেই বাংলার কুম্ভকার সম্প্রদায় বিশ্বকর্মা নয়, শিবকে নিজেদের উপাস্য দেবতা হিসেবে মানেন। বৈশাখ মাসে কুম্ভকারেরা চাকের উপর শিবমূর্তি বসিয়ে রাখেন এবং পুরো এক মাস কর্মবিরতিতে থাকেন। এবিষয়ে তাদের প্রচলিত একটি ছড়া হল —

বারো মাস ফল ধরে একমাস মানা।

যতগুলি ফল ধরে ততগুলি কানা।।

উল্লেখ্য, কৃষ্ণনগরের নতুন বাজার রথতলা এলাকায় মৃৎশিল্পীদের পরিচালনায় শিব পার্বতীর পুজোকে কেন্দ্র করে একটি মেলাও বসে।

প্রচলিত মতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমল (১৭২৮-১৭৮২ খ্রিঃ.) থেকে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের জয়যাত্রার সূচনা। ইতিপূর্বে রেউই গ্রাম থেকে কৃষ্ণনগরের রূপান্তর ঘটে গেছে। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষ্ণনগরে জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করেন। প্রসঙ্গত বলতে হয় বহুল প্রচলিত একটি মতানুযায়ী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামেই ‘কৃষ্ণনগর’ নামটি হয়েছে। কিন্তু কথাটি পুরোপুরি ভুল। দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায়ের ‘ক্ষিতীশ বংশাবলিচরিতম’ থেকে জানা যাচ্ছে যে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের অনেক আগেই রাজা রুদ্র রায় (১৬৭৬-১৬৯৩ খ্রি:) রেউই গ্রামের বাসিন্দা গোপদের আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণের নামানুসারে কৃষ্ণনগর নামটি দিয়েছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন রাজা রুদ্র রায়ের প্রপৌত্র। সুতরাং কৃষ্ণনগর নামকরণ প্রসঙ্গে বহুল প্রচলিত মতটি মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। তবে কৃষ্ণনগরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণ পর্বে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তেমনি কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প-ঐতিহ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের অবদানের কথা স্বীকার করতে হয়।

নদিয়া-রাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় নাটোর এবং রাজশাহী থেকে কিছু বিশিষ্ট মৃৎশিল্পীকে কৃষ্ণনগরে এনেছিলেন। তারা নদিয়া-রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থায়ীভাবে কৃষ্ণনগরেই বসবাস করতেন। মূলত প্রতিমা গড়ার কারিগর হিসেবেই তাদেরকে কৃষ্ণনগরে আনা হয়েছিল। ক্রমে কৃষ্ণনগরের আদি প্রতিমাশিল্পী এবং রাজশাহী ও নাটোর থেকে আগত নতুন শিল্পীদের সহাবস্থানে কৃষ্ণনগর মৃৎশিল্পের ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়। কালের নিরিখে প্রতিমা গড়ার পাশাপাশি কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা বাস্তব জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মডেল তৈরিতে পারদর্শিতা অর্জন করেন। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের কারিগরি দক্ষতায় মাটির পুতুল যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। তারা বাস্তব জীবনের বহুবিধ বিষয়কে খুব সহজে মৃন্ময় রূপ দিতে সিদ্ধহস্ত হলেন। একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণ — গায়ের রং, মাথার চুল, কাপড়ের পোশাক থেকে শুরু করে চামড়ার ভাঁজ পর্যন্ত অবিকল মডেল তৈরিতে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের জুড়ি মেলা ভার। রাখাল বালক, পুরোহিত, জেলে, কুমোর, কামার, নাপিত, ধোপা, সাপুড়ে, শিকারি আরো কত কী। একাধিক পেশার সাথে জড়িত মানুষদের মিনিয়েচার তৈরিতে তারা পারদর্শিতা অর্জন করলেন। সমগ্র বাংলার মধ্যে প্রথম কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির মৃৎশিল্পেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তব জীবনের অনুকরণ লক্ষ্য করা যায়। এটাও কিন্তু একটি বিস্ময়। অনুসন্ধিৎসু গবেষক ও নিষ্ঠাবান পাঠকদের মনে নিশ্চয় প্রশ্নটি উঁকি মারবে। তবে সীমিত কলেবরের এই প্রবন্ধে সেই উত্তরের খোঁজ মিলবে না।

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের মূল ঘাঁটি শহরের উত্তর-পূর্বে ঘূর্ণি অঞ্চলে হলেও, সেটি কিন্তু কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের একমাত্র বসতি নয়। কৃষ্ণনগর পৌর এলাকার আরও দুটি জায়গার কথা বলতেই হয়, যেখানে সুদীর্ঘকাল ধরে মৃৎশিল্পীরা বসবাস করছেন। একটি হল শহরের দক্ষিণে নতুন বাজার রথতলা অঞ্চল। আরেকটি হল শহরের উত্তরে জলঙ্গী নদীর কাছে ষষ্ঠীতলার কুমোর পাড়া অঞ্চল। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের উপনিবেশ ঘূর্ণিও জলঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত। ভৌগোলিক দিক থেকে কৃষ্ণনগর ২৩.২৪ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে অবস্থিত কৃষ্ণনগরের মাটি মৃৎশিল্পের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। কৃষ্ণনগরের মাটির বিশেষত্ব হল বেলে মাটি ও দোআঁশ মাটির চমৎকার মিশেল। আর তার সঙ্গে পরিমাণমত এঁটেল মাটির উপস্থিতি। এছাড়া এই মাটিতে কাঁকরের পরিমাণ খুবই কম। এটি হলো এমন এক মিশেল যাতে মাটির সূক্ষ্ম কাজ করতে শিল্পীদের বিশেষ সুবিধা হয়। এই জনপদের মাটি যেমন মোলায়ম, তেমনি হলো এর ধরে রাখার শক্তি। মডেলকে আটকে রাখতে পারে।

সন তারিখ নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য যে প্রায় তিন শতকের সে কথা আমরা বলতেই পারি। তবে কৃষ্ণনগরে মৃৎশিল্পের আবির্ভাব প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। যেমন ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় জনৈক প্রফুল্লকুমার সরকার ‘কৃষ্ণনগর রাজপরিবার’ শীর্ষক নিবন্ধে (অগ্রহায়ণ ১৩৬৪) লিখেছিলেন — “কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের আরম্ভ হইয়াছিল কৃষ্ণনগরের রাজার জন্য ‘নরনারীকুঞ্জর’ গঠন হইতে, নয়টি নারী পুতুলের সমষ্টিতে গড়া হইয়াছিল এই অদ্ভুত পুতুল। বিখ্যাত মৃৎশিল্পী যদুনাথ পালের পূর্বপুরুষ গোপাল পাল ইহার শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা”। এই তথ্যটি একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়। দেখুন এখানে কোনো রাজার নাম নেই। আবার অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে বিখ্যাত মৃৎশিল্পী যদুনাথ পালের পূর্বপুরুষদের মধ্যে গোপাল পাল নামে কোনো ব্যক্তি নেই। সুতরাং পুরোটাই বিভ্রান্তিকর।

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় থেকে শুরু করে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমুদনাথ মল্লিক, কমলকুমার মজুমদার, মোহিত রায়, সুধীর চক্রবর্তীর মতো একাধিক গুণী লেখক কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং শিল্পীদের নিয়ে চর্চা করেছেন। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের স্বতন্ত্রতাই হল তার বাস্তবধর্মীতা। ১৮৫১ সাল, ভারতে ব্রিটিশ শাসন তখন মধ্যগগনে। সেই বছর লন্ডনে ‘এক্সিবিশন অব দি ওয়ার্কস অব ইন্ডাস্ট্রি অব অল নেশনস’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী শ্রীরাম পালের তৈরি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছিল। কৃষ্ণনগরের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মৃৎশিল্পী গৌতম পালের মতে, “শ্রীরাম পালই সম্ভবত প্রথম মৃৎশিল্পে আন্তর্জাতিক সম্মান ও পদক অর্জন করেন।” যাই হোক, শ্রীরাম পাল ছাড়াও যদুনাথ পাল, চন্দ্রভূষণ পাল, রাখালদাস পাল, বক্রেশ্বর পাল, চারুচন্দ্র পাল প্রমুখরা কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আসলে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা সুদীর্ঘ এক ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেছেন।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধটি কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং মৃৎশিল্পীদের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বলা যায়। কারণ এই কালপর্বে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছিলেন। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের বিশ্বব্যাপী প্রচার ঘটেছিল। আর এই আন্তর্জাতিক পরিচিতি ঘটানোর ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসক শ্রেণীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ঘূর্ণির মৃৎশিল্পের বিশ্বব্যাপী এই প্রসার সম্ভব হতো না।

সরণি: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক সম্মান

সাল স্থান প্রদর্শনীর নাম পুরস্কার প্রাপক
১৮৫১ লন্ডন এক্সিবিশন অব দি ওয়ার্কস অব ইন্ডাস্ট্রি অব অল নেশনস শ্রীরাম পালের পক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
১৮৫৫ প্যারিস এক্সপোজিশন ইউনিভার্সেলে দ্য শ্রীরাম পাল
১৮৬৭ প্যারিস এক্সপোজিশন ইউনিভার্সেলে দ্য যদুনাথ পাল, শ্রীরাম পাল
১৮৮১ মেলবোর্ন মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন মতিলাল পাল, গোপালচন্দ্র পাল, যদুনাথ পাল
১৮৮৩ আমস্টারডাম    আমস্টারডাম এক্সিবিশন যদুনাথ পাল
১৮৮৩ বস্টন ফরেন আর্ট ইন্ডাস্ট্রি চন্দ্রভূষণ পাল
১৮৮৩ জার্মানি ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল যদুনাথ পাল
১৮৮৩ কলকাতা ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন শ্রীরাম পাল, যদুনাথ পাল, রাখালদাস পাল, মতিলাল পাল
১৮৮৬ লন্ডন কলোনিয়াল এন্ড ইন্ডিয়ান এক্সিবিশন চন্দ্রভূষণ পাল, যদুনাথ পাল, রাখালদাস পাল
১৮৮৮ গ্লাসগো গ্লাসগো ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন যদুনাথ পাল, বক্রেশ্বর পাল, রাখালদাস পাল, নিবারণ পাল
১৯০০ প্যারিস এক্সপোজিশন ইউনিভার্সেলে ইন্টারন্যাশনালে যদুনাথ পাল, চারুচন্দ্র পাল

প্রসঙ্গত একটি ঘটনার কথা এখানে বলতেই হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের কারিগরি দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তখন ১৯৪০ সাল, বছরখানেক হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঘূর্ণির মৃৎশিল্পী কার্তিকচন্দ্র পালের ২৫ বছর বয়স। সেই বয়সেই তিনি কবিগুরুর সামনে বসে মূর্তি গড়ার সুযোগ পেয়ে যান। আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেই মূর্তিটি গড়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং কার্তিকচন্দ্র পালের কারিগরি দক্ষতার প্রশংসা করে বলেছিলেন, “কৃষ্ণনগরের মূর্তি শিল্পী শ্রীযুক্ত কার্তিকচন্দ্র পাল আমার যে মূর্তি গঠন করিয়াছেন তাহাতে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি। তাঁহার দ্রুত হস্তের নৈপুণ্য প্রশংসনীয়। ইউরোপ আমেরিকায় যে শিল্পীরা আমার মূর্তি গঠন করিয়াছেন তাঁহারা আমাকে ক্লান্তিতে পীরিত করিয়াছেন। ইহার হাতে সে দুঃখ পাই নাই।”

প্রথম পর্যায়ে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল রাজপরিবার এবং জমিদার শ্রেণী। আবার কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং বিশ্বব্যাপী প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে ইংরেজদের অবদান অনস্বীকার্য। প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী রাখালদাস পালের অর্ডারের খাতা থেকে কতগুলি নাম পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলি এইরূপ — ১) মন্মথ বাবু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ২) এডওয়ার্ড সাহেব স্থানীয়, ৩) শ্রীযুক্ত বাবু মন্মথনাথ বক্সী, নাটোর, ৪) হরিচরণ বসু, সেক্রেটারি রংপুর একজিবিশন, ৫) মি: আমেদ হোসেন, শান্তিপুর, ৬) শ্রীমহেশচন্দ্র আতর্থী, শ্রীমানীর বাজার, কলিকাতা, ৭) মাখনলাল দে, উর্দুবাজার, ঢাকা, ৮) এস, দাস এন্ড কোং, লয়্যাল স্ট্রিট, ঢাকা, ৯) শ্রীদয়ার্দ্র নাথ দাস, বন্দর বাজার শ্রীহট্ট, ১০) প্রমথ নাথ রায়, সিংহজানি ময়মনসিংহ, ১১) খগেন্দ্র মোহন বসু, রাখা মাইনস সিংভূম, ১২) বেঙ্গল হোম ইন্ডাস্ট্রিজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, ১৩) ভারত স্টোরস লি:, আগ্রা প্রভৃতি। সুতরাং রাখালদাস পালের এই অর্ডারের খাতাটি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে যে, তৎকালীন সময়ে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের গ্রাহক কারা ছিলেন।

এহেন কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যমন্ডিত মৃৎশিল্প এবং শিল্পীসমাজ আজ বড়ই সংকটে। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের মধ্যে কয়েকজন তো খুবই কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন গুজরান করছেন। দীর্ঘদিন তাদের হাতে কোনও কাজ নেই। সমগ্র দেশে লকডাউন চলছে। নোভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মৃৎশিল্পীদের জীবনে কাল হয়ে নেমে এসেছে। লকডাউন চলাকালে অন্নপূর্ণা পুজো, বাসন্তী পুজোর তিথি পড়ায়, মৃৎশিল্পীরা বেশ সমস্যায় পড়েছেন। নদিয়া জেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রতিবছর অন্নপূর্ণা পুজো এবং বাসন্তী পুজো বেশ ধুম ধাম করে হয়ে থাকে। করোনার প্রাদুর্ভাবের পূর্বে সেই সকল পুজোর প্রতিমা তৈরীর জন্য কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা একাধিক বরাত পেয়েছিলেন। কিন্তু লকডাউনের জেরে সেই সকল অর্ডার বাতিল হয়ে যায়।

এখানেই শেষ নয়, পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, বুদ্ধ পূর্ণিমা — সবকিছুকেই করোনা এবং তদজনিত লকডাউন গ্রাস করে। এমতাবস্থায় কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা বেজায় সংকটে পড়েন। মৃৎশিল্পীরা বছরভর এই ‘সিজন’-এর অপেক্ষায় থাকেন। কারণ এই সময় পুজোর জন্য লক্ষ্মী, গণেশের মূর্তির চাহিদা তুঙ্গে থাকে। তাই আগে থেকেই মৃৎশিল্পীরা বেশি করে লক্ষ্মী, গণেশ তৈরি করে রাখেন। ২০২০-২০২১ সালও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। কিন্তু দেশব্যাপী লকডাউন সব হিসেবে জল ঢেলে দেয়। করোনার জেরে ২৫ মার্চ, ২০২০ থেকে দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ায়, মৃৎশিল্পী সমাজের সর্বস্ব যেন ভূলুণ্ঠিত হয়। ঘূর্ণি পুতুলপট্টির পৌঢ় মৃৎশিল্পী প্রবীর পাল তার দোকানঘর দেখিয়ে বলেন, “এই যে সব মাল পড়ে রয়েছে, ঈশ্বরই জানেন — আগামী দিনে কি সংকট আসতে চলেছে?” কৃষ্ণনগরের বড় বড় মৃৎশিল্পীরা এই সংকট থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু ছোট মৃৎশিল্পী কারিগরেরা যাদের আর্থিক সঙ্গতি খুবই কম, তারা এখনো পুরোপুরি সেই দুর্বিষহ পর্যায় কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

করোনা অতিমারীর সংকট স্তিমিত হলেও, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং মৃৎশিল্পী সমাজ কবে আবার পূর্ব গরিমা ফিরে পাবে — সেবিষয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের একটা বড় অংশ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হয়। সাধারণ মানুষ থেকে শিল্প রসিক সকলেই মূলত নিজেদের শখ পূরণ করতে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প সংগ্রহ করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন করোনা অতিমারীর জেরে অর্থনীতির যে হাল, তাতে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা আতান্তরে পড়েছেন। কৃষ্ণনগরের নতুনবাজার এলাকার সোমনাথ পাল, ভবেশ পালের মতো মৃৎশিল্পীরা তাদের বংশানুক্রমিক জীবিকার পরিবর্তনের কথাও ভেবেছেন। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং মৃৎশিল্পী সমাজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তাদেরকে যেন এক যুগসন্ধিক্ষণের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। ভবিষ্যতই উত্তর দেবে — ইতিহাসে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং মৃৎশিল্পীদের ঠাঁই কিভাবে হবে এবং কতটা হবে!

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের সাক্ষাৎকার, ক্ষেত্রসমীক্ষা, ক্রাফটস এন্ড ক্রাফটসমেন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, আর্ট মেনুফেকচারস অফ ইন্ডিয়া, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং মৃৎশিল্পী সমাজ, এ স্ট্যাটিস্টিকাল একাউন্ট অফ বেঙ্গল।

লেখক পরিচয় : আঞ্চলিক ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু লেখক।


আপনার মতামত লিখুন :

11 responses to “কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও মৃৎশিল্পী : দীপাঞ্জন দে”

  1. রোশনী হালসানা says:

    লেখাটা অসাধারণ হয়েছে

  2. অমিতাভ মিত্র says:

    অসাধারণ লেখা দীপাঞ্জনবাবু। এই লেখাটাই দুমলাটের মধ্যে আরও সুন্দর হবে।যদিও এটা একটা সামগ্রিক কাজ, তবুও শিল্পী ধরে ধরে, তাঁদের ধারাবাহিক কাজ নিয়ে যদি একটা কাজ করা যায়, খুব ভাল হয়।খুব খুব ভাল লাগল লেখাটা।মূল্যবান লেখা🥰🥰🥰

  3. Sanjiban Murmu says:

    অসংখ্যা ধন্যবাদ স্যার।

  4. SATYEN BANERJEE says:

    খুব সুন্দর গবেষণা সমৃদ্ধ লেখা। আপনার সাথে পরিচয় হয়তো অনেক দিনের নয়, কিন্তু ইতিমধ্যেই আপনার লেখা, আপনার বক্তব্য, নিজেকে একটু আড়ালে রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপনার সুচারু সাংগঠনিক উদ্যোগ আমাকে গভীর ভাবে আকৃষ্ট করেছে- মোহিত করেছে। অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে – কিন্তু বিশেষ কারণে জোর করেই নিজেকে বিরত করলাম। খুব বড় হবেন আপনি, নিশ্চয়ই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন