১৯ এবং ২৬ এপ্রিল দু’দফায় ২৪-এর লোকসভার রায়দান পর্ব শেষ হয়েছে। দু’দফায় ২৩টি রাজ্যের ১৯০টি লোকসভা আসনের ভোটগ্রহণ মিটে গিয়েছে। ভোট শেষে দেখা গিয়েছে, দু’দফাতেই ভোটের হার ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় প্রায় তিন শতাংশ কম। এর মধ্যে ৫৯টি লোকসভা আসনে ২০১৯ সালের তুলনায় পাঁচ শতাংশ বা কম ভোট পড়েছে। কিন্তু প্রথম দফার ১১ দিন আর দ্বিতীয় দফার চার দিন পরে নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে প্রথম দফায় ৬৬.১৪% এবং দ্বিতীয় দফায় ৬৬.৭১% ভোট পড়েছে। অথচ দ্বিতীয় দফার ভোট শেষের পর কমিশনের তরফে জানানো হয়েছিল ভোট পড়েছে ৬০.৯৬%। হটাৎ কয়েকদিন পরে ৫.৭৫% ভোট বেড়ে গেল কী করে? সাধারণত প্রতিবার ভোট গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচন কমিশন কত শতাংশ ভোট পড়েছে তা জানিয়ে দেয়। কিন্তু এবার তা হয়নি। তবে দ্বিতীয় দফা ভোট শেষে কমিশন জানিয়েছিল ভোট পড়েছে ৬০.৯৬%। কিন্তু তাদের চূড়ান্ত হিসেবে দ্বিতীয় দফায় ভোট শতাংশ লাফ দিয়ে বেড়ে গেল তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন। রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে দেশজুড়ে।
এদিকে প্রথম দফায় ভোট কম পড়ার পর বিজেপি যথেষ্ট মাথাব্যাথা নিয়ে কারণ বিশ্লেষণে বসেছিল। কেবল তাই নয়, গত লোকসভার থেকে পাঁচ শতাংশ কম ভোট নরেন্দ্র মোদীর উদ্বেগ এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে তিনি বাধ্য হয়ে দেশের উন্নয়ন ও বিকাশের গল্প থামিয়ে তিনি সরাসরি ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য বক্তব্য দিতে শুরু করেন। প্রচার সভায় কংগ্রেস ও মুসলমানদের সমার্থক প্রতিপন্ন করতেও ছাড়েন না। কংগ্রেস মানুষের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে এমন স্বকল্পিত কাহিনি বলে ভোটের বাজার গরম করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মোদীর কথায় দ্বিতীয় দফাতেও কাজ হয়না। ভোটে নিরুৎসাহী মানুষ তাতেও সাড়া দেয়নি। নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী দ্বিতীয় দফাতেও ভোটের হার ৬৪ শতাংশ। যা গতবারের থেকে কম। কারণ এই কেন্দ্রগুলোয় আগেরবার ছিল ৭০ শতাংশের কাছাকাছি। নির্বাচন কমিশনের তরফে আচমকা ভোটের শতাং বেড়ে যাওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বিরোধীরা। স্বভাবতই হিসাবের এই গড়মিলে অভিযোগের আঙুল উঠেছে কমিশনের দিকে। বিরোধীরা কমিশন ভোট গ্রহণের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলেই মনে করছেন। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনের দেওয়া আচমকা হিসাব প্রমাণ করে যে তারা বিজেপির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই কাজ করছে। কীভাবে আচমকাই ৫.৭৫% ভোট বেড়ে গেল, তা তাঁরা জানতে চেয়ে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক ডি দেবরাজন ইতিমধ্যেই চিঠি দিয়ে কমিশনের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন।
এবার যে ভোটে কোনো হাওয়াই নেই তা খুব ভাল করেই বোঝা যাচ্ছে। ভোটের হাওয়া তুলতে স্বয়ং মোদী চেষ্টার কসুর করছেন না মানুষকে ভোটে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে নাগাড়ে আবেদন জানাচ্ছেন, বিরোধীদের তুলোধনা করছেন, ঘৃণ্য বক্তব্য রাখতেও মুখে লাগাম দিচ্ছেন না। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও গণমাধ্যমে নানা ধরণের বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোটদানের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছেন। তবু মানুষের মধ্যে সাড়া কম, অত্যধিক গরমের কথা প্রথম দিকে বলা হয়েছে কিন্তু সঠিক কারণ বোঝা যাচ্ছে না। বিজেপি ধরেই নিয়েছিল তারা অনায়াসেই ফিরে আসছে আরও অনেক বেশি আসন জয় করে, কিন্তু ভোট চলাকালীন তাদেরই একাংশের জিজ্ঞাসা, বেশি ভোট না পড়ার অর্থ তাহলে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নেই, নাকি জনগনের আশাভঙ্গ ঘটেছে? যদিও ভোটের হার কম নিয়ে সব মহলেই বিশ্লেষণ চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে নেতা কর্মীদের আলাপ আলোচনায় নানা কারণ উঠে আসছে ঠিকই, কিন্তু একটা বিষয়ে আধিকাংশের মত, সাধারণ মানুষের মধ্যে এবার আর ভোট নিয়ে তেমন একটা উৎসাহ নেই। কট্টর সমর্থক ছাড়া অন্য কেউ ভোট দিতে যাচ্ছেন না- একথা বিজেপি মহল থেকেও শোনা যাচ্ছে।
এটা ঘটনা ২০১৪ এবং ২০১৯-এর লোকসভায় মোদীকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল উৎসাহ ছিল, সোজা কথায় দুটি ভোটেই ছিল মোদী হাওয়া। কিন্তু এবার অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন মোদীকে নিয়ে মানুষের উৎসাহ নিভে গেছে। যে কারণে বিজেপির দুর্গ বলে পরিচিত কেন্দ্রগুলোতেও ভোটের হার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। তা নাহলে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলিতে ভোটের হার এত কম হয় কিভাবে। বিশেষজ্ঞরা একথাও বলছেন, এই রাজ্যগুলিতে তো বিজেপি বিরোধীদের অনায়াসে পরাজিত করবে বলেই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু দু-দফা ভোটের পর তারা আর নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। বরং ভোটের হার যদি শেষ পর্যন্ত কমই থেকে যায় তাহলে একক গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও বিজেপির পক্ষে ২০১৪ ও ২০১৯-এর সাফল্য ছোঁয়া সম্ভব হবে না। সেই কারণেই উন্নত ভারত ইত্যাদি প্রচারের উল্টো দিকে গিয়ে কংগ্রেসের মুসলমান প্রীতির কল্পিত কাহিনি, মুসলমান জুজু দেখিয়ে হিন্দুদের জাগাতে চাইছে। সবশেষে নির্বাচন কমিশনের তথ্যে আচমকা ভোট শতাংশ বেড়ে যাওয়াটাও যে গেরুয়া প্রভাব সেকথাও বলছেন বহু বিশেষঙ্গ।
সঠিক বিশ্লেষণ। হয়তো বিজেপিই ক্ষমতায় আসবে। বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ নয়। তাই। কিন্তু মনে রাখা উচিৎ, প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশের সমর্থন পেয়ে। অর্থাৎ বাকি ৯০ শতাংশ মানুষ কিন্তু বিজেপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়নি।
আমাদের ভোট রাজনীতিতে এটাই সবচাইতে বড় পরিহাস। সরকার গড়বে তারা যারা ভোটের বিচারে সঙ্খালঘু। হাস্যকর।