শুক্রবার | ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:৩৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (প্রথম পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান : শৌনক দত্ত বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ত্রয়দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নন্দিনী অধিকারীর ছোটগল্প ‘শুভ মাতৃদিবস’ গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফ্লোরেন্স থেকে রাধানগর রেনেসাঁস ও রামমোহন’-এর মোড়ক উন্মোচন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১-এ কথা দিয়েও স্পেনে গেলেন না কেন রবীন্দ্রনাথ : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ : তারাপদ রায় ও তার অন্ত নাই গো নাই : প্রব্রাজিকা বেদরূপপ্রাণা পেজফোরনিউজ-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন কাশ্মীরে বিজেপির প্রার্থী নেই, মোদীর সফরও বাতিল উপত্যকা ও লাদাখে : তপন মল্লিক চৌধুরী অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে অক্ষয় হোক সম্পদ সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি : রিঙ্কি সামন্ত শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (একাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথরা কি কবিয়ালের বংশধর? : অসিত দাস নিমাই ভট্টাচার্য-এর বড়োগল্প ‘প্রাইভেট প্রাকটিশ’ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে নজর কাড়ল আরামবাগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দশম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আমার রবীন্দ্রনাথ : লুৎফর রহমান রিটন রবীন্দ্র সাহিত্যের নতুন প্রান্ত : মিল্টন বিশ্বাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ছোটগল্পকার আলাউদ্দীন আল আজাদ : আবু জাফর রেহমান

আবু জাফর রেহমান / ১৭৭ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১ মে, ২০২৪

আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : গাজী আব্দুস সোবহান; মাতা : মোসাম্মাৎ আমেনা খাতুন; স্ত্রী : জামিলা আজাদ। প্রবেশিকা : নারায়ণপুর শরাফতউল্লাহ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়, রায়পুরা (১৯৪৭)। উচ্চ মাধ্যমিক (কলা) : ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (১৯৪৯) তিনি ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি সরকারি কলেজের অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ (১৯৫৫), ঢাকা জগন্নাথ কলেজ (১৯৫৬-৬১), সিলেট এমসি কলেজ (১৯৬২-৬৮) এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ (১৯৬৪-৬৭)-এ অধ্যাপনা করেন। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন এক বছর (১৯৭৪-৭৫) এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। পেশাগত জীবনে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব, সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ঈশ্বরগুপ্তের জীবন ও কবিতা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ এর ৩রা জুলাই শুক্রবার রাতে ঢাকার উত্তরায় নিজ বাসভবন রত্নদ্বীপে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আজাদের কবর।

তার বিখ্যাত কতগুলো গল্পকে ২ভাগে ভাগ করে আলোচনা করছি। প্রথম ভাগে আছে তার সমাজ সচেতন গল্পের সারসংক্ষেপ। দ্বিতীয়ধাপের গল্প গুলোতে আছে তার মার্কসবাদী বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতিফলন।

সমাজ সচেতন লেখক হিসেবে আলাউদ্দিন আল আজাদের নাম উল্লেখযোগ্য। লেখকের প্রথম দিককার গল্পে শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কিত বলিষ্ঠ বক্তব্য রূপায়িত হয়ে উঠেছিল বলে তিনি সহজেই খ্যাতিলাভ করতে পেরেছেন। সংগ্রামী মানুষের জীবনালেখ্য তার গল্পে বিধৃত হয়েছে, জীবনমুখিনতা তার বৈশিষ্ট্য। কোনো কোনো গল্পে সমাজজীবনের বাস্তব ও অন্তরঙ্গ পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে গল্লকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার পদচারণা আছে। তবে ছোটগল্পে তার অবদান বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য। নিম্নে ছোটগল্পকার হিসেবে আলাউদ্দিন আল আজাদের অবদান ও তার অবস্থান তুলে ধরা হলো : —

সমালোচকের অভিমত

১। সমালোচকের মতে, ‘বাংলা কথাশিল্পের বাস্তবতা-নিবিড় বিষয়বৈচিত্র্যের বাইরে আলাউদ্দিন আল আজাদের শিল্পসচেতনতার যে অতিরিক্ত বিশেষত্ব ধরা পড়ে তার পরিচয় রয়েছে তার ভাষার কাব্যময়তায়, বর্ণনার শিল্পিত মাধুর্যে ও বাক্যবিন্যাসের চমৎকারিত্বে, যার সমন্বয়ে অনায়াসে গড়ে উঠে তার রচনার অনন্য এক শিল্পশৈলী।’ :

আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা ছোটগল্পগ্রন্থগুলো হলো : ১. ‘জেগে আছি’ (১৯৫০), ২. ‘ধানকন্যা’ (১৯৫১), ৩. ‘মৃগনাভি’ (১৯৫৩), ৪. ‘অন্ধকার সিড়ি’ (১৯৫৮), ৫. ‘উজান তরঙ্গে’ (১৯৬২), ৬. ‘যখন সৈকত’ (১৯৬৭), ৭. ‘আমার রক্ত স্বপ্ন আমার’ (১৯৭৫), ৮. ‘জীবনজমিন’ (১৯৮৮), ৯. ‘নির্বাচিত গল্প’ (১৯৯৫), ১০. ‘মনোনীত গল্প’ (১৯৮৭), ১১. ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৮৭) ইত্যাদি।

তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয়বস্তু – প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁকে সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করে। দেশ বিভাগের পরে তিনি দেশের চলমান প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব। এ সময়ে যাঁরা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী ভাবধারায় তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। প্রথম জীবনে গ্রামের মানুষ ও তাদের সংগ্রাম, প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও সংহারমূর্তি দুইই তাঁর মনে ছাপ ফেলে গেছে। নগরজীবনের কৃত্রিমতা, রাজনীতিক সংগ্রাম, নিপীড়ন, প্রতারণা তিনি তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয়বস্তু করেছেন —

২। আলাউদ্দিন আল আজাদ বৈচিত্র্যধর্মী লেখক। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো ছোটগল্পেও তার দক্ষতা অপরিসীম। তিনি বিচিত্র স্বাদের উৎকৃষ্ট গল্প রচনার পরিচয় দান করেছেন। সমালোচকের মতে, ‘এসব গল্পের উপজীব্য বিষয় সংগ্রহে তিনি যেমন স্বদেশের এবং বিশেষ করে গ্রাম্য-জীবনের পটে বিচরণ করেছেন তেমনি চরিত্র সৃষ্টিতেও কোনোরূপ আরোপিত বৈশিষ্ট্যের অন্বেষী হননি। ফলে তার ‘জেগে আছি’, ‘ধানকন্যা’ প্রভৃতি ছোটগল্পের পরিসরে সমাজের বাস্তব ও অন্তরঙ্গ পরিচয়ই বিধৃত হয়েছে। এসব রচনায় উপজীব্য বিষয় ও চিত্রের সাথে লেখকের গভীর ও নিবিড় পরিচয়। আন্তরিকতায় অভিব্যক্তিতেও গ্রাম্য-জীবনের পরিচয়। কিন্তু পরবর্তী রচনায় আলাউদ্দিন আল আজাদ এই অন্তরঙ্গ ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারেন নি।পরবর্তী রচনায় আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তবতা এবং অতিরেক দোষকেই প্রশয় দেওয়া হয়েছে। ফলে আধুনিক জীবন সমস্যা ও মানসিক দ্বন্দ্ব ও মনোবিকলনের রূপায়ণের নামে অমিতাচারিতাও অবাস্তবকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। ফলে সৃষ্টিতে যেমন আরোপিত বৈশিষ্ট্য ধরা দিয়েছে, তেমনি রচনার ভাষাও তির্যকতা হারিয়েছে।’

৩। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘আলাউদ্দিন আল আজাদ দেশকাল ও সমাজ সচেতন ছোটগল্পকার। শ্রেণিসংগ্রাম ও সংগ্রামের পরেই সাফল্য এই নীতিতে স্থিরবিশ্বাসী আজাদকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তার প্রথম পর্বের রচনাগুলোতে। এ পর্যায়ের গল্পগুলোর বিষয়বস্তু অনেকক্ষেত্রে গ্রামীণ।…. মার্কসবাদী লেখক হিসেবে তার গল্পের মধ্যে শ্রেণিসংঘর্ষের নির্মম পরিণতি প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে আজাদ ফ্রয়েডীয় রীতিতে বিশ্বাসী হয়েছেন। বস্তুত মার্কসবাদী রোমান্টিকতা তাকে দ্বন্দ্ব-ক্ষত করেছে কিন্তু মূলত আজাদ রোমান্টিক। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনেকাংশে তার কাছে রোমান্টিক সাম্যবাদে পর্যবসিত হয়েছিল। এই দ্বন্দ্বের কার্যকারণ যেমন তাকে শিল্পসমৃদ্ধ করেছে, তেমনি তাকে করেছে গভীর বিশ্বাস থেকে উৎকেন্দ্রিক।’

প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘জেগে আছি’ : — আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যকর্মে জীবনের বাস্তব প্রতিফলন ছাড়াও এদেশের মাটির কাছাকাছি মানুষের হাসিকান্না ও দুঃখ – ব্যথার যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘জেগে আছি’র লেখকের স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্য সহজেই লক্ষণীয়। গ্রন্থটি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হলেও ২০১৮ এ গতিধারা প্রকাশন থেকে যে সর্বশেষ সংকলন বের হয় তাতে মোট ১০ টি গল্প স্থান পায়, সেগুলো হলো -কাঠের লকশা, কয়লা কুড়ানো দল, সৃষ্টি, কয়েকটি কমলালেবু, সুন্দরী, সুন্দরী, মুখোমুখি, ফেরার, ছুরি, শিকড়, একটি কথার জন্ম ইত্যাদি।গল্পগুলো তার শুরুর দিকের রচনা হলেও শিল্পমূল্য অত্যধিক।

কাঠের নকশা :-‘জেগে আছি’র প্রথম গল্প ‘কাঠের নকশা।’ এতে লেখকের বিশেষ আদর্শটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শ্রমজীবী মানুষের হিংসা দ্বন্দ্ব আদর্শবোধ এ গল্পে লক্ষ্য করা যায়। সার্থের দ্বন্দ্বে ওস্তাগারকে শ্রমিক আন্দোলনের অভিযোগে জেলে যেতে হয়। রহমান সেই পদটি দখল করে শ্রমিকদের শ্রমিকদের সার্থবিরোধী কাজ করে। ওস্তাগারের তৈরি নকশাগুলো হস্তগত করতে গিয়ে রহমান তীব্র প্রত্যাখ্যানের সম্মুখিন হয়। গল্পের – প্রারম্ভটা সহজেই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ওস্তাগারের মেয়ের সাথে তার সংলাপের শুরুটা এরকম: “হি হি করে হাসে মেয়েটা। গরবে ঝলমল করে মুখ। গোল চেহারা, সুঠাম শরীর আর বেশভূষায় দেখতে আমার চেয়ে চেঙা। এতে কী হয়, আগেকার দিন থাকলে দেখিয়ে দিতাম মজা। চুল ছিঁড়ে, আঁচড়িয়ে, খামচিয়ে। আমার সাথে ইয়ারকি – চালানো? কিন্তু সে-দিন আর নেই। ভুরু কুচকিয়ে বললাম, ‘পথ ছাড়ো’। ‘কেন?’ ‘তোমার বাবার সাথে একটু কাজ আছে। ‘জরুরি – কাজ’। ‘বাবা বাড়িতে নেই।’ ‘নাই? কোথায় গেছে? আসবে কখন? চুলগুলো ঝাকড়া করে ছেড়ে দিয়ে আবার বেঁধে নিলো খোঁপা। এতোদিনে অনেক বড় হয়েছে চুল, ছড়িয়ে পড়ে কোমর ছাড়িয়ে। সুগন্ধি তেলে নিবিড়। বারো বছরের মেয়ে দশহাতি শাড়িটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরায় চেহারায় বেশ একটা পাকামোর আদল ফুটে উঠেছে। তবু মানিয়েছে বেশ, লালপেড়ে শাড়ি।”

‘সৃষ্টি’: সৃষ্টি গল্পটি শিক্ষকজীবনকে অবলম্বন করে লিখেছেন। শিক্ষকজীবনে রয়েছে যেমন মুগ্ধতা, অনেক প্রাপ্তির গল্প, তেমনি রয়েছে অভাব-অনটন, না পাওয়া ও বৈষম্যের বিচিত্র কাহিনিও। একজন শিক্ষককে গ্রামীণ রাজনীতির পাতি নেতাদের আক্রোশে কীভাবে হেনস্তা, অপমানিত ও নির্যাতিত হতে হয়, সে-কাহিনিই এই গল্পে বিধৃত।

কয়লা কুড়ানো দল :  কয়লা কুড়ানো দল:-কয়লা কুড়ানো দলের গল্পে মার্কসবাদী আদলে শোষক -শোষিত স্পষ্ট হয়ে উঠে অনায়াসে। শোষিতের দলে দেখা যায় কয়লা কুড়ানো ছিন্নমূল মনু, সোনাভান, রুপভান,এবং টোকাই দলের দলপতি লালু, পদ্মামাসি ও পুলিশ সুবেদার আলী কনস্টেবল। শোষক দলে দেখা যায় স্টেশন মাস্টারকে যে কয়লা – কুড়ানো ছিন্নমূল টোকাই শ্রেণীর কাছ থেকে সুবেদার আলী কনস্টেবল এর মাধ্যমে ঘুষ না খেয়ে পারে না।

‘সুন্দরী’ সুন্দরী’: সুন্দরী সুন্দরী গল্পে চারশো ঘর প্রজা, তার মধ্যে আড়াইশো ঘরের বিরম্নদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করেছে নায়েব, বকেয়া খাজনা পরিশোধ না করার শাস্তিস্বরূপ প্রজাদের প্রতি এমন আচরণ; কিন্তু প্রজারা খাজনা দেবে না, গ্রামে কে বা কারা আগুন দেয়, পুলিশ চৌকি বসিয়ে আসামিকে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু কেউই স্বীকার করে না। সত্তর বছরের বুড়ি, যার এককালে একটা নাম ছিল ‘বুবি, সময়ের স্রোতে সে নাম কোথায় তলিয়ে গেছে, এখন ছেলেবুড়ো সবাই তাকে সুন্দরী বলে ডাকে। ‘সুন্দরী’ গল্পটি এই বুড়িকে কেন্দ্র করে বেড়ে উঠেছে, যার এককালে সবই ছিল, বাপ ছিল তার জাতচাষি, যেমন শক্তিশালী তেমনি সাহসী, সেবার আকালের বছর, শিলাবৃষ্টিতে জমিজমা সব ভেসে যায়, ইচ্ছে থাকলেও মহাজনের খাজনা দিতে পারেনি, কিন্তু মহাজন শুনবে না কোনো কথা, একটা ফ্যাসাদ বাধে। কিন্তু বাপ তার ওদের কাবু করতে পারেনি, বুকের ওপর শক্ত কাঠ রেখে সাতটি জোয়ান মানুষ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়, তারপর বেশিদিন আর বাঁচেনি বাপটা। সুন্দরীর সব কথা মনে পড়ে, সেই খাজনা নিতে এসেছে সেপাই, তাঁবু ফেলে গ্রামের মানুষকে রাত্রের অন্ধকারে ধরবে, কঠিন শাস্তি দেবে, কিন্তু সুন্দরী রাত্রের অন্ধকারে সব খবর পেয়ে যায়, গ্রামবাসীকে দূরে পাঠিয়ে দেয় এবং সে নিজের ঘরে থাকে, তারপর বাঁশের দরজা ভেঙে তিনজন তার ঘরে ঢুকলে সে তখন একটা পুলিশকে দায়ের কোপ মারে, মহাজনের চামচা শ্রেণির মানুষগুলো বলে ওঠে, এই বুড়িই সবকিছুর মূল। এর কারণেই গ্রামবাসী খাজনা দেয়নি। সুন্দরী যে নিজের ঘাড়ে সমসত্ম দোষ-অপরাধ নিল, তার কারণ সে নিজেই বিদ্রোহ করতে চেয়েছে, বাপের মৃত্যু তাকে কতটা রক্তাক্ত করেছে এখানে তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবেই মানুষ নিজের অধিকার-স্বাধিকার আন্দোলনে শরিক হয়। বাংলার মানুষ চিরকালই শ্রেণিবিন্যাস এবং ইংরেজ শাসন-শোষণের বিরম্নদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করেছে, দেশকে-জাতিকে জাগিয়ে তুলেছে, জোতদারের সঙ্গে সংঘর্ষ করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেমন এ-গল্পে ‘সুন্দরী’ হয়ে উঠেছে একটা প্রতীক, যার হাত ধরে বলিষ্ঠ হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ।

‘বৃষ্টি’ : ‘বৃষ্টি’ আলাউদ্দিন আল আজাদের একটি বিশিষ্ট গল্প। মানব মনের বিচিত্র রহস্য উদঘাটনের সাথে সাথে সমাজের স্বরূপও উন্মোচিত হয়েছে এ গল্পে। অসহায় নারী বিচারের সম্মুখিন হলে তাকেই নির্যাতন ভোগ করতে হয়। গাঁয়ের মৌলানা বৃষ্টি না হওয়ার কারণ হিসেবে বাতাসীর অবৈধ গর্ভই চিহ্নিত করেন। সাত আট মাস আগে স্বামী মারা গেছে। সে মামাতো ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকে। বাতাসী আর মামাতো ভাই রহিমদ্দি অপরাধী বিবেচিত হয়। হাজি কলিমুল্লাহ সমর্থন জানায়। অন্যদিকে হাজি কলিমুল্লাহ ষাট বছর বয়সে একুশ-বাইশ বছরের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রীকে ঘরে এনেছে। স্ত্রীকে সে কখনো কাছ ছাড়া করতো না। বাপের বাড়ি থেকে আনার জন্য কলিমুল্লাহ প্রথমপক্ষের ছেলে খালেদকে পাঠায়। খালেদ আর ছোট মা জোহরা সমবয়সি। চাঁদনি রাতে বাড়ি ফেরার সময় খালেদের সঙ্গ সুখ জোহরার উপাদেয় মনে হয়। হাহাকার ভরা হৃদয়ে বহুদিনের প্রতীক্ষিত অনেক আরামের এক পশলা বৃষ্টি হলো। সে রাতে অসহায় বাতাসী আর ম্যালেরিয়া ক্লিস্ট রহিমদ্দিনকে ফতোয়ার ফলে পঞ্চাশ ঘা জুতোর বাড়ি দিয়ে গ্রামছাড়া করে কলিমুল্লাহ বলল ‘আল্লাহ রহস্য।’ পরিতৃপ্ত জোহরা বৃষ্টিতে ভিজছে বলছে, ‘বছরের পয়লা বৃষ্টি ভিজলে খুব ভালো। এতে ফসল ফলবে।’ অসাধারণ এই গল্পটিতে লেখক নরনারীর যৌনতাকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত করেছেন। সমাজ বাস্তবতাকে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রূপ দিয়েছেন।

‘সমতল’ আলাউদ্দিন আল আজাদ কোনো কোনো গল্পে সমাজের শ্রেণিগত বিভেদ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ‘সমতল’ নামের গল্পটিতে এই শ্রেণির ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নবিত্ত শহরে জীবনের বিড়ম্বনা এর উপজীব্য। জীবনের একই সমতলে বাস করে রশিদ করিম গফুর সালাম আর জমির। তারা পরস্পর কোনো না কোনো কারণে ঋণী। ঋণ শোধ করতে না পারার জন্য নানারকম ছলনার আশ্রয় নেয়। তাদের কারো মনে অন্যের প্রতি সহানুভূতি জন্মালেও স্ত্রীর বাধার জন্য তা কোনো উপকারে আসে না। তারা নিয়তির এমন বাঁধনে আটকে গেছে যা ছিন্ন করা যায় না। এদেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ছবি এভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।

‘কবি’ : ‘কবি’ নামক গল্পে সাম্যবাদের ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে। আবু মহসিন একজন কবি ও প্রেমিক। কিন্তু প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে সে কবির মানসিকতা নিয়ে বিচ্ছেদ সহ্য করে। কবি তার হৃদয়ে বেদনা কবিতা নিয়ে প্রকাশকের কাছে যায়। কবিতার কোনো বাজার নেই বলে প্রকাশক তাকে ফিরিয়ে দেয়। সে তখন খবরের কাগজের হকার হয়। মুয়াজ্জিনের জীর সাথে মহসিনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু প্রেম আর কবিতা তার জীবনে কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। সে সংবাদপত্র হকার সমিতি গঠন করে শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেয়। এই গল্পে লেখক সূক্ষ্ম কৌশলে সাম্যবাদের কথা বলেছেন। ভি:- মৃগনাভি’ গল্পগ্রন্থের ‘ছাতা’ নামক গল্পে মধ্যবিত্ত মানুষের পিতৃস্নেহের স্বরূপ ব্যক্ত হয়েছে

‘ছাতা’ : ‘মৃগনাভি গল্প গ্রন্থের ছাতা নামের একটি ছাতাকে রূপক হিসেবে বিবেচনা করে সংসার চিত্র উদঘাটন করা হয়েছে। সংসারে স্বামী ছাতার মতোই বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে। কাজে কর্মে বসতে শুতে তার কেবলি মনে হয় সংসার-ধর্মে স্বামী একটা ছাতা বিশেষ, যে সুদিনে দুর্দিনে ছেলে পুলে বৌকে ছায়া প্রদান করে, ঝড়বৃষ্টি রোদের হাত থেকে বাঁচায়।’ তাই রোকেয়া ছেলের স্কুলে যাওয়ার চেয়ে স্বামীর অফিসে যাওয়ার বেশি প্রয়োজনীয়তা মনে করে। রোকেয়া বানু দেখে যে ছাতাটি পিতৃস্নেহের আধিক্যে পুত্রের কাজে লেগেছে, স্বামীর উপকারে লাগেনি তখন সে আর্তনাদ করে উঠে। সংসারের জন্য স্বামীই ছাতা ব্যবহার করে। মধ্যবিত্ত জীবনের দুর্দশা, পিতৃস্নেহের আধিক্য, সংসারের জন্য স্ত্রীর উৎকণ্ঠা গল্পটিকে মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছে।

পরী : কাজের মেয়ে পরীকে মৃতা স্ত্রীর পাঁচ ভরি ওজনের হার দিয়ে বশীভূত করে। কিন্তু অথর্ব ধনু মোল্লার জন্য পরী তাকে বুইড়া বলে ফেলে চলে যায়। যৌবন অতিক্রান্ত মানুষ কিভাবে বিড়ম্বনার শিকার হয় তা এ গল্পে দেখানো হয়েছে।

আলাউদ্দিন আজাদ ছিলেন “মার্ক্সীয়” ধারার গল্পকার

তিনি ছিলেন গল্পকার ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, গবেষক। তিনি ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ও ছিলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের দিনলিপি নিয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণের আলোকে রচনা করেন ‘ফেরারী ডায়েরী।”তার গল্পে যেমন আছে মার্ক্সীয় ধারা তেমনি কবিতায়ও পাই মার্কসবাদী চেতনা ও সংগ্রামী মনোভাব — স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো; / চারকোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো! যে-ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে হীরার মুকুট নীল পরোয়া খোলা তলোয়ার/ খরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে-পদপ্রান্তে / যারা বুনি ধান / গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই, সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য। / ইটের মিনার/ ভেঙেছে ভাঙুক, ভয় কি, বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী / চারকোটি পরিবার।

তার লেখায় মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্র:- আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পে মার্ক্সবাদী চেতনার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে হলে মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের পেক্ষাপট জানা জরুরী। জন কার্লমার্কস তার “ডাস কেপিটাল” গ্রন্থে কমিউনজমের তত্ব দেন।সাম্যবাদ, সোসালিজম, মার্কসবাদ এক সময় পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের পূজিত ছিলো। এখনও তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। সোভিয়েত সম্রাজ্যের মতো রাষ্ট্র ব্যবস্থার মার্ধ্যমে যেমন মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় তেমনি ব্যক্তি বা সমাজেও তার চর্চা করে পূজিবাদের বিপরীতে সামাজিক ভারসাম্য বিধান করা যায়। আলা উদ্দীন আল আজাদ সাহিত্যিক হিসেবে যেমন প্রতিভাধর তেমনি তার মার্কসবাদী আদর্শের লেখাগুলোও প্রশংসাযোগ্য।

যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধাদের নিয়ে লেখা :  মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধের করুণ জীবন নিয়ে তিনি বেশ কিছু গল্প ও প্রবন্ধ লিখে সাড়া ফেলে দিয়ে ছিলেন। আজ মুক্তিযোদ্ধারা যে পরিমাণে সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, তার পেছনে আলাউদ্দিন আল আজাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন স্বোচ্ছার। নিজ অধিকার আদায়ে সাধারণ মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। অপশক্তির করাল গ্রাসে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ কর্মী। উনার ক্ষুরধার লেখনী ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য বিভিন্ন সময় অপশক্তির সমালোচনা ও হুমকির মুখে পড়েও পিছিয়ে আসেননি। তিনি তার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল।

সমাজতন্ত্র ও শ্রেণী চেতনা : সমাজতন্ত্র ও শ্রেণী চেতনা তার গল্পের প্রধান বিষয়। গ্রামীণ জীবন, সমাজ, সেই সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিচয় তার সাহিত্যে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ধর্মান্ধতা কতোটা শেকড় বিস্তার করে আমাদের সমাজ জীবনকে অতিষ্ঠ করেছে এবং সেখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা কতোটা সংকীর্ণ, সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশের গল্প তুলে ধরেছেন। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে যেমন জানিয়েছেন, পাশাপাশি ধনী-গরিবের আকাশ-পাতাল বৈষম্যের কথা উপস্থাপন করেছেন। মার্কসীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ আজাদ বলেছিলেন, ‘সেখান থেকে আর কোনো নিস্তার নেই, যদি না সমাজতন্ত্র আসে। করুণা নয়, ভিক্ষা নয়, ফিতরা-জাকাত নয়, চাই ফসলের ন্যায্য অধিকার, সম্পদের সুষম বণ্টন, তখনই হবে বন্ধুত্ব-ভ্রাতৃত্ব, সমাজে ফিরে আসবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি। কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়, বড় নয়, মানুষ হবে মানুষের মতো। মানুষ পাবে বাঁচার অধিকার, প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতা। বদলে যাওয়া সেই সমাজে সব কুসংস্কার-ধর্মান্ধতা বিলীন হবে, মানুষ বাঁচবে মানুষের ভালোবাসায়, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে গাইবে সাম্যের গান। তাই তো চাই সমাজতন্ত্র।

তার যেসব গল্পে মার্কসবাদী আদলে রচিত তার কয়েকটির সার সংক্ষেপ নিম্নরুপ :

‘মাঝি’ : ‘মাঝি’ নামক গল্পের একটু পরিচয় তুলে ধরা যাক — ‘ঘুটঘুটে অন্ধকারে তিনটে লোক এলো ভূঁইয়া বাড়ির সামনে, একটু দাঁড়ালো এরপর আরেকটু এগিয়ে এলো, বাংলাঘরের বারান্দায় কি একটা ভারী বস্তু কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে বর্ষণের মধ্যে আবার অন্ধকারেই মিলিয়ে গেলো।’ ‘মাঝি’ গল্পে এভাবেই পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে, নৌকার মাঝি জহর আলীকে তার ন্যায্য পারানির পয়সা দেয়নি ভূঁইয়া, আড়তের গদিতে চাইতে গিয়েছিল। মানুষের সামনে চাওয়ার কারণে ইজ্জত চলে যায় এবং সে কারণে জুতো খুলে ঘাড়ে-গর্দানে বেশ কয়েক ঘা বসিয়ে দেয় ভূঁইয়া, তা বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা; কিন্তু সে শোধ তুলেছিল তিন বাপ-ব্যাটায়, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে মাঝরাতে যখন নৌকায় চড়ে বাড়ি ফিরছিল, সেই পুরনো দগদগে ঘায়ের স্মৃতি স্মরণে আসে। নিম্নবিত্ত মানুষেরা কখনো-কখনো যখন প্রচ- ঝাঁকুনি বা আঘাত করে বসে তখন কিন্তু সামলানো কঠিন, কাউকে ছোট-বড় জ্ঞান করা সমীচীন নয়, এভাবেই মানুষ প্রতিবাদ করে, প্রতিবাদী মানুষের চেহারা তখন ভয়াবহতার রূপ পায়, কারণ সে কোনোভাবে বাঁচার জন্য জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ, তার কাছে ইজ্জত-সম্মান যেমন, ঠিক তেমনি পয়সাটাও কোনো অংশে কম নয়, যার যেমন অধিকার এবং যার-যার পাওনা বুঝিয়ে দেওয়াটাই রীতি, কিন্তু কেউ যদি কারোটা মেরে খায় তার তো পরিণাম ভালো হওয়ার নয়, এভাবেই লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। মনে রাখতে হবে, জমিদারের দারের দশদিন আর গেরসেত্মর একদিনে অন্ধকারেই খতম।

‘আঁতুড়ঘর’ : আঁতুড়ঘর’গল্পটা দেখুন, মানুষ সম্পর্কে মানুষের কী বিচার। আঁতুড়ঘর’ গল্পে মানুষের ভেতরের মানুষকে দেখার যে আকাঙক্ষা তা বেশ ফুটে উঠেছে, আমাদের সমাজের কতিপয় মানুষ আছে, জানি না তারা আবার কতটা মানুষের মর্যাদা পাবে, তারা মানুষের চেয়েও কুকুরকে বেশি মর্যাদা দেয়, হয়তো তারা কুকুরের বংশভূত, কিন্তু মানুষ যে আশরাফুল মাখলুকাত। গল্পে দেখা যায় পথভিখারি অন্ধ সলিমদ্দি এবং তার সাত-আট বছরের ছেলে হাসু ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সমত্মানসম্ভবা বউ রহমজানকে নিরাপদ একটা স্থানে নিয়ে আসে, এবং পরক্ষণে সমত্মান প্রসব করে, কুকুরের থাকার জায়গাটাকে নিরাপদ স্থান ভেবে বাছাই করলেও প্রকৃতপক্ষে তা নিরাপদ নয়। বিপত্তি বাধে যখন ছেলের সংবাদ শুনে সলিমদ্দি আজান দেয়, বাড়ির সব কাজের লোক-দারোয়ান-ড্রাইভার থেকে সাহেব পর্যমত্ম ছুটে আসে, কিন্তু সাহেব ভালোভাবে নেয়নি, চাকরদের হুকুম করেন, আগামীকাল সকালে আপদগুলোকে বাইরে রাস্তায় সরিয়ে দিতে, ‘যত্তোসব রাবিশ, শুয়োরের বাচ্চারা বিয়োবার আর জায়গা পায় না…’ মানুষ যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা এ-গল্পে দেখতে পাওয়া যায়। সলিমদ্দি-রহমজানরা আজ রাস্তায় পড়ে থেকে ভিক্ষা করে খায়, কিন্তু তাদেরও একটা সুন্দর জীবন ছিল, মাটি দিয়ে নিকোনো আর ছন দিয়ে ছাওয়া দুটো ছোটঘর, দুই কানি জমি, একটা তাঁত ও হাঁস-মুরগি নিয়ে নিরিবিলি সংসার, খালপাড়ের জমিরআল নিয়ে দেওয়ান বাড়ির সঙ্গে কাইজা বেঁধে যায়, একজনের মাথা ফাটে, ফৌজদারি মামলায় ফতুর হয় বাপ, তারপর মামলা চালাতে বেচতে-বেচতে জীবন শেষ, আজ সবই স্মৃতি, রাস্তা-ফুটপাত আর পরের বাড়ি বা দোকানের সামনের খালি জায়গাটুকুই হলো তাদের আশ্রয়, জীবনের পরিসমাপ্তি এখানেই, কিন্তু মানুষের মানবতাবোধ নষ্ট হয়ে গেছে, কুকুর আর মানবসমত্মানের মধ্যে আর কোনো ফারাক নেই।

১৫। ‘সুন্দরী সুন্দরী’ : ‘সুন্দরী সুন্দরী’ গল্পে চারশো ঘর প্রজা, তার মধ্যে আড়াইশো ঘরের বিরম্নদ্ধে আদালতে মামলা রম্নজু করেছে নায়েব, বকেয়া খাজনা পরিশোধ না করার শাস্তিস্বরূপ প্রজাদের প্রতি এমন আচরণ; কিন্তু প্রজারা খাজনা দেবে না, গ্রামে কে বা কারা আগুন দেয়, পুলিশ চৌকি বসিয়ে আসামিকে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু কেউই স্বীকার করে না। সত্তর বছরের বুড়ি, যার এককালে একটা নাম ছিল ‘বুবি’, সময়ের স্রোতে সে নাম কোথায় তলিয়ে গেছে, এখন ছেলেবুড়ো সবাই তাকে সুন্দরী বলে ডাকে। ‘সুন্দরী’ গল্পটি এই বুড়িকে কেন্দ্র করে বেড়ে উঠেছে, যার এককালে সবই ছিল, বাপ ছিল তার জাতচাষি, যেমন শক্তিশালী তেমনি সাহসী, সেবার আকালের বছর, শিলাবৃষ্টিতে জমিজমা সব ভেসে যায়, ইচ্ছে থাকলেও মহাজনের খাজনা দিতে পারেনি, কিন্তু মহাজন শুনবে না কোনো কথা, একটা ফ্যাসাদ বাধে। কিন্তু বাপ তার ওদের কাবু করতে পারেনি, বুকের ওপর শক্ত কাঠ রেখে সাতটি জোয়ান মানুষ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়, তারপর বেশিদিন আর বাঁচেনি বাপটা। সুন্দরীর সব কথা মনে পড়ে, সেই খাজনা নিতে এসেছে সেপাই, তাঁবু ফেলে গ্রামের মানুষকে রাত্রের অন্ধকারে ধরবে, কঠিন শাস্তি দেবে, কিন্তু সুন্দরী রাত্রের অন্ধকারে সব খবর পেয়ে যায়, গ্রামবাসীকে দূরে পাঠিয়ে দেয় এবং সে নিজের ঘরে থাকে, তারপর বাঁশের দরজা ভেঙে তিনজন তার ঘরে ঢুকলে সে তখন একটা পুলিশকে দায়ের কোপ মারে, মহাজনের চামচা শ্রেণির মানুষগুলো বলে ওঠে, এই বুড়িই সবকিছুর মূল। এর কারণেই গ্রামবাসী খাজনা দেয়নি। সুন্দরী যে নিজের ঘাড়ে সমসত্ম দোষ-অপরাধ নিল, তার কারণ সে নিজেই বিদ্রোহ করতে চেয়েছে, বাপের মৃত্যু তাকে কতটা রক্তাক্ত করেছে এখানে তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবেই মানুষ নিজের অধিকার-স্বাধিকার আন্দোলনে শরিক হয়। বাংলার মানুষ চিরকালই শ্রেণিবিন্যাস এবং ইংরেজ শাসন-শোষণের বিরম্নদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করেছে, দেশকে-জাতিকে জাগিয়ে তুলেছে, জোতদারের সঙ্গে সংঘর্ষ করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেমন এ-গল্পে ‘সুন্দরী’ হয়ে উঠেছে একটা প্রতীক, যার হাত ধরে বলিষ্ঠ হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ।

১৬। ‘বৃষ্টি’ : ‘বৃষ্টি’ আলাউদ্দিন আল আজাদের একটি বিশিষ্ট গল্প। মানব মনের বিচিত্র রহস্য উদঘাটনের সাথে সাথে সমাজের স্বরূপও উন্মোচিত হয়েছে এ গল্পে। অসহায় নারী বিচারের সম্মুখিন হলে তাকেই নির্যাতন ভোগ করতে হয়। গাঁয়ের মৌলানা বৃষ্টি না হওয়ার কারণ হিসেবে বাতাসীর অবৈধ গর্ভই চিহ্নিত করেন। সাত আট মাস আগে স্বামী মারা গেছে। সে মামাতো ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকে। বাতাসী আর মামাতো ভাই রহিমদ্দি অপরাধী বিবেচিত হয়। হাজি কলিমুল্লাহ সমর্থন জানায়। অন্যদিকে হাজি কলিমুল্লাহ ষাট বছর বয়সে একুশ-বাইশ বছরের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রীকে ঘরে এনেছে। স্ত্রীকে সে কখনো কাছ ছাড়া করতো না। বাপের বাড়ি থেকে আনার জন্য কলিমুল্লাহ প্রথমপক্ষের ছেলে খালেদকে পাঠায়। খালেদ আর ছোট মা জোহরা সমবয়সি। চাঁদনি রাতে বাড়ি ফেরার সময় খালেদের সঙ্গ সুখ জোহরার উপাদেয় মনে হয়। হাহাকার ভরা হৃদয়ে বহুদিনের প্রতীক্ষিত অনেক আরামের এক পশলা বৃষ্টি হলো। সে রাতে অসহায় বাতাসী আর ম্যালেরিয়া ক্লিস্ট রহিমদ্দিনকে ফতোয়ার ফলে পঞ্চাশ ঘা জুতোর বাড়ি দিয়ে গ্রামছাড়া করে কলিমুল্লাহ বলল ‘আল্লাহ রহস্য।’ পরিতৃপ্ত জোহরা বৃষ্টিতে ভিজছে বলছে, ‘বছরের পয়লা বৃষ্টি ভিজলে খুব ভালো। এতে ফসল ফলবে।’ অসাধারণ এই গল্পটিতে লেখক নরনারীর যৌনতাকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত করেছেন। সমাজ বাস্তবতাকে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রূপ দিয়েছেন।

১৭। ‘সমতল’ আলাউদ্দিন আল আজাদ কোনো কোনো গল্পে সমাজের শ্রেণিগত বিভেদ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ‘সমতল’ নামের গল্পটিতে এই শ্রেণির ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নবিত্ত শহরে জীবনের বিড়ম্বনা এর উপজীব্য। জীবনের একই সমতলে বাস করে রশিদ করিম গফুর সালাম আর জমির। তারা পরস্পর কোনো না কোনো কারণে ঋণী। ঋণ শোধ করতে না পারার জন্য নানারকম ছলনার আশ্রয় নেয়। তাদের কারো মনে অন্যের প্রতি সহানুভূতি জন্মালেও স্ত্রীর বাধার জন্য তা কোনো উপকারে আসে না। তারা নিয়তির এমন বাঁধনে আটকে গেছে যা ছিন্ন করা যায় না। এদেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ছবি এভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।

আবু জাফর রেহমান, শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী, সহকারী সম্পাদক, মাসিক ফটিকছড়ি। চট্টগ্রাম।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন