সোমবার | ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৩১
Logo
এই মুহূর্তে ::
ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘বিকাশের বিয়ে’ গরমের সময়ে চোখের যত্ন না নিলে অন্ধত্ব এবং ক্যানসারের ঝুঁকিও থাকে : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর সেকাল একাল : দীপাঞ্জন দে

দীপাঞ্জন দে / ৬৮৯৮ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০২২

বাংলায় দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো হয় দুর্গাপুজোর ঠিক একমাস পর, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো এবং হুগলি জেলার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো খুবই বিখ্যাত। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আলোকসজ্জা যেমন বিশেষভাবে নজর কাড়ে, তেমনি কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রতিমা দর্শনার্থীদের হৃদয় জয় করে। করবে নাইবা কেন? বিশ্বের দরবারে কৃষ্ণনগর যে তার মৃৎশিল্পের জন্যই প্রসিদ্ধ। তবে বর্তমানে জগদ্ধাত্রী প্রতিমার পাশাপাশি কৃষ্ণনগরের ক্লাব বারোয়ারিগুলির হরেক রকম ‘থিম’ দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে। ২০২২ সালের জগদ্ধাত্রী পুজোতেই যেমন প্যারিসের আইফেল টাওয়ার থেকে শুরু করে চারধাম, দিল্লির লালকেল্লা, আগ্রা ফোর্ট, পুরীর জগন্নাথ মন্দির, রোমের থ্রেভি ফাউন্টেন, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী, নারায়ণ দেবনাথের কার্টুন — সবই দেখতে পাওয়া যায়। তবে শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর এবং চন্দননগর এই দুটি জায়গায় জগদ্ধাত্রী পুজো হয় মনে করলে ভুল হবে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কমবেশি জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। নদিয়া জেলার কথাই যদি বলি তবে শান্তিপুর ও তেহট্টর জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। ইতিমধ্যে এই দুটি জায়গার জগদ্ধাত্রী পুজো বেশ চর্চিত। এছাড়াও দোগাছি, রানাঘাট, নবদ্বীপ, কল্যাণী, ভান্ডারখোলা, দইয়ের বাজার, বেতাই, করিমপুরের আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে থাকে।

“ওঁ দূং শ্রীশ্রীমজ্জগদ্ধাত্রীদুর্গায়ৈ নমঃ”— জগতকে যিনি ধারণ করেন তিনিই জগদ্ধাত্রী। তিনি হলেন জগৎপালিকা। নীলকণ্ঠ শিব হলেন তাঁর সঙ্গী। দুর্গারই আরেকটি রূপ হলেন জগদ্ধাত্রী। তিনি সিংহবাহিনী, ত্রিনয়নী। জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড (করীন্দ্রাসুর) থাকে। বলা হয়— সিংহবাহিনীর সিংহ হাতিকে জব্দ করে রেখেছে। আসলে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তীরূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামেও পরিচিত। জগদ্ধাত্রী হলেন চতুর্ভুজা। তাঁর চার হাতে চারটি অস্ত্র দেখতে পাওয়া যায়— শঙ্খ, ধনুক, চক্র এবং বাণ। বামদিকের দুটি হাতে যথাক্রমে শঙ্খ ও ধনুক। আর ডান দিকের দুটি হাতে যথাক্রমে চক্র এবং বাণ। জগদ্ধাত্রী হলেন ব্রহ্মাণ্ড পালিকা। দেবীর হাতের অস্ত্রগুলি তাঁর শক্তির প্রতীক। ডান দিকের উপরের হাতে রয়েছে চক্র, যা ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক এবং দেবীর অঙ্গুলিহেলনে সর্বদা ঘূর্ণায়মান। নিচের হাতটিতে রয়েছে বাণ, যা হল মানুষের লক্ষ্য প্রাপ্তি এবং সমাজ কল্যাণের কাজে উদ্ভূত হয়। দেবীর বামদিকের উপরের হাতে রয়েছে শঙ্খ, যা শব্দের প্রতীক। এই শব্দই হল নাদ, আর নাদই হল ব্রহ্ম। নিচের হাতে রয়েছে ধনুক, যা অসীম চৈতন্যশক্তির প্রতীক—

ওঁ দূং সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।

চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।

শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তাং-বামপাণিদ্বয়ান্বিতাং।

চক্রঞ্চ পঞ্চবানাঞ্শ্চ ধারয়েতঞ্চ দক্ষিণে।।

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয় আকর্ষণের কেন্দ্রে যারা থাকেন— কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির ঐতিহ্যমন্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজো, রায়বাড়ির সাবেকি জগদ্ধাত্রী প্রতিমা, চাষাপাড়া বারোয়ারির বুড়িমা, নুড়ি পাড়া বারোয়ারির চার দিনী মা, মালোপাড়া বারোয়ারির পুজো, পাত্র বাজার স্বীকৃতি ক্লাবের পুজো, বউবাজার বারোয়ারি, রায়পাড়া মালিপাড়া বারোয়ারি, ঘূর্ণি দাসপাড়া বারোয়ারি, শিবতলা বারোয়ারি, বাগদী পাড়ার পুজো, কালীনগরের রেনবো ক্লাব, শক্তিনগরের পাঁচমাথা মোড় বারোয়ারি, শক্তিনগরের এমএনবি ক্লাব, গোলাপটি বারোয়ারি, ক্লাব প্রীতি সম্মিলনী, ক্লাব প্রতিভা, চকের পাড়া বারোয়ারি প্রভৃতির মতো আরো অনেক ক্লাব বারোয়ারির নাম এই তালিকায় রাখা যায়।

কৃষ্ণনগরের অন্যতম বিখ্যাত পুজো হল চাষা পাড়ার বুড়িমা। ২০২২ সালে বুড়িমার পুজো ঘিরে উন্মাদনা যেন বিগত বছরগুলিকে ছাড়িয়ে গেছে। পুজো কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী এ বছর হল বুড়িমার সার্ধ দ্বিশতবর্ষ। সেই ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে পুজো উদ্যোক্তারা এই বছর আয়োজনও করেছেন সেই মাত্রায়। বুড়িমার অলংকার প্রতিবছর দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেজন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। এবছর বুড়িমার অলংকারের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পূজার্থীদের বিশ্বাস বুড়িমা খুবই জাগ্রত। ফি-বছর হাজারে হাজারে মানুষ বহু দূর-দূরান্ত থেকে বুড়িমাকে দর্শন করতে আসেন। এ বছরও ব্যতিক্রম নয়। নবমীর সকাল থেকেই চাষা পাড়ার বুড়িমাকে দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে। পুজো প্যান্ডেলের সামনে থেকে দর্শনার্থীদের প্রায় এক কিলোমিটার লাইন দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চাষা পাড়ার বুড়িমার বয়স যদি ২৫০ বছর বলা হয়, তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কালেই (১৭২৮-১৭৮২ খ্রি.) এই পুজোর সূচনা হয়েছিল ধরতে হবে। যে বিষয়টি অবশ্যই আলোচনাসাপেক্ষ।

জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস অনুসন্ধান করার কাজটি বেশ দুরূহ। ঐতিহাসিক তথ্যের অভাব এতটাই যে, অনেক ক্ষেত্রেই অনুমানভিত্তিক আলোচনা করতে হয়। কিছু প্রশ্ন অমীমাংসই থেকে যায়। বহুল প্রচলিত একটি মত হল অষ্টাদশ শতকে নদিয়া-রাজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে জগদ্ধাত্রী পুজোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তিনি কৃষ্ণনগরে প্রথম এই পুজোর প্রচলন করেন। তারপর থেকেই এর প্রসার। যদিও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আগেও দেবী জগদ্ধাত্রী বাঙালি সমাজে অপরিচিত ছিলেন না। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে শূলপাণি কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ করে গেছেন। এছাড়া খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া গেছে পূর্ববঙ্গের বরিশালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে সেটি রক্ষিত রয়েছে। নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দিরের গাত্রে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি রয়েছে। শান্তিপুরের এই মন্দিরটি কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের অনেক আগেই নির্মিত হয়। অনুমান নদিয়া-রাজ রুদ্র রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র রামকৃষ্ণের জননী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন, আরেকটি মত হল নদিয়া-রাজ রাঘব রায় এটি প্রতিষ্ঠা করেন। আরেকটি মন্দির হল রাঘবেশ্বর শিবমন্দির, যার গাত্রেও জগদ্ধাত্রীর মূর্তি পরিলক্ষিত হয়। শান্তিপুরের অনতিদূরে দিগনগরে কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ মহারাজা রাঘব রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠালিপি থেকে জানা যায় যে, এই মন্দিরটি ১৫৯১ শকাব্দে (অর্থাৎ ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে) নির্মিত হয়েছিল। সুতরাং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে থেকেই বাংলায় দেবী জগদ্ধাত্রী পরিচিত ছিলেন। তাই আমরা মনে হয় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তকের ভূমিকায় না রেখে প্রচারকের ভূমিকায় রাখলে বিষয়টি অধিক ন্যায়সঙ্গত হবে।

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জগদ্ধাত্রী আরাধনা সম্পর্কে যে লোকশ্রুতিটি প্রচলিত রয়েছে, সেটি হল— বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ-র রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই নজরানা দিতে অপারগ হন। অতঃপর নবাবের বাহিনী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে (মতান্তরে মুঙ্গেরে) নিয়ে যায়। এর কয়েক মাস পর কৃষ্ণচন্দ্র মুক্তি লাভ করে নদীপথে কৃষ্ণনগরে ফিরছিলেন। সেই সময় নদীঘাটে তিনি বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে বুঝতে পারেন যে, সেই বছর দুর্গাপুজোর কাল উত্তীর্ণ হয়েছে। এই বিষয়টি মহারাজাকে বিশেষভাবে ব্যথিত করে। সেই রাতেই দেবী দুর্গা জগদ্ধাত্রী রূপে মহারাজার স্বপ্নে আবির্ভূত হন এবং তাঁকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পুজো করার আদেশ দেন। দেবীর আদেশ পেয়ে সেই বছরই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো করেন। অনুমান কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো হওয়ার সালটি ছিল ১৭৫২ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তবে এক্ষেত্রে আরেকটি মতও রয়েছে যে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আলীবর্দী খাঁ নয়, নবাব মীর কাশিমের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরছিলেন। উল্লেখ্য, নবাব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের দলে ছিলেন জগৎ শেঠ, যাঁর আবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। মসনদে বসার পর তাই স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাশিম সেই ক্ষমতাচক্রকে ভাঙতে উদ্যোগী হন। তিনি ১৭৬৩ সালে জগৎ শেঠকে হত্যা করেন। কৃষ্ণচন্দ্রকেও বন্দী করে তাঁর নতুন রাজধানী মুঙ্গেরে নিয়ে যান। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদান্যতায় কৃষ্ণচন্দ্র মুক্তি পান। অর্থাৎ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক জগদ্ধাত্রী পুজো সূচনার ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়কাল পাওয়া যাচ্ছে।

হুগলির চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলনের পশ্চাতেও কৃষ্ণনগরের যোগসূত্রতা রয়েছে। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক হিসেবে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর নামটি সামনে আসে। ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অতি ঘনিষ্ঠ। তিনি ছিলেন ফরাসি সরকারের দেওয়ান। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। তবে এখানে একটি গরমিল রয়েছে, সেটি হল— কৃষ্ণনগরে যদি জগদ্ধাত্রী পুজো প্রবর্তিত হয়েছিল ধরা হয় ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের পরে কোনো এক সময়, তাহলে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী তখন তো জীবিতই ছিলেন না। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দেই তিনি প্রয়াত হন। তাহলে কিভাবে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন করলেন? এ প্রশ্নটিও থেকে যায়।

আবার এমনও মনে করা হয় যে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র রাজা গিরীশচন্দ্র রায় (১৮০২-১৮৪১ খ্রি.) জগদ্ধাত্রী পুজো প্রবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। রাজা গিরীশচন্দ্র নদিয়ার শান্তিপুরের কাছে ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণ পরিবারকে স্থাপন করে একটি গ্রামের পত্তন করেন, সেই গ্রামের নাম হয় ব্রাহ্মশাসন। সেই গ্রামের তন্ত্রসাধক চন্দ্রচূড়ের সাধনায় পাওয়া যায় দেবী জগদ্ধাত্রীর বর্ণনা। সালটি ছিল অনুমান ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ। রাজা চন্দ্রচূড়কে রাজসভায় থাকার জন্য অনুরোধ জানান এবং সেই সময় ঊষাকালে প্রথম বার জগদ্ধাত্রীর মূর্তি গড়ে কামরাঙা গাছের নীচে পঞ্চমূণ্ডির আসনে পুজো করা হয়। এর পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয় বলে অনুমান। সুতরাং জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন এবং বিস্তার সম্পর্কে একাধিক মত রয়েছে। আর সেগুলি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকরও বটে। এবিষয়ে আমাদের আরো বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।

লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।


আপনার মতামত লিখুন :

6 responses to “কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর সেকাল একাল : দীপাঞ্জন দে”

  1. MOUSUMI says:

    তথ্যপূর্ণ লেখা।পড়ে ভালো লাগল।

  2. TANMOY DEY says:

    খুব ভালো লাগলো

  3. দীপাঞ্জন দে says:

    জেনে ভালো লাগলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন