মঙ্গলবার | ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৬:৫১
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (অষ্টম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন স্বর্গলোকে মহাত্মা ও গুরুদেবের সাক্ষাৎকার : সন্দীপন বিশ্বাস বই ছাপানো নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড : সাইফুর রহমান শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘শান্তিগন্ধা’ বিজেপির প্রভাবেই কি নির্বাচন কমিশনের আচমকা ভোট বৃদ্ধি : তপন মল্লিক চৌধুরী শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষষ্ঠ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নগ্ন নৃত্যে বাংলায় বৃষ্টির ব্রত – পুণ্যিপুকুর, হুদুম দেও, ব্যাঙের বিয়ে : রিঙ্কি সামন্ত শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন বিজন প্রাণের প্রাঙ্গণে : সন্দীপন বিশ্বাস বিভূতিভূষণের পান্ডুলিপি — ‘পথের পাঁচালী’ : সবিতেন্দ্রনাথ রায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্থ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (শেষ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের বিদেশি ফটোগ্রাফার : দিলীপ মজুমদার দর্শকের অগোচরে শুটিং-এর গল্প : রিঙ্কি সামন্ত রশ্মির নাম সত্যজিৎ “রে” … : যীশু নন্দী হুগলিতে মাধ্যমিকে চতুর্থ ও দশম উল্লেখযোগ্য ফলাফলে নজর কাড়ল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (তৃতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (ষষ্ঠ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের স্প্যানিশ ফ্লু হয়, পেরুযাত্রার সময় : অসিত দাস গাইনোকলজি ও গাইনি-ক্যান্সারে রোবোটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারীর ভূমিকা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ছোটগল্পকার আলাউদ্দীন আল আজাদ : আবু জাফর রেহমান শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (পঞ্চম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাতি ফোলালেও আম জনতাকে ভোট কেন্দ্রে টানতে পারেননি : তপন মল্লিক চৌধুরী আলুর দামে রাশ টানতে না পারলে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বাংলার হস্তশিল্প (পর্ব এগারো), পাটের পুতুল, বাঁশের কাজ, হ্যাজাক, কাঁশা-পিতল : বিশ্বেন্দু নন্দ

বিশ্বেন্দু নন্দ / ১১৬৭ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

নদীয়া

প্রায়-বাংলাদেশে চলে যাওয়া এই জেলার সদর ছিল একদা বাংলার রাজধানী কৃষ্ণনগর। পলাশী চক্রান্ত সংগঠনের অন্ততম চরিত্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর রাজত্ব শহুরে বাঙালির জীবনে বড় মোড়। শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায় – এমন এক মানুষ জন্মেছিলেন এই সহস্রাব্দে বাংলায় এই জেলায় যিনি শুধু বাংলাই নয় বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান নায়ক – নিজে কোনও কথা না বলে এক কলমও না লিখে মহাবতার – যে যুগে টিভিসংবাদপত্রবেতার নেই, সেই যুগেই মাত্র ২৯ বছর বয়সেই বাংলার সাধারণের হৃদয়েশ্বর – বাংলার তাবড় তাবড় ধনী মানুষ তাঁর ডাকে অতুল ঐশ্বর্য ছেড়ে আসছেন শুধু তার আনুগামী হওয়ার জন্য – যিনি ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রথম রাজনৈতিক মিছিল করেছিলেন হরে কৃষ্ণ স্লোগানে কাজীর বিরুদ্ধে। কয়েক হাজার বছর ধরে যে নীল বিশ্ব জয় করেছে, যে নীলের ব্যবসায়িক নাম হয়েগিয়েছিল যে দেশে সে জন্মায় সেই দেশের নামে ইন্ডিগো, এই জেলায় আবদান। আজ কলকাতায় যে বালিগঞ্জীয় উচ্চারণে কথা বলি সেটি নবদ্বীপীয়া বাংলা। এই শহরের একটু পুরোনো যে কোনও সাধারণ মানুষের বাংলা উচ্চারণ শুনলে শুধু থ নয় ত থেকে দ-য়ের মধ্যে যে কোনও কিছু হয়ে যেতে পারেন।

কৃষ্ণনগরের ঘুর্ণির মাটির পুতুল একদা বিশ্বজয় করেছিল। বাংলার গ্রাম শিল্প-এর ইতিহাসে খুব পুরোনো নয়, কিন্তু বাস্তবতায় ভাস্বর। বাংলার গ্রাম শিল্পের কোনও পুতুলই বাস্তবতার কাছাকাছি নয়, তাঁকে একটু বেঁকিয়ে চুরিয়ে তার ভেতরের স্বভাবকে বার করে আনার চেষ্টা করেছেন শিল্পী গোষ্ঠী। কিন্তু কৃষ্ণনগর সবার আলাদা। যে জিনিসটি তৈরি করবে, তা যেন স্বাভাকিকের থেকে স্বাভাবিক। শোনা যায় মাটির তৈরি ফলকে আসল ভেবে ঠুক্রোতে গিয়েছিল এক পাখি। এমত কৃষ্ণনগরের মাটির কারিগরেরা ১৮৮৫তে পঞ্চম জর্জের সম্মানে ব্রিটেনে আয়জিত সাম্রাজ্যের শিল্প প্রদর্শনীতে যে সব জিনিস বিক্রির জন্য নিয়ে যান, তা হাজার হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আজও ঘুর্ণির দোকানে দোকানে ঘুরলে এরকম বহু মডের দেখা যাবে যা দেখে হাঁ হয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন পেশার মানুষের এক একটি মূর্তির দাম একশ থেকে শুরু হয়ে হাজার টাকার ওপরে যায়। জাতীয় পুরস্কার জয়ী এক শিল্পীর পুত্র ২০১০ সালে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, প্রণববাবুর একটা অর্ডারই দিতে পারছি না মশাই। নতুন আর্ডার আমরা নিচ্ছি নে। মনে রাখতে হবে প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন ইউপিএ-২-এর দোর্দণ্ড প্রতাপ অর্থমন্ত্রী। তাঁরা তার কাজই দিতে পারছেন না, আমরা মরণশীলরা তো কোন তুচ্ছ।

কিন্তু যাঁরা ঘুরতে ঘুর্ণি যাবেন তাদের জানিয়ে রাখি বাংলার আর একটি ঐতিহ্য চালচিত্রও আঁকা হয় এখানেই। দেবী দুর্গার পেছনের চালির ওপরে আর এক্কেবারে মাথায় যেখানে শিব থাকেন তার নিচে যে অর্ধ গোলাকার দীর্ঘ ছবির মালা থাকে তাই চালচিত্র। সেটি আঁকেন এখানকার শিল্পী। এ বিষয়ে যোগাযোগ করতে পারেন রবি বিশ্বাসের সঙ্গে।

পিতল-কাঁসার সুদিন নবদ্বীপে চৈতন্যজন্মের বহু আগে থেকেই ছিল। অষ্টাদশ শতকে এর ব্যাপক সাড়া ভারতে ছড়ায়। নবদ্বীপের উপর লেখা অন্যতম প্রামাণ্য বই ‘নবদ্বীপ মহিমা’তে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী লিখেছেন, ১৮ শতকের গোড়ার দিকে নবদ্বীপের কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী গুরুদাস দাসের সারা ভারতে মোট ৮০০ জায়গায় দোকান ছিল। তাঁর তখন বার্ষিক উপার্জন ছিল এক কোটি টাকা। সবই কাঁসা-পিতলের সৌজন্যে।

নবদ্বীপের কাঁসা-পিতল শিল্পের এক বিশেষ নির্মাণশৈলী “ঠোকাই” পদ্ধতিতে সরু মোটা নানা ধরনের লোহার ছেনি, যার মাথা ভোঁতা, কাঠের হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে পিতলের ধাতব পাতের উপর নজরকাড়া নকশা আঁকেন এখানকার পিতল-কাঁসার কারিগরেরা। চৈতন্যজন্মের অনেক আগে থেকেই নবদ্বীপ কাঁসা-পিতল শিল্পের জন্য সারা ভারতে পরিচিত ছিল। ঠোকাই পদ্ধতির প্রয়োগ নবদ্বীপের এই শিল্পকে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে খ্যাতির শীর্ষে রেখেছিল।

কয়েক বছর আগেও সংগঠনের জেলা সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল। তাঁর মূল ব্যবসা দেবী মূর্তির শস্ত্রগুলি, বিশেষ করে দেবী দুর্গার প্রহরণগুলি দিয়ে উঠতে পারেন না। বছরে তাঁর কয়েক লক্ষ টাকার বরাত থাকে, কিন্তু ছেলেরা টাকা তোলার কম্পানিতে গিয়েছে। ফলে তিনি এর কয়েক ভগ্নাংশই দিতে পারেন।

ব্রিটিশ আমলে কালীগঞ্জ থানার মাটিয়ারির হ্যাজাক কব্জা করে ফেলেছিল কলকাতা ঢাকা কটক লখনো চাটগাঁ

অন্য দিকে মাটিয়ারির কাঁসা-পিতলের নানান তৈজস। কাটোয়া রেল রাস্তায় দাঁইহাট হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে আর শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর-লালগোলা রাস্তায় দেবগ্রামে নেমে বাসে প্রায় এক ঘন্টা মাটিয়ারি ধর্মদা মুড়াগাছা সাধনপাড়া। ব্রিটিশ আমলে কালীগঞ্জ থানার মাটিয়ারির হ্যাজাক কব্জা করে ফেলেছিল কলকাতা ঢাকা কটক লখনো চাটগাঁ। বরযাত্রীরা ফিরতে পারত না সেনকিট হ্যাজাকের জ্যোৎস্না ছাড়া। সে যুগ গিয়েছে, কিন্তু আজও বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখান নরহরি বর্মনরা।

এক সময় উলা-বীরনগরের খ্যাতি ছিল কাঠের কাজে। বিনয় ঘোষ আজ থেকে সত্তর বছর আগে দেখেছিলেন মিত্র-মস্তৌফিদের বাড়ির কড়ি, বা অন্যান্য আসবাবের কাঠের কাজ।

সে দিন আর নেই কিন্তু পাশের তাহেরপুরের সরা আজও তাঁর খ্যাতি ধরে রেখেছে। রানাঘাট কৃষ্ণনগর ভায়া বাদকুল্লা বীরনগর রুটের বাসরাস্তা নিমতলা গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। তাহেরপুরের নিমতলা গ্রামে পটশিল্পী হিসেবে পরিচিত প্রায় পঞ্চাশটি পরিবার আছে। দশরথ পাল সুকুমার দাসেরা আজও সরা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

সরা শিল্পীরা প্রথমে মাটি ছেনে মাটির তালকে হাতের দুতালুর চাপে রুটির মত গোল আকৃতি দেন এর নাম চরা কাটা। এবার ঐ সরা আকৃতির তালকে কেনো পকা সরার ওপরে রেখে জলমাটির (ঘোলা) তরল মিশ্রণে ভেজানো পাতলা ন্যাকড়ার সাহায্যে মসৃণ করা হয়। এবারে কিছুক্ষণ ছায়ায় রেখে সেটিকে শোকানো হয়। এরপর ভাটিতে পোড়ানোর জন্য যায় এই সরা। তাঁর পর রং করার কাজ।

পঞ্চকল্যাণী পটের বংশাবলীর মধ্য থেকে সরার জন্ম, এরকম প্রবাদ চালু। লক্ষ্মীপজোয় উপলে ধানের শীষ, কলমী, পদ্ম, প্যাঁচা, কৃষ্ণ-রাধা বা দুর্গা মূর্তির সরা আজও পাওয়া যায়। সরার পাড়ে লাল রঙে এক আঙ্গুল পরিমাণ পাড় এঁকে মূল দেবীচিত্রের সঙ্গে নানাবিধ সহচরী মূর্তি বা পুতলি আঁকার প্রবণতা দেখা যায় – এলাকা অনুযায়ী এই পুতলির সংখ্যা বাড়ে বা কমে।

পুরাকালে মানে অতীতে ঘট পটে অর্থাৎ সরা আর ঘটে পুজো হত। লক্ষ্মীর পটে শুধু তিনি থাকেন না, সঙ্গে নানান সহচরী থাকেন। কোনও কোনওতে লক্ষ্মী-নারায়ণ অথবা রাধা-কৃষ্ণ থাকেন।

বাংলাদেশের ঢাকাই সরা বা ফরিদপুরের সরার নিজস্ব আঁকার পদ্ধতি রয়েছে। ঢাকাই সরার দেবদেবী আঁকার নিচের দিকে থাকে একটি নাওএর প্রতিমা আর ফরিদপুরের সরাতে দেবদেবীরা সাধারণতঃ একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন। ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরার উপরিঅংশে সপরিবারে মহিসাসুরমর্দিনীর ছবি আঁকা হয়, আর নিচে সবাহন লক্ষ্মীমূর্তি থাকেন। তাহেরপুরেও ফরিদপুরের অঙ্কণ শৈলী আনুসরণ করা হয়। সরা চার প্রকার। পরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা, গণকী সরা আর ঢাকাই সরা। ঢাকাই সরার কানা উঁচু। লক্ষ্মী-নারায়ণ মুখোমুখী দাঁড়ানো থাকেন। হাতে ধানের শীষ, দেবীর পায়ের কাছে রত্নভাণ্ডার আর প্যাঁচা। নিচের দিকে নাওএর আঁকা হয়। ফরিদপুরী সরার কানা উঁচু নয়। দেব্দেবীরা সাধারণত চৌখুপির মধ্যে থাকেন। সুরেশ্বরীর পট পাঁচ ভাগে বিভক্ত। মাঝে থাকেন লক্ষ্মীদেবী। ওপরে সপরিবারে দেবী দুর্গা। গণকীর পটভূমি লাল, কিনারা কালো। পটে থাকেন দেবী দুর্গা আর তাঁর পরিবার। নিচে লক্ষ্মী আর তাঁর বাহন।

মুর্শিদাবাদ

ইংরেজ আমলে রাজধানী কলকাতায় চলে আসার আগে যে শহরে ছিল তাঁর নাম মুর্শিদাবাদ। যে শহর দেখে ক্লাইভকে বলতে হয়েছিল, এই নগরী লন্ডনের মতই জনবহুল এবং সমৃদ্ধশালী (সম্পূর্ণ মিথ্যা – তখনো বাংলা লুঠের সম্পদে লন্ডন তথা ইওরোপ সেজে ওঠেনি) – কিন্তু এখানে যত ধনী মানুষ আছেন, লন্ডনে তা নেই। মুর্শিদাবাদেরই রাঙ্গামাটি-কানসোনা গ্রামের নামে লুকিয়ে রয়েছে হর্ষবর্ধনকে বিজয়ী শশাঙ্কের গৌড়তন্ত্রের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ। সেখানে এসেছিলেন হিউ-এন-সাং। হাওড়া-ব্যান্ডেল-আজিমগঞ্জ-বারহাড়োয়া রেল রাস্তায় কর্ণসুবর্ণ স্টেশন হয়েছে। সেখানে গেলে পুরোন বাংলার প্রাচীন রাজধানীর কিছু উৎখনন দেখা যাবে। আর গাড়িতে গেলে বহরমপুর থেকে গোকর্ণ হয়ে প্রায় ২৫ কিমি। মুর্শিদাবাদে আগে রাজধানী ছিল ঢাকায়।

মুর্শিদাবাদ এখন বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। আজও প্রসিদ্ধ কাঁসা-পিতল বাসন শিল্পের জন্য। বহরমপুরের খাগড়া অঞ্চলে কাঁসা-পিতলের কাজ হয়। নবাবি আমলে এখানকার বাসনের সুনাম ছিল সারা ভারতে। সে সময় খাগড়া অঞ্চলে প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে ভেসে আসত ঠুংঠাং আওয়াজ, হাপরের শব্দ। খাগড়ার একটি পাড়ার নাম ‘কাঁসারি পট্টি’। ভৌগলিক কারণেই মুর্শিদাবাদ জেলা প্রসিদ্ধ ছিল তামা-পিতল-কাঁসার বাসনের জন্য। কাঠ আসত গড় জঙ্গল থেকে।এই কাঠের আগুনেই পিতল গলানো হত। আজও খাগড়ায় বেঁচে আছে কাঁসা পিতলের কাজ।

এককালে মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার রাজধানী এবং বাংলাই ছিল বিশ্ববাজারের প্রধান রপ্তানিকারক অঞ্চল। বাংলার মুর্শিদাবাদে গড়ে উঠেছিল হাতির দাঁতের হস্তশিল্পের বিশাল শিল্প। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের নবাবরা বিভিন্ন হস্তশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করার সঙ্গে সঙ্গে হাতির দাঁতের শিল্পীদেরও বিপুলভাবে সহায়তা করা শুরু করেন। আজও বিভিন্ন প্রাসাদে দেখা যায় হাতির দাঁতের কাজ। কয়েক দিন আগে ক্রিস্টির নিলামে বহরমপুরের হাতিরদাঁতের কারুকার্য ওয়ালা আসবাবপত্রের নিলাম হল বিপুল দামে। যে কোনও ব্রিটিশ নিলাম কোম্পানির ওয়েবসাইটে অবশ্যি মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের নানান শিল্পকর্মের নিদর্শন বিক্রির জন্য রয়েছে।

ব্রিটিশ আমলেও বিদেশিদের লেখায় হাতির দাঁতের কাজের নানান উল্লেখ পাই। বিশেষ করে বিভিন্ন আমলাদের সমীক্ষায় এবং জেলা পরিচয়ে (ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার)। ১৮৫১-য় আর ১৮৮৮তে সালে লন্ডনের সাম্রাজ্যের শিল্প প্রদর্শনীতে বিপুল পরিমানে মুর্শিদাবাদের শিল্পীদের হাতির দাঁতের কাজ ঠাঁই পায়। আর যে কয় দিন বহরমপুরের সেনা ছাউনি ছিল ততদিন সেখানে এই শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। গুরুসদয় দত্তের শিল্প পরিচিতিতে আর ওম্যালির ডিস্ট্রক্ট গেজেটিয়ারে হাতির দাঁতের কাজের বিষয়টির সামাজিক্তা, অর্থনীতি, বাজার ইত্যাদি বিশদে বর্ণনা রয়েছে।

আজ এই শিল্পীরা কেউ শোলার শিল্পে কেউবা কাঠের খোদাই শিল্পে পালিয়ে বেঁচেছেন। এককালে নবাবি আমলে গোটা হাতির দাঁতের আম্বারি তৈরি হত, অর্থাৎ হাতি, তাঁর হাওদা এবং তাঁর ওপর নহবতখানা, আথবা বিভিন্ন নৌকোর আকার ইত্যাদি তৈরি হত।

আজ শিল্পীরা এই কাজ করেন হয় শোলায় আর কাঠের। এর মধ্যে কয়েকজন সরকারি নির্দেশনামায় হাতির দাঁতের কাজ করেন তবে তাঁর দাম আকাশ ছোঁয়া। একটা তিন ইঞ্চি সাধারণ মূর্তির দাম প্রায় বারো হাজার টাকা। কাজ বেশি থাকলে তার দাম প্রায় দ্বিগুণ। হাতির দাঁত বলে অবাঙ্গালি উত্তরভারতীয়রা এগুলি কিনে থাকে দরদাম না করেই। এই শিল্পীরা এখন খাগড়ায় থাকেন।

জীবন্তীর পাটের পুতুল

বহরমপুর থেকে কাঁদির দিকে। এই গ্রামের রাশিনা বেওয়া, গোলবানু বিবি পাটের পুতুল, খেজুরপাতার নানান সামগ্রী তৈরি করেন। অপূর্ব সুন্দর দেখতে এই জিনিসগুলির বাজারের চাহিদা রয়েছে।

সারগাছি

বহরমপুর-কৃষ্ণনগর রেল রাস্তায় পড়ে। বাঁশের কাজ হয়। মাঝখানে বেশ বাজার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি স্থানীয় এক গান্ধীবাদী সংগঠন এই শিল্পকে তুলে ধরেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান নিয়ে এসে।

মালদা

মালদহে গেলে অবশ্যই আমের সঙ্গে সঙ্গে চেখে দেখবেন দুই ডাকসাইটে মিষ্টি-কানসাট আর পোস্ত জড়ানো রসকদম্ব। তবে রসকদম্ব নামে মালদার বাইরে যে মিষ্টিটি পাওয়া যায় তা খুব একটা স্বাদকর নয়। সদ্য তৈরি কানসাটের স্বাদ-ই আলাদা। পুরনো হলে এর আসল স্বাদ হারিয়ে যায়। এখানে হাতিপা লুচি পাওয়া যায়। সেটি খেতে ভুলবেন না।

মালদার হস্তশিল্প বললেই দুটি জিনিস মনে পড়ে, প্রথমটি বাঁশের সূক্ষ্ম কাজ আর ইংরেজ বাজারের গম্ভীরা মুখোশ, যদিও গম্ভীরার পোড়ামাটির মুখোশ এখন প্রায় তৈরি হয় না বললেই চলে। বাংলায় নববর্ষের সময়, বিশেষ করে চৈত্র সংক্রান্তির গাজনের সময় এই মুখোশ কিছুটা ওঠে, কিন্তু সারা বছর তার আর দেখা পাওয়া ভার।

তবে মালদাকে চেনা যায় বাঁশের কাজের সূক্ষ্মতায়। গাজোল-সহ বেশ কিছু এলাকায় মূলত সাঁওতাল স্থানীয় ভাষায় মাহালিরাই বাঁশের সুক্ষ্ম কাজগুলি করে থাকেন। এছাড়াও অন্যান্য বর্ণ হিন্দুরাও এই কাজ করে থাকেন, তবে বাঁশের কাজে তাঁরা অবশ্যই এই মাহালিদের কাজ ব্যবহার করেন।

বাংলায় পরম্পরা ভিত্তিক তিন ধরণের বাঁশের কাজ হয় তিন এলাকায়। একটি দিনাজপুরে। এর বিশদ আগে আলোচনা হয়েছে। মূলত তক্ষণ শিল্প ভিত্তিক – এলাকার বাঁশ ছাড়াও তাঁরা ব্যবহার করেন জলপাইগুড়ির বাঁশ। মূলত রাজবংশী সম্প্রদায় এই কাজ করে থাকেন। দ্বিতীয়টি কোচবিহার এবং কোচবিহার সংলগ্ন জলপাইগুড়ি জেলায়। মূলতঃ বাঁশের নানান ঘর সাজানো নানান জিনিস। কিছুটা অসমের বাঁশের শিল্পকর্মের প্রভাব রয়েছে এই এলাকার বাঁশের কাজে কেননা অসমগুরু শংকরদেব প্রায় পাঁচশ বছর আগে অসম ছেড়ে কোচবিহারে বসবাস করার জন্য আসেন। এখনও কোচবিহারের লংকাবরে অসমিয়া গামোছা তৈরি হয়।

আর আমাদের আলোচ্য বাঁশের কাজ হয় গাজোল এলাকার মজলিসবাগ গ্রামে। আদিনা মসজিদের উল্টো দিকের রাস্তায় যুবক শ্রীনাথ টুডু আর প্রৌঢ় বিধান টুডু গ্রামে বেশ দারুন কাজ করছে। তাদের বাড়ির পাশেই আদিনা অভয়ারণ্য। থাকা যায়।

গাজোলে রবিদাসেরা এই বাঁশের কাজ করেন। সেখানে সুরেশ রবিদাস বেশ ভাল বাঁশের গয়না সহ নানান সূক্ষ্ম কাজ করেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন