শুক্রবার | ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:১৬
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্থ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (শেষ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের বিদেশি ফটোগ্রাফার : দিলীপ মজুমদার দর্শকের অগোচরে শুটিং-এর গল্প : রিঙ্কি সামন্ত রশ্মির নাম সত্যজিৎ “রে” … : যীশু নন্দী হুগলিতে মাধ্যমিকে চতুর্থ ও দশম উল্লেখযোগ্য ফলাফলে নজর কাড়ল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (তৃতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (ষষ্ঠ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের স্প্যানিশ ফ্লু হয়, পেরুযাত্রার সময় : অসিত দাস গাইনোকলজি ও গাইনি-ক্যান্সারে রোবোটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারীর ভূমিকা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ছোটগল্পকার আলাউদ্দীন আল আজাদ : আবু জাফর রেহমান শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (পঞ্চম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাতি ফোলালেও আম জনতাকে ভোট কেন্দ্রে টানতে পারেননি : তপন মল্লিক চৌধুরী আলুর দামে রাশ টানতে না পারলে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি-র ছোটগল্প ‘সই’

মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি / ১৯৬ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।

মাঠের মধ্যে দিয়ে আলপথ ধরে ভর দুক্কুরে যেতে বিতুনের ভারি ভয় করে। নির্জন, নগ্ন, দুপুর রোদে ঝলসে যায় যদ্দুর দেখা যায় তদ্দুর। চত্তির শেষ হবে হবে করছে। এমনিতে সক্কালে বেশ শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া দেয় এখনও। তারপর যতো রোদ চড়ে তত গরম বাড়ে। গাঁ গঞ্জের ধারাই এমন। বিতুনের এই দুক্কুরে আলপথ পেরোতে হয় একটাই কারণে, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া যায়। মাঠের এ পাশে তাদের পাঠশালা। ও পাশে বিতুনের গ্রাম। সকাল বেলা সাড়ে দশ বাজলে যে মা কুসুম দুটি ভাত রেঁধে দেবে তা তো নয়, মা তখন এক ঝুড়ি গোবর নিয়ে বাইরের পাঁচিলে থ্যাপ থ্যাপ করে ঘুঁটে দেয়। আর কালী কমলি হাগেও বলিহারি যাই! এই এত! বিতুন একা আলপথ দিয়ে যেতে যেতে কালী কমলির হাগার পরিমাণ ভেবে নিজের মনেই ফিকফিক করে হেসে ফেলে। হি হি হি হি। ভয় ভয় ভাবটা কোথায় পালায়। তাই সকালে আর ভাত জোটে না কপালে।

“অ মা! খেতে দিবি নে?” এক হাত গোবর মাখা হাতেই মুখের পাশ থেকে উড়ে আসা চুল সরিয়ে কুসুম বলে, “আজ দুটি মুড়ি বাতাসা খেয়ে পড়তে যা বাপ। টিপিনে এসে গরম গরম ভাত খাবি ক্যামন!” বিতুনের গালটা ফুলে ওঠে। রোজই তুই ভাত রাঁধিস না, কেবল ঘুঁটে দিস… বিতুন তোর কেউ নয়? ওই কালী কমলিকে নিয়েই থাক তুই, আর ওদের হাগা নিয়ে ঘুঁটে দে। মনে মনেই বলে। মুখে কিচ্ছুটি বলে না। পাড়ার লোকে বলে, “অই মা! তোর ছেলেটা কি শান্ত রে! সাত চড়ে রা টি নেই!” উঁ… একবার মেরেই দ্যাখো না! অত সোজা নয় বিতুনের গাল। এগুলোও মনে মনে। তারপর একটা পেতলের সরা নিয়ে তাতে চারটি মুড়ি ঢেলে কটি বাতাসা দিয়ে চেবায় আর এক ঢোঁক করে জল খায়। বাবা সাইকেল নিয়ে কাজে বেরোনোর আগে বলে, “অত জল খাসনি রে, পেট ফুলে যাবে। আগে মুড়িটা খা, তাপ্পর জল খা।” বাবা যাবে সেই গঞ্জের গদাই মল্লিকের আড়তে। পেল্লাই বড়লোক মল্লিকরা। সোনার বেনে কিনা! মা বলে, ঠাকমা বলে, পাশের হরিমতী জেঠি বলে সোনার বেনেরা খুব, মস্ত, পেল্লাই বড়লোক হয়। তাদের গায়ের রঙ ও নাকি সোনার মতো হয়। কই! বিতুন তো একবার গেছলো তার বাপের সঙ্গে সাইকেলে চেপে গঞ্জের মল্লিকদের বাড়ি। হ্যাঁ… তাদের গায়ের রঙ একটু বেশি ফর্সাই বটে… তবে সোনার বন্ন… তা নয় মোটেই! এ কথা বিতুন এসে বলেছিল তার মায়ের কাছে। ও মা! তার মা এত হেসেছিল এত হেসেছিল যে মায়ের চোখে জলই এসে পড়ল, বিতুনের মা বেশি হাসলেই তার চোখে জল পড়ে। তারপর আবার ঠাকমা, পাশের বাড়ির সবাইকে ডেকে ডেকে বিতুনের কথা শুনিয়েছিল। যেন বিতুন বিরাট ভুল বলেছে। আর সবাই খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসেছিল, বিতুনের এখনও মনে পড়ে। আসলে মায়েরা তো লেখাপড়া করেনি, জানবে কি করে? মানুষের যে সোনার বন্ন হয় না, ওরা জানেই না। ওরা তো আর সুধা মাস্টারের কাছে পড়েনি, পড়লে জানতো।

বিতুন মুড়ি আর জলে পেট ঢাক করে ইস্কুলের ব্যাগ নিয়ে দৌড়য়। পেছন থেকে মা ঠাকমা চ্যাঁচায়। “দুগ্গা দুগ্গা। আস্তে যা। পড়ে যাবি।” বিতুনের কানে যায় না সেকথা। দৌড়য় সে। আশেপাশের বাড়ি থেকে আরও চারটি ছেলে মেয়ে সঙ্গী হয় দৌড়ে, তারাও যাবে পাঠশালায়। চার পাঁচটি গ্রামের মধ্যে ওই একটি পাঠশালা। গ্রাম ছাড়িয়ে ভাল রাস্তা ধরেও যাওয়া যায়, কিন্তু ছেলের দল ধরে আলপথের আঁকাবাঁকা পথ। অনেক তাড়াতাড়ি হয় সেইজন্য। সকলে বারণ করে আলপথ দিয়ে যেতে। কারণ অনেক। একে মেঠোপথ, তাতে জমির ভেতরে কোন মা মনসার সন্তান ঘাঁটি গেড়ে আছে তা কেউ জানে না। বেশি থাকে কালকেউটে। এক ছোবলে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না সে। এছাড়াও আরও ভয় আছে। শুনসান দুপুরে, বা সন্ধে হবো হবো সময় ও রাস্তা না ধরাই ভাল। তেনারা আছেন। কখন কার ঘাড়ে চাপেন, জানা তো নেই। তাই বারণ করে গ্রামের মুরুব্বিরা।

আলপথ গিয়ে যেখানে তিনটে ফেঁকড়া বেরিয়ে একটা রাস্তা সোনানদীর দিকে গেছে, জমির মধ্যে হঠাৎ করে একটা ঝাঁকরা পাকুড় আর অশ্বত্থ গাছ জড়ামড়ি করে আছে, তার নিচেই একটা ছোট কুঁড়েঘর। বায়েন ধীরার ঘর। একটা লাল ছেঁড়া কাপড়ের নিশান ওড়ে পতপত করে। বায়েনের নিশানা। যার মানে বিপদ আছে, তফাৎ যাও! কেউ তাকে ঘাঁটায় না। মঙ্গল আর শনিবার চারপাশের গ্রাম থেকে কেউ না কেউ ওই নিশানের তলায় রাখা বেতের ধামায় কিছু চাল, ডাল, একটু সর্ষের তেল, কিছু জমিতে হওয়া বা বাড়ির উঠোনে হওয়া কুমড়ো, বেগুন, দুটি ডাঁটা রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালায়, পেছনে ফিরে দেখে না। দেখলেই, একবার চোখে চোখ পড়লেই দেহের সব রক্ত টেনে নেবে সব্বোনাশী রাক্ষুসি বায়েন। কিন্তু এ ডাইন নয়, তাই একে পুড়িয়ে মারা যায় না। ডাইন হলে কোন চিন্তা ছিল না, গ্রামের শেষ প্রান্তে এনে একটা গাছে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু তা হবার নয়। ধীরা ডাইন নয়। বায়েন। তাই একে তুতিয়ে পাতিয়ে রাখতে হয়, তাতেই গ্রামের মঙ্গল, মড়ক লাগে না, কারো কোল, পেট খালি হয়ে যায় না অকালে। নিয়ম করে সিধে দিতে হয় তাই। ধীরাবায়েনের জন্যেও ছেলেপুলেদের বারণ করে মায়েরা আলপথ না ধরতে। কিন্তু ওরা কথা শোনে না।

বিতুন নিজের মনে কথা বলতে বলতে, হাসতে হাসতে আসছিল। হঠাৎ খাঁ খাঁ রোদ সরে গিয়ে যেন ছায়ার চাদরে ঢেকে গেল আলপথ। চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে বিতুন, সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বৌ। তার মায়ের মত। এর গায়ের রঙ যেন বেনেবৌদের মত, নাক তিল ফুলের মত। এখন জমিতে তিল, ধানের চাষ। ধান গাছ এখন বেশ ছোট ছোট, সবুজে সবুজ। রোদের তাপে আরও চিকন লাগে রঙ। এই সবুজের টানেই তো বিতুন রোজ আলপথ ধরে, নাহলে তো ঘুর পথে ভাল রাস্তা দিয়ে পাঠশালা যাওয়াই যায়। বৌমানুষটির চুল গুলো যেন কেমনধারা। জট পড়ে আছে। কতদিন যেন তেল নেই। আর চোখ দুটো থেকে যেন দুপুরের সূর্য ধকধক করে ঠিকরে বেরোচ্ছে। বিতুন একবার তাকিয়েই আর সে চোখে চোখ রাখতে পারে না। চোখ নামিয়ে নেয়।

“তুই কুসুমের বেটা বটে? কি সোন্দর! গোলগাল চেহারা তোর বাপ, ঠিক যেন রাজপুত্তুর!”

“হ। তুমি আমায় চিনলা ক্যামনে?”

“আমি সব্বাইকে জানি। আসবি আমার ঘর? চিনি আর লেবু দিয়ে ঠান্ডা পানা দোবো। আহা! অমন চাঁদপানা মুখ যেন রোদে ঝলসে গ্যাছে গ! তা আলপথ দিয়ে যাতায়াত করিস কেন বাপ? এখন চত্তির মাস। রোদ বাড়ে। জমিতে সব ছোট চারা। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই।”

বিতুন চুপ করে থাকে। রা কাড়ে না।

“কি রে আসবি? ঐ দেখ সামনে আমার ঘর” আঙুল তুলে দেখায়, আলপথ, যেখানে তিনটে রাস্তা নিয়েছে তার গায়ে সোনানদী। আর তার গায়েই দুটো বিশাল গাছ জড়িয়ে আছে। পাশে বায়েনের ঘর!! এক পা এক পা করে পিছিয়ে বিতুন তিলক্ষেতে নেমে আসে। বউটি দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। বিতুন দৌড় শুরু করে তিলক্ষেত মাড়িয়ে। দৌড়, দৌড়। পিছনে বোধহয় আসছে সে! দৌড়ে এসে যখন বাড়ির চৌকাঠে আছড়ে পড়ল বিতুন, তখনও কে যেন পেছন থেকে বলছে “ওরে অত করে ছুটিস না। পড়ে যাবি।” সে রাত থেকে জ্বরে বেহুঁস বিতুন। আর মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে উঠছে, “ওই, ওই আসছে, আমায় ধরে নিবে। চোখ দুখানা জ্বলছে!!”

দুদিন দুরাত কিভাবে যে কেটেছে কুসুমের, তা কুসুমই জানে। এক গা জ্বর নিয়ে ইস্কুল থেকে ফিরল ছেলেটা। সঙ্গে উল্টো পাল্টা কথা… কে ধরতে আসছে… চোখ জ্বলছে…। সমানে কপালে জলপট্টি দিয়ে, মাঝে মাঝে মাথা ধুইয়ে দিয়ে ছেলের গা এখন ঠান্ডা হয়েছে। ভোর ভোর উঠে পড়েছে কুসুম, মেলা কাজ। উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে শুনতে পেল, পেছনের খিড়কির দরজা কে যেন শেকল নাড়া দিল, টক… টক… টক। তারপর আবার চুপ। এত ভোরে কে আসবে? কুসুম সবচেয়ে ভোর ভোর ওঠে। দরজা না খুলে আবার ঝাঁট দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কুসুম। কেউ আসেনি, মনের ভুল, দু রাত ঘুম নেই ভাল করে, তাই কি শুনতে কি শুনছে। আবার টক… টক… টক। সঙ্গে ফিসফিস করে ডাক “সই! সই! শুনতে পাচ্চিস!” কুসুমের হাত থেকে খ্যাংরা ঝ্যাঁটা পড়ে যায়। গোটা অঙ্গ শিথিল হয়ে আসে। হঠাৎ শীত শীত করে এই চত্তিরের শেষে। সই তো এ গাঁয়ে একজনই পাতিয়েছিল। কিন্তু! শীত ভাব যেমন এসেছিল, আবার কমেও গেল। শিথিল অঙ্গ শক্ত হলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে খিড়কির দরজা হাট করে খুলে ফেলল কুসুম। সামনে দাঁড়িয়ে মুখ চাপা দিয়ে ধীরা, ধীরা বায়েন।

“মুখ খোল”

“মুখ দেখবি? ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস সই, আমার চোখে চোখ পড়লে যদি তোর অমঙ্গল হয়! সেদিন তোর ছেলেটাকে সামনে দেখে বড় লোভ হয়েছিল… আমারটা থাকলেও এত বড়টি হতো। কিন্তু সে এত ভয় পেয়ে ছুট দিল… আমার বড় ভয় করল রে সই। দুদিন তারে ইস্কুল যেতে দেখি না… এই ফুল টা মায়ের থানের। এট্টু মাথায় ছুঁইয়ে দিস। ভাল হয়ে যাবে।”

ভোরের হাওয়ায় মুখের আঁচল সরে যায়। সেদিনের সুন্দরী ধীরা আজ শীর্ণ রসহীন কাঠের মত। শুধু চোখ দুটো আগের মতোই উজ্জ্বল, সবার কাছে যেন একটু ভালবাসা পাবার উগ্র আর্তি সে চোখে। লোকে এই চোখ দেখেই ভয় পায়, ভাবে, সব রক্ত সে টেনে নেবে। যার নিজের শরীরে এক ফোঁটা রক্ত নেই, সে নাকি সবার রক্ত চুষে খায়! কুসুম বহুদিন পর সইয়ের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নেয়। ঠান্ডা, ভেজা দুটি হাত। কতক্ষণ দুজন এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল জানে না তারা, হুঁশ ফিরল পেছনের থেকে খ্যানখেনে আওয়াজে। কুসুমের জা সুন্দরী গালে হাত দিয়ে যতোটা চেঁচানো যায় ততোটা গলা তুলে চেঁচাচ্ছে।

“ওগো! কি সব্বোনেশে কতা গো! নিজের ছেলেকে খেয়ে স্বাদ মেটেনি, আবার এ বাড়ির দিকে নজর! আর বলিহারি বড়দি! তুমি ওই মাগির সঙ্গে কতা কইচো! মা দেকলে তোমার কপালে কি লেকা আচে ভগমান জানেন। ঠাকুর! ঠাকুর! ঠাকুর!”

কুসুম নিজের চোখ মুছে নিয়ে একটু ঠেলা দেয় ধীরাকে। ধীরা, সুন্দরীর চিৎকারে থতমত খেয়ে গেছিল, এখন সম্বিত ফিরে পেয়ে দৌড় লাগালো আলপথের দিকে। একবার হোঁচটও খেল। আহারে! কুসুমের মনটা একই সঙ্গে ভাল লাগা, ভীষণ কষ্টবোধ আর বিরক্তিতে ভরে গেল। সে আবার ঝাঁটা তুলে নিয়ে উঠোন ঝাঁটাতে শুরু করল।

“কি গো বড়দি, কিচু বলচো না যে! এত বড় অন্যায় তুমি করলে কি করে? তোমার ঘরে কচিকাঁচা নেই? কবে ও তোমার সনে সই পাতাপাতি করেছিল তাতে তুমি এই ভোর বেলা ওই মহাপাতকীর মুখ দেখলে!”

কুসুম চুপ করে ঝাঁট দেয়। শাশুড়ি এসে দাঁড়ায়। শোনে সব কথা, একবার খরচোখে কুসুমের দিকে তাকিয়ে চলে যায় পাতকো’র ধারে। কুসুমের মনে পড়ে সেদিনের কথা। যখন ধীরা নতুন বউ হয়ে তার বিয়ের কয়েক সপ্তাহ পরেই এলো। সদ্য নতুন বউ কুসুম বারেবার ধীরার কাছে গিয়ে বসে ভাব করে ফেলল বেশ। তারপর কয়েকদিন পরই এ ওর মুখে একটু নাড়ু দিয়ে সই পাতিয়েছিল। একসঙ্গে পুকুরে যাওয়া, মাঠে ভাত দিতে যাওয়া, মেলায় যাওয়া, সব একসঙ্গে। তারপর কুসুম মা হলো। ধীরা সবসময় কুসুমের গায়ে গায়ে থাকত। এবার ধীরা গর্ভবতী হলো যখন, তখন হঠাৎ করে পাড়ার দুটি বাচ্চা ছেলে ডুবে মরল পালেদের পুকুরে। বাচ্চা দুটোকে যখন জল থেকে তোলা হল, তখন হঠাৎ ছেলে দুটোর মা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, “ওই ধীরা, কাল ছেলে দুটোর দিকে কিরকম করে তাকিয়েছিল। ওর তুকেই জলজ্যান্ত ছেলে দুটো ডুবে ম’ল।”

ধীরা ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না আর। কিছুদিনের মধ্যে সেও মা হলো। সুন্দর সুস্থ ছেলে। ছেলে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে সে। ঘরের কাজে গা লাগায় না বিশেষ, এ নিয়ে সংসারে অশান্তি। তারপর এল সেই দিন। সারাদিন খুব গরমের পর বিকেল থেকে তুমুল ঝড় জল। তারমধ্যেই ধীরার বর ছুটে এল কুসুমদের বাড়ি। কুসুমের শাশুড়িকে বলল, “কাকি, ছেলেটার বড় জ্বর এসেছে গো, হঠাৎ… কি করি বলো দেখি?” ঝড় জল তখন একটু কমেছে। কুসুম, ওর শাশুড়ি ধীরার বাড়ি গেল। একরত্তি ছেলের গায়ে যেন আগুনের ছ্যাঁকা। জলপটি, জল ঢেলে কিছুই হলো না, ভোর রাতে ছেলে আরও নেতিয়ে পড়ল। সূর্য ওঠার আগেই ছেলের গা ঠান্ডা হতে শুরু করল। ওরা ভাবল, জ্বর কমছে। কিন্তু না, ছেলে আর চোখ মেলে তাকাল না।

ধীরার কাছ থেকে ছেলে যখন সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে তখনই ধীরার চোখ মুখ অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। নাকের পাটা ফুলে উঠল। চোখ দুটি আগুনখেকো। সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “আমি খেয়েচি। আমার কচি ছেলেটাকে আমি খেয়েচি।” কুসুম আর ওর শাশুড়ি, ধীরার মুখে চাপা দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেও সে থামল না। বলেই চলল এক কথা। তার সঙ্গে এও বলতে লাগলো, “তোমরা বিশ্বাস করচো নি? দাসেদের দুটো ছেলে যে ডুবে ম’ল, সে তো আমার জন্যি। জানো না?” কেউ ধীরাকে চুপ করাতে পারল না। দাসেরা বলল, “দেখলে তো, তখন তোমরা কেউ আমাদের কথা মানলে না, আজ ও নিজেই স্বীকার যাচ্ছে… ও ছেলেখাকি। বিদেয় করো। এ পাপ বিদেয় করো। নাহলে কারো ছেলেপুলে বাঁচবে না।” গ্রামের সমস্ত মানুষের সায় একদিকে হল। ধীরা তখনও অস্বাভাবিক ভাবে বলে যাচ্ছে, সে’ই ছেলেকে মেরে ফেলেছে।

কুসুম চান করে এসে বিতুনের মাথায় ফুল ঠেকিয়ে দিল। বিতুন চোখ মেলে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিল।

“তুই সেদিন ভয় পেলি ক্যানে বিতুন?”

“বারে! বায়েন আমারে ধরতে এল যে।”

“না রে বাপ। ও বায়েন নয়। ও তোর সইমা।”

“ধ্যার। তাহলে ও একা থাকে ক্যানে? সবাই তো ওকে ভয় পায়।”

“পাক। তুই আর পাস নে। এবার দেকা হলে ভয় পাবি নে, কতা দে!”

“দিলুম। পাবো না ভয়।”

মা ছেলে দুজনেই হেসে ওঠে।

চৈত্র শেষে পয়লা বৈশাখ বড় সুখের দিন বিতুনের। বাবা মেলা থেকে নতুন জামা এনে দিয়েছে। আর আজ বিকালে বাবার হাত ধরে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দু তিন বাক্স মিষ্টি আর সরবত খেয়েছে বিতুন। মন বেজায় খুশি তার। বাড়িতে ফিরতেই মা বলল, “বিতুন, একটা কাজ করে দিবি বাপ?”

“কি? কও…” মিষ্টি খেয়ে মনটা খুশি খুশি আছে বিতুনের।

“কাউরে কিচু বলবি নি। আমি তোরে মাঠের ধার অবধি পৌঁছে দেবো। তুই শুধু এক বাস্ক মিষ্টি ওই ধীরারে দিয়ে আসিস। আজ তো বচ্ছরকার দিন। শুভদিন, আর ওর শুভ কামনায় তোর শরীর ভাল হয়েছে… দে আসবি বাপ?”

বিতুনের মনটা খুব খুশিই ছিল। কিন্তু মায়ের কথা শুনে তার পেট ভয়ে আবার গুরগুর করে উঠল। বাপরে! আবার সেই বায়েনের কাছে? চোখ দুটো যেন জ্বলছে! “না, আমি পারবো নি। তু যা। আমার ভয় লাগে, ওর চোখ দুটো যেন আগুনের ভাঁটা। তু যা। আজ পেথম দিন, মিষ্টি খেলুম, কত্ত মজা হল। তার মধ্যি তুই আমায় বায়েনের কাছে পাঠাতে চাস? ও যদি আমারে টপ করে গিলে নেয়? আর তো আমায় পাবি নে তুই? কেঁদে কেঁদে মরবি তো তখন অ বিতুন অ বিতুন করে।”

ওর বলার ধরণে কুসুম ফিক করে হেসে ওর মুখে চাপা দেয়। “চুপ, চুপ, এখুনি কেউ শুনে ফেলবে। ওরে, বায়েন বলে কিচ্ছু হয় না। এসব বদ মানুষের সিষ্টি। ক্যানে, তোদের মাস্টার শেখায় নি, যে ডাইনি বলে কিছু হয় না… ও সব একদম বিশ্বাস করবি না, তুই না পড়া লেখা করিস… চ, আমি আছি, কুনো ভয় নাই তোর।”

বৈশাখের প্রথম সন্ধেয় আধো অন্ধকারে দুটি আবছা অবয়ব মাঠের দিকে রওনা দেয়। হাতে একটা ছোট্ট মিষ্টির প্যাকেট।

আলপথের বাঁক ঘুরতেই একটু দূরে চোখে পড়ে অশ্বত্থ আর পাকুড় গাছের বন্ধুত্ব। যেন দুই সই বহুদিন পর মিলিত হয়েছে।

“হেই মা! দ্যাখ! দ্যাখ! সইমার ঘর থেকে ধোঁয়া বেরুচ্চে!”

অবাক কুসুম। ভর সন্ধে নামতে না নামতে কি করছে ধীরা? একা মানুষ। হঠাৎই বুকটা যেন কাঁপন লাগে কুসুমের। কিছু হয়নি তো সইয়ের?

তারপরই মনে হয়, ধুর! ওর কে ক্ষতি করবে? গায়ের বাচ্চা থেকে বুড়ো সব্বাই ওকে ভয় পায়। তবু কুসুম বলে, “তাড়াতাড়ি পা চালা বাপ! ”

“তোর দেখি আর তর সইছে নি।”

ছেলের মাথায় আলগা চাঁটি মেরে এগিয়ে দেয় কুসুম। নিজেও দ্রুত পা চালায়।

কুঁড়ের একটু দূর থেকেই যেন গন্ধটা ভক করে এসে নাকে ঢোকে। পোড়া মাংসের গন্ধ! বিতুনকে অজানা ভয়ে কুসুম থামিয়ে দেয়।

“তুই আর এগোস না বাপ। আমি আগে যাই। তুই চুপটি করে দাঁড়া।”

“আমার তরাস লাগবে যে মা।”

“কুনো ভয় নাই। বায়েন তোর সইমা হয় না!”

“তুই যে বললি ও বায়েন লয়!”

“হ। ঠিক কতা। ও বায়েন লয়। লোকে ওকে মিথ্যে মিথ্যে বায়েন বলে। তবে ভয়ও করে। তুই দাঁড়িয়ে থাক। আমি আসি।”

বচ্ছরকার প্রথম দিনে কুসুম ধীরার কুঁড়ের সামনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, এরা কি? এরা কি পশুরও অধম! বায়েনের শরীরও তাহলে পুরুষের ভোগে লাগে! তারপর দাও পুড়িয়ে। অর্ধদগ্ধ, অর্ধনগ্ন ধীরা কুসুমকে শেষ কয়েকটি কথা বলতে পেরেছে। কারা এসেছিল, কজন এসেছিল, কোন বাড়ির… আর শেষ বারের মতো কুসুমের হাতে একটু জল খেয়েছে। খরচোখে এক বিন্দু জল নেই কুসুমের। বিকট মুখ ব্যাদান করে একটা চিৎকার ছাড়ে সে… আকাশ বাতাস চিরে ছিঁড়ে যায় ফালাফালা হয়ে। ছাড়বে না, সে কাউকে ছাড়বে না। বচ্ছরকার প্রথমদিনে তার প্রিয় সইয়ের পোড়া দেহ ছুঁয়ে শপথ নেয় কুসুম। এর শেষ দেখে সে ছাড়বে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন