“মাঝে মাঝে লাগে। তবে সেটা সাময়িক। খুব এটা বেদনাদায়ক নয়। আমার এক দাদু আছেন। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমি চলে আসার পর আমি তার অসুখের কারণ হই। ভাবতে মজা লাগে যে নাসিমা একটি অসুখের নাম’’ (পৃ. ৯৬)।
এভাবে সালমা বাস্তবের সংঘাতে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রকিবের ভালবাসাকে সে বলে —
“দূর, ভালবাসা আবার কি?’’ মিলনের পরও তার শূন্যতা আবিষ্কার হয়ে ওঠে অনিবার্য —
“মিছে ডাকছিস রকিব। তোর ঐ আবাল খেলার স্বাদ তো তুই আমাকে দিয়েছিস। সত্যি বড় চমৎকার। কিন্তু এত ক্ষণিকের যে আমি ভুলে যাই সে স্মৃতি। কেন আমার সোনার কৌটায় মানিক হয়ে জ্বলে না রকিব? কেন জোনাকীর মত জ্বলে নিভে যায়?’’ (পৃ. ১১৭)।
নিঃসঙ্গ সালমা, ব্যক্তিমানসে জাগরুক নেই রকিব। পার্থিব চাওয়া-পাওয়া যেন তার শেষ হবার পথে। মনোজগতের অসীম সংকটের শিল্পরূপ দিতে গিয়ে ঔপন্যাসিক সময়-পরিবেশ-পরিস্থিতির সংমিশ্রণে কাব্যময় ভাষার সুষম বিন্যাস করেন —
সালসমার চোখের কোণায় জলের রেখা দ্রুত গড়ায়। চোখ বুঁজে শুয়ে থাকে ও। অন্তরে কোন রকিব নেই। বাইরে সন্ধ্যা গাঢ় হয়। জলিল মিয়া বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। সালমার ঘরে মিটমিটে আলো। সালমার চোখে জল। ঠোঁটে রকিবের স্পর্শ। গালে রকিবের স্পর্শ। বুকের ওপর রকিবের স্পর্শ। কিন্তু অন্তরে কোন রকিব নেই’’ (পৃ. ১২১)।
ছকবাঁধা জীবনের বাইরে এসে যেমন নাসিমা-সাব্বির যে জীবনকে অবগাহন করেছে, সেই জীবনের চিত্রগুলো খুব নিকট থেকে দেখে দেখে সালমার ভেতর জেগে ওঠে নিঃসব্দের বিদ্রোহ চেতনা। এ জন্য রকিবের “তুই ভালোবাসা চাস না সালমা’’ প্রশ্নের জবাবে সে বলেছে —
“কখনো কখনো চাই। সব সময় না। তাছাড়া ভালবাসার অধিকার আমার আর সহ্য হয় না। অধিকার যখন জোর করে দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তখন আমার মরতে ইচ্ছে করে’’ (পৃ. ১৩০)।
রকিবের প্রেমসংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে চেয়ে পত্রের প্রত্যুত্তর না দেয়া, তাকে বাড়ি থেকে প্রত্যাখ্যান করে তাড়িয়ে দেয়া, পিতার ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে আমেরিকা যাত্রাকালে কোন রকম আগ্রহ আতিশয্যের প্রকাশ না করা এবং এরই পাশাপাশি রুবা আবীর সিলেটে চলে যাবার সিদ্ধান্তে বিচলিত হওয়া সবকিছুই সালমার চেতনায় আলো ফেলে।
অন্যদিকে নাসিমা-সাব্বির যারা বুকবাঁধা জীবনের অভিলাষী নন, দু’জন তরুণ-তরুণী অনাড়ম্বরভাবে ঘরোয়া বিবাহে সম্মত হয়েছেন কারণ —
“আমি মা হতে চাই সালমা। ঐ ছেলের জন্যে আমার একটা পরিণতি দরকার।’’
অর্থাৎ পুরাতনের মধ্যে নতুনের অভ্যূদ্বয়কে স্বাগত জানানো প্রগতিশীল চরিত্রের অন্বিষ্ট। একারণে সন্তান লাভেরর জন্য প্রলাগত বিবাহের স্পর্শ সালমার দৃষ্টিকোণ লেকে উপন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে —
“বীজ বোনার জন্যেই তো ওদের জীবনে রংয়ের আবির্ভাব। ওদের চোখে এখন ফসলের স্বপ্ন। ফসলের সোনালী ঐশ্বর্য।’’
পিতার বিবাহ আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বলে —
“জাহিদ চৌধুরী তুমি অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়াও। সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দাও। বই লিখে নাম কর। ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে বিদেশ যাও। ছাত্র পিটিয়ে মানুষ করার গৌরবে অহংকারবোধ কর। কৃতীছাত্রকে নিয়ে জোর গলায় কথা বলে আরাম পাও। কিন্তু সত্যি করে বলতো জাহিদ চৌধুরী তুমি নিজের সম্পর্কে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ কি না? আজ তুমি আরেকজনের ওপর সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছ। অথচ সেই ক্ষমতাই যে তোমার নেই তুমি তা একবারও তলিয়ে দেখছ না। আমি একটা সামান্য মেয়ে। তোমার ভাষায় এক রত্তি মেয়ে। আমি নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তোমার মত বেঁকেচুরে যাই না। তোমার মত ভুল পথে গিয়ে দীনতার গ্লানিতে হাবুডুবু খাই না। আমি সালমা অনায়াসে সাগর সাঁতরাতে পারি।’’
অনায়াসে সাঁতার কাটার ক্ষমতা নিয়ে সালমা ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে নাসিমা সাব্বিরের নতুন বাসায় গমনও যেন সালমার পরিণতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কারণ সালমাদের দোতালায় তারা থাকলে সালমা-রকিবের বিবাহোত্তর আশ্রয় পাওয়া কষ্টকর হয়ে উঠত। দুর্বিনীত ভালোবসার কাছে আত্মসমর্পণ করেও সালমার ভেতর “মুক্তির আনন্দ’’ আর “ভালবাসার স্বাদ’’ একীভূত না হয়ে বিচ্ছিন্নতা বোধের জন্ম হয়। এ জন্য তার অনুভাবনাময় চেতনালোক —
“আমি চেয়েছিলাম একজন শক্তিমান পিতা, একজন মহৎ পিতা। — যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি নিজের অস্তিত্বকে মহান বলে অনুভব করতে পারতাম। … ভালোবাসা নয়। তোমায় নিয়ে আমি দূরে সরে যেতে চাই। আমি যা করেছি তার জন্যে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইব না। কেননা আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পার না। তোমার ব্যর্থতাকে আমি নিজে অতিক্রম করব বলে পথে নেমেছি। তোমার কানে কোনদিন পৌছবে না আমার পদশব্দ’’ (পৃ. ১৭৯)।
এভাবে সালমা জন্মদাতা পিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন দিগন্তের সংস্পর্শে এসেছে এবং বাস্তব জীবনে সে নির্বাচন করে নিয়েছে নব জীবনের অঙ্গীকার।
সরলপ্লটে সংগ্রথিত কাহিনী সর্বজ্ঞলেখকের দৃষ্টিকোণ লেকে রূপায়িত হয়েছে। তবে চরিত্রের মনোজগত উন্মোচন ও অপর পার্শ্বচরিত্রের বিকাশে সালমার দৃষ্টিকোণ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া প্রতিপার্শ্ব নির্মাণ ও চরিত্রের অন্তর্জগতের দ্বন্দ্ব উন্মোচনে ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন দৃশ্যময়, চিত্রময় পরিচর্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। সময়প্রবাহকে জীবনপ্রবাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে ভাষায় গতিবেগ এনেছেন সযত্নে প্রয়াসে। চেতনাপ্রবাহ রীতির সরল আবর্তে সালমার মনোকথন হয়েছে উপন্যাসের মূল কৌশল।
বর্ণনামূলক “পদশব্দের’’র শব্দ ও ভাষা প্রয়োগে সেলিনা হোসেনের বৈচিত্র্য অনুসন্ধান —
ক. রিণরিণে যন্ত্রণার কাঁপুনি (পৃ. ১৬৯)।
খ. মাড়াল পথেই আমার সুখ বেশি (পৃ. ১৭৭)।
গ. কয়েক হাজার স্পিলিনটারের মত তা গেঁথে গেল মনে (পৃ. ১৭১)।
জীবন ও সময়প্রবাহের সঙ্গে ব্যক্তির যন্ত্রণাকে একাত্ম করে তাকে রুপায়িত করা হয়। সালমার মনোজগতে নাসিমা আপার কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেক যন্ত্রণার সূত্রপাত এবং নির্ঘুম মধ্যহ্নে তার নিঃসঙ্গ মুহূর্তকে বর্ণনা করা হয়েছে নিুরূপে —
“বাগানে রোদের লুটোপুটি। কলাবতী ঝোপ লেকে টুনটুনি উড়ে গেছে। হলুদ প্রজাপতিও নেই। আনুর মা রান্নাঘরের বারান্দায় আঁচল পেতে শুয়ে আছে। জলিল মিয়া কামিনীগাছের নিচে বসে বিড়ি টানেন। দুপুরে ঘুম আসে না ওর। করতোয়াপাড়ের ছেলে সহজে অলস হয় না। কাঠের বাক্সের ভেতরে সালমার সুখ-দুঃখ একে অপরের গায়ে মুখ ঘষে। জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। বাটি থেকে দুধ খায়। অথবা তারের ওপর মুখ রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আম, নিম, আমড়ার পাতা ফসফস করে জ্বলে ওঠা দিয়াশলাইর কাঠির মত টুপ করে ঝরে যায়। বেদনাহীন ঝরায় কোন আলোড়ন নেই’’ (পৃ. ৩৬)।
মূলত নারীর অধিকার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে আত্মস্বরূপ বিকাশে প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করে উজ্জীবিত হয়ে ইতিবাচক জীবনদর্শন নির্বাচন করাই সেলিনা হোসেনের “পদশব্দের মূল বিষয়।’’ ‘সালমা’ যে পদশব্দ শুনেছে নাসিমা আপার কাছ থেকে সেই পদশব্দের শ্রুতি তাকে পৌঁছে দিয়েছে গন্তব্যের দিকে সিদ্ধান্তের সন্নিকটে। এজন্য সালমা সমাজের কাছে পদশব্দ শুনিয়েছে কারণ সমাজের গতানুগতিক পথের বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয় সুনির্দিষ্ট জীবনপরিক্রমায়।
“মগ্ন চৈতন্যে শিস’’ (১৯৭৯) সেলিনা হোসেনের নাগরিক মধ্যবিত্তের মানসিক জটিলতার শিল্পভাষ্য। চেতনার গহীন স্তর থেকে নৈঃসঙ্গ পীড়িত মানুষের আর্তনাদ চূর্ণবিচূর্ণ স্মৃতিচারণে প্রবল আবেগের অনুরণনে শব্দরূপ পেয়েছে। উপন্যাস বিধৃত চরিত্রপুঞ্জের ভেতর জামেরী ও মিতুলের অন্তর্যন্ত্রণা এবং অন্তর্মুখি চেতনাপ্রবাহ গীতলতায় পর্যবসিত হয়েছে পরিণতিতে।
জামেরী ও মিতুলের অন্তঃসংলাপ, স্বীকারোক্তি, আত্মঅনুসন্ধানের আত্মদহন, বোধ ও নিঃসঙ্গতার সঙ্গে নিরন্তর ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কাহিনী “মগ্ন চৈতন্যে শিস।’’ ‘ইনার রিয়ালিটি’ ধর্মী এই ধরনের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সেলিনা হোসেনের বক্তব্য স্মরণীয় —
“এ ধরনের উপন্যাস মাত্রই রঙিন জলবায়ুর অধিকারী। জলবায়ু দেহের এবং মনের। দেহ যেমন আঙ্গিকের বিষুবরেখার বিচিত্রিত হয় মন তেমন সাইকেডেলিক কালারে নিঃশেষ পরিক্রমণ ভালোবাসে। বিদেশি উপকরণে অরুচি নেই, কিন্তু আমরা চাই দেশীয় চেতনায় তার আত্মস্থ রূপ। নইলে রচনার বর্ণাভ উজ্জ্বলতা ফিকে হতে বাধ্য’’ (স্বদেশে পরবাসী, পৃ. ২০)। [ক্রমশ]