শুক্রবার | ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:০৬
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্থ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (শেষ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের বিদেশি ফটোগ্রাফার : দিলীপ মজুমদার দর্শকের অগোচরে শুটিং-এর গল্প : রিঙ্কি সামন্ত রশ্মির নাম সত্যজিৎ “রে” … : যীশু নন্দী হুগলিতে মাধ্যমিকে চতুর্থ ও দশম উল্লেখযোগ্য ফলাফলে নজর কাড়ল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (তৃতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (ষষ্ঠ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের স্প্যানিশ ফ্লু হয়, পেরুযাত্রার সময় : অসিত দাস গাইনোকলজি ও গাইনি-ক্যান্সারে রোবোটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারীর ভূমিকা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ছোটগল্পকার আলাউদ্দীন আল আজাদ : আবু জাফর রেহমান শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (পঞ্চম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাতি ফোলালেও আম জনতাকে ভোট কেন্দ্রে টানতে পারেননি : তপন মল্লিক চৌধুরী আলুর দামে রাশ টানতে না পারলে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বিজয়া দেব-এর ছোটগল্প ‘ভিজে শালিকের ডানা’

বিজয়া দেব / ১১৬ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।

ভেতর থেকে চড়াগলায় ডাক এল — বৃষ্টি!

সাথে সাথেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আকাশটা অবশ্য অনেক সময় থেকে ভারী হয়েছিল কালো মেঘে।

সৌগত হেসে উঠে বলল — এই দ্যাখো, আকাশের কালো মেঘ এতক্ষণ মা-র এই চড়াসুরের ডাক শোনার অপেক্ষায় ছিল।

বৃষ্টি সৌগতর দু’হাত চেপে ধরে বলে — ঠাট্টা করো না তো! এখন আমি কি করি?

সহজসুরে সৌগত বলে — আপাতত ভয়টাকে তাড়াও।

বর্ষণের ঝমঝম ছাপিয়ে ফের সুনেত্রার কণ্ঠ এঘরের ভেতর আছড়ে পড়ে — বৃ-ষ-টি!

বৃষ্টি ছুটে তাদের শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে বাহারি পাঞ্জাবি ও জিনস খুলে নাইটি পরে, তার ওপর চাপিয়ে দেয় হাউসকোট।

এখন বিকেল। বিকেলের চা পানের সময়। আজ রোববার, তাই সৌগত বাড়িতে আছে।

বৃষ্টি ভেতরের ঘরে ঢুকতেই সুনেত্রার চোখ বৃষ্টির আপাদমস্তক দেখছে। বৃষ্টির অস্বস্তি, বৃষ্টি জড়োসড়ো।

অতঃপর সুনেত্রা — কি? চা হবে এখন?

বৃষ্টি চট করে ঢুকে পড়ল কিচেনে। গ্যাসের উনুন জ্বালিয়ে চাপিয়ে দিল চায়ের জল। সৌগতর বাবা সুবিনয় কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন -চা হলো বৃষ্টি?

— হ্যাঁ বাবা, এই হয়ে এলো।

রান্নাঘরের খোলা জানালায় একটি ভিজে শালিক, একেবারে জবুথবু। ডানা নেড়ে ছোট্ট দেহের বৃষ্টিজল ঝেড়ে ফেলল। রোঁয়া ফুলে আছে। বৃষ্টি দেখছে, চায়ের জল ফুটছে। শালিক উড়ে গেল। বৃষ্টি চা করল, ট্রে-র ওপর চায়ের পেয়ালাগুলো বসিয়ে এনে খাবার টেবিলে রাখল।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সুবিনয় বলে উঠলেন — একি! চায়ে চিনি দাওনি?

চমকে ওঠে বৃষ্টি। তড়িঘড়ি চিনির কৌটো নিয়ে আসে। তাড়াহুড়োতে এক চামচ চিনি টেবিলে ছড়িয়ে পড়ে।

সৌগত বলে — বৃষ্টি, পটে চা দিও। চিনি দুধ তাহলে নিজেদের মত করে মেশানো যাবে।

সুনেত্রা একটু শব্দ করে হেসে ওঠে বলেন — আর নতুন নিয়ম চালু করতে যাস না তো, তাহলে চা পান পর্ব আরও বিগড়ে যাবে।

অতঃপর সবাই চুপচাপ। শুধুমাত্র চায়ের চুমুক, টোস্টে মৃদু কামড় বসানো ও বিস্কুট চিবোনোর মৃদু আওয়াজ নীরবতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অস্বস্তিতে বৃষ্টি মুখ তুলে তাকায় না। বিশেষ করে শাশুড়ি মা সুনেত্রার অবয়ব যেন দ্বিগুণ হয়ে তার চারপাশকে ঘিরে ফেলছে এমনি এক অনুভবে সে আড়ষ্ট হয়ে চায়ে চুমুক দেয়।

সৌগত বলে — রিল্যাক্স বৃষ্টি! এত টান টান হয়ে আছ কেন?

বৃষ্টি ঘাড় গুঁজে চায়ে চুমুক দেয়। সৌগতর কথা তার কানে গেছে বলে মনে হয় না।

বৃষ্টি মেয়েটা ভীরু। এই ভীরুতা তার সহজাত। বাবা মা-র একটি মাত্র মেয়ে। আদরযত্নে লালিত হয়েছে। সৌগতর সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে না পড়লে এখনও বিয়ে হত না তার। মা বাবার তো এতো অল্প বয়েসে তাকে বিয়ে দেবার ইচ্ছেই ছিল না। বয়েস তার এখন মাত্র বাইশ চলছে। একুশ বছরে পা দিয়ে হয়েছিল বিয়ে। আদুরে মেয়ে হলেও সে এতটুকু বেপরোয়া কিংবা সাহসী হয়ে ওঠেনি। আসলে বৃষ্টির বাবা মনোময় নরম প্রকৃতির মানুষ, মা বিনীতাও তেমনই। তাদের বাড়িতে চেঁচামেচি, রাগারাগি, বিরক্তি, পছন্দের ব্যাপারগুলোতে বিধিনিষেধ আরোপ করা এসবের তেমন বাড়াবাড়ি নেই। অনেকটাই খোলামেলা সহজ পরিবেশে বড় হয়েছে বৃষ্টি। মেয়েটা কবিতা লেখে। তার নারী প্রকৃতি ভিজে নরম, ভীরু হরিণীর মত তার চোখ।

— তোমাকে যখন ডাকছিলাম শুনতে পাওনি?

সুনেত্রার ভারিক্কি কন্ঠ খাবার টেবিলের নীরবতা ভাঙল।

উত্তরটা সৌগত দিল — তোমাকে বললাম যে মা, বৃষ্টি বাথরুমে ছিল।

— কাল সকালবেলা তুই চা করিস তো সৌগত।

— বেশ তো করা যাবে, ও আর এমন কি!

সৌগত কাল অফিসফেরত বৃষ্টির জন্যে চমৎকার ডিজাইনের পাঞ্জাবি ও জিনস নিয়ে এসেছিল। ওগুলো পরে বাইরে যেতে পারে না বৃষ্টি। ওসব আধুনিক বেশবাস পছন্দ নয় সুনেত্রার। লুকিয়ে তাই ওগুলো আজ পরেছিল সৌগতকে দেখাবার জন্যে। বৃষ্টি এই বছর দুয়েকের মত বিবাহিত জীবনে দেখেছে এ বাড়ির আনাচকানাচে অদৃশ্য তর্জনী তার দিকে দিকনির্দেশ করছে এদিকে চলো ওদিকে নয়, সুরে সুর মেলাও…. ছন্দপতন যেন না হয়।

ভালবেসে যখন বৃষ্টি আকুল তখন মা হেসে বলেছিল — ভালবেসেছিস, খুব ভালো — কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনটা তোর খেয়ালখুশিতে চলবে না বৃষ্টি, সামাল দিতে পারবি তো?

তখন উথাল-পাতাল সময়, উথাল-পাতাল ঢেউ, তখন ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টি শুধু ঝরে পড়ার অপেক্ষায়।

বিয়ের পর একদিন তার পছন্দের পোশাকে সৌগতের সঙ্গে বাইরে যাবে তো সৌগত চমকে উঠে বলে — কী সর্বনাশ! তুমি এই বেশে বেরোবে নাকি?

— সর্বনাশ? কীসের সর্বনাশ? এই বেশে তো বেড়াতে যাই আমি সৌগত। তোমার সাথে দেখা করতে গেছি কতবার এইসব পোশাকেই তো।

— সে তখন তোমার বিয়ে হয়নি।

— তো? বিয়ে হলে কি হয়?

— আগের তুমি আর তুমি থাকো না। আগে তুমি ছিলে বৃষ্টি, এখন তুমি মিসেস সৌগত।

— মানে? কি বলছ কি? বিয়ে করে কি আমার আইডেনটিটি পালটে গেছে নাকি? আমি আর আমি নেই?

— আরে আরে ঠাট্টা করছি। না না তুমি সেই বৃষ্টিই আছো। আসলে আমাদের বাড়িটা একটু সেকেলে। সেকেলে বলব কি? নাহ্! মানে “ট্র‍্যাডিসন” শব্দটা এই পরিবারে একটা আলাদা মানে রাখে, এই আর কি। মা বিশেষ করে, আর বাবাও। এই বেশবাস ওরা একদম মেনে নেবে না। তুমি শাড়ি পরো।

বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে — তাহলে তোমাকেও ধুতি পাঞ্জাবী পরতে হয় সৌগত। ট্র‍্যাডিশন।

সৌগত গম্ভীর হয়ে বলে — ঠাট্টা নয়। আমি সিরিয়াসলি বলছি।

— মানে? আমাকেই শুধু ট্র‍্যাডিসন রক্ষা করতে হবে?

সৌগত কিছুটা বুঝি অপরাধী ভাবছিল নিজেকে। তাদের বাড়ির এইসব নিয়মশৃঙ্খলার কথা বিয়ের আগে হয়তো বলা উচিত ছিল বৃষ্টিকে। কিন্তু বলা হয়নি। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়। তেমন করে ভাবা হয়নি। সে খানিকটা অনুনয়ের সুরে বলে — ভুল বুঝো না বৃষ্টি। আসলে বাবা-মার তো বয়েস হয়েছে, ওদের দৃষ্টিভঙ্গীকে সম্মান না জানালে ওরা যে দুঃখ পাবেন।

সেই থেকে বৃষ্টি আর তার পছন্দের পোশাক পরেনি। শাড়িকে আজও বাগে আনতে পারেনি সে।

আজকাল মাঝে মাঝে ভাবে বৃষ্টি, ভালবাসা বলে সত্যিই কি কিছু আছে? না কি ভালবাসা মানে কিছু বায়বীয় স্বপ্ন শুধু? কতগুলো সমঝোতার নাম কি ভালবাসা হতে পারে? অথচ সে-ই কিনা ভালবাসা নিয়ে এই কবিতাটি লিখেছিল —

ভালবাসা মানে

একমুঠো ঘাস

সজীব পরশ

ভালবাসা মানে

ধ্বসে পড়া সব জীর্ণ দেয়াল

ভালবাসা মানে

টুকরো কথার কাটাকুটি খেলা,

ভালবাসা মানে

সুরঞ্জনা আর আকাশলীনা।

আশ্চর্য কত স্বপ্ন দেখিয়েছে তাকে ভালবাসা। স্বপ্নই তো তাকে বসিয়ে দিল বিয়ের পিঁড়িতে। একুশ বছরের ডানা মেলা তারুণ্য ভিজে শালিখ পাখি হয়ে জবুথবু দেহকে জানালার কপাটে বসিয়ে দিল। অথচ ভিজে শালিখের ডানা থেকে বৃষ্টিবিন্দু ঝেড়ে ফেলার দক্ষতাটুকুও তার হল না। এদিকে ভালবাসার নির্দেশে বিয়ের আগের ছেলেমানুষি কৈশোর, একুশ বছরের উচ্ছল তারুণ্য দুম করে তার বিবাহোত্তর জীবন থেকে খসে যেতেও পারল না। এ কি গোলমেলে খেলা এই ভালবাসার! ভালবাসার নির্দেশে লুকিয়ে সৌগত তার জন্যে জিনস ও বাহারি পাঞ্জাবি কিনে আনে। বারো বাই বারোর শোবার ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়াল আয়নায় তার ভাললাগা পোশাক পরে নিজেকে দেখতে হয়, দেখাতে হয় সৌগতকে। তারপর ওগুলো খুলে ফেলে আলমারির অন্ধকোণে তার একান্ত পছন্দের পোশাকগুলো চালান দিতে হয়। এটুকুই তার জীবন আপাতত এগুলোই তার ভালবাসার হিসেবনিকেশ।

পরদিন সকালবেলায় চা করল সৌগত। টেবিলে চা পর্ব চলছে যখন সুনেত্রা হঠাৎ বলেন — চা টা কেমন লাগছে বৃষ্টি? বৃষ্টি মোটেও চোখ তুলে তাকায় না। না তাকিয়েই সে টের পায় যে হাওয়া তার চারপাশে বইছে তার গতিবেগ খুব একটা সুবিধের নয়। চোখ তুলে তাকালেই সুনেত্রার ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে হালকা হাসির বক্ররেখাটি সে দেখতে পাবে নিশ্চয়ই। সুতরাং সে ঘাড় গুঁজেই অস্ফুটে বলে — ভালো।

— ভালো লাগছে তোমার? আমারও খুব ভালো লাগছে। তবে দুঃখের কথা কি জানো, তোমার স্বামী এতদিন ধরে তোমায় এই চা করাটা ঠিকমতো শেখাতে পারলো না।

বৃষ্টির মাথা আরও একটু ঝুঁকে পড়ে। হ্যাঁ ভুল তার হয়। কাজ করতে গিয়ে মশলা তেল নুন চিনি আর এটা ওটা হাজারও টুকিটাকি এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেই তো বিভ্রাট। বাড়িতে মা সব সামলে নিত। বাবা তো বলতোই – কে ভুল করেছে? বৃষ্টি? এসব নাহক ভুল।

মা বলত — নাহক ভুল মানে কি?

বাবা বলত -ওই অকারণ পুলক আর কি!

মা বলত — মানে?

— মানে খুঁজো না, মানে খুঁজো না। একটা সময় এলে দেখবে কোনও কিছুর কোনও মানে নেই। শুধুই অকারণ পুলক…লাইফ ইজ অ্যান অ্যাবসার্ড জার্নি।

মা কপট রাগ দেখিয়ে বলত — সব পাগল নিয়ে বাস করছি, ধুর।

বাবা মায়ের মুখের সামনে গিয়ে গান ধরত – আমি তাইতো পাগল হলাম না সই / মনের মত পাগল পাইলাম না…

মা বলত — ধুর! বলে হাসত।

হ্যাঁ মা তাকে বুঝিয়েছিল — এত তাড়াতাড়ি বিয়ের পিঁড়িতে বসিস না। জীবনটা অনেক বড় তো। বিয়ে পরে হোক, তার আগে আরও এগিয়ে যা। পড়াশুনো নিজের পায়ে দাঁড়ানো…

যাক সেসব ভেবে আর লাভ কী! উদাসীন সময় কারো কথা শোনে না। একমুখীন গতি তার। তাকে ফেরায় কার সাধ্যি!

নীরবতা ভেঙে সুবিনয় বললেন — হ্যাঁ ভালো চা করতে হবে তোমায় বৃষ্টি। একটু মন লাগালেই দেখবে শেখা হয়ে যাবে।

অতঃপর সব চুপচাপ। নাহ এরা ততটা সরব নয় এটা ঠিক, তবে শরীরী ভাষ্যে অপছন্দের ইঙ্গিত বারবার ফুটে ওঠে।

মাঝে মাঝে সৌগত বলে — চাকুরি করবে বৃষ্টি?

— চাকুরি? কে দেবে আমায়?

— আমি বলি কি তুমি বি.এড টা করে নাও। তারপর কোনও ইশকুলে… কিন্ডারগার্টেন ইশকুলে চেষ্টা করে দেখা যায়। সময়টা তাহলে বেশ ভালো কাটবে তোমার।

— ওরা কি রাজি হবেন? মা-বাবা?

— নিশ্চয়ই। রাজি না হওয়ার কী আছে?

— আগে তুমি ওদের মতমত নাও।

— উঁহু, আগে চাকরির পাকা ব্যবস্থা করি।

সৌগত দেখে বৃষ্টির চোখের কোণে ক্লান্তির ছোঁয়া। এই মেয়েটা বিয়ের আগে ভারি মিষ্টি ছিল। সবসময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মৃদু হাসির রেখা আজ বেমালুম মুছে গেছে। সৌগতর নিজেকে ভারি অপরাধী মনে হয়। বিয়ের আগে একবার বাড়িতে এনেছিল সে বৃষ্টিকে। বিয়ের কথা তখনও সে সেইভাবে ভাবেনি। বৃষ্টিকে দেখার পর তার মা বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। বৃষ্টির মা বাবা এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজি ছিলেন না। শুধু তার জন্যেই বৃষ্টি এককথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সে এই নরমসরম মেয়েটার মুখের হাসি মুছে দিয়েছে। সৌগত তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে — আজ তোমায় সিনেমায় নিয়ে যাব, বাড়ি থেকে শাড়ি পরে বেরোবে, আমার অফিস যাবে। নতুন জিনস পাঞ্জাবি প্যাকেটে পুরে নিয়ে যেও। অফিসে আমি চেঞ্জের ব্যবস্থা করে দেব..তোমার পছন্দের পোশাক পরে নেবে।

বৃষ্টি ম্লান হয়ে বলে -ওগুলো তুমি দোকানে ফেরত দাও সৌগত। আর কক্ষনো ওসব এনো না।

— কেন?

— লুকিয়ে আর কিছু করব না।

— কি হয়েছে তোমার বৃষ্টি?

— কিছু হয়নি। লুকোচুরি কেন করব বলতে পারো? দেখো সৌগত, সব মানুষেরই ভাল লাগার একটা নিজস্ব জায়গা আছে, সেখানে সে নিজেকে খুঁজে পায়। এই যেমন তুমি টেনিস খেলতে ভালবাসো, নতুন রেসিপিতে শখ করে ছুটির দিনে দু’একটা পদ রাঁধতে ভালবাসো, বাথরুমে ঢুকে দরাজ গলায় গাইতে ভালবাসো…ওখানে তুমি সম্রাট, জায়গাগুলো তোমারই সাম্রাজ্য।

— সে তো তোমারও আছে বৃষ্টি, যেমন তুমি কবিতা লেখ…

— হুঁ তারপর? তারপরের জায়গাগুলো? বলো সৌগত?

সৌগত চুপ হয়ে যায়। সে কি জানে না বৃষ্টির ভাললাগাগুলো? তার চাইতে বেশি আর কে জানে! বৃষ্টির পোশাক-আশাক, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, ওদের সাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া… এইসব জায়গাগুলো সত্যিই সে হারিয়ে ফেলেছে। সুনেত্রা যে ভারী কাজকর্মের বোঝা তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। রান্নাঘরে হালকা কাজগুলো এলোমেলোভাবে করে নেয় বৃষ্টি। রান্নার মাসি আসে। এছাড়াও ছুটির দিনে সৌগত রান্নার মাসিকে উনুন থেকে সরিয়ে দু’একটা পদ রাঁধে। পাশে দাঁড়িয়ে দেখে বৃষ্টি। সৌগত ইয়ার্কি মেরে বলে – হতে যাচ্ছিলাম বড় হোটেলের সেফ, হলাম সরকারি চাকুরে। এভাবেই দিন আসে দিন যায়।

— বৃষ্টি ভাবিত সৌগতকে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলে — কি হলো? চুপ করে গেলে যে! কিছু বল!

— কেন বৃষ্টি, মা-র সাথে তো বেড়াতে যাও।

হ্যাঁ যায় বৈকি সে। এখন তার যাবতীয় ঘোরাফেরা তো সুনেত্রার সাথেই। গুছিয়ে শাড়ি পরতে গিয়ে হোঁচট খায়, সুনেত্রা বিরক্ত হয়ে ওঠেন। সুবিনয় নির্দেশ দিয়েছেন — বৃষ্টি, মা-র সাথে বেড়াতে যেও। এতকাল গেছে একা, যেদিন আমি পেরেছি সঙ্গ দিয়েছি। এখন থেকে সুনেত্রা যেখানে যাবে তুমি যাবে সাথে, বয়েস হয়েছে, একা যেতে দিও না।

কোথায় যাওয়া? গুরুদেবের আশ্রম, সৌগতের মাসির বাড়ি, ছোটকাকার বাড়ি মোটামুটি এইসব জায়গা। সুনেত্রার বান্ধবীর বাড়ি মাঝেসাঝে। অনেকেই সুনেত্রাকে জিজ্ঞেস করে — বউ তোমার কেমন হয়েছে?

সুনেত্রা বলেন — খুব ভালো। খুব মিষ্টি। খুব শান্ত।

সবাই খুব প্রশংসাই করে। বলে — হ্যাঁ মুখখানা দেখলেই বোঝা যায়, ভারি নরমসরম মেয়ে।

সত্যিই তো, সুনেত্রার বয়েস হয়েছে। একা চলাফেরা কেন করবেন তিনি, তাঁর, সঙ্গ দেওয়াটা প্রয়োজন। কিন্তু তার বন্ধুরা যে হারিয়েই যেতে বসেছে। ওদের সাথে বেড়ানোর জন্যে একটা দুটো বিকেল কি বৃষ্টিকে ছেড়ে দেওয়া যায় না? সুনেত্রাকে বলে দেখেছে বৃষ্টি — বন্ধুদের সাথে যাবে? একা? বেশ তো রোববার দিন যেও, সৌগতকে সাথে নিয়ে যেতে পারবে।

বন্ধুরা বিয়ের পর পর ফোন করত, তার সঙ্গ চাইত, এ বাড়িতে বিধিনিষেধের বহর দেখে ধীরে ধীরে তারা দূরে সরে গেছে।

দুপুরে খেতে বসে সুনেত্রা বলেন — বৃষ্টি, তুমি এখন থেকে বাড়িতে শাড়ি পরা অভ্যেস করো। যেমন বিকেলের দিকে এইসব ঘরোয়া কাপড়চোপড় ছেড়ে শাড়ি পরো। আমাদের ভালো লাগবে।

এবার সুবিনয় বললেন — বুঝলে বৃষ্টি, আমাদের সৌমি শাড়িতেই স্বচ্ছন্দ। অতো পড়াশোনা করেছে কিন্তু কক্ষণো অন্য পোশাক আশাক পরেনি। শাড়িতেই মেয়েদের সুন্দর দেখায়। আজকাল মেয়েরা বেশবাসে এত পশ্চিমী অনুকরণ করছে। নিজেদের ঐতিহ্যটা ধরে রাখতে হবে। ওটা তো হারিয়েই যেতে বসেছে।

বৃষ্টি ভাবে — আজকাল বিয়ের বরও ধুতি পাঞ্জাবী পরতে চাইছে না। কিন্তু এসব কিছু তর্ক তোলার সাহস তার বিলকুল নেই।

বিকেলের দিকে ফের আকাশে কালো মেঘ জমল। ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল। এমনই সময়ে সৌগতর ফোন এল — বৃষ্টি, তোমার জন্যে বোধহয় একটি চাকরির ব্যবস্থা করেই ফেললাম। আমার বন্ধু বিনায়কের একটি কিন্ডারগার্টেন ইশকুলের পরিচালনা সমিতির সেক্রেটারির সাথে খুব চেনাজানা আছে। সে এ নিয়ে কথা বলবে এরমধ্যেই। চাকরিটা হয়ে গেলে তুমি খুব ভালো থাকবে বৃষ্টি দেখে নিও…

বাইশ বছরের তরুণী বৃষ্টি স্বপ্ন দেখে। বারবার দগ্ধ দুপুরের খরতাপ তার সব স্বপ্নকে, জীবনের সব রহস্যকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। তবু বৃষ্টি স্বপ্ন দেখে তার চারপাশ ঘিরে আছে ফুলের মত শিশুরা। সৌগত কি আদায় করতে পারবে বাবা-মার সম্মতি? সত্যিই ব্যবস্থা করতে পারবে চাকরির? সত্যিই কি সম্ভব?

— আজও বিকেলে বৃষ্টি নামল অঝোরধারায়। মুক্তোর মতো বৃষ্টিবিন্দু গলে পড়ছে। চারপাশ ধোঁয়াটে, মেদুর আলোর উদ্ভাসে মায়াময় বিকেল যেন অবিরাম স্বপ্নের জন্ম দিচ্ছে…

বৃষ্টির কবিতার খাতা ভরে উঠেছে কবিতায়। হয়তো এই কবিতাগুলো কোনও দিন কেউই পড়বে না। তবু বৃষ্টি লেখে খাতার শেষ পৃষ্ঠায় —

ভেজা শালিকের ডানার ঝাপটে

ঝরে পড়ে সব জমে থাকা জল।

শিউরে ওঠে তার রোমকূপগুলি,

আশ্বাস বুঝি ভালবাসা না কি ভিন্ন ছল!

#

ভাললাগা মানে ছোট সব খেয়ালি রেখা,

যেখানে মানুষ মুক্ত, দুর্নিবার

ভাললাগা যেন গতিচঞ্চল টেনিস র‍্যাকেট

ভাললাগা যেন উর্মিমুখর নদী পারাপার।

#

অথচ এখানে ভাললাগা সব রুদ্ধ কপাট

চারপাশে শুধু প্রহরী আর ধাতব চোখ।

মেনে নেওয়া আর মানিয়ে চলার

নির্দেশনামা, নেই কোন প্রতিরোধ।

#

খাদের প্রান্তে ঠেকেছে যে পা,

বেঁচে আছি শুধু এই তো ঢের।

হাতে তুলে নিই যত অভিযোগ

ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলি ফের।

#

কাকে কী যে বলি

বাইশ বছরের ব্যর্থ রূপ,

শেখাতে শেখাতে শেখাল না কিছু

শুধু এই অভিযোগ।

#

অসন্তোষের বক্ররেখায় কুটিল সময়

সর্পিল পথ, পালাব কোথায়?

তবে তাই হোক।

কবিতাটি লিখে ফেলতেই জানালার কপাটে সেই ভিজে শালিকটি বসলো। ভিজে ডানা থেকে নিঙড়ে নিল জল। তির্যক চোখে দেখল বৃষ্টিকে। বৃষ্টির ঠোঁটে ফুটে উঠল মুক্তোবিন্দুর মত একটুকরো হাসি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন