শুক্রবার | ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৩৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্থ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (শেষ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের বিদেশি ফটোগ্রাফার : দিলীপ মজুমদার দর্শকের অগোচরে শুটিং-এর গল্প : রিঙ্কি সামন্ত রশ্মির নাম সত্যজিৎ “রে” … : যীশু নন্দী হুগলিতে মাধ্যমিকে চতুর্থ ও দশম উল্লেখযোগ্য ফলাফলে নজর কাড়ল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (তৃতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (ষষ্ঠ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের স্প্যানিশ ফ্লু হয়, পেরুযাত্রার সময় : অসিত দাস গাইনোকলজি ও গাইনি-ক্যান্সারে রোবোটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারীর ভূমিকা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ছোটগল্পকার আলাউদ্দীন আল আজাদ : আবু জাফর রেহমান শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (পঞ্চম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাতি ফোলালেও আম জনতাকে ভোট কেন্দ্রে টানতে পারেননি : তপন মল্লিক চৌধুরী আলুর দামে রাশ টানতে না পারলে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস

ড. মিল্টন বিশ্বাস / ১০৩ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪

সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাসের নাম ‘যুদ্ধ’। উপন্যাসটির পুরোটা জুড়ে আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ কাহিনী শুরু হয়েছে যুদ্ধ দিয়ে, শেষ হয়েছে যুদ্ধের ফলাফল দিয়ে। পাকসেনাদের দ্বারা ধর্ষিত বেণু যখন তার গর্ভকে ‘জরায়ুর জখম’ আর যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধা তাঁর ক্রাচ দুটোকে ‘যুদ্ধের পা’ বলে অভিহিত করে তখন মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা ধৃত হয় উপন্যাসে।

একাত্তরের যুদ্ধে এভাবে নর-নারীর সম্মিলিত আত্মত্যাগ যুদ্ধকে মহান করে তুলেছে। একাত্তরের যুদ্ধের বিচিত্র মাত্রা পর্যবেক্ষণ করেছেন ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মানুষের বেঁচে থাকার সংকট, তার স্বজন হারানোর বেদনা আর ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের রূপান্তর- সবই তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসের বিস্তৃত আখ্যানে। এ ধরনের যুদ্ধে উদ্ভূত পরিস্থিতি পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় একই রকম।

এ জন্য ‘যুদ্ধ’ গ্রন্থটির আবেদন চিরন্তন। বাংলাদেশের সাহিত্যে সরাসরি ‘যুদ্ধ’ শব্দটি দিয়ে কয়েকটি মাত্র সৃজনশীল কর্মের দেখা মেলে। তবে যুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে শতাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প, কয়েকটি নাটক আর অজস্র কবিতা। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতা ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বাস্তব চিত্র ধৃত হয়েছে।

একই সঙ্গে যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক বিপর্যয় প্রকাশ পেয়েছে। সেলিনা হোসেনের ‘যুদ্ধ’ ছাড়া সত্তর থেকে শূন্য দশকের মধ্যে মাত্র তিনটি উপন্যাসের নামকরণে যুদ্ধ শব্দটি লক্ষ করা যায়। এগুলো হলো: ইমদাদুল হক মিলনের ‘মহাযুদ্ধ’, আমজাদ হোসেনের ‘যুদ্ধে যাব’ এবং ‘যুদ্ধ যাত্রার রাত্রি’। ইমদাদুল হক মিলনের একাধিক উপন্যাসে যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাস্তবতা উপস্থাপিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত গুরুত্বের সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন।

আমজাদ হোসেনের ‘যুদ্ধ যাত্রার রাত্রি’ উপন্যাসের একটি অংশে যুদ্ধ সম্পর্কে একটি অসাধারণ বর্ণনা লক্ষণীয়- ‘এমন স্তব্ধতা আমি দেখিনি।…কিন্তু এই ভাষাহীন শব্দ হারানো স্তব্ধতার অন্ধকার চেহারা মৃত্যুর চাইতেও ভয়ংকর।…কোথাও আর গোলাগুলির শব্দ নেই। যুদ্ধ যুদ্ধ মারাত্মক বিস্ফোরক শব্দগুলি সব থেকে গেছে। আর্মিদের জিপ কনভয়েও কোনো রকম দৌড়াদৌড়ি নেই। রাস্তাঘাটে ধুধু অন্ধকার। দূরে দূরে, এখনো আকাশমুখী আগুনের পাহাড় উঠছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। লকলকে আগুন আর ধোঁয়া একাকার হয়ে ঊর্ধ্বমুখে ওড়াউড়ি করছে। অথচ এই আগুনের কোনো ফুটফাট শব্দও শোনা যাচ্ছে না এখানে। যেন বিশাল এক অন্ধকার রাত্রির ফ্রেমে ছবির মতোই আগুন লাগা বিধ্বস্ত ঢাকা শহরের ছবি ঝুলে আছে নিঃসঙ্গ।’ সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমাদের জাতিসত্তার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল একাত্তরে। হুমায়ূন আহমেদ ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ সেই জাতিসত্তা নির্মাণের একটি আখ্যান বিবৃত করেছেন। আখ্যানের নায়ক-নায়িকা নাইমুল ও মরিয়মের ১৯৭১-এর মার্চে বিবাহ হয়। তার পরই আসে ভয়াল ২৫ মার্চ। সেই মার্চের অভিজ্ঞতায় নাইমুল বলে, ‘আমি কিন্তু যুদ্ধে যাব।’ এর উত্তরে মরিয়ম বলেছে, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।’ উত্তরে নাইমুল বলেছে, ‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে- স্বাধীন বাংলাদেশে।’ স্বাধীন বাংলাদেশে নাইমুল ঠিকই ফেরত আসে; কিন্তু যুদ্ধবিক্ষুব্ধ সময়ের স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে আখ্যানের বিস্তৃত অংশজুড়ে।

এভাবে বাংলাদেশের লেখকদের বর্ণনায় যুদ্ধ একটি ভয়ংকর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সন্ত্রাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ফিল্মে ‘হরর’ কিংবা ‘থ্রিলার’ বলতে যা বোঝায় তারই চিত্রকল্প হচ্ছে যুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো যুদ্ধের গল্পে পরিণত হয়েছে। গণহত্যা আর সন্ত্রাসী হামলা এখন মানুষের সাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্রের অনিবার্য উপকরণ। আবার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘সামরিক সাহিত্য’ বা যুদ্ধের সাহিত্য। বাংলাদেশে এই ঘরানার সাহিত্য সৃজন প্রচেষ্টা নতুন। বিশেষত শান্তি মিশনের উদ্দেশ্যে অন্য দেশে অবস্থান করার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের অভিজ্ঞতা লিখে সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত করেছেন। কাজি রাফির উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা'(২০১০) এ রকম একটি সৃষ্টিকর্মের দৃষ্টান্ত।

মূলত যুদ্ধ হলো সশস্ত্র সংঘাত এবং সংঘর্ষ, যা ঘটে থাকে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর রাষ্ট্রের কিংবা দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের আর যুদ্ধ সংঘটিত হয় পৃথিবীর ত্রিসীমানাজুড়ে- স্থল, জল ও আকাশপথে। যুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে রণঝঙ্কারে, মানুষের আর্তনাদে উচ্চকিত হয়ে ওঠে। একটি রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীই প্রধানত যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ যদি একাত্তরের আদলে হয়, যেখানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল; সেই যুদ্ধ আর সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সীমিত ছিল না, তা পরিণত হয়েছিল জনযুদ্ধে। একাত্তরের যুদ্ধ জনযুদ্ধের উজ্জ্বল ইতিহাস। রাষ্ট্র কিংবা দলের খল অথবা মহান নায়করা যুদ্ধ সংঘটিত করেন তাঁদের দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পরিণতিতে উপনীত হওয়ার জন্য। ফলে দীর্ঘায়িত হয় যুদ্ধের ইতিহাস। চরম মূল্য দিতে হয় জনগণকে। সন্ত্রাস, সামাজিক সংহতির বিনষ্টি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় আর রাজনৈতিক কোন্দল অথবা মধ্যস্থতার সমীকরণ পাল্টে যায় যুদ্ধের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। একপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত অন্য পক্ষ নির্মূলের এই পদ্ধতি ও কৌশল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি হিসেবে চিহ্নিত হয়। যুদ্ধের অনুপস্থিতিই হলো শান্তি। শত্রুকে বিতাড়িত করার জন্য বলপ্রয়োগের এই পদ্ধতি বহু পুরনো। কিন্তু এর ফলাফলে থাকে মানবিক বিপর্যয়। অথচ মানুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকে শান্তির সপক্ষে। সব সময় যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলে মানব সভ্যতা টিকত না। শান্তি ও মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্যই রাষ্ট্রে স্থিতি প্রয়োজন। বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধের দরকার হলে এবং তা দীর্ঘদিন বহাল থাকলে যুদ্ধের সর্বজনীনতা আর থাকে না। তা পরিণত হয় বিশেষ কিছু রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষীর অনিষ্টকর কর্মকাণ্ডে।

মানব সভ্যতার ঊষাপর্বে যুদ্ধ ছিল ছোট পরিসরে। বারো হাজার বছর আগে এক গোত্রের সঙ্গে অন্য গোত্রের সংঘর্ষে মারা গিয়েছিল কিছুসংখ্যক মানুষ। আর পাঁচ হাজার বছর আগে রাষ্ট্র ধারণার উৎপত্তি হলে সামরিক বাহিনী তৈরি হয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানে সেই বাহিনীই কাজ করে। তবু যুদ্ধ চলছে এই পৃথিবীতে। এক হিসাবে পৃথিবীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সাড়ে চৌদ্দ হাজার যুদ্ধে প্রায় চার কোটি মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরো অনেক বেশি। মাত্র তিন শ বছর এই বিশ্বের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পেরেছে। স্মরণ করুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। সে সময় ৮৫ লাখ মানুষের জীবন সংহার হয়। যুদ্ধ আসলে আমাদের কী দেয়? যুদ্ধ শান্তি স্থাপন করে। শত্রুকে বিতাড়িত করে সামাজিক জীবনে সংহতি ফিরিয়ে আনে। মানুষে মানুষে বিশ্বাস পুনঃস্থাপিত হয়। অবশ্য আমাদের একাত্তরের যুদ্ধ বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড উপহার দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু নামক মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আমরা পেয়েছি।

সাহিত্যে যুদ্ধ বলতে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ডায়েরি, চিঠিপত্র, স্মৃতিকথাকে বোঝানো হয়ে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান শতাব্দী পর্যন্ত সাহিত্যে যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। হাজারের ওপর গ্রন্থে মানব সভ্যতা ও মানবতা বিপর্যয়ের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে যুদ্ধ প্রতিফলিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের সেই ইতিহাস যন্ত্রণা ও কান্নার ইতিহাস, তা থেকে সাফল্য ও গৌরব এলেও তাতে সত্য হয়ে আত্মপ্রকাশ করে রক্তের প্লাবন। একজন যোদ্ধা হিসেবে কোনো কোনো লেখক প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ময়দান থেকে অভিজ্ঞতার রসদ সংগ্রহ করেছেন। আর অধিকাংশ লেখক যুদ্ধের ফাইল ঘেঁটে তৈরি করেছেন যুদ্ধের ভয়ানক ইতিবৃত্ত। হোমার খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দে সবচেয়ে পুরান যুদ্ধ ট্রজান ওয়ারকে লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর মহাকাব্য ইলিয়াড আর ওডিসিতে।

গ্রিক মিথ অনুসারে ট্রয় নগরীর যুবরাজ প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করার পরই শুরু হয় ট্রয়ের যুদ্ধ। ইলিয়াডে সেই কাহিনীই বিবৃত হয়েছে ট্রয় পুড়ে ছারখার হওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু হেলেন উদ্ধার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহান বীর একিলিসের মৃত্যুও সেই আখ্যানের মর্মন্তুদ উপাদান। জয় ও পরাজয়ের মধ্য দিয়ে একপক্ষের আনন্দোল্লাসের পাশে বিজিত গোষ্ঠীর অবসাদ ও পরাজয়ের গ্লানিও উপেক্ষিত হয়নি মহৎ সাহিত্যিকদের হাতে। ‘মহাভারতে’র কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ভর করে আজও মানুষকে হাহাকারে নিমজ্জিত করে।

উনিশ ও বিশ শতক হলো যুদ্ধ সাহিত্যের স্মরণীয় কাল। টলস্টয়ের (১৮২৮-১৯১০) ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ (১৮৬৯) একটি বহুস্বরিক ও বহুমাত্রিক উপন্যাস। রাশিয়ার অভিজাত জনগোষ্ঠী, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আর রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির অনুপুঙ্খ রূপায়ণ রয়েছে উপন্যাসটিতে। ১৮১২ সালে মহাবীর নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এটির প্লট নির্মিত হয়েছে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫) সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্গারেট মিচেলের (১৯০০-১৯৪৯) ‘গন উইথ দি উয়িন্ড’ (১৯৩৬) একটি রোমান্টিক উপন্যাস। দুটি নর-নারীর প্রেমের সম্পর্কের অমোঘ বিধান হিসেবে গৃহযুদ্ধ ও নির্মীয়মাণ যুগের অশনি আছড়ে পড়েছে গল্পের কাঠামোতে। অন্যদিকে জন জ্যাক দেখালেন যুদ্ধ দূরবর্তী দুই প্রান্তের মানুষকে এক স্থানে টেনে আনে, গড়ে ওঠে সৌহার্দ্য। তাঁর উপন্যাসে দেখা যায়, দুটি চরিত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্কে জড়িত হয়ে শেষ পর্যন্ত সেই সম্পর্কের বাইরে এসে নিজেদের আবিষ্কার করে ওই যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) পৃথিবীর অসংখ্য লেখককে আন্দোলিত করেছে। বিশেষত তার পরপরই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা মানুষকে নতুন সংগ্রামের সম্মুখীন করে। তারা নিজেদের দেখতে পায় আরেক যুদ্ধের করালগ্রাসে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) আত্মজৈবনিক ভঙ্গিতে ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ (১৯২৯) লিখে চমকে দিয়েছিলেন। ইতালির সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুল্যান্সের আমেরিকান ড্রাইভার হেনরি যুদ্ধকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে জীবন সম্পর্কে, বেঁচে থাকার মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। লেখক নিজে ইতালিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কর্মসূত্রে জড়িত ছিলেন যুদ্ধের সময়। তার আলোকে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞকে হেনরির ব্যক্তিগত ঘটনার কার্যকারণ সূত্র দিয়ে নির্মাণ করেছেন। এরিক মারিয়া রেমার্ক (১৮৯৮-১৯৭০) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অসামান্য রূপকার হিসেবে খ্যাত। তাঁর ‘অল কোয়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে’র (১৯২৯) পাতায় পাতায় রয়েছে একজন জার্মান সৈনিকের শারীরিক ও মানসিক চাপ, তাঁর অনুভূতির অসামান্য বর্ণনা। যুদ্ধের ফ্রন্ট থেকে সৈনিকের নিজগৃহে ফেরার আকুতি বর্ণিত হয়েছে শৈল্পিক বুননে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-১৯৩৯) শুরু হয়েছিল সেখানকার সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকজন জেনারেলের স্বঘোষিত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। রিপাবলিকদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্ব বিদ্রোহে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে রিপাবলিকানদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এবং অনেকেই স্পেন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। হেমিংওয়ে সেই কাহিনী নিয়ে ১৯৪০ সালে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন ‘ফর হুম দি বেল টোলস’। উপন্যাসটিতে যুদ্ধের ক্ষত উন্মোচিত, যেখানে মানুষের ভ্রাতৃত্ব নন্দিত হয়েছে। স্মরণীয়, স্পেনের গৃহযুদ্ধ কবি লোরকাকে মহান করে তুলেছিল। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) যুদ্ধে সরাসরি যোগ দিয়ে উপন্যাসের উপকরণ সাজিয়েছিলেন। তাঁর উপন্যাসগুলো ভয়ংকরভাবে বেঁচে থাকা মানুষের কাহিনীতে পূর্ণ। এজরা পাউন্ডের দ্বারা প্রভাবান্বিত এই মার্কিন ঔপন্যাসিক জীবনের অর্থ খুঁজেছেন কঠিন বাস্তবতার মধ্যে। তাঁর উপন্যাসে যুদ্ধোত্তর প্যারিস ও স্পেন নগরের জীবন যেমন আছে তেমনি আছে মনস্তাত্তি্বক সংকটের জালে আবদ্ধ মানুষের ঘটনা। তাঁর অ ঋধৎববিষষ ঃড় অৎসং (১৯২৯) উপন্যাসে যুদ্ধকালীন এক অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভার ও ইংরেজ নার্সের প্রেমের ট্র্যাজিক সম্পর্কের বয়ান রয়েছে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ লেখককে একটি মহৎ সৃষ্টিকর্মে উজ্জীবিত করেছিল।

যুদ্ধের বাস্তবতা রূপায়ণে বাংলাদেশের কবি ও কবিতার ভূমিকা যেমন অনন্য তেমনি বিশ্বের। একাত্তরের যুদ্ধ, যোদ্ধা এবং তার আত্মীয়স্বজন প্রতিদিনের সংঘাত, মানসিক যন্ত্রণা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন আমাদের কবিরা। কখনো কখনো দেখা গেছে, যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকরা কয়েকজন মিলে দেয়ালিকা বের করেছে এবং কবিতা ও গানে সহযোদ্ধাদের মুগ্ধ করেছে। যুদ্ধ এক অর্থে নাটকীয়তায় পূর্ণ আখ্যান বা ঘটনা। মানুষের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আবেগ তথা ভীতি, শঙ্কা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে যুদ্ধের সাহিত্যে। দুর্যোগের মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষের গল্প কার না শুনতে ভালো লাগে। যুদ্ধের মুহূর্তগুলোতে সৈনিক থেকে শুরু করে সাধারণ জনতার অনেকেই তাদের পরিস্থিতির জীবন্ত ক্যানভাস। পৃথিবীজুড়ে সেই ক্যানভাসই সাহিত্যের তুলিতে উদ্ভাসিত।

লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন