১৯২১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রঅনুরাগী ও রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুবাদক স্প্যানিশ সাহিত্যিক হুয়ান রামোন হিমেনেথ-এর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েও কেন শেষ পর্যন্ত স্পেনে গেলেন না, তা নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। অনেক তত্ত্বের উপস্থাপনা করা হয়েছে। কিন্তু আসল কারণটি কেউ ধরতে পারেননি। মূলত স্প্যানিশ ফ্লু-র আক্রমণ থেকে বাঁচতেই যে তিনি হিমেনেথের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েও শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসেন, সেটাই আমার মনে হচ্ছে।
তখন বিশ্ব জুড়ে চলছে স্প্যানিশ ফ্লু-র দাপট।
সাক্ষাৎ শান্তিনিকেতনে, বড় এবং ছোট অর্থে রবীন্দ্র-পরিবারে, জোর হানা দিয়েছিল এই স্প্যানিশ ফ্লু, বম্বে ফ্লু বা যুদ্ধজ্বর। ২ জানুয়ারি ১৯১৯ প্রাণ গিয়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র কৃতীন্দ্রনাথের স্ত্রী সুকেশী দেবীর। স্বয়ং প্রতিমা দেবী মরণের মুখ থেকে ফিরে আসেন। সাংঘাতিক ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন হেমলতা দেবীও, তিনিও কোনও মতে সেরে ওঠেন। ‘ক্যাশবহি’তে ‘‘অকসিজেন গ্যাসের জন্য’’ খরচের সাক্ষ্যর উল্লেখ করেছেন রবিজীবনীকার।
শুধু শান্তিনিকেতন নয়, ‘মীরা দেবী পুত্র নীতীন্দ্রকে নিয়ে হায়দ্রাবাদে ছিলেন। সেখানে তাঁর কনিষ্ঠ দেবর শান্তির ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে মৃত্যু হয়। এর পরে মীরা দেবী ও নীতুও এই রোগে আক্রান্ত হন।’
রক্তের সম্পর্কে অনাত্মীয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আত্মার আত্মীয় অজিতকুমার চক্রবর্তীরও মৃত্যু হয়েছিল এই রোগেই, ছত্রিশ বছর বয়সে। তিনি অবশ্য তখন শান্তিনিকেতন-ছাড়া। ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৮ রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘অজিতের অবস্থার কথা শুনে মন বড় উদ্বিগ্ন হল। বুঝতে পারচি কোনও আশা নেই এবং এতক্ষণে হয়ত জীবনাবসান হয়ে গেছে। অল্প বয়স থেকে ও আমার খুব কাছে এসেছিল — ও যদি চলে যায় ত একটা ফাঁক রেখে যাবে।’
প্রশ্ন হচ্ছে : কল্প-নিরাপত্তার ঘেরাটোপে-মোড়া (রথী ঠাকুর তাই বলেছেন) শান্তিনিকেতন সংসারে কোথা দিয়ে ঢুকল এই মারণ বীজ? ঢুকল ওই বিশ্বকে একনীড়ে আনবার পথ ধরেই। মাদ্রাজ থেকে গাঁধীর ‘কন্যাসম’ এসথার ফেরিং (Esther Faering, ১৮৮৯-১৯৬২) নাম্নী এক ডেনিশ মহিলাকে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে আশ্রমে নিয়ে এসেছিলেন অ্যান্ড্রুজ (যদিও এসথার খুব ভাল ইংরেজি জানতেন না)। ১৯১৮-র বড়দিনে শান্তিনিকেতনে মেয়েদের জন্য/দ্বারা আয়োজিত ‘আনন্দবাজার’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন এসথার, যে-অনুষ্ঠানে সুকেশী দেবীর ছিল অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা। ঠিক তার পরেই এসথার যুদ্ধজ্বরে আক্রান্ত হন। তাঁর সেবায় নিয়োজিত শান্তিনিকেতন-বাসিনীরাও রেহাই পেলেন না। একে একে সুকেশী দেবী, হেমলতা দেবী, প্রতিমা দেবী সবাইকেই ছোবল মারল ওই ভাইরাস। রথী ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আমার এক কাজিন সে-রোগ থেকে আর মুক্তি পায়নি।’ এই ‘কাজিন’ সুকেশী দেবী। রথীবাবুর মতে, ‘কলকাতা থেকে আগত এক অতিথি ওই সংক্রমণের আমদানি করেছিলেন।’ ইঙ্গিতটা স্পষ্টত ফেরিং-এর দিকেই। ফেরিং নিজে অবশ্য সেরে ওঠেন। কিছু দিন পরেই শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান সবরমতী। তার পর ফিরে যান স্বদেশ ডেনমার্কে। অনেক পরে আবার ফিরে আসেন ভারতে। তখন তিনি মিসেস এসথার ফেরিং-মেনন, কেরলের ডাক্তারই কুনি মেনন-এর স্ত্রী। তিনি কি জানতে পেরেছিলেন, কী মারণ-বীজ তিনি পুঁতে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে?
বিবিসির একজন ব্রডকাস্টার অ্যালেস্টার কুক, যিনি ‘লেটার ফ্রম আমেরিকা’ অনুষ্ঠানের জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনিও শৈশবে এই স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি সেই অভিজ্ঞতার কথা ২০০৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছিলেন এভাবে:
“আমি বিছানায় গেলাম এবং হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। জীবনে নিজেকে কখনো এতোটা অসুস্থ মনে হয়নি। শরীরে প্রচণ্ড রকমের ব্যথা হচ্ছিল। ক্লান্তি আর অবসাদে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। গায়ে ছিল প্রচণ্ড জ্বর।”
এইডা ডারউইন নামের একজন নারী বর্ণনা করছিলে যে তার পিতাও কীভাবে এই ফ্লুতে আক্রান্ত হন। রণাঙ্গনে একটি সামরিক হাসপাতালে সৈন্যদের নার্সিং সেবা দিচ্ছিলেন তার পিতা এবং সেখানেই তিনি আক্রান্ত হন।
তিনি বলেন, “সেদিন সোমবার সকাল সকাল। আমার বাবা অসুস্থ। তিনি তো পুরো যুদ্ধের সময় বেঁচে ছিলেন। কতো বিপদ ছিল তার। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসার সাথে সাথেই তিনি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে গেলেন।”
স্প্যানিশ ফ্লুর জন্যে দায়ী এইচওয়ান এনওয়ান ভাইরাস। কিন্তু কথা হচ্ছে এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু কেন হলো? এর সঙ্গে কি স্পেনের কোন সম্পর্ক আছে? লন্ডন কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েলকাম ট্রাস্টের একজন গবেষক মার্ক হনিগসবাউম ১৯১৮ সালের এই মহামারি নিয়ে একটি বই লিখেছেন। নাম ‘লিভিং উইথ এঞ্জা।’ তিনি বলেন, স্প্যানিশ ফ্লু নামকরণের পেছনে কারণ হলো স্পেনের সংবাদ মাধ্যম এই ফ্লুর খবরটি মুক্তভাবে পরিবেশন করছিল।” যখন এই মহামারি শ প্রচারিত হয প্রথম ধাক্কাটি আসে মে-জুন মাসে। কিন্তু এটি স্পেন থেকে আসেনি, এসেছিল আমেরিকা থেকে। তবে ব্রিটেন-আমেরিকা-রাশিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় এই যুদ্ধজ্বরের খবর সেন্সর করেছিল। স্পেন নিরপেক্ষ অবস্থান অবলম্বন করায় এই সংক্রমণজনিত মৃত্যুর কথা ফলাও করে ছাপছিল। তাই সমগ্র বিশ্বে এই মারণসংক্রমণের নাম ‘স্প্যানিশ ফ্লু” হিসেবে চিহ্নিত হয়। যদিও ১৯১৮ সালে খোদ মাদ্রিদে মাত্র ১৮০০ লোকের মৃত্যু হয় এই তথাকথিত স্প্যানিশ ফ্লু-তে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মৃত্যুর হার আরও অনেক বেশি ছিল। রবীন্দ্রনাথ যদি আসল সত্যিটা জানতেন, তবে হয়তো তিনি স্পেনে যেতেও পারতেন হিমেনেথ ও তাঁর বন্ধুদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে।