পাঁচ
‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’। যার নায়ক নবীনকুমার বা কালীপ্রসন্ন সিংহ। সে লেখার বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে আছে হরিশ মুখার্জীর কথা। ইতিহাসের সঙ্গে মোটামুটি সংগতি রেখেই সুনীলদা হরিশ মুখার্জীর কথা লিখেছেন। তাই আমার বই প্রকাশিত হলে আমি তাঁকে বই দিয়ে এলাম। সুনীলদা একদিকে যেমন সর্বগ্রাসী পাঠক, অন্যদিকে গুণগ্রাহী। পরিচয়ের আগে তাঁর চরিত্রের এই দিকগুলি সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম না। ১৫.১২.১৯৮৬ তারিখে একটি চিঠিতে সুনীলদা লিখলেন :
“আপনার ‘হরিশ মুখার্জী : জীবন ও ভাবনা’ পড়ে ফেলেছি এবং ভালো লেগেছে। আপনি প্রচুর তথ্য সংযোজন করেছেন, সময়ের পটভূমিকায় আপনি হরিশের উদ্যম ও বিশ্বাসের যথার্থ বিশ্লেষণ করেছেন।”
নবজাতক প্রকাশন ‘হরিশ মুখার্জী : জীবন ও ভাবনা’ প্রকাশ করেছিলেন। সে বই নিঃশেষিত হবার পরে এডুকেশন ফোরাম ‘হরিশ মুখার্জী : যুগ ও জীবন’ নাম দিয়ে সে বই-এর নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন। ‘দেশ’ পত্রিকার ‘গ্রন্থলোক’ বিভাগে ২০১০ সালের ১৭ মে তার সমালোচনা করেন সোমনাথ রায়। সমালোচনা না বলে তাকে চরিত্রহনন বলা সঙ্গত। ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার প্রতিবাদপত্র প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের ২ জুন। চিঠি লিখে সুনীলদাকে ব্যাপারটা জানাই। ততদিনে সুনীলদা অবসর নিয়েছেন। সুনীলদা আমাকে জানান যে আমাদের দেশে গ্রন্থসমালোচনার সঠিক মানদণ্ড এখনও ঠিক হয় নি।
‘হরিশ মুখার্জী : জীবন ও ভাবনার’ সমালোচনা প্রকাশিত হয় বেশ কয়েকটি পত্রিকায়। ‘যুবমানস’এ ঐতিহাসিক নিশীথরঞ্জন রায় লিখলেন, —
“সম্পূর্ণ এককভাবে হরিশচন্দ্রের জীবনী ও ভাবনা নিয়ে বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব দিলীপ মজুমদারের। এই গ্রন্থটি রচনা করে গ্রন্থকার ইতিহাস অনুরাগী এবং বাংলা ভাষাভাষী মাত্রেরই প্রশংসাভাজন হয়েছেন।”
‘আজকাল’ পত্রিকায় অগ্নিমিত্রও একটি দীর্ঘ সমালোচনা লেখেন। এই অগ্নিমিত্রই পরবর্তীকালে ‘আপোষ করিনি’ নামে হরিশ মুখার্জীর একটি চমৎকার জীবনোপন্যাস রচনা করেছিলেন। অগ্নিমিত্র লিখলেন :
“শ্রী দিলীপ মজুমদার বাংলা সাহিত্যের একটি বিরাট অভাব পূর্ণ করেছেন। এ কথা আবারও বলছি। তাঁর গবেষণারীতির মধ্যে একরোখা মনোভাব এবং পূর্ব সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যগ্রতা নেই। এটি ইতিহাস গবেষকের পক্ষে সুলক্ষণ।”
‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় নন্দগোপাল সেনগুপ্ত লিখলেন :
“বইটি লিখে শ্রীমজুমদার একটি জাতীয় কর্তব্য পালন করেছেন। হরিশচন্দ্রের নামে কলকাতার একটি বৃহৎ রাস্তা চিহ্নিত করে দেশবাসী তাঁকে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, তাঁর কোন প্রতিকৃতি নেই।”
ছয়
‘দেশবাসী হরিশচন্দ্রের প্রতি সুবিচার করে নি’ — ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের এই কথা কয়টি আমার মনে গেঁথে বসে গিয়েছিল। তাই আমি সাধ্যমতো হরিশের প্রচার ও স্মৃতি সংরক্ষণের কথা ভাবছিলাম। পত্র–পত্রিকায় আমার বইটির সমালোচনা প্রকাশিত হওয়ায় কিছুটা প্রচার হয়। ‘সংবাদ প্রতিদিন’, ‘সকালবেলা’, ‘আজকাল’, ‘গণশক্তি’, ‘বর্তমান’ প্রভৃতি পত্র পত্রিকায় চিঠি ও নিবন্ধ লিখি হরিশ মুখার্জী সম্বন্ধে। এই সময়ে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী এক প্রস্তাব দেন। তিনি হরিদাস মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বর্ধমান জেলা পরিষদের সহ-সভাপতি। তিনি বলেন বর্ধমান টাউন হলে সি পি এমের একটি সভায় আসছেন মন্ত্রী অশোক মিত্র। তাঁকে দিয়ে আমার বইটি উদ্বোধন হবে। উদ্বোধনপর্ব শেষ হবার পর হরিদাসবাবু তাঁদের গাড়িতে আমাকে নিয়ে যান হরিশ মুখার্জীর পৈত্রিক নিবাস শ্রীধরপুরে। গ্রামটি বর্ধিষ্ণু। এখানকার সমবায় সমিতি বেশ নামকরা। দেখি হরিশের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। দাশরথি তা মহাশয়ের উদ্যোগে এটি তৈরি হয়। একটি মাটির একতলা বাড়ি দেখিয়ে বলা হয়, সেখানেই হরিশের বাড়ি ছিল। কিন্তু হরিশের আত্মীয়-স্বজনের হদিশ পাই নি। এখানে একটা কথা বলা দরকার। আমার বই প্রকাশিত হবার কিছুদিন পরে আমেরিকা থেকে দিবাকর মুখার্জীর একটি চিঠি পাই। তিনি নিজেকে হরিশ মুখার্জীর প্রপৌত্র বলে দাবি করেন। তাঁর হাতের লেখা ছিল দুর্বোধ্য। আর যে তিনি কি লিখেছিলেন, উদ্ধার করতে পারিনি। ঠিকানা অস্পষ্ট থাকায় তাঁকে চিঠিও দিতে পারিনি।
হরিশের স্মৃতিরক্ষার ব্যাপারে আমি পত্রিকায় বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলাম। যেহেতু শাসক দলের আনুকূল্য ব্যতীত স্মৃতি রক্ষা সম্ভব নয়, তাই ১৯৯২ সালের ১৪ এপ্রিল বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সি পি এমের মুখপত্রে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখি। আমি ভেবেছিলাম হরিশের প্রতিবাদী, যুক্তিবাদী ভাবমূর্তি বামপন্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সরকার যে কার্যকর কিছু করেননি তার একটি প্রমাণ ‘সংবাদ প্রতিদিন’এ ২০১০ সালের ২৮ মে আমার লেখা একটি নিবন্ধ :
“সম্প্রতি হরিশ মুখার্জী রোডে হরিশ মুখার্জীর বাস্তুভিটা বলে পরিচিত একটি বাড়ি ভেঙে বহুতল করার ব্যাপারে পুরসভায় সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষের প্রবল বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে। মেয়র মহাশয়ের বক্তব্যে জানা গেল, যে বাড়িটি ভাঙা হয়েছে সেটিতে হরিশ মুখার্জী জন্মগ্রহণ করেননি, জ্ঞানীগুণী সমন্বিত হেরিটেজ কমিটি সে কথা তাঁদের নিঃসংশয়ে জানিয়েছে।
“হরিশ পার্কের উল্টোদিকে একটি হলুদরঙা দোতলা বাড়ির সামনে দেওয়ালের উপর লাগানো ছিল একটি প্লেট। সেই প্লেটে লেখা ছিল ‘এখানে হরিশ মুখার্জী জন্মগ্রহণ করেন’। এখন প্রশ্ন হল হেরিটেজ কমিটির বক্তব্য অনুযায়ী সে বাড়ি যদি হরিশ মুখার্জীর জন্মস্থান না হয়, তাহলে এই প্লেট কারা কবে লাগিয়েছিল? তার কি কোন রেকর্ড আছে? যে বাড়িটি ভাঙা হল সেটি কবে তৈরি হয়? তার মালিকের নাম কি?
“মেয়র মহাশয় এসব প্রশ্নের উত্তর দেন নি। কোথায় যে হরিশ মুখার্জীর বাড়ি ছিল, হেরিটেজ কমিটি বা পুরসভা এখনও পর্যন্ত তা নির্ণয় করতে পারেন নি। সঠিক স্থান নির্ণয়ের পূর্বে প্রচলিত বিশ্বাসকে বিনষ্ট করা অনৈতিক হয়েছে।”
শুধু কলকাতার মেয়র নন, আমি এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী, পৌরমন্ত্রী, তথ্য-সংস্কৃতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলাম। কোন উত্তর পাইনি।
দুর্ভাগা হরিশচন্দ্রের ছবি সংগ্রহের ব্যাপারেও ব্যর্থ হয়েছি এবং তাজ্জব বনে গেছি। বহু বাংলা ও ইংরেজি জীবনী গ্রন্থ ঘেঁটেছি। কোথাও তাঁর ছবি পাইনি। ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর বর্তমান পত্রিকার ‘রবিবারের পাতায়’ ‘বঞ্চনার শিকার হরিশ মুখার্জী’ নামে আমার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখি শিরোনামের উপর একটি ছবি। হরিশ মুখার্জীর এ ছবি কোথায় পেলেন? পত্রিকার পক্ষে সফিউন্নিসা জানালেন তাঁরা নেট থেকে পেয়েছেন। তখন আমার কম্পিউটার ছিল না। আমি যাচাই করতে পারিনি। কিছুদিন পরে হরিশ মুখার্জীর আর একটি ছবি আমার সামনে হাজির হল। আকাশবাণী কলকাতায় হরিশ মুখার্জী সম্নন্ধে আমার ‘অপরাজেয়’ নামে একটি শ্রুতিনাটক সম্প্রচারিত হয়। প্রযোজনা করেছিলেন সমরেশ ঘোষ। কয়েক বছর বাদে সে নাটক পুনঃ সম্প্রচারিত হলে সমরেশ তার সংবাদ হরিশের ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। বর্তমানের ছবির সঙ্গে এ ছবির মিল নেই। সমরেশ কোথা থেকে পেলেন এই ছবি? তিনি জানালেন নেট থেকে পেয়েছেন। গুগল সার্চ করে আমি এবার সে ছবি দেখতে পেলাম। কিন্তু ছবির সূত্র দেওয়া নেই। ছবিটা আসল না নকল কে জানে!
কতকাল ধরে হরিশ মুখার্জীর সন্ধান করে বেড়াচ্ছি। বারবার ব্যর্থ হয়েছি। কানে ভাসে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা : ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস নাই, বাঙ্গালী ইতিহাস লিখিতে জানে না।’ [শেষ]