মঙ্গল মূরতি তব মারুতি নন্দন।
সকল অমঙ্গল বিঘ্ন বিনাশন ৷৷
পবন তনয় সাধুজন হিতকারী।।
হৃদয়ে বিরাজ কর রক্ষকূল অরি।।
পবনপুত্র হনুমান ভক্ত সমাজের শিরোমনি। ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের কাজ করার জন্যই তাঁর আবির্ভাব, তিনি প্রভুর লীলা সহচর। তিনি যেমন বীর, বলবান তেমনি মহাপণ্ডিত, পরমজ্ঞানী। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জন্য তিনি বহু প্রশংসিত। জন্মই শুরু হয় তাঁর বীরত্বের গাঁথা দিয়ে। জীব ও শিবের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী ভক্ত হনুমান ধীরে ধীরে নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে হয়ে উঠলেন দাস্যভক্তির চুড়ামণি। তাঁর স্মরণ করলে সাংসারিক বাধা বিপত্তি নাশ হয়। ভক্ত বৎসল তিনি। তাই রামচরিতমানস রচয়িতা গোস্বামী তুলসীদাস হনুমান চল্লিশার একেবারে শুরুতেই লিখলেন —
জয় হনুমান জ্ঞান গুণ সাগর।
জয় কপীস তিহুঁ লোক উজাগর॥
হনুমানের এহেন গুণের অধিকারী হওয়ার সূত্রপাত তার জন্মের পর থেকেই। নানান পুরাণে তাঁর জন্মদিন আর জন্মকথার বিভিন্ন কাহিনী রয়েছে। হনুমানের মায়ের নাম অঞ্জনা, পিতা পবন দেবতা, পালক পিতা সূর্যের কৃপাধন্য স্বর্ণময় সুমেরু পর্বতে রাজ্য শাসনকারী বানাররাজ কেশরী। ব্রহ্মপুরাণ মতে, অঞ্জনা পূর্বজন্মে ছিলেন পুঞ্জিকস্থলা নামে এক শাপভ্রষ্ট অপ্সরা। দেবরাজ ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু নিয়ে অঞ্জনা ঠাট্টা করেছিলেন বলে ইন্দ্র তাকে অভিশাপ দেন। তিনি বানরী রূপ লাভ করেন। কিন্তু দৈবিশক্তি সহায় তিনি ইচ্ছামতো যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারতেন।
একদিন অঞ্জনা এক নির্জন পাহাড়ি পথে সবুজ অরণ্যে পাহাড়ের গায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। এমন সময় পবনদেব সেই পথে যাওয়ার সময় দেখতে পেলেন পরামাসুন্দরী, সুনয়নী অঞ্জনাকে। বয়ে যাওয়ার আছিলায় তিনি অঞ্জনাকে ছুঁয়ে গেলেন। অঞ্জনার মধ্যে এক অলৌকিক অনুভূতি হল, যেন কোন পরপুরুষ নির্লজ্জভাবে তাকে আলিঙ্গন করেছে। পতিব্রতা অঞ্জনা ক্ষুব্ধ হয়ে অদৃশ্য বাতাসকে হুমকি দিলেন। তখন পবনদেব সামনে আবির্ভূত হয়ে বললেন — অঞ্জনা ভয় পেয়ো না, তোমার কোন অনিষ্ট আমি করিনি। কেবলমাত্র আলিঙ্গন করে তোমার মধ্যে প্রবেশ করেছি। শীঘ্রই তুমি একটি জ্ঞানী বীরপুত্রের জন্ম দেবে — যার গতিবেগ হবে একেবারে আমার মতই।
নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্জনগুহায় পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন অঞ্জনা। বিষ্ণুর মায়াতে রাবণ বধের জন্য হনুমানজির জন্ম। জন্মানোর পর মাতৃহারা হন হনুমান। শিশু হনুমান মাকে দেখতে না পেয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, সেই সঙ্গে তার খুব খিদেও পেয়ে গেছিলো। তখন ছিল ব্রাহ্মমুহূর্ত। আকাশের সূর্যোদয় হয়েছে সূর্যকে ফল ভেবে ক্ষুধার্ত হনুমান এক লাফে তিনশো যোজন পথ লাফ দিয়ে আকাশে উড়ে গেলেন। পবনপুত্রের কান্ড দেখে দেব দানব যক্ষগণ হতবাক।
সূর্যদেব আগেই জানতে পেরেছিলেন এই শিশু রামচন্দ্রের কাজের জন্য অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন, তার উপর শিশু। তাই সূর্যদেব কৃপা করে হনুমানকে দগ্ধ করলেন না।
সেদিন ছিল সূর্যগ্রহণ। সূর্যকে গ্রাস করবে বলে রাহু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শিশু হনুমান রাহুকেও ফল ভেবে তার দিকে ছুটে গেলেন। কোনমতে রাহু প্রাণ বাঁচিয়ে ইন্দ্রের কাছে নালিশ ঠুকলেন।
অভিযোগ শুনে ইন্দ্র স্থির থাকতে না পেরে বাহন ঐরাবতের পিঠে চড়ে রাহুকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এদিকে রাহুকে দেখে হনুমান আবার লাফ দিলেন। শুধু রাহু নয়, ঐরাবতকে দেখতে পেয়ে তার দিকেও ছুটে গেলেন। তখন ইন্দ্র হনুমানের উপর বজ্র প্রহার করলেন। সেই আঘাতে হনুমান মহাশূন্য থেকে একটি পাহাড়ের উপর গিয়ে আছড়ে পড়লেন। তার বাঁদিকের হনু বা চোয়াল ভেঙ্গে গেল।
পবন দেব পুত্রের এহেন দশা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সমগ্র মর্ত্যের জীবকূলকে নিষ্প্রাণ করে দেবে বলে নিজের গতি রুদ্ধ করলেন। বায়ুর অভাবে সমগ্র জীবকূলের শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার যো, ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো। মর্তবাসীর সংকট দেখে দেবতারা ছুটলেন ব্রহ্মার কাছে। পবন দেবের কোলে শায়িত নিষ্পাপ শিশুর দিকে তাকিয়ে ব্রহ্মার মন বিগলিত হয়ে গেল পুনর্জীবন দান করলেন হনুমানকে। পুত্রকে আবার জীবিত দেখে বায়ু আগের মত বিচরণ করতে লাগলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মর্তবাসি।
ইন্দ্র নিজেই ভুল বুঝে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ নিজের কন্ঠ থেকে পদ্মের মালা খুলে শিশুর গলায় পরিয়ে দিলেন। তাঁরই নিক্ষিপ্ত বজ্রের আঘাতে বামহনু ভেঙে যাওয়ায় স্বয়ং ব্রহ্মার নির্দেশে ইন্দ্র এই শিশুটির নাম রাখলেন হনুমান।একে একে সূর্যদেব বরুণদেব মহাদেব কুবের বিশ্বকর্মা, প্রভৃতি দেবতাদের বরে বলিয়ান হয়ে উঠলেন হনুমান।
আবার শিবপুরাণে কথিত রয়েছে, সমুদ্র মন্থনের সময় ভগবান বিষ্ণু দেবতা ও অসুরদের মধ্যে অমৃত ভাগ করার জন্য অসাধারণ সুন্দরী এক রমণীর রূপ ধারণ করেছিলেন, নাম নিয়েছিলেন মোহিনী। শিবের সেই অপূর্ব জগত মোহিনী রূপ দেখে রেতঃপাত হল। জগৎ কল্যানার্থে সেই রেতঃ সপ্তর্ষি একটি পাতার দোনায় সংরক্ষণ করে রাখলেন। বহুবছর ধরে পুত্র না হওয়ার জন্য অঞ্জনা যখন উচ্চকোটির তপস্যা করছিলেন ভগবান শিবের, তখন তার কর্ণ দিয়ে প্রবেশ করানো হয়েছিল এই রেতঃ। জন্ম হল শিবের অংশজাত পরাক্রমী হনুমানের।
বিষ্ণুর মায়াতে রাবণ বধের জন্য হনুমানজির জন্ম। সুতরাং দেবনির্ভর এই জন্ম হলো বিধির বিধান। হনুমানজি পরবর্তী সময় সূর্যকে গুরু রুপে বরণ করে তার থেকে বেদবেদান্ত, ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন। আকাশ পরিক্রমা করতে করতে মাত্র ষাট ঘন্টায় বেদ ও ষড়দর্শন পাঠ শেষ করে ফেলেন। অধ্যায়ন শেষে হনুমানজি গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলে সূর্যদেব বলেন তার পুত্র সুগ্রীবের সহচর ও মন্ত্রী হয়ে থাকতে।
সাধারণত মঙ্গলবার পবন পুত্রের জন্য উৎসর্গিকৃত। চৈত্র সংক্রান্তির মঙ্গলবার চিত্রা নক্ষত্রে হনুমানজির জন্ম হয়েছিল। বহু বছর পর এবছরই এই যোগ পড়েছে আজ। চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথি শুরু হয়েছে ২৩ শে এপ্রিল ভোর ৩:২৫ থেকে কাল অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল ভোর ৫:১৮ মিনিট অবধি।
জীবনের অন্তে মরণ অবসম্ভাবী। তবে ব্যতিক্রমও দেখা গিয়েছে মহাকাব্য ও পুরাণগুলিতে। মহাকাব্যের পাতা ওল্টালে সাতজন এমনই চরিত্রের নাম উঠে আসে যারা অমরত্ব পেয়ে চিরঞ্জীবী হয়ে আছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলেন হনুমানজি। যুগে যুগে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য-সিদ্ধি করার জন্যই তাদের অমর করে রাখা হয়েছে।
লোকবিশ্বাস গাড়ওয়াল হিমালয় আজও দেখা যায় হনুমান পৃচ্ছশৃঙ্গ ও হনুমান টিব্বা। বিশ্বাস নিয়ে সংকটমোচন হনুমানজীর নাম নিলে ভক্তরা তার ফল নিশ্চয়ই পান। আর পান ভক্তের সঙ্গে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র ও মাতা সীতাকে। তাঁকে স্মরণ করতে থাকলে সব বাধাবিঘ্ন কাটে। ভক্তের দাস্যভক্তি তার পূজার প্রধান উপাচার। সঙ্গে সামান্য গরিব দুঃখী কে দান করলে সবকিছু আরো মঙ্গলময় হয়।
ভক্তি কোন বাসনা পূরণের পথ নয়। একমাত্র ভক্তিই সমাদয় বাসনা নিরোধের কারণ স্বরূপ। ভগবান গীতার দ্বাদশ অধ্যায় বলেছেন,ভক্তি এমনই যা কর্মযোগ জ্ঞানযোগ ও ক্রিয়াযোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ভক্তি বা প্রেম দেশকালের অতীত, পূর্ণস্বরূপ, নিরপেক্ষ। হনুমানজি ছিলেন সেই ভক্তিরই পরাকাষ্ঠা। তাই ভক্তিভরে হনুমান চল্লিশা এবং হনুমান অষ্টকের নাম জপ করলে সংকটমোচন ঘটে।পাঠ মানেই তো প্রার্থনা। এই বিশ্বাসে বিশ্বাস রেখে মঙ্গলময় হোক সকলের জীবন।
ওঁ শ্রী হনুমান চালিশা ওঁ।।