সোমবার | ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৫৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘বিকাশের বিয়ে’
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বাঁধের এপার ওপার : মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য

মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য / ১৬৬ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।

রংদার চকমকি মন্তাজের উৎসব আজ হার মেনেছে নিস্তব্ধতার কাছে। উৎসব শুরুর লাল, নীল, গোলাপী আলোর মালা এবার নামাতে হবে যে! বছরের শেষ পূজো মা জগদ্ধাত্রীরও বিসর্জন পর্ব শেষ হয়েছে। নিঃশব্দে আসা শীতের ঝরাপাতা যেন বলে ওঠে, “সকলি ফুরালো স্বপনপ্রায়।”

আজ সকাল থেকেই ঋকের মন খারাপ। সকাল সকাল কপালে জুটেছে মায়ের বকুনি। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আগেই ও ছোট ছোট আলোর মালায় বাড়ি সাজিয়েছিল। রোজ সন্ধ‍্যেবেলায় সেগুলো জ্বালিয়ে দিলেই আনন্দে ভরে ওঠে মন। কিন্তু ওর মা জলি বুঝলে তো!

স্টার মার্কস পেয়ে হায়ারসেকেণ্ডারী পাশ করার পর ঋক কলকাতার কলেজে ভর্ত্তি হয়েছে। কিন্তু কলেজ, টিউশন সেরে বাড়ি ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। শরীর ক্লান্ত থাকায় পড়াশোনাটাও ঠিকমতো হচ্ছে না। সব পুজো শেষ হয়ে গেলেও  মন থেকে উৎসবের রেশ যেন কাটতেই চাইছে না।

ছেলের এমন কাণ্ড দেখে জলি আজ আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারে নি। অফিস বেরোনোর আগে ছেলেকে শাসিয়েছে, “এবার পুজোর গন্ধ গা থেকে মুছে আজই সব আলোর মালা খুলে ফেলবি; নইলে অফিস থেকে ফিরে আমিই সব টেনেটুনে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলব। যা এবার পড়াশোনায় মন দে।”

মা অফিস বেরিয়ে যেতেই ঋক গুটিগুটি নিজের ঘরে ঢুকে বইপত্তর নিয়ে খাটের ওপর বসে, কিন্তু বইগুলো ছুঁয়ে দেখতেও ইচ্ছে করে না। চারপাশে ছড়ানো বইয়ের মাঝেই শুয়ে পড়ে ও। ঠাম্মা এসে মাথায় হাত রেখে বলে, “মন খারাপ কোরো না দাদুভাই। শেষ না হলে শুরুর আনন্দ যে থাকে না।” ঠাম্মার দিকে অবাক হয়ে তাকায় ও। তারপর একলাফে উঠে বসে ঠাম্মার গলা জড়িয়ে ধরে। মনের ভেতরে জমে থাকা শুকনো পাতা যেন মর্মর শব্দে গুঁড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় উত্তুরে হাওয়া।

ঋক ছাদে উঠে আলোর মালা খুলতে শুরু করে। বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারে পচার চায়ের দোকান। দোকান থেকেই পচা চেঁচায়, “কি গো ঋকবাবু, সব আলো খুলে ফেলছ যে! এখনও তো বড়দিন বাকি।”

“বড়দিন তো সাহেবদের জন্যে গো পচাকাকু। তখন ওরা সাজাবে, আমরা দেখব।” ঋক হাসে।

হঠাৎ খিক্ খিক্ শব্দ শুনে ঋক ছাদের আলসে থেকে বাড়ির নীচের দিকে তাকায়। দেখে ভেবলু ওপর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই ভেবলু পেছন ফিরে রাস্তা পেরিয়ে চলে যায়।

বছরখানেক আগে এপাড়ায় ভেবলুর আগমন। পচার দোকানের সামনে চুপ করে বসে থাকে, কেউ কিছু খেতে দিলে ইচ্ছে হলে খায় নাহলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কিছু জিজ্ঞাসা করলে কোনো উত্তর দেয় না। খানিকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার মাথা নীচু করে আপনমনে বসে থাকে। সেই থেকেই ওর নাম হয়ে যায় ভেবলু।

ঋকের ঠাম্মা কয়েকদিন ধরেই ব‍্যাপারটা লক্ষ্য করে একদিন দুপুরে কাগজের থালায় ভাত,তরকারি নিয়ে গিয়ে ওর সামনে রেখে বলেছিল, “খেয়ে নাও”। ভেবলু সামনে রাখা থালাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। ঋক স্কুল থেকে ফিরে দেখে ঠাম্মা মন খারাপ করে বসে আছে। তারপর ভেবলুর কাণ্ড শুনে বলে, “চিন্তা কোরো না ঠাম্মা, কাল রবিবার। স্কুল ছুটি। আমি যাব ওর খাবার নিয়ে।”

পরদিন দুপুরে যথারীতি পচার দোকানের সামনে বসে ভেবলু ঝিমোচ্ছিল। ঋক ডাকে, “ভেবলু ও ভেবলু”। চোখ খোলে ভেবলু, তারপর চোখ কুঁচকে ঋকের দিকে তাকিয়ে থাকে। পচা বলে, “অমন করে কি দেখছিস রে? ও ঋক। তোর জন্যে খাবার এনেছে।”

ভেবলু যেন খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ঋক ওর সামনে খাবারের থালাটা নামিয়ে রাখতেই ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ভেবলু। ঋক প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “খেয়ে নাও ভেবলু।”

হাত ছেড়ে দিয়ে থালাটা টেনে নেয় ও। তারপর গোগ্ৰাসে খেতে শুরু করে। এরপর থেকে ঋক প্রতিদিন স্কুলে বেরোনোর সময় ওকে কিছু না কিছু খেতে দিয়ে যায়। ভেবলু কি বোঝে কি জানি ঋককে দেখলেই বলতে থাকে খিক্ খিক্ খিক্। ঠাম্মা বলে, “ও তো সুস্থ নয় দাদুভাই, তাই বোধহয় ঋক বলতে পারে না।”

নিরীহ ভেবলু থেকে যায় ওর খিকের দেওয়া খাবার আর পচার দোকানের আশ্রয়ে।

********

বেলা একটার সময় মোটরবাইকটা বিকট আওয়াজ তুলে বাড়ির গেটে এসে থামল। ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে রীতা এসে দরজা খোলে। মানিক ঘরে ঢুকেই হাতে ঝোলানো কালো প্লাস্টিকের ব‍্যাগদুটো রীতার হাতে ধরিয়ে দেয়।

“রাতে ক’জন বন্ধুবান্ধব আসবে, একটু মেটে চচ্চড়ি আর তোপসে ফ্রাই করে রেখ। সবাই বলে, মদের সাথে আমার বৌয়ের হাতে তৈরী চাট খেলে নিজেকে রাজা-উজির মনে হয়।” বলেই রীতার গালদুটো টিপে দেয় ও।

রীতা এক ঝটকায় সরে যায়, “খবরদার দিনে-দুপুরে মদ গিলে পিতলা-পিরীত করতে এসো না। তোমার সব্বোনাশ স্বয়ং ভগবানও ঠেকাতে পারবে না।”

এবার রেগে যায় মানিক, “অশিক্ষিত মেয়েমানুষ!”

“ঠিক বলেছ” রীতা বলে, “কিন্তু আমি অশিক্ষিত হলেও বুঝতে পারি যে তোমার ক্লাস এইটের বিদ‍্যে সম্বল করে বাজারে সব্জি বেচে রোজ রোজ মুর্গী, মটন খাওয়া যায় না। এই পেল্লায় বাড়ি বানিয়ে নবাবী চাল দেখানো যায় না। অসৎ উপায় না থাকলে এভাবে দুহাতে টাকা ওড়ানো যায় না। যেদিন মাটিতে আছড়ে পড়বে সেদিন আর ওঠার ক্ষমতা থাকবে না জেনে রাখ।”

খ‍্যাকখ‍্যাক করে কানএঁটো করা হাসি হাসে মানিক। বলে, “দেখো, আকাশের ঐ গনগনে সূর্যটাকেও একদিন ধরে ফেলব। আর তোমার ঐ জ্ঞানের ঝুলি সূর্যের তেজে ছাই হয়ে যাবে। তখন দেখবে, আমার নিয়ম তোমার নিয়ম সব এক হয়ে মিলে যাবে। এখন মেলা না বকে যেটা বলেছি সেটা করোগে যাও।”

হেঁড়ে গলায় গান ধরে ও, “আছে গৌর নিতাই নদীয়াতে, কালীঘাটে আছে কালী” তারপর একটু থেমে বলতে থাকে, “হুঁ হুঁ বাবা, কালীঘাটে কালী না; আছে আমার দেবী। দেবীর প্রসাদ আমি খাই।”

বাড়ির ভেতর চলে যায় মানিক।

“তোমার পাপের ঘড়া পূর্ণ হতে আর বেশি দেরী নেই। এ সংসার একদিন ছারখার হয়ে যাবে।” গজগজ করতে করতে রীতা প্লাস্টিকের প‍্যাকেট দুটো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

আজ অনেকদিন পর রীতার মনটা খুব ভালো রয়েছে। গতকাল হায়ারসেকেণ্ডারী পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। ছেলে জয় কোনোরকমে পাশ করে গেছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী স্কুলের গণ্ডী না পেরোলেও ছেলেটা যে কলেজের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পেরেছে এতেই ওরা খুশি। সকাল সকাল মন্দিরে গিয়ে ও পুজো দিয়ে এসেছে। তারপর ছেলের পছন্দমতো লুচি আর সাদা আলুচচ্চড়ি বানিয়েছে। মানিক নিয়ে এসেছে জয়ের পছন্দের ছানার জিলিপি। জলখাবার খাওয়ার পর্ব মিটলে মানিক ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বলে, ফিরতে দেরী হতে পারে।

সন্ধ‍্যের একটু আগে পাড়া কাঁপিয়ে মোটরবাইক নিয়ে বাড়ি ফেরে মানিক। রীতার জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের কথা বুঝতে পারে। বলে, “জয় পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। চলে আসবে এখুনি।”

বলতে বলতেই একটা ঝকঝকে নতুন বাইক এসে থামে বাড়ির সামনে। রীতা অবাক হয়ে দেখে বাইক থেকে নামছে জয়, মাথায় হেলমেট। হেলমেটটা খুলে মার দিকে তাকিয়ে হাসে জয়। বলে, “দ‍্যাখো, বাবা সারপ্রাইজ গিফ্ট দিল।”

অজানা আশঙ্কায় শিউরে ওঠে রীতা। এই দানবীয় দুচাকা ও মোটে সহ‍্য করতে পারে না। মানিক বাইক নিয়ে যতক্ষণ বাইরে থাকে ততক্ষণই যেন ও ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। এটা ভালো করে জানে বলেই মানিক বাইকটা বুক করা থেকে আজকে আনতে যাওয়া পর্যন্ত ওকে কিছুই জানায় নি।

জয় এগিয়ে এলে রীতা ছেলের মাথায় হাত রাখে তারপর ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

জয় কলেজে ভর্ত্তি হয়েছে। পকেট ভরা টাকা আর বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো বাঁধনহীন জীবনে অভ‍্যস্ত হয়ে উঠছে ও। রীতা মানিককে বলে, “এখনি লাগাম না টানলে ছেলে বিপথে চলে যাবে।”

মানিক বিরক্ত হয়, “ওসব বুলি কপচিও না। সোজা পথে আজকাল কিস‍্যু হয় না বুঝলে! আমার ছেলে আমার মতই হবে।”

এরপর থেকে রীতা ওর কাছে আর কখনও কোনো অনুযোগ জানায়নি।

আজকাল প্রায়শই মাঝরাত পার করে জয় বাড়ি ফেরে। রীতা সভয়ে তাকিয়ে দেখে পড়াশোনা শিকেয় তুলে ছেলে দিন দিন বাপের ছায়া হয়ে উঠছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে, “বাবা জানে।”

কাল সারারাত বাড়ি ফেরেনি জয়। ফোন করলে ফোন বেজে যাচ্ছে, ধরছে না। মানিক আজ বড়ই অস্থির। এখানে সেখানে ফোন করতে থাকে। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে যায়। বেলা বাড়তে থাকে। উৎকন্ঠিত হয়ে রীতা বারবার ফোন করতে থাকে মানিককে। একবারই মাত্র ফোন ধরে ও। বলে, “ছেলেকে নিয়েই ফিরব। দেরী হবে। বিরক্ত কোরো না।”

সন্ধ‍্যেবেলায় মানিক ফেরে। কাঁচের গাড়িতে সাদা ফুলের মাঝখানে শুয়ে জয় ফেরে। ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞান হারায় রীতা।

পরে জানতে পারে মদ‍্যপ অবস্থায় বাইকের পেছনে বান্ধবীকে বসিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটছিল জয়। ফ্লাইওভারের বাঁকের মুখে টাল সামলাতে না পেরে বাইকসমেত ওপর থেকে নীচে পড়ে যায়। দুটো জীবন অকালে ঝরে পড়ে। চোখে আগুন নিয়ে রীতা এসে দাঁড়িয়েছিল মানিকের সামনে। কিন্তু মানিক তখন অন্য মানুষ। ভাষা হারিয়ে ফেলা নিজেকে গুটিয়ে রাখা জড়ভরত। শুধু ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রীতা ফিরে গিয়েছিল নিজের ঘরে। আর কখনো ওর মুখোমুখি হয়নি। কিছুদিন পর মানিকও কর্পূরের মতো যেন বেমালুম উবে গেল। কেউ তার কোনো খোঁজ রাখল না।

********

অঘ্রাণ শেষ হতে না হতেই উৎসব শেষের হিমেল হাওয়ায় মন ভারী হয়ে যায় ঋকের। ল‍্যাম্পপোস্টের বাল্বের হলুদ আলো মলিন হয়ে নিশ্চুপ আবেগে জড়িয়ে রাখে রাস্তা। এখানে শীতের রাতে উজ্জ্বল নিয়নবাতি, সার্কাসের তাঁবু, ঝকমকে মেলা নেই। আটপৌরে শীত পথিককে কানে কানে বলে, বাড়ি ফেরো। ভালোবাসার ওম্ পাবে।

আজকাল জলি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে প্রায়ই দেখে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঋক ঘুমিয়ে পড়েছে। শাশুড়ীর আপত্তি সত্ত্বেও ও ঠিক করে ঋকের কলেজ, টিউশন যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটা স্কুটি কিনে দেবে। অকালে পিতৃহীন ঋক মা, ঠাম্মার ছায়ায় বড়ো হয়ে উঠেছে। জলি বোঝে যে শান্ত স্বভাবের ঋক সবদিক সামলে চলতে জানে।

ঋক আজই প্রথম স্কুটি নিয়ে কলেজ যাবে। বাড়ি থেকে বেরোতেই পচা হাঁক দেয়, “কি গো ঋকবাবু, তোমার বাহনটিতো বেশ খাসা হয়েছে!”

ঋক হাসে। দেখে ভেবলু মাথা নীচু করে পচার দোকানের পাশে বসে আছে। পচা ভেবলুকে বলে, “ঐ দেখ ভেবলু, তোর খিক্ নতুন স্কুটি চড়ে কলেজে যাচ্ছে।।”

ভেবলু কোনো সাড়া দেয় না। ঋক চেঁচায়, “ও ভেবলু, এই দেখ আমার নতুন স্কুটি।” ঋকের গলার আওয়াজে ভেবলু মাথা তোলে। চোখ কুঁচকে একটু দেখে। তারপরই এক ঝটকায় উঠে টলতে টলতে রাস্তা পেরিয়ে ঋকের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

পচা বলে, “ঋকবাবু, তোমার খিকও খুব খুশি হয়েছে। তোমার বাহন দেখতে যাচ্ছে।”

ভেবলু ঋকের কাছে এসেই স্কুটি ধরে প্রাণপণে ঝাঁকাতে থাকে, আর জোরে জোরে দুপাশে ঘাড় নাড়াতে থাকে।

ঋক হতভম্ব হয়ে বলে, “তোমার পছন্দ হয়নি ভেবলু?” দোকান ছেড়ে দৌড়ে আসে পচা। ওকে টেনে সরাতে চায়। কিন্তু ওর গায়ের জোরের সাথে পেরে ওঠে না। হঠাৎই ভেবলু স্কুটি ছেড়ে দিয়ে সজোরে ঋকের গালে চড় মারে। তারপর নিজের জায়গায় ফিরে শুয়ে পড়ে।

রাত্রি আটটা। ঋক বাড়ি ফেরার সময় দেখে পচার দোকানের সামনে বেশ ভিড়। আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দু-চারজন দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে স্কুটিটা ঢুকিয়ে রেখে ও এগিয়ে যায় জটলার দিকে। শোনে, ওকে চড় মারার পর ভেবলু নিজের জায়গায় ফিরে এসে সেই যে শুয়ে পড়েছে আর কোনো সাড়া দেয়নি। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে, গলার কাছটায় কিরকম দলা পাকিয়ে আসে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ও। বাড়ি ফিরে আসে। নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে। ঠাম্মা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালায়। নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “সকালের ঘটনাটা আমি শুনেছি দাদুভাই। হয়তো কোনো একসময় এইরকম কোনো মোটরবাইক ওর জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। হয়তো সেইজন্যই তোমাকে দেখে ওর অন্ধকারে ঢাকা মন বিপদের আশঙ্কায় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। ও আজ তোমার মনে একটা অন‍্যরকম আলো জ্বেলে দিয়েছে দাদুভাই। সে আলো সংযত হতে বলে।” ঋক উঠে বারন্দার গ্ৰীলের ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। তখন পৌরসভার গাড়ি তুলে নিয়ে যাচ্ছে ভেবলুকে। কুয়াশার চাদরে আড়াল হয় খিক্।।


আপনার মতামত লিখুন :

4 responses to “বাঁধের এপার ওপার : মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য”

  1. বিমলেন্দু ভট্টাচার্য্য। says:

    মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।এত ঝরঝরে পরিশুদ্ধ শব্দচয়ন একবারে শেষ না করে ছাড়া যায় না। আপনাকে অভিনন্দন জানাই। এমন পরিচ্ছন্ন জীবনের স্বপ্ন দেখার চোখ আছে । ভালো থাকবেন।

  2. অরুন্ধতী বসু says:

    এক কথায় অনবদ্য……

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন