সোমবার | ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৫৬
Logo
এই মুহূর্তে ::
রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘বিকাশের বিয়ে’
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বাংলার ঐতিহ্যবাহী হালখাতা উৎসব : সুখেন্দু হীরা

সুখেন্দু হীরা / ২৯৭ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।

বাংলা নববর্ষ আসলেই আমার শৈশবের হালখাতার কথা মনে পড়ে। ছেলেবেলায় নতুন বৎসর পদার্পণের আনন্দের চেয়ে বেশি আনন্দ ছিল ‘হালখাতা’র। বেশিরভাগ ভাগ হালখাতা হ’ত নববর্ষের দিন। আর হালখাতায় পাওয়া যেতো একটা প্যাকেট মিষ্টি, আর একটা ক্যালেন্ডার। আমার মিষ্টির প্রতি অত লোভ ছিল না। আমার লোভ ছিল ক্যালেন্ডারটার প্রতি। ক্যালেন্ডারের রঙিন ছবি ছিল আমার মূল আকর্ষণ। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য বা ঠাকুর দেবতার ছবি ছিল ক্যালেন্ডারগুলোর প্রধান উপজীব্য।

তখন আমার অবশ্য ঠাকুর দেবতার ছবি বেশি পছন্দের ছিল। যে ক্যালেন্ডারের ছবি বেশি পছন্দ হত, সেগুলো আমি সংগ্রহ করে তুলে রাখতাম, ভবিষ্যতে বাঁধবো বলে। এভাবে অনেক ক্যালেন্ডারে ছবি আমি জমিয়ে ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে সেগুলো আর বাঁধানো হয়নি। কালের স্রোতে কোথায় যে হারিয়ে গেছে!

একবার আমি এত ক্যালেন্ডার সংগ্রহ করেছিলাম যে, ঘরের দেওয়াল ভরে গিয়েছিল। তা দেখে আমার পিতৃদেব বলেছিলেন, ‘ঘরটাকে সেলুনের মতো মনে হচ্ছে’। আগে যখন সফেস্টিকেটেড সেলুন ছিল না, তখন সেলুন দোকান ক্যালেন্ডার দিয়েই সৌন্দর্যায়ন করা হত। এ নিয়ে একটা জোকস পড়েছিলাম। এই সুযোগে সেটা বলে নি, লেখাটা মুচমুচে হবে।

একটা সেলুনে হাড় হিম করা ভয়ংকর সব ছবি লাগানো ছিল। তা দেখে এক খরিদ্দার বলেছিল, “এরকম সব ভয়ংকর ছবি লাগিয়েছেন কেন”? সেলুন কর্তা জানিয়ে ছিলেন, “ছবিগুলো দেখে খরিদ্দারের চুল খাড়া হয়ে গেলে, আমার কাটতে সুবিধা হয়”।

সেলুনে হালখাতা হতে আমি দেখিনি। তবে আমি চোলাই মদের দোকানের হালখাতা হতে দেখেছি। আমি যখন কর্মসূত্রে বারুইপুর মহকুমায় ছিলাম, তখন জয়নগর থানা এলাকার একটি চোলাই মদের ঠেক ভাঙতে গিয়েছিলাম আবগারি দপ্তরের সঙ্গে। সেই দোকানে দেখি দেওয়ালে লেখা “হালখাতা আগামী ২২ শে ফাল্গুন”।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় কোনও নির্দিষ্ট দিনে হালখাতা হয় না। এক এক দোকানে, এক একদিন হালখাতা হয়। সেদিন দোকান ফুল দিয়ে সাজানো হয়। মাইক বাজে, ক্যালেন্ডার ছাপায়, প্রধানত বাংলা ক্যালেন্ডার। বছরের মাঝখানে হালখাতা হলেও সেই বছরের ক্যালেন্ডার দেওয়া হত। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। খরিদ্দাররা তাদের সমস্ত পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দেয়। খরিদ্দারসহ দোকানদারের আত্মীয়-স্বজনদেরও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। কোনও কোনও দোকানে বছরে একাধিকবার হালখাতা হয়।

আমি বড় হয়েছি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। সেখানে হালখাতা হত পয়লা বৈশাখ ও অক্ষয় তৃতীয়াতে। পয়লা বৈশাখে বেশি হত। আমরা এমনিতে নগদে জিনিসপত্র কেনার পক্ষপাতী ছিলাম। কিন্তু ফাল্গুন-চৈত্র মাসে জিনিস কিনলে ধার বাকি রাখতাম। যাতে ধার শোধ করার নাম করে হালখাতার দিন সেই দোকানে যেতে পারি এবং একটা ক্যালেন্ডার লাভ করতে পারি। ধার বাকি না থাকলে দোকানদার নেমতন্ন করত না। আসলে আমরা এমন কোনও ‘লক্ষী খরিদ্দার’ ছিলাম না, আমাদের এমনি এমনি নেমতন্ন করবে!

হালখাতা’য় নেমতন্ন করলে, হালখাতার দিন কিছু টাকা দিয়ে খাতা খুলে আসা দস্তুর। তাহলে খামোকা আগে আগে টাকা জমা রেখে আসার মতো বিলাসিতা আমাদের ছিল না। তাই বছরের শেষে দোকানে কিছু ধার-বাকি রাখা হত। আর পেয়ে যেতাম হালখাতার চিঠি, আর তাতে উল্লেখ থাকত ধার বা বাকি টাকার পরিমাণ।

পাড়ার হালখাতায় আমরা সাধারণত বাংলা ক্যালেন্ডার পেতাম। বাংলা ক্যালেন্ডার পঞ্জিকার কাজ করত। সেখানে ইংরাজি বছরের ক্যালেন্ডার ভীষন সাহেবি। শুধু সরকারি ছুটির লাল কালির দাগ ছাড়া আর কিছু বোঝা যেত না। এই সমস্যাটা বেশি মুখোমুখি হলাম চাকরি পাওয়ার পর। কর্মক্ষেত্রে যেখানে অবস্থান করতাম, সেখানে শুধুই সাহেবি ক্যালেন্ডার এবং সঙ্গে একটা ডায়রি লাভ হ’ত। বাংলা হালখাতার আভাস পর্যন্ত পেতাম না। একে-ওকে বলে একটা বাংলা ক্যালেন্ডার জোগাড় করতাম।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ছাড়া অন্য সব জেলায় পয়লা বৈশাখ ও অক্ষয় তৃতীয়াতে হালখাতা হতে বেশি দেখা যায়। মালদহ জেলাতে গাজলের দিকে ধানমিল, সাইকেলের দোকানে বিশ্বকর্মা পূজার দিন হালখাতা করতে দেখা যায়। খরিদ্দারদের কার্ড দিয়ে পূজার নেমতন্ন করে, সঙ্গে থাকে বকেয়া টাকা মেটানোর আবেদন। একজনকে দেখেছি বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন হালখাতা হতে। তাঁর অবশ্য সারের দোকান। কারণ জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল, তিনি ড. বি. আর. আম্বেদকরের ভক্ত। ড. আম্বেদকর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

বাংলায় ‘হাল’ শব্দটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যে একটি অর্থ হল বর্তমান। যেমন হাল সাকিন, হাল খাজানা, হালখাতা। বাস্তবে হালখাতা মানে হ’ল নতুন খাতা। বিগত বছরের হিসাব মিটিয়ে নতুন বছরের হিসাব কিতাবের জন্য নতুন খাতা খোলা।

হাল-খাতার নামকরণের একটি ব্যাখ্যা হরিপদ ভৌমিকের “পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ নয়” বইতে পড়লাম। মানুষ যখন স্থায়ী হয়ে চাষবাস শুরু করল, তখন লাঙ্গল অর্থাৎ হালের ব্যবহার শুরু করল। তারপর চাষের জিনিসের বিনিময় প্রথা শুরু হল। তখন হালের দ্রব্য অর্থাৎ কৃষিজ ফসলের বিনিময়ের হিসাব রাখার জন্য ‘খাতার’ প্রয়োজন পড়ল। আর খাতাটির নাম হল ‘হালখাতা’।

তখন থেকেই হিসাব-নিকাশের জন্য নতুন খাতা খোলার একটা দিন ঠিক ছিল। মুঘল সম্রাট আকবর সেই অনুকরণে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন রাজস্ব আদায়ের ‘পুণ্যাহ’ চালু করলেন। পরবর্তীকালে বাংলা নবাবরা ওই দিনটিকেই রাখলেন রাজস্ব আদায়ের পুণ্যাহ। অনেকে এই কারণে আকবর ১ বৈশাখ বাংলা নববর্ষ শুরু করেছিলেন বলে দাবি করেন।

অনেক বিশেষজ্ঞগণ বলেন ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ নয়। আমরা সে বিষয়ে কিছু বলছি না, কারণ আমাদের বিষয় হালখাতা। তাঁরা অবশ্য বলেন ১লা বৈশাখ হল হালখাতা। আমরা আগে দেখলাম শুধু পয়লা বৈশাখ নয়, বছরের অন্যান্য দিনেও ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান হয়। তবে এটা ঠিক পয়লা বৈশাখ হালখাতা সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এই বঙ্গে। সেকালের কলকাতার হালখাতা অনুষ্ঠানে সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ড. অতুল সুর তাঁর ‘বাংলা ও বাঙালী’ পুস্তকে।

“আগেকার দিনে নববর্ষ বলতে বোঝাত হালখাতার দিন। আজকালও দোকানদাররা হালখাতা করে বটে, কিন্তু আগেকার দিনের সে রেশ নেই। আমরা ছেলেবেলায় যে হালখাতা দেখেছি, তার দৃশ্য এখনও দেখতে পাওয়া যাবে পঞ্জিকার পৃষ্ঠার ছবিতে। বাস্তব জগতে তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তাছাড়া হালখাতার দিনে ময়রারা একরকম মিঠাই তৈরি করত, যার নাম ছিল ‘হালখাতার মিঠাই’। সে মিঠাই তারা বছরে মাত্র একদিনই তৈরি করত। এখন (১৯৮০) আর সে মিঠাই তৈরি হয় না।

আজকের দিনে দোকানদাররা হয় কালীঘাটে, আর তা নয়তো দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরে তাঁদের নতুন খাতা পূজা করিয়ে নিয়ে আসে। আগেকার দিনে তা করত না। দোকানেই সকালবেলা গণেশ পূজা ও খাতা মহরত হত। খাতা মহরত মানে, নতুন খাতায় সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা ও দেবতার নাম লেখা। কোনো কোনো দোকানে হয়তো আজও গণেশ পূজা হয়, কিন্তু আগেকার সে জাঁকজমক নেই। বিকালে দোকানে নিমন্ত্রণ করা হত খরিদ্দারদের। দোকানে সেদিন ফরাস পেতে আসর তৈরি করে নিমন্ত্রিতদের আদর- আপ্যায়ন করা হত। সকলের গায়ে গোলাপ জল ছড়ানো হত। আসরের মাঝখানে বসানো থাকত রূপার তৈরি হুকাদানের উপর দু-তিনটে রূপা-বাঁধানো হুঁকা, খরিদ্দারদের তামাক খাবার জন্য। সকলকেই দেওয়া হত মিঠাইয়ের চেঙারি, বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। নতুন খাতা নিয়ে আসরের একধারে বসত দোকানের এক কর্মচারী। খরিদ্দাররা দিত তাদের বাকি টাকা, হয় সম্পূর্ণ, আর তা নয়তো আংশিক। আর যাদের বাকির বালাই থাকত না, নতুন খাতায় তাদের নামে টাকা জমা করে নেওয়া হত। এভাবে বছরের প্রথম দিনেই দোকানদারের হাতে এসে পড়ত একটা মোটা অঙ্কের মূলধন।”

বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে মূল বিষয়টা আমার ছেলেবেলা বা বর্তমান কালের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই। উপকরণের প্রভেদতো হবেই, কারণ তা সহজলভ্যতার ওপর নির্ভর করে।

বিশেষজ্ঞ আরও বলেন নববর্ষ উপলক্ষে বিশ্বের সমস্ত দেশেই আনন্দ উৎসব পালন করা হয়, বাংলায় কিন্তু নববর্ষ উপলক্ষে সেরকমটা হয় না। যদিও আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে নববর্ষে ঢাকা শহরে খুব বড় উৎসব হয়। তবে সেটা অবশ্য পরবর্তীকালে আরোপিত।

যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিষ্টি গবেষণা করে জানিয়েছেন, “আমরা এখন ১লা বৈশাখ (নতুন) বৎসর ধরেতেছি, কিন্তু এই রীতি বেশি দিনের নয়। ২৪১ শক, ইংরেজি ৩১৯ সালে ইহার আরম্ভ হইয়াছে, তাহাও ভারতের সর্বত্র নয়।”

আমাদের কাছে ৩১৯ খ্রিষ্টাব্দ, এটাই অনেক প্রাচীন। নববর্ষের দিন নতুন জামা কাপড় পরে আনন্দপ্রকাশের একটা প্রথা আছে আমাদের। আগে পয়লা মাঘ নতুন বর্ষ সূচনা গণনা করা হ’ত। এজন্য এখনও জঙ্গলমহলে অনেক জায়গায়, যেখানে ‘মকর পরব’ (পৌষ সংক্রান্তি ও পয়লা মাঘ) প্রধান উৎসব, সেখানে মকরে নতুন পোশাক পরিধান করাটা প্রায় আবশ্যক।

তবে এটা ঠিক ইংরেজরা নববর্ষ উপলক্ষে যে রকম আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতো বা এখনও ওঠে, তেমন বাঙালিরা বাংলা নববর্ষে করে না। টেকচাঁদ ঠাকুর ওরফে প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় বলেছেন –

“ইংরেজরা, নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন। আগামীকে দারাগুয়া পান দিয়ে বরন করে ন্যান – নেসার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দ্যান। বাঙালিরা বছরটী ভাল রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ হক, সজ্নে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়ে পূরাণকে বিদায় দ্যান। কেবল কলসি উচ্ছুগগু কর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারই নতুন বৎসরের মান রাখেন।”

এখনও পর্যন্ত নতুন বৎসর বা হালখাতার মান রেখেছে লাল কাপড়ে বাঁধানো খাতাগুলো। ব্যবসায়ীরা নববর্ষের দিন সকাল সকাল লাল খাতা নিয়ে পুজো করতে হাজির হন মন্দিরে। এজন্য শুধু কালীঘাট বা দক্ষিণেশ্বর মন্দির নয়, অন্যান্য স্থানীয় জাগ্রত ও জনপ্রিয় মন্দিরে লম্বা লাইন পড়ে। পুজো দিয়ে লালখাতায় এঁকে নেন মাঙ্গলিক চিহ্ন; হয়ে যায় হালখাতা।

আগেও বলা হয়েছে বছরের প্রথম দিনটি অত্যন্ত পবিত্র মান্য করে মানুষ তাঁর আরাধ্য দেবতাকে বন্দনা করেন। এক্ষেত্রেও হালখাতা পুজো দিয়ে নতুন বছরে ব্যবসার গতিকে অব্যাহত রাখা বা এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা লক্ষ্য থাকে। আজকাল অবশ্য অনেকে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি পুজো দিতে নিয়ে এসে সংবাদমাধ্যমে নজর কাড়েন।

আমার বরাবর নজর কাড়ত হালখাতার এই লালশালু দিয়ে বাঁধাই খাতাগুলো। লালখাতাগুলো ভীষণ আকর্ষণের। এই খাতাগুলোকে কী খাতা বিক্রেতারা হালখাতা বলেন? কৌতুহল মেটাতে ধর্মতলার একটি দোকানে ঢু মারা হল। এখানে লাল ডায়েরি বলতে খাতাগুলো বার করে দিল। তাঁরা জানালেন সারা বছরই কম বেশি এই খাতা বিক্রি হয়। নববর্ষ, অক্ষয় তৃতীয়ার আগে বেশি চলে। খাতাগুলো ওনারা আনেন শিয়ালদহের বৈঠকখানা বাজার থেকে।

তবে চলো বৈঠকখানা বাজার। কথা হ’ল বৈঠকখানা বাজারের কল্যাণী বুকস্টলের সমীর দেবনাথের সঙ্গে। তাঁদের তিন পুরুষের ব্যবসা। শিয়ালদহ চত্বরে এগুলো তৈরির কারখানা আছে। এই খাতা গুলোকে তাঁরা আদৌ হালখাতা বলেন না। কিছু সনাতনী দোকানদার, ব্যবসায়ী এগুলো কেনেন যাদের কারবারে পুরোনো দিনের লোকেরা হিসাব কিতাব লেখেন। এখন লোকজন সাধারণ রেজিস্টার খাতা কিনতে অভ্যস্ত। তার ওপর বহুদিন হ’ল চলে এসেছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাব ইত্যাদি।

সাইজ অনুযায়ী লালসালু বাঁধানো খাতা গুলোকে ডাকবই, হাতবই, বড়জাবেদা, খতিয়ান ও দোফর্দি খতিয়ান বলে। যার যেরকম প্রয়োজন কেনেন। খাতা কিনে তার ওপর মাঙ্গলিক চিহ্ন একে হালখাতার কাজে লাগায়। খাতার মাপগুলোও টুঁকে নিয়েছি। ডাকবই — লম্বা সাড়ে ১০ ইঞ্চি, প্রস্থ সাত ইঞ্চি, হাতবই — ১৪ ইঞ্চি × সাড়ে ৫ ইঞ্চি, বড় জাবেদা — ১৪ × ১১, খতিয়ান — সাড়ে ২০×৭, দোফর্দি খতিয়ান — ৩০×সাড়ে ১০।

সমীর দেবনাথ বাবু ‘হালখাতা’ নামকরণের উনার একটা ব্যাখ্যা শোনালেন। সেটা একান্তই উনার মত। ‘হাল’ মানে সমাধান। আমরা অবশ্য অনেক সময় বলি, “হাল কিছু বের হল?” গত বছরের হিসাব হাল অর্থাৎ সমাধান করে, নতুন বছরের খাতা খোলা হল, তাই এর নাম ‘হালখাতা’

‘বইপাড়া’তে পয়লা বৈশাখ এক উৎসব মুখর দিন। এগারোটার সময় অনেক দোকানে গেলে শুনতে হয়, ‘দাদা একটু ঘুরে আসুন।’ কারণ দোকানদার তখন দোকানে ফুলমালা লাগাচ্ছেন, তখনও পূজা করা হয় না। একটু পরে দোকানে গেলে লাভই হয়। নববর্ষ উপলক্ষে কেউ কেউ একটু বেশি ‘ডিসকাউন্ট’ দেন। পাওয়া যায় একটা মিষ্টির প্যাকেট। কলেজ স্ট্রীট বইপাড়ায় হালখাতার পরিবেশ।

প্রকৃতপক্ষে এই দিনটা পুস্তক প্রকাশনা জগতে হালখাতার মতো; লালশালুতে বাঁধানো হিসাবের খাতা না থাকলেও। এদিন লেখকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁদের কিছু পাওনা টাকা। প্রকাশকগণ কাগজ ব্যবসায়ীদের ও অন্যান্য পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করেন। আগে সাহিত্যকদের বকেয়া টাকা ‘ঢাকে ঢোলে’ শোধ করার রীতি ছিল, বৈশাখ মাসে ও পূজার আগে। বৈশাখ থেকে ভাদ্রর পাওনা, আশ্বিনে; কার্তিক থেকে চৈত্রের পাওনা নববর্ষে। এছাড়া লেখকদের যখন যার প্রয়োজন হত প্রকাশকদের কাছ থেকে নিয়ে যেতেন, বছর শেষে তা হিসাব হ’ত।

সেই সঙ্গে বসত লেখক প্রকাশকদের আড্ডা। বইপাড়ার নববর্ষের মজলিসে আড্ডা কিংবদন্তি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আড্ডা এখনও হয়। অনেকেই অপেক্ষা করে বলেন, ‘আগের মতো আড্ডার সেই আমেজ আর নেই।’

নববর্ষের দিন প্রকাশিত হ’ত নতুন বই। এখনও হয়। শোনা যায় বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়েছিল নববর্ষে। পয়লা বৈশাখ শুরু হয়েছে অনেক বিখ্যাত পত্রিকা। যেমন ১৯৭৯ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা। ১২৯৭ বঙ্গাব্দে ‘সাহিত্য’ পত্রিকা, প্রবাসী (১৩০৮ বঙ্গাব্দ), সন্দেশ (১৩২০ বঙ্গাব্দ) মাসিক বসুমতী (১৩২৯ বঙ্গাব্দ)। একটা ছোটদের বার্ষিকী ‘হালখাতা’ বেরিয়েছিল ১৩৭৮ বঙ্গাব্দে। তাতে বিশ্বকবি আশীর্বাণী দিয়েছিলেন –

“আদি অতি পুরাতন, এ খাতা হালের

হিসাব রাখিতে চাহে নতুন কালের।

তবুও ভরসা ভাই, আছে কোনো গুণ

ভিতরে নবীন থাকে অমর ফাল্গুন।

পুরাতন চাঁপা গাছে নূতনের আশা

নবীনকুসুমে আনে অমৃতের ভাষা।।”

অনেকে বছরের প্রথম দিন পাওনাগণ্ডার বৈষয়িক বিষয়টিকে পছন্দ করেন না। যেমন প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, “নতুন বৎসরের প্রথম দিন অপর দেশের অপর জাতের পক্ষে আনন্দ উৎসবের দিন। কিন্তু আমরা সেদিন চিনি শুধু হালখাতায়। বছরকার দিনে আমরা গত বৎসরের দেনা পাওনা লাভ লোকসানের হিসেব নিকেশ করি, নতুন হালখাতা খুলি এবং তার প্রথম পাতায় পুরনো খাতার জের টেনে আনি।”

যাইহোক প্রমথ চৌধুরী কথাই রেশ ধরে বলতে পারি, পুরনো বছরে দেনা-পাওনা, লাভ-লোকসানের হিসাব ভুলে নতুন বছরে যেন আমরা এমন কিছু করি, যাতে আগামী বছরের হালখাতার প্রথম পাতায় যেন পুরনো বছরের জের না টানতে হয়।

তথ্য ঋণ:

১. বঙ্গীয় শব্দকোষ – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (সাহিত্য একাডেমী)

২. হালখাতা: ১৪২৭ বঙ্গাব্দের সূচনায় ‘হরপ্পা’ নিবেদিত বৈদ্যুতিক পুস্তিকা

৩. পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ নয় – হরিপদ ভৌমিক (ইতিকথা পাবলিশার্স)


আপনার মতামত লিখুন :

3 responses to “বাংলার ঐতিহ্যবাহী হালখাতা উৎসব : সুখেন্দু হীরা”

  1. লেখকের সঙ্গে আমার ছেলেবেলার কিছু কিছু ঘটনা মিলে যায় যেমন, ‘ঘরটাকে কি সেলুন বানিয়ে ফেলবি’…
    যাইহোক লেখাটাকে খুব সুন্দর ভাবে উপভোগ করলাম ধন্যবাদ লেখক কে এমন একখানা লেখা উপস্থাপন করার জন্য।

  2. chinmoy choudhury says:

    khub valo lekha hoeche..amar akhono sei purano din gulokei valo lage jekhane chilo akrittim antorikota o valobasha ja akhon tothakotito unnotite harie jete boseche

  3. সঞ্জীব says:

    অনেক পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কুর্নিশ, এইরকম একটি তথ্যসমৃদ্ধ,মন ভালো করা উপস্থাপনার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন