পঁচিশ.
প্রথম শান্তিনিকেতনে যাবার পর জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল একবার। নেহরু উদয়নের একতলার ঘরে বসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। হাতে-পায়ে চঞ্চল নেহরু বসবার তাকিয়া দুমড়াতে দুমড়াতে আমরা। কে কোন দেশ থেকে এসেছি জেনে নিচ্ছিলেন। শারীরিক চাঞ্চল্য সত্ত্বেও কী মনোযোগের সঙ্গে যে তিনি পরিচয় নিয়েছিলেন, বোঝা গেল তার ভাষণের সময়ে। প্রত্যেক দেশ নিয়ে বলবার সময়ে উনি। সেই দেশের শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে বললেন। কোনো ভুল হলো না! সে দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে বলতে বলতে বারবার মূল এক কথায় ফিরে গেলেন–সে হচ্ছে Asia is one। বললেন, রবীন্দ্রনাথও ওই মতে বিশ্বাসী ছিলেন। বক্তব্য ছিল চমৎকার গোছানো।
উদয়ন ভবনের বাইরের প্রাঙ্গণে আমাদের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন নেহরু। শান্তিনিকেতনে শম্ভুবাবু নামে একজন সব ছবি তুলতেন। তিন-চার কপি ছবি পেয়েছিলাম। এ নিয়ে মজার ব্যাপার হলো। পাকিস্তান আমলে আমাদের বাড়িতে যারা আসতেন, সকলেই যে বন্ধুভাবে আসতেন তা মনে করা যায় না। তাই একসময়ে দেখা গেল, ভারত আর নেহরুর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতার প্রমাণ হিসেবে সম্ভবত, নেহরুর সঙ্গে তোলা সেই ছবিগুলো বাসা থেকে উধাও হয়েছে। গুপ্তচর বিভাগের দপ্তরে ওগুলোর খুব কদর হয়েছিল নিশ্চয়ই!
আমাকে কোনো না কোনো দেশের গুপ্তচর ভাবতে কারোরই কোনো কসুর হতো না। একবার শান্তিনিকেতনে রটে গেল, আমি নাকি কেজিবির এজেন্ট! বিষয়টা কী তা আমার জানা ছিল না। বান্ধবী সুতপা ভট্টাচার্য জানালেন, প্রতিভা বসুর বাড়িতে আলাপ শুনেছেন। নরেশ গুহ গৃহকত্রীকে জানাচ্ছিলেন যে আমি বস্তুত কেজিবির এজেন্ট। অর্থাৎ রাশিয়ার গুপ্তচর! বোকা বনে গেলাম, এ আবার কী কথা! কলকাতায় গৌরী আইয়ুবকে দুঃখ জানিয়েছিলাম। দেশে বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়ন আর প্রসারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে এই নাম জুটল আমার!
বহুদিন পরে নিজেই ওর কারণ বুঝতে পারলাম। ভালো স্যুটকেসের অভাব ছিল আমার। কন্যা রুচিরা মস্কোতে লেখাপড়া করছিল। সেবার ঢাকায় এল ‘সিসিসিপি’ লেখা একটা বেশ বড় ব্যাগ নিয়ে। আমিও খুশিমনে ব্যাগখানি বগলদাবা করে কাপড়চোপড় ভরে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গেলাম। এখন বোলপুর স্টেশন থেকে আমার আবাস পর্যন্ত রিকশায় মস্কোর নাম লেখা ওই ব্যাগ নিয়ে যাবার সময়ে আমাকে ও দেশের গুপ্তচর হিসেবে চিনে ফেলতে কোনো অসুবিধা হয়নি সংশ্লিষ্টদের! পাকা ছাপমারা ব্যাপার যে! দুইয়ে দুইয়ে চার হয় তো!
ছাব্বিশ.
একাত্তর সালে ঢাকা থেকে পালিয়ে কলকাতায় গিয়ে প্রবোধ সেন কাকাবাবুর কাছে উঠেছিলাম, তার মেয়ের বাসায়। কাকাবাবু তাঁর বন্ধু খড়গপুর ইনস্টিটিউটের ইংরেজির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রমোহন কাকাবাবুর কাছে প্রথমে, তারপরে জাস্টিস মাসুদ আলীর বাসায় আমার সপরিবারে থাকবার ব্যবস্থা করলেন। মাসুদ সাহেব আমার মায়ের বোনজামাই। সেদিক থেকে তিনি আত্মীয় বটে। বিশ্বভারতী বোর্ডের ট্রেজারারও ছিলেন তিনি। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে আমার জন্যে কোনো ব্যবস্থা করতে পারবেন জাস্টিস মাসুদ, এই ভরসা ছিল কাকাবাবুর। বোর্ডের সভায় সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী, আমাদের অমিতদাও বিশ্বভারতীতে আমার একটা ফেলোশিপের ব্যবস্থা করলে আমার হিল্লে হলো।
সঙ্গে সঙ্গেই যে শান্তিনিকেতনে যেতে পারলাম, তা তো নয়! তবে গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যেই একাত্তরের জুনে ইন্টারন্যাশনাল গেস্টহাউসে পরিবার নিয়ে গিয়ে উঠলাম। বাচ্চুদির স্বামী অমিয়দা তখন ওখানে রেজিস্ট্রার। অল্প কদিন পরেই পূর্বপল্লীর এক বাড়ির আউটহাউস ভাড়া নিয়ে সেখানে চলে গেলাম। ছোট্ট ছোট্ট তিনটি ঘর, রান্নাঘর আর বারান্দা। ভাড়া মাসিক আশি টাকা। তার সঙ্গে বিদ্যুৎ বিল যখন যেমন হয়। বিশ্বভারতীর গোটা তিনেক চৌকি পাওয়া গেল। বাচ্চুদি ঘরসংসারের এটা ওটা দিলেন। ভুলুদা তত দিনে মারা গেছেন। সুপ্রিয়াদি ওঁদের ব্যবহারের জন্যে রাশিয়া থেকে আনা ভাঁজ করা একটা টেবিল আর চারটা চেয়ার আমাকে দিলেন। খাবার টেবিল, চেয়ার হয়ে গেল।
প্রথম দিকে অনেক দিন বড় দুটো টিফিন ক্যারিয়ারে করে কিচেন থেকে খাবার আনাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাড়ির কোণে এক গর্তে কিচেনের ভাতের অনেকখানিই প্রায় ফেলে দিতে হতো, খাওয়া হতো না। বাড়িওয়ালা কাকাবাবু একদিন বাগান থেকে কী একরকম শাক তুলে আমাকে দিয়ে গেলেন। সকালের ডিম ভাজার জন্যে ঘরে তেল ছিল। তাই দিয়ে শাক ভাজি করে টেবিলে বেড়ে দিলাম। আশ্চর্য! সেদিন ছেলেমেয়েদের ভাত কম পড়ে গেল শাক ভাজির গুণে! তাই দেখে কাকাবাবু ওঁর বাগানের একটা-দুটো করলা বা পোকাধরা একটা ফুলকপি কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে আমাকে দিয়ে যেতেন। অবস্থা বুঝে এটা-ওটা রান্না করে ছেলেমেয়েদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে শুরু করা গেল। শেষ পর্যন্ত ভাত-মাছ সবই রাধা আরম্ভ করলাম। কিছুদিন আগে থেকেই রাতে রুটি বানিয়ে সেঁকে ন্যাকড়া জড়িয়ে রেখে দিতাম সকালের খাবারের জন্যে। বড় মেয়ে অপালা ডিম ভেজে নিয়ে তিন ভাইবোনে খেয়ে পাঠভবনে পড়তে যেত। আমাদের একটা বাড়ির পরে উত্তর দিকের দোতলা থেকে উপাচার্য প্রতুল গুপ্ত মশাই ওদের স্কুলে যাওয়া দেখতেন, কেমন চুল ছেড়ে স্কুলের দিকে ছুটত, দেখতে ভালো লাগত তার।
প্রতুল গুপ্ত মশাই আমার সঙ্গে খুব সৌজন্য করতেন। বিকেলে আমি প্রবোধ কাকাবাবুর কাছে যেতাম। প্রতুলবাবুও গিয়ে নানা বিষয়ে আলাপ করতেন আমার সঙ্গে। রবীন্দ্রভবনের একটি ফেলোশিপ আমাকে দিয়েছিলেন উনি। তা নিয়ে সরকারের প্রতি বিরূপ ব্যক্তিরা নানা মন্তব্য করতেন। বলতেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ওদের চাকরি দিতে চান, ভালো কথা, চাকরি তৈরি করুন! আমাদের জন্যে যেসব চাকরি, তা ওদের দেওয়া হবে কেন? প্রতুল গুপ্ত মশাই আমাকে বলেছিলেন, প্রথম দিকে যা-ই হোক আমার জন্যে ভিন্ন ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে যখন ফিরে আসব, তখন বড় একটা থালায় করে মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের জন্যে। অপালা তো ছিল মিষ্টির পোকা! সারাক্ষণ ঘুরে ঘুরে মিষ্টি খেয়েছিল।[ক্রমশ]