সোমবার | ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:২৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (শেষ পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী মোদি ম্যাজিক ছিল কিন্তু সে ম্যাজিক ফিকে হয়ে গেছে : দিলীপ মজুমদার সুশান্ত দাসের ‘প্রকৃতিগাথা’ : দিলীপ মজুমদার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা ও আরাকান আর্মি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন কেদারনাথ-বদ্রীনাথ ভ্রমণ : প্রকৃতি আর ঈশ্বর যখন একটি বিন্দুতে মিশে যায়… : অমৃতাভ দে আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (তৃতীয় পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী বসিরহাটে নুনের হাট, শ্যামবাজার নুনের বাজার : অসিত দাস মুর্শিদাবাদের আমকথা (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত জেন অস্টিন নারী স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ : মনোজিৎকুমার দাস ইসবার ইন্ডিয়া জোটকা সরকার, আমরা একাই একশো — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (শেষ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন মুর্শিদাবাদের আমকথা (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (দ্বিতীয় পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (শেষ পর্ব) : জমিল সৈয়দ কবি কুসুমকুমারী দাশ ও পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ : বিজয়া দেব হুগলির লোকসভা ভোটে গ্রামীন এলাকায় ১৭১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (প্রথম পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান : শৌনক দত্ত বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ত্রয়দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দশম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন

সন্‌জীদা খাতুন / ১০১ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

ষোল.

আমি ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ নিয়ে কাজ করতে শান্তিনিকেতনে গেলে কাকাবাবু খুশি হননি। তিনি তখন তাঁর সেজ কন্যা নোটনের (সঙ্ঘমিত্রা) থিসিসের তত্ত্বাবধান নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। আমার কাজ নিয়ে তার দুটি আপত্তি ছিল। প্রথমত, বিষয়টি সাধারণ মানুষের জন্যে নয়। ওসব বুঝবে কে? কী উপকার হবে ও থেকে! এ ছাড়াও পঞ্চাশ বছর। বয়স পার করে এ রকম কাজ করতে গেছি। কিছু যদি ফল দেখা না দেয় তো সে বেইজ্জতি সইব কী করে।

যে কাকাবাবু এত ভালোবাসতেন, চিঠির পাঠ লিখতেন ‘তনয়া প্রতিমাসু’, সেই কাকাবাবু এমন সরাসরি দোষ ধরলেন–কোনো উৎসাহ দিলেন না একেবারে। ফিরতি পথে চোখের জল তো ঝরলই, স্কলার্স ব্লকে ফিরে দরজায় খিল দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। বেশ কিছু সময় চুপচাপ বসে থেকে মনের মধ্যে জেদ হলো–না, এ কাজ পারতেই হবে।

কিছুদিনের ভেতরেই সকাল আটটায় লাইব্রেরিতে গিয়ে বসলাম। আহমেদাবাদের স্বল্প পরিচিত এক স্কলার ভোলাভাই প্যাটেল বললেন, আপনি যে বিষয়ের কথা বলছেন, তা নিয়ে কাজ করতে হলে Stanley Burnshaw — র The Poem Itself বইটি পড়তে হবে। পড়া শুরু করলাম। যে — যা বলে সব করি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্কলার ছিলেন তখন ওখানে। তাঁকে ধরে লিঙ্গুইস্টিকসের কত বই পড়লাম, কী বলব। নোট করে করে পড়া। একটার আগে উঠে কাউন্টারে বই জমা রেখে বেরোতাম। ঘরে ফিরে খাওয়া সেরে পাঁচ মিনিটের জন্যে বালিশে মাথা রাখতাম। সময় দেখে তড়াক করে উঠে আবার ছুট লাইব্রেরিতে। তত দিনে প্রসেনজিৎ — রত্নার আহ্বানে ওদের বাসায় থাকতে শুরু করেছি। পুঁচকিদি নামে একজন খাবার সরবরাহ করবার ব্যবসা করতেন। তার বাড়ি থেকে খাবার আসত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে মুহম্মদ আবদুল হাই স্যার আমাদের ফোনেটিকস পড়াতেন। লন্ডনের JR Firth ছিলেন স্যারের গুরু। Firth — এর লেখা Papers on Linguistics পড়তে শুরু করলাম। Firth বলছেন, ভাষাধ্বনি ব্যক্তি আর সমাজের সকল ধারণার বাহন হয়ে বয়ে চলে। সমাজভুক্ত মানুষের জীবনে সামাজিক সাহিত্যিক বিনিময় সূত্রে ওই ধারণাগুলো দিনে দিনে হয়ে ওঠে সেই সমাজের জাতীয় ধারণা। ব্যাপারটি ভাষাবিজ্ঞানের Phonaesthetic অর্থাৎ ধ্বনি সৌন্দর্যমূলক বিবরণ হিসেবে ব্যক্তির ক্ষেত্রেও যেমন, তেমন ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও মূল্যবান। এই মত আমাকে ধ্বনিব্যঞ্জনা আলোচনার ভাষাবিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি সরবরাহ করল।

গবেষণাপত্রের তত্ত্বের মতো ভারী বিষয়ে স্মৃতিকথায় এর বেশি কিছু লেখা সমীচীন হয় না।

সতেরো.

প্রথমবার শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর পাঠভবনের যে মেয়েরা আমার জানালায় এসে গল্পে মত্ত হতো, তাদের কনিষ্ঠতম ছিল শ্যামলী খাস্তগীর। ক্লাস শেষ হলে সে এর-ওর বাড়ি ঘুরতে বেরোত। কখনো রবীন্দ্রনাথের সেজ মেয়ে মীরা দেবীর মালঞ্চ, কখনো নটীর পূজার ‘শ্রীমতী’ ভূমিকার বিখ্যাত গৌরী ভঞ্জ চৌধুরীর বাড়ি। শিল্পী নন্দলাল বসুর জ্যেষ্ঠ কন্যা তিনি। আশ্রমকন্যা হিসেবে শান্তিনিকেতনের সব বাড়িতেই শ্যামলীর যাতায়াত ছিল। গৌরীদি তার আমলের শান্তিনিকেতনের উৎসব-অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলতেন। শ্যামলী সেসব মনে ধরে রাখত। নন্দলাল বসুর আরেক মেয়ে যমুনাদির কাছেও পুরোনো কথা শুনতে যেত শ্যামলী। আরও ছিলেন শিল্পাচার্য পুত্র বিশ্বরূপ বসু আর নিবেদিতা বউদি। ওই পাড়াতেই পথের ধারে আরও ছিল লাবুদির বাসা। শ্যামলীর স্বভাব ছিল পথের ধারে কিংবা কারও প্রাঙ্গণে ফোটা ফুল তুলে খোঁপায় গোঁজা। ভালো লাগত ওরই খোঁপায় আশ্রমে প্রথম ফোঁটা পলাশ কিংবা অগ্নিশিখা ফুল দেখতে পেলে। অগ্নিশিখা ফুলের ক্রমিক রং বদল করা একটা দেখবার মতো ব্যাপার ছিল। ফুটত সবুজ রং নিয়ে। সবুজের ডগায় এরপর দেখা যেত হলুদ শিখা। সে রংও বদলে লাল আগুনের রং ধরত। এরপর কালচে লাল হয়ে খসে পড়বার প্রস্তুতি। স্মৃতি এত দিনে ঝাপসা হয়ে আসছে, এ ফুলটা যেন যমুনাদির উঠোন থেকেই পেত শ্যামলী। ঘোরাঘুরির পরে সারা দিনে চুলের পারিপাট্য বলতে কিছুই থাকত না। ওকে দেখে একটা বনবালা বলে মনে হতো। কপালে সিঁদুরের টিপও যেত ধেবড়ে। চোখের কাজলেরও ওই দশা। বুধবার ছুটির দিনের বিকেলে শ্যামলীর চেহারা দাঁড়াত ওই রকম।

সন্ধ্যাবেলা নার্স শান্তিদির সিকরুমে জড়ো হতাম আমরা কজন। শ্যামলীর মা ছিলেন না। ও শান্তিদিকে মায়ের মতোন জানত। আমি, শিউলি, কখনো কখনো রীতা (রীতা গাঙ্গুলি, পরে কোঠারি) রোগীর জন্যে পাতা বিছানাতে জটলা করে বসতাম। পাঠভবনের তখন স্টাডি আওয়ার, তবুও ছুটে চলে আসত আরও কেউ কেউ। গান হতো। শান্তিদির মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠত। শিউলির যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর খুব ভালোবাসতাম শুনতে। অনেক পরে অর্থনীতির অনুপমবাবুর স্ত্রীর গলায় এই গানটা শুনেছিলাম। উনি মোহরদির ভালো নকল করতেন। অনেক কাজ দিয়ে গাইতেন গানখানি। ওঁর দুই মেয়েও চমৎকার গান গাইত। সিকরুমের আসরে আমার গান ছিল, অশ্রুনদীর সুদূর পারে। প্রায় প্রতিদিন গাইতে হতো। রীতার পছন্দের গান ছিল খুব। তবে সেসব কথা তার এখন আর মনে নেই। এখন বেগম আখতারের কাছে শেখার কথা বলে বেশি। এই আসরে গীতাঞ্জলি নামে আর একটি মেয়ে যোগ দিয়েছিল পরের বছর। ওর গলায় তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও শুনতাম খুব। একবার মিষ্টি করে গেয়েছিল শিউলি — ফোঁটা ফুরোল যেই ফুরোল।

শ্যামলীটা ছিল পাগলি! না হলে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করতে করতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে বলে আমেরিকার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলন জুড়ে দিল! রাস্তায় অবস্থান নিয়ে হাজতবাস পর্যন্ত করেছে! ভ্যাঙ্কুভারে থাকত তখন। শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনেই ফেরত এল ছেলেকে নিয়ে। বাবা বাড়ি রেখে গেছেন, আর আছে। ওড্রদেশীয় বংশী’ চাকর। একে-তাকে ধরে এনে এনে খাওয়ায়। একা খেতে ভালো লাগে না তো! আর এক আছে ‘মন্টু’ রিকশাওয়ালা। খুচখাচ সাহায্য-সহযোগিতা পায় আর শ্যামলীকে নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যায়। যতবার শান্তিনিকেতন গিয়ে পূর্বপল্লী গেস্টহাউসে উঠি ঠিক খবর হয়ে যায়। মন্টু রিকশাওয়ালার গাড়ি খড়খড় করে এসে দাঁড়ায়। হাঁক আসে ‘মিনুদি!’। আমার জন্যে শ্যামলীর হৃদয়ের দুয়ার সব সময়ের জন্যে খোলা। ঢাকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খবর নিয়ে উত্তেজিত হয়ে থাকত। সংস্কৃতি নিয়ে ওদিকের মানুষের ভাবনাচিন্তা নেই বলে মন খারাপ থাকত। আমাকে বড় ভালোবাসত সে।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে দেখে গেছে এখানকার কাজকর্ম। আমার বাড়ির সাদামাটা রান্নাবান্না তার খুব পছন্দ হয়েছিল। চাল, ডাল, আলু, পটোল, বরবটি এটা-ওটা একসঙ্গে চুলোয় চাপিয়ে ফুটিয়ে খিচুড়ি করে ওপর থেকে খানিকটা ঘি ছেড়ে দিয়ে যে দ্রব্যটি প্রস্তুত হয়েছিল, তার নাম বৈরাগীভাত। মহা পছন্দ তার। সঙ্গে পাঁচফোড়ন দিয়ে সম্বরা দেওয়া জলপাই বা তেঁতুলের টক-মিষ্টি আচার থাকলে আর কথা কী! এমন খাবারের পরেও লোকে কেন মাংস — মাংস করে কে জানে! মাংস খাওয়া দুচক্ষে দেখতে পারত না–এই এক বাতিক ছিল ওর।

আণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল বুঝি আর এক বাতিক। সেই বক্তব্য নিয়ে প্রায় একই ধরনের বহু ছবি এঁকেই চলত। একবার ওই সব ছবির এক এক্সিবিশনে আমাকে এক বিকেলে গান গাইতে বলল। গেলাম ওর সঙ্গে কলকাতায়। উদ্বোধনের দিনই হবে গান। উদ্বোধক লেডি রানু মুখার্জি। বর্ষার দিন। সারা বিকেল একের পর এক প্রিয় বর্ষার গান গাওয়া চলল, আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে’, ‘উতল ধারা বাদল ঝরে’, ‘পুব হাওয়াতে দেয় দোলা, মম মন — উপবনে চলে অভিসারে’–একের পর এক। রানু মুখার্জি বসে ছিলেন প্রথম থেকেই। আর কোনো প্রদর্শনী উদ্বোধনে যেতে হবে বলে আমাকে গান গেয়ে যেতে বললেন। চট করে ফিরে এসে আরও গান শুনবেন ইচ্ছে করেছিলেন। কিন্তু ঘণ্টা দুই গাইবার পরে থামতেই হলো। রানু মুখার্জি ফিরে এসে মন খারাপ করেছিলেন।

জাদুগোড়াতে ইউরেনিয়ামের খনি থেকে পুরো এলাকায় কী রকম বিকিরণ হয়েছিল তার দৃশ্য শ্রমিকদের বসতিতে বিকলাঙ্গ শিশুদের দেখে শ্যামলী সরাসরি জেনেছিল। সে নিয়ে সচিত্র বই লিখে ছাপিয়েছিল শ্যামলী। ভোপালে কীটনাশক কারখানার গ্যাস ট্যাংক লিকেজের ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর শুনে শ্যামলীকে ছুটে যেতে দেখেছি সেখানে। দুর্গত মানুষের সেবা ছিল তার ব্রত। নিজের নিরাপত্তার পরোয়া করতে দেখিনি কখনো। সমাজকর্মী পান্নালাল দাশগুপ্তকে তাঁর শেষ জীবনে শ্যামলীর যত্নেই জীবনযাপন করতে দেখেছি। ‘পলাশ’ বাড়িতে থেকেই বীরভূমের গ্রামের সংস্কৃতি আর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতেন তিনি।

মন্টু রিকশাওয়ালার কথা লিখছিলাম। মন্টু মাঝেমধ্যে দরকারে পাঁচ-দশ টাকা ধার নিত। রিকশায় কোথাও যাওয়ার থাকলে ওকে ডাকতাম। কখনো কখনো টাকা ফেরত দিতে দেরি করলে বলতাম, কী মন্টু, আজকে তাহলে আর রিকশা ভাড়াটা দিই না। সজোরে মাথা নেড়ে বলত, না দিদি না, আজ থাক। আর এক রিকশাওয়ালা মহাদেব’ ছিল কবি। একটু বড় বড় চুল রাখত। ওর রিকশায় উঠলে ওর কথাবার্তা চলত বেশ গুরুগম্ভীর, কবিতা শুনতে হতো কখনো কখনো। সে — ও ধার নিত। একবার গোটা বিশেক টাকা নিয়ে আর তো দেয় না! তাগাদা করাতে ওর মানে লাগল। দিন কয় পরে টাকাটা ফেরত দিয়ে গেল। সত্যেন রায় মশাই সে কথা শুনে হেসে আর কূল পান না। বললেন, এই ব্যাপার! বুদ্ধি রাখে তো! সেই দিনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে তার কাছ থেকে বিশটা টাকা ধার নিয়েছে। অর্থাৎ সেই ধার করা। টাকায় আমার টাকা শোধ করেছে। কইয়ের তেলে কই ভাজা!

কয়েক বছর আগে সুতপা ভট্টাচার্যের ফোন পেলাম কলকাতা থেকে। শ্যামলীর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মারাত্মক অবস্থা। হাসপাতালে রয়েছে। কয়েক দিন গেল ছটফট করে। তারপর শ্যামলীর মোবাইলে কল দিলাম। অনুমান করছিলাম তত দিনে ওর ছেলে আনন্দ এসে গেছে খবর পেয়ে। আনন্দ ফোন ধরল। বলল, জ্ঞান ফিরেছে। ভুরু কুঁচকে ইশারা করে দেখাচ্ছে আনন্দকে নাকে নল আর স্যালাইনের তার-টার এসব কেন। কোনো কৃত্রিম আয়োজন তো পছন্দ নয় তার! দু-চার দিন পরে আর ফোন ধরল না কেউ। হয়তো সে চলে গেছে। আর আনন্দও ফিরে গেছে ভ্যাঙ্কুভারে। শ্যামলীকে এখানে আর কে চেনে! একা একা শোক যাপন করেছিলাম। তবে দেখা গেল শ্যামলী মাসিকে পার্থ-রুচিরা ‘পলাশ’ বাড়িটা সমেতই চেনে ভালোভাবে। ‘মনফকিরা’ থেকে ওর একটা বই ছেপে বার করেছে সন্দীপনরা, তার মলাটে ‘পলাশ’ বাড়ির ছবি সামনের পেছনের প্রচ্ছদ মিলিয়ে। ওরা দেখেই বলল, শ্যামলী মাসির বাড়ি। [ক্রমশ]


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন