সাত দফার লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে ইতোমধ্যেই চার দফা ভোট হয়ে গিয়েছে। তার মানে প্রায় ৭১ শতাংশ আসনের ভোট সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। চতুর্থ দফায় ভোটের হার কিছুটা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সেই হার ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় কম। গত মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১০টি রাজ্যে ভোট হয়েছে। তার মধ্যে বাংলায় ভোটদানের হার বেশি। বাকি ন’টি রাজ্যে কিন্তু ভোটদানের হার বেশ কম। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে অরুণাচল প্রদেশে। সবথেকে কম ভোট পড়েছে জম্মু ও কাশ্মীরে। ভোটের হার কম হওয়ায় কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির কপালে চিন্তার ভাঁজ লক্ষ্য করেছেন অনেকেই। অন্যদিকে তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে আছেন নরেন্দ্র মোদি। যিনি লোকসভা ভোট শুরুর আগেই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্লোগানের সুরে হেঁকেছিলেন ‘আব কি বার চারশো পার’ — অর্থাৎ বিজেপি জোট এবার চারশো অতিক্রম করবে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, সাত দফার মধ্যে চার দফার ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার আগে থেকেই বিজেপি নেতারা আর ‘চারশো’-র প্রসঙ্গ ভুল করেও মুখে আনছেন না। একদিকে বিরোধীরা যেমন প্রকাশ্যেই বিজেপির আসনসংখ্যা দুশোও হবে না বলে জানাচ্ছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন যে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি জোট এগিয়ে থাকলেও গত নির্বাচনে বিজেপি যে এককভাবেই ৩০৩টি আসনে জিতেছিল, সেই পুরনো রেকর্ড ধরে রাখাও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল, আজ থেকে দু’মাস আগে পর্যন্ত, আরও স্পষ্ট করে বললে লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘন্ট প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই নির্বাচনকে ‘ডান ডিল’ বা ‘ফলাফল তো জানাই’ বলে ধরা হয়েছিল, কিন্তু আচমকাই দেশের সেই নির্বাচনের গতি প্রকৃতি যেন আকাশ পাতাল বদলে গেল। প্রথম দু’দফায় ভোটের হার অন্যান্য বারের থেকে লক্ষ্যনীয় ভাবে কম হওয়ায় গেরুয়া শিবিরের নেতারা রীতিমতো বিশ্লেষণে বসে যান, তাদের তরফে এ ধরণের উদ্যোগ থেকে বোঝাই যায় তারা যথেষ্ট চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন। এর উপর অভিজ্ঞ সাংবাদিক থেকে শুরু করে সোফলজিস্ট সবাই বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে নরেন্দ্র মোদির ৪০০ আসন জেতার স্বপ্ন এবার অলীক হয়েই থেকে যাবে। অনেকে এমনও বলছেন যে অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকার যেমন ২০০৪ সালের ভোটে অপ্রত্যাশিতভাবে খারাপ ফল করেছিল, নরেন্দ্র মোদির সরকারের হাল এবার তেমন হতে পারে। কিন্তু দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি সরকারের তৃতীয়বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার ধারণা কে মাথায় আসছে?
লোকসভা নির্বাচনে প্রথম দুই দফায় ভোটের হার তৃতীয় দফাতেও বিশেষ হেরফের হল না। কার্যত বিশ্লেষণের কথা বললেও দেখা গেল স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে আচমকাই নিয়ে এলেন হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, তাঁর বক্তৃতায় কেবলই কংগ্রেস দলকে বিষোদগার এর ধরণের ঘৃণ্য বক্তব্য রাখাটা তাঁর দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর আগে কিন্তু দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীদের মুখে এই ভাষা বা বক্তব্য কখনো শোনা যায়নি। কথায় বলা হয়, একজন বিশেষ ব্যক্তিকে যখন ক্ষমতা হারানোর চিন্তা গ্রাস করে তখন তিনি চরম হতাশায় মুখে যা আসে তাই বলতে থাকেন, তিনি হুঙ্কার ছাড়তে থাকেন। লক্ষ্য করা গেল একটা সময়ের পর মোদীর ৪০০ ৪০০ করে হুঙ্কার ছাড়াটা, যা বলে তিনি ভোটের বাজার গরম করতে চাইছিলেন, কিন্তু তা যে বাস্তবে আর সম্ভব নয় বুঝতে পেরে মুসলমান সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে গালমন্দ শুরু করলেন, যা কোনো রাজনীতি করা মানুষ করেন না। তিনি কি ভুলে গিয়েছেন যে তাঁরই জমানায় একাধিক শিল্পপতি হাজার হাজার ট্রিলিয়ন টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, দেশে ধনী গরিবের বৈষম্য বেড়েছে বিপুল আকারে, বেড়েছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা, তাঁরই পুলিশ বাহিনি কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ভেঙে দিতে লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছে, তাঁরই আচমকা লকডাউন ঘোষণায় যে হাজার হাজার পরিবার না খেতে পেয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েছিল, মনিপুরের আগুন যে আজও নেভেনি, তা নিয়ে কি প্রধানমন্ত্রীর কোনও হুঁশ আছে? নেই। রাজনৈতিক মহল বিশ্লেষণ অব্যাহত রাখলেও বিজেপির নেতারা কিন্তু ঘৃণা ভাষণ বন্ধ করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ আর ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন এক নয়। ২০১৯-এ মোদী পুলওয়ামার আবেগকে অনেকটাই কাজে লাগিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে সেই পরিস্থিতি নেই। ২০১৪ থেকে ২০২৪- এই ১০ বছরের মোদী যদি কোনো পরিবর্তনই না ঘটাতে পারেন, তবে আর কখনো যে পারবেন সেই বিশ্বাস মানুষ কিভাবে করবেন। তাছাড়া ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে। যে বিষয়টি মানুষের মধ্যে একটা ক্লান্তি বা একঘেয়েমি তৈরি করেছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে দেশের অর্থনীতির কোনো উন্নতি ঘটছে না, কর্মসংস্থান বা চাকরিরও খবর হচ্ছে না। কেবলই হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদী প্রচার, তাতে মানুষের পেট ভরে না, জিডিপির হারও মোদির দ্বিতীয় মেয়াদে সর্বনিম্ন এবং মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধিও থেমে আছে। ফলে মোদীর হিন্দুত্বের হুঙ্কার নিয়ে মানুষ আর ভাববে না।