সাতাশ.
দ্বৈতগানে গীতা ঘটকের সঙ্গে বাচ্চুদির গলা কী চমৎকার মিলত, কী বলব! ১৯৫৪ সালে শান্তিনিকেতনের সাহিত্য মেলা ৫৩-র বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম। মন্দিরের কাছের যে বাড়িটিকে অনেকে। শান্তিনিকেতন বাড়ি বলে ’৫৪ সালে, সেটি ছিল বিদ্যাভবনের আপিস। ওই বাড়ির ছাদ সে রাতে বসন্ত পূর্ণিমার আলোতে ধুয়ে যাচ্ছিল। প্রবোধ কাকাবাবু বাচ্চুদিকে গান গাইতে বললে, তিনি গীতাদিকে সঙ্গে নিয়ে গাইলেন ‘নিবিড় অমা-তিমির হতে বাহির হল জোয়ার-স্রোতে/ শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।’ দুটি ঐশ্বর্যমণ্ডিত কণ্ঠস্বরে ওই যুগল পরিবেশনা যে সেই রাতে কী মায়া বিস্তার করেছিল, সে কথা বলে বোঝানো যাবে না।
গীতাদির তখন অনীশ ঘটকের সঙ্গে সদ্য বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরপরই এসেছেন শান্তিনিকেতনে। সিঁদুর দিয়ে সিঁথি লাল করে সুখী সুখী মুখে শ্রীসদনের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে খোলা গলায় গান গাইছেন বিভোর হয়ে। মঞ্চ পরিবেশনা কোথায় লাগে! সেই সময়কার গানের সৌন্দর্যই আলাদা।
চাঁদের আলোয় ধোয়া বিদ্যাভবনের ছাদে সেদিন আমি এমন ফেল করেছিলাম, সে কথাও বলতে হয়। সাহিত্যমেলার বর্ষপূরণ বলে প্রবোধ কাকাবাবু হঠাৎ আমাকে বাংলাদেশের তখনকার সাহিত্য নিয়ে বলতে বললেন। এমন বোকা হয়ে গেলাম যে তো তো করে মুখ দিয়ে কোনো কথাই বার করতে পারলাম না। এমন আচরণ জীবনে আর কখনো করেছি বলে মনে পড়ে না।
বাচ্চদির স্বভাবটা এমন ছিল যে তাকে ভালো না বেসে পারা যায়। না। আমি তো প্রায় সর্বক্ষণ বাচ্চুদির মুখের দিকেই চেয়ে থাকতাম। সংসারের কাজ করতেন, সে-ও দেখতে ভালো লাগত। আমাকে, আমার পরিবারকে কতবার নিজে-হাতে রান্না করে খাইয়েছেন। কম মসলার সুস্বাদু রান্না। শেষ পাতে একটু চাটনির ছোঁয়াও দারুণ আকর্ষণীয় ছিল।
শৈলজাদা একবার বেশ কিছুদিন ঢাকায় থেকে আমাদের গানটান শিখিয়ে অনুষ্ঠানের মহড়া দিয়ে শেষে অমিয়দা আর বাচ্চুদিকে ডেকে পাঠালেন। অমিয়দা গান নিয়ে বলবেন আর বাচ্ছদি গানের দলে নেতৃত্ব দেবেন। কী সুন্দর অনুষ্ঠানই যে হয়েছিল! শৈলজাদা আমাদের বলতেন বাচ্চুর মতো ঢেলে গাইতে পারে না কেউ। ‘আমি জ্বালব না। মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি’–এই ‘না’টা আর কেউ এমন করে গাইতে পারে না।
বাচ্চুদিকে আমরা পরেও নিয়ে এসে গান শিখেছি। যে শিল্পীই গান শিখতে আগ্রহী, তাকেই আমরা বসিয়েছি সেই শিখবার আসরে। এর ফলেই বাচ্চুদির কিডনির সমস্যা হয়েছে শুনে আমরা ঢাকার সব রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীকে একত্র করে শ্রবণগাথা গীতিনাট্য মঞ্চস্থ করতে পেরেছিলাম। নাট্যশিল্পী আলী যাকের, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, যুবরাজ (খালেদ খান)–এরা এসে নাট্যাভিনয় অংশটিতে যোগ দিয়েছিল। বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ বাচ্চুদির চিকিৎসার জন্যে তুলতে পেরেছিলাম আমরা।
শেষ যেবার ওঁর বাড়িতে খেলাম, সেদিন উনি আমার জন্যে একটা সুন্দর শাড়ি নিয়ে রতনকুঠিতে এসে আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন, ‘তুমি পরো’।
তাঁর শেষযাত্রাকে কিছুতেই ‘শেষ’ মনে হয়নি আমাদের। কলকাতার ক্লিনিকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে প্রসন্নমুখে তাকালেন। বললেন, ‘আবার বাংলাদেশে যাব’। বলেই পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলেন। পরদিন আমার ঢাকায় ফিরবার কথা। ছিলাম সল্টলেকে বান্ধবী সন্ধ্যা মৈত্রের বাসায়। গ্রন্থন বিভাগের প্রধান অশোক মুখোপাধ্যায় ফোনে জানালেন, তিনি চলে গেছেন। তাঁর দেহ সকালবেলাতে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রাখা ছিল, সবাই গিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল। দুপুরের পরেই আমার এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে হবে। আমি আর জোড়াসাঁকোতে যেতে পারলাম না। সন্ধ্যার সঙ্গে চুপ করে বসে রইলাম কিছু সময়।
সন্ধ্যা মৈত্রের কথা আগেও বলেছি। বিনয় ভবনে স্কুল — কলেজের শিক্ষকেরা এসে পড়েন টিচার্স ট্রেনিং বিষয়ে। অর্থাৎ বয়স্ক ছাত্রছাত্রীরাই পড়তেন সেখানে। বান্ধবী সন্ধ্যার অভিজ্ঞতার কথা বলি। লেখাপড়া শেষ করে চলে যাবার আগে কুমারী সন্ধ্যার বয়স্ক ছাত্র ভবেশ মৈত্র এসে শিক্ষয়িত্রী সন্ধ্যাকে জানালেন, ‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।’ সন্ধ্যাও দাপটের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, ‘বয়স কত?’ তা, বয়স শুনে বুঝলেন ব্যাপারটা বেমানান হবে না। ব্যস, হলো বিয়ে। সন্ধ্যার কিছু শারীরিক সমস্যা — সন্তান না হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। চোখেও কী যেন অসুখ ছিল। তবে ‘মিয়া — বিবি রাজি, তো কেয়া করেগা কাজি’!
বিনয় ভবনের কোয়ার্টার্সে ভবেশবাবুর বিশেষ থাকা হতো না। চাকরিস্থলেই থাকতে হতো, মাঝেমধ্যে সুযোগমতো চলে আসতেন। উনি আবার রাজনীতি করা লোক। মহাবতাপ্রবণ! টেরিয়ে টেরিয়ে দেখতাম, খুব একটা পছন্দ হতো না। অত ‘নীতি’র বক্তিমে কে শোনে! আমাকে দেখলেই বাংলাদেশের চাল, ডাল, চিনি, তেল ও আটার দাম ইত্যাদি জিজ্ঞেস করতেন। ফাঁপরে পড়তাম। আমি ওখানে লেখাপড়া করতে গেছি, ঢাকার বাজারদর নিয়ে অত কথা জানব কী করে?
কলকাতায় সন্ধ্যার অসুস্থ মা থাকতেন। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন ভবেশবাবুই, অনেক যত্ন নিয়ে। সন্ধ্যা কলকাতা গিয়ে গিয়ে মায়ের সেবা করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আগাম অবসর নিয়ে কলকাতাবাসী হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। সেই সুবাদে ঢাকা থেকে শান্তিনিকেতন যেতে কলকাতায় একটু পা ঠেকিয়ে যাবার সুযোগ হলো আমার। আর গান! ভোরে উঠে দোতলার ঘরে বসে প্রাণভরে গান গাও–তাতে সন্ধ্যার যদি প্রাণ ভরে। কোনো কোনো দিন বলবে, ‘ওমা, কই, এখুনি শেষ হয়ে গেল!’
ভবেশবাবু সরকারি শিক্ষা বিভাগে কাজ করতেন আর সিপিএমের রাজনীতি করতেন। রাজনৈতিক বন্ধুরা মর্নিংওয়াকে বের হয়ে, কই ভবেশবাবু!’ হাঁক দিয়ে জড়ো হতেন এসে, আর চলত ওঁদের রাজা উজির মারা গপ্পো। সন্ধ্যাও যে ওসবে যোগ দিত না, তা নয়। দুজনের একই রাজনীতি তো! দুজনের ভাবও তেমনি। খেতে বসে ইনি ওঁকে তুলে দিচ্ছেন, উনি এঁকে। ডায়াবেটিস আছে তো কী? মিষ্টি খেতে তুমি এত ভালোবাসো, তা খাবে না? সে অসুখও দুজনেরই। ভালোবেসে পরস্পর পরস্পরকে প্রিয় মিষ্টান্ন খাওয়াচ্ছেন! ওই প্রেম দেখতে ভালোই লাগত।
এখন সন্ধ্যা চলে গেছে। ভবেশবাবুর দশা দেখে সহ্য করা যায় না। কেবলই প্রলাপ বকেন, ‘তোমরা ডাকো, তবে যদি আসে! আমার ডাকে তো এল না!’
মোহরদিকেও কয়েকবার ঢাকায় এনে গান শিখেছি আমরা। সপ্রেমে শিখিয়েছিলেন ‘ডুবি অমৃত পাথারে’। গোরা হারমোনিয়াম ধরত আর উনি গেয়ে গেয়ে শেখাতেন। গোরাসুদ্ধ মোহরদিকে নিয়ে যশোর, খুলনা, চট্টগ্রামেও ঘুরেছি। সর্বত্র গান শেখার আসর হয়েছে। মোহরদির আলসেমি ধরলে গোরা একাও শিখিয়েছে গান। যশোরের নড়াইলে সেবার ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বাসায় মোহরদির সে কী ভালো — লাগা! খুশিতে নিজের পরা কিছু শাড়ি আমাকে আর প্রিয়ভাষিণীকে দান করলেন।
চট্টগ্রামের এক বাড়িতে কেবল ইলিশ মাছ দিয়ে রাতের খাবার দিয়েছিল বলে মোহরদির সে কী রাগ! সন্জীদা তো ইলিশ মাছ খেতে পারে না, কী বলে ওরা শুধু ইলিশ মাছ দিয়ে খেতে দিল! মোহরদি খাটে শুয়েছিলেন। আমি আর মালেকা আজিম খান মাটিতে। শুয়ে শুয়ে আমাদের জন্যে মোহরদির কী মন খারাপ! এই আদরগুলোই জমার খাতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। মনে পড়ছে কারা যেন মোহরদিকে বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে ব্যাকুল ছিল, আমাদের কাউকে নেবে না। রাগে মোহরদি গেলেনই না ওদের বাড়ি।
একাত্তর সালে শান্তিনিকেতনেও মোহরদির অনেক আদর পেয়েছিলাম। ধোপায় ধোয়ানো চারখানা শাড়ি দিয়েছিলেন আমাকে পরবার জন্যে। শীতের সময় দরকারি বিছানাপত্র সবই আমার পরিবারের জন্যে দেবেন বলেছিলেন। আমারও যেমন! বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক জামিল চৌধুরীকে খুশি করবার জন্যে উনি তাঁর ভাইঝি মিলিয়াকে এ গ্রেডের শিল্পী করেছিলেন। আর আসল ভালো গাইয়ে ফ্লোরা আহমেদকে বি গ্রেডে দিয়েছিলেন। আমি এই বিচারের সমালোচনা করেছিলাম কট কট করে। কলকাতার রেডিওর কোনো বড় কর্তা সে কথা মোহরদিকে জানানোতে উনি বিগড়ে গেলেন আমার ওপর। শীতবস্ত্র দেবেন বললেও পরে বললেন, ‘তুমি কেন আগে থেকে বলোনি, এখন দিতে পারব না।’ বাড়ি ফিরবার পথে খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। দীন শরণার্থী হলে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়! আমারই মুখের দোষে মোহরদির আদর হারিয়েছিলাম বলতে হবে।
দেশে ফিরে ওঁকে কৃতজ্ঞতার চিঠি লিখলে পরে উনি চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। দেখা হলে সব খুলে বলেছিলেন আমাকে। [ক্রমশ]