রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারীর পদবি বদলে গিয়ে না হয় ঠাকুর হয়ে গেল, সেই ঠাকুর আবার কাদের কেরামতিতে Tagore হল, সেটাই রহস্য। সব স্বীকৃত বইয়ে বলা হয়েছে, Tagore হল ঠাকুরের Anglicised ফর্ম। অর্থাৎ ইংরেজরাই এটা করেছিল। কিন্তু যে প্রশ্নটা ভাবায়, তা হল বাংলা ‘ক’ লিখতে গিয়ে ইংরেজরা K, C, Ch, এমনকি Q না লিখে G লিখতে গেল কেন? কলকাতার আদি বাসিন্দা বসাকপরিবার। বসাককে ইংরেজরা লিখেছে Bysak বা Bysack, Bysag লেখেনি। তেমনি রাজা নবকৃষ্ণকে Nabkissen লিখেছে, Nabgissen লেখেনি। তাহলে ঠাকুর-কে Takur বা Thacore বা Tachore না লিখে Tagore লিখতে ইংরেজরা যাবে কোন দুঃখে? এইখানেই একটা প্রশ্ন জাগে, অন্য কোনও ইউরোপীয় জাতি এটা করেছে কিনা। অন্তত চেক-রা যে করেনি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি সাম্প্রতিক ইউরোপ ভ্রমণে। প্রাগ শহরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষমূর্তির নীচে নাম লেখা আছে,’Rabindranath Thakur’। জায়গাটির নামও ভারি সুন্দর, Thakurova। কলকাতার নামকরণের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি, পণ্ডিত রাধাকান্ত দেব একটি থিয়োরি দিয়েছেন। ওলন্দাজরা হবু-কলকাতার পাশ দিয়ে জাহাজে করে যাওয়ার সময় সেখানে মড়ার খুলির স্তূপ দেখতে পেয়েছিল সাড়ে তিনশ বছর আগে। বাইবেলে এই রকম খুলিপূর্ণ জায়গাকে গোলগাটা(GOLGATA) বলা হয়েছে। সে দৃশ্য দেখে ওলন্দাজরা তাদের উচ্চারণে চেঁচিয়ে ওঠে “KOLKATA”। যেহেতু তারা Gকে K উচ্চারণ করে। রাধাকান্ত দেবের এই তত্ত্বেই প্রথম জানতে পারি ডাচদের উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্যের কথা। পরে ডাচ ফুটবলার রুড গুলিট, ডাচ চিত্রশিল্পী ভ্যান গঘ- এর নামের ক্ষেত্রেও G এর প্রায়-K উচ্চারণ লক্ষ্য করলাম। ওলন্দাজী বা ডাচ উচ্চারণে রুড কুলিত ও ফ্যান কখ -এর মতো লাগে। ১৬৬০ এ আঁকা ডাচ পর্যটক ভ্যান ডেন ব্রুকের মানচিত্রে কাঁকিনাড়া-র বানান লেখা হয়েছে Canginere। Van Gogh ডাচ উচ্চারণে ভ্যান কখ। সমস্ত বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছে ডাচরাই ঠাকুরের রোমান লিপ্যন্তর Tagore করে। ইংরেজরাও সেটা মেনে নেয়। পঞ্চানন কুশারীর ডাচ জাহাজে করে খুলনা থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে কলকাতার গোবিন্দপুরে আসার সমূহ সম্ভাবনা। পরে গোবিন্দপুরে বসবাসকালে ডাচ ও ইংরেজ জাহাজে পণ্যসরবরাহকারী বা স্টিভডোর ছিলেন। অবসরের নেশা ছিল কবিগান গাওয়া। সেইসূত্রেও তাঁর সঙ্গে ডাচদের মেলামেশা ছিল। ডাচরাই তাঁকে ঠাকুর থেকে Tagore বানিয়ে দেয়।
ঠাকুর কেন Tagore অনেক দিন ধরেই এই প্রশ্নটা করে যাচ্ছি। বিদ্বজ্জনদের দুচারজনকে সামনাসামনি জিজ্ঞাসাও করেছি। সদুত্তর পাইনি। প্রত্যেকেরই বাঁধা গৎ যে ওটা অ্যাংলিশাইজ্ড ফর্ম। অর্থাৎ ইংরেজদের উচ্চারণেই এই বিকৃতি ঘটেছে। বাস্তবে তা নয়। ইংরেজরা ঠাকুরকে নিজেরা লিখলে লিখত Thakore /Tacore । প্রসন্ন ঠাকুরের নাম ইংরেজদের লেখা বইয়েই আছে Thacore । আসলে এটা ডাচ বা ওলন্দাজদের কীর্তি । ওরা G এর উচ্চারণ K করে। Rud Gulit , Golgata, Golf এর উচ্চারণ ওরা করে যথাক্রমে রুড কুলিট, কলকাটা, কল্ফ। তেমনভাবে “ঠাকুর” বোঝাতে ওরা রোমান হরফে লিখত ‘Tagore’। অর্থাৎ ওলন্দাজ বা ডাচরাই ‘ঠাকুর’কে Tagore বানিয়েছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে ওলন্দাজ বিজনেস-টাইকুনদের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। ডাচেদের বানানটাই ইংরেজরা শিরোধার্য করেছে।
সম্প্রতি ইউরোপভ্রমণে গিয়ে নেদারল্যান্ডসে ছিলাম তিনদিন। ওখানকার লোকেরা যে G কে K-এর মতো উচ্চারণ করে তা লক্ষ্য করলাম। তবে ডাচভাষা জানলে আরও গভীরভাবে ব্যাপারটা উপলব্ধি করা যায়।
ছবি : প্রাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। জায়গাটির নাম Thakurova
🙏
অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ।