মঙ্গলবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:৩৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সাইদ আহমদ এবং তার “শেষ নবাব” নাটকের ঐতিহাসিকতা : আবু জাফর রেহমান

আবু জাফর রেহমান / ১৬৯ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

শেষ নবাব, নাট্যকার সাইদ আহমেদ-এর লেখা একটি ঐতিহাসিক নাটক। ইতিহাসের সাথে এ নাটকের সংশ্লেষ বা সংশ্লিষ্টতা যে অনেকটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা আলোচনা করার জন্য সাইদ আহমেদের নাট্য কৃতিত্ব ও এ নাটক সম্পর্কে তার কিছু অভিমত ব্যক্ত করবো।

সাইদ আহমদের জন্ম, শিক্ষাজীবন ও কৃতিত্ব :

সাঈদ আহমদ, জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩১, ঢাকা। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস্-এ। পুরানো ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, বড় হয়েছেন গানবাজনা, নাটক-চলচ্চিত্র ঘেরা পরিমণ্ডলে। বাল্যে সেতারবাদন শিক্ষা নিয়েছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে, পরে খাদেম হোসেন খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় তৎকালীন ঢাকা বেতারে অর্কেস্ট্রা বাদন পরিচালনা করেছেন। সঙ্গীতজগতের গুণী ব্যক্তিত্বদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। নাটক ও চিত্রকলার প্রতি তার আগ্রহ গভীর। কালবেলা (১৯৬২), মাইলপোস্ট (১৯৬৫), তৃষ্ণায় (১৯৬৮), একদিন প্রতিদিন (১৯৭৪) এবং শেষ নবাব (১৯৮২) তার উল্লেখযোগ্য নাটক। ষাটের দশকে রচিত ও অভিনীত তার বিভিন্ন নাটক আধুনিকতার ধারণা বয়ে আনে। বাংলা নাট্যমঞ্চে ইংরেজিতেও কয়েকটি নাটক লিখেছেন তিনি। এছাড়া তাঁর নাটক অনূদিত হয়েছে ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায়। তিনি চিত্রকলার সমালোচক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। নাট্যকার, চিত্র-সমালোচক ও সংস্কৃতিবেত্তা হিসেবে বিশ্বের নানা দেশ পরিভ্রমণ করেছেন, অর্জন করেছেন বিভিন্ন সম্মান ও পুরস্কার। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৫ সালে, ওয়াশিংটনের এরিনা স্টেজের নাট্যশালার দর্শকাসনের একটি সারিতে তাঁর নামাঙ্কিত রয়েছে, ফরাসি সরকারের লিজন দ্য অনার পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। সাঈদ আহমদের পরিপূর্ণ শৈল্পিক সত্তা ও বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তাঁকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে।

শেষ নবাব নাটকের ঐতিহাসিকতা বা ঐতিহাসিক সংশ্লেষ ও সাইদ আহমেদের নিজের মন্তব্য —

শেষ নবাব নাটকটি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার শোচনীয় পরাজয়, সেনাপতি মির জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও পলাশীর প্রান্তরে ঘটিত ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে রচিত একটি গদ্যনাট্য। নাটকটির সাথে ঐতিহাসিক সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে নাট্যকার সাইদ আহমেদ বলেন, ‘শেষ নবাব’ রচনায় আমাকে প্রায় দশটি বছর ব্যয় করতে হয়েছে। ১৯৭৮ সালে আমি গিয়েছিলাম হংকং-এ আর্টস ফেস্টিভ্যালে বক্তৃতা দিতে। তখন সবেমাত্র নাটকটি লেখা শুরু করেছি। আমার বক্তৃতার পর সে দেশের খবরের কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল সিরাজদ্দৌলার কাহিনী। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নাটকের জন্য বেশ কিছু তথ্যও পেয়েছিলাম। এরপর লেখার মাঝে মাঝে আমার সুযোগ হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নবাব সিরাজদ্দৌলা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি দেশী-বিদেশী বই, গবেষণা পত্র, দলিলাদি পড়ার। আমি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কোলকাতা, মাদ্রাজের পুরোনো সেক্রেটারিয়েট অফিসে গিয়ে বিভিন্ন দলিলপত্র দেখেছি। বৃটেনেও গবেষণার কাজ চালিয়েছি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পেয়েছি অনেক চমকপ্রদ তথ্যাদি। এই নাটকে পলাশী যুদ্ধক্ষেত্রের ম্যাপটি মাইকেল এউয়ার্জের বই থেকে সংগ্রহ করেছি ম্যাপটি নাটককে আরও সমৃদ্ধ করেছে বলেই আমার বিশ্বাস”।

শিল্পকলা একাডেমি কতৃক মঞ্চস্থ করার প্রাক্কালে নাট্য নির্দেশক খ ম হারুন বলেন, “অনেকের কাছেই মনে হতে পারে ‘শেষ নবাব’ নাটকটি একটি ঐতিহাসিক নাটক। আমার কাছে নাটকটি ঐতিহাসিক তবে একই সঙ্গে আধুনিক। এর প্রধান চরিত্র সিরাজদ্দৌলাকে কেন্দ্র করে। বাংলা ভাষায় বেশ ক’টি নাটক রচিত হয়েছে। তবে সে সবের সঙ্গে এ নাটকটির একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ‘শেষ নবাব’-এর বক্তব্য স্পষ্ট ও গভীর এবং তা সমকালকে স্পর্শ করে। পলাশীতে নবাব সিরাজ হেরে গেছেন বটে কিন্তু তাঁর বীরত্ব, স্বাধীনতা চেতনা, মর্যাদাবোধ হারেনি। নাটকে যে যুদ্ধ তা উপলব্ধির, সচেতনতার এবং সর্বোপরি তা আমাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত”।

শেষ নবাব নাটকের দীর্ঘ কাহিনী সংক্ষিপ্ত রুপে আলোচনা করা যাক।

শেষ নবাব নাটকে ১৭৫৬ সালের ১৯ জুন থেকে ১৭৫৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত সময় সীমার মধ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ ঘটনা স্থান পেয়েছে। ১৭৫৬ সালের ১৯ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন ক্লেন মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ নিয়ে কামান চালাচ্ছেন আর অন্য সৈন্যদের প্রাণপণে যুদ্ধ করার জন্য অনুপ্রাণিত করছেন। এর মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দেওয়ার অনুরোধ করলে ক্লেটন বাঙালিদের উদ্দেশে আপত্তিকর মন্তব্য করায় বাঙালি ওয়ালি খান তার প্রতিবাদ করে। এ সময় হলওয়েল প্রবেশ করে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে পরামর্শের কথা বলে ক্লেটন পালিয়ে যান। তখন দুর্গের দায়িত্ব এসে পড়ে হলওয়েলের ওপর। যুদ্ধজয়ী নবাব হলওয়েলের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন “বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার স্পর্ধা ইংরেজরা পেল কোথা থেকে?” নবাবের নির্দেশে কাশিমবাজার কুঠির পরিচালক বন্দি ওয়াটসনকে আনা হলে নবাব তাদের অশিষ্ট আচরণ ও অনাচারের জবাব চাইলেন। তারা কাশিমবাজারে গোলাবারুদ আমদানি করছে, কলকাতার আশপাশের গ্রামগুলো নিজেদের দখলে নিচ্ছে দুর্গ সংস্কার করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে, নবাবের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দিয়েছে, এমনকি নবাবকে নজরানা পর্যন্ত পাঠায়নি।

এসব ধৃষ্টতার জবাবদিহিতা না করা পর্যন্ত নবাব বাংলায় তাদের বাণিজ্য করা বন্ধ ঘোষণা করে দিলেন। একই সঙ্গে তিনি নির্দেশ দিলেন, গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা কামানের গোলায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে এবং ইংরেজদের অবিলম্বে কলকাতা ত্যাগ করতে। আর আশপাশের গ্রামবাসী যেন তাদের কাছে কোনো সওদা বিক্রি না করে, সেটা জানিয়ে তাদের জানিয়ে দিতে বললেন। তিনি নির্দেশ দিলেন যে, প্রত্যেক ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে যেন নবাবের তহবিলে জমা করা হয়। কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক ইংরেজের কাছ থেকে কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ আদায় করারও ফরমান জারি করলেন নবাব।

কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে পলাতক ইংরেজরা ভাগীরথী নদীতে ভাসমান ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে আশ্রয় নেয়। অন্ন-বস্ত্রের অভাবে তারা অসহনীয় অবস্থার মধ্যে পড়ে। বন্দি করে বিচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হলওয়েল ও ওয়াটসনকে নবাব ছেড়ে দেন। এতে তাদের ধারণা হয় কিছু উপহার-উপঢৌকন নিয়ে নবাবের দরবারে হাজির হলে তার সঙ্গে এখনও ভালো সম্পর্ক তৈরি করা যাবে। দূতের মাধ্যমে নবাবের অন্যতম অমাত্য উমিচাঁদের চিঠিতে তাদের জানানো হলো যে, কলকাতার দেওয়ান মানিকচাঁদ বারো হাজার টাকা নজরানা নিয়ে ইংরেজদের ব্যবসায় করার অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া সিরাজের সিপাহসালার মিরজাফর, অমাত্য রাজবল্লভ ও জগৎশেঠের দল শওকতজঙ্গকে সমর্থন দেবে এবং উমিচাঁদ ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্বের আশ্বাস দিয়েছেন। নবাব আলিবর্দি খাঁর ইঙ্গিতে সিরাজ ঢাকার সেনাপতি হোসেন কুলি খাঁকে হত্যা করলে সিরাজের সঙ্গে তার খালা ঘসেটি বেগমের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেই ঘটনার সূত্র ধরে সিরাজের স্থলে নিজ পালকপুত্র শওকতজঙ্গকে নবাবি আসনে বসানোর প্রক্রিয়ায় প্রধান সেনাপতি ও অন্যতম অমাত্যদের সমর্থন লাভের উদ্যোগ নেন মতিঝিল প্রাসাদে। এ সময় নবাব সিরাজউদ্দৌলা উপস্থিত হয়ে ঘসেটি বেগমকে নিজ প্রাসাদে নিয়ে আসেন। কারণ নবাব বুঝতে পারেন, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীরা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রেখেছে। ওদিকে ইংরেজরাও ব্যবসায়ের নামে বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। এ অবস্থায় চক্রান্তকারীদের অন্তরে শুভবোধ জাগ্রত করার জন্য সেনাপতি, অমাত্যবর্গ ও ইংরেজ প্রতিনিধিদের নিজ দরবারে ডাকেন এবং তাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন। ধর্মগ্রন্থ নিয়ে শপথ করলেও নিজ নিজ অবস্থানে তারা পুনরায় ষড়যন্ত্রে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নবাব মোহনলালকে দিয়ে শওকতজঙ্গকে দমন করেন। মানিকচাঁদকে কয়েদ করে দশ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন। এর ফলে ষড়যন্ত্রকারী ও ইংরেজরা প্রমাদ গুণতে থাকে। অবশেষে মিরজাফরপুত্র মিরনের বাড়িতে তাদের শেষ মন্ত্রণাসভা বসে। নর্তকীদের সমাগমে সেই সভায় রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মিরজাফর উপস্থিত হন। মহিলার ছদ্মবেশে আসেন ক্লাইভ ও ওয়াটসন। রায়দুর্লভ এসে তার নিজের জন্য সিপাহসালারের পদটির প্রত্যাশা জানিয়ে যান। ধুরন্ধর রবার্ট ক্লাইভ একথা বুঝতে পেরে নিরাপদ বোধ করেন। কারণ এখানে সবাই স্বার্থের পশ্চাতে ধাবমান। বিশেষ করে উমিচাঁদের লোভের সীমা-পরিসীমা নেই। তাই তাঁকে ঠকানোর জন্য নকল দলিলে বিশ লক্ষ টাকা দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়, আর আসল দলিলে উমিচাঁদের কোনো উল্লেখই থাকে না। দলিলে ভয়ানক যে বিষয়টি রাজবল্লভ লক্ষ করেন তা হলো — “এই সন্ধি অনুসারে সিপাহসালার শুধু মসনদে বসবেন। আর রাজ্য চালাবে কোম্পানি।” মিরজাফরের তখন এত কিছু ভেবে দেখার মতো অবস্থা ছিল না। এভাবেই ইংরেজদের কূটকৌশলচক্রে ধরা দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধালোভী বিশ্বাসঘাতকরা নবাবের বিরোধিতা করে, যুদ্ধ না করে, তাদের পক্ষে কাজ করে তারা বাংলাকে পরাধীনতায় ঠেলে দেয়।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে একদিনও নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেননি। স্ত্রী লুৎফার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তার চারদিকে কেবল দেয়ালের সমাহার। কোনোটি ভাঙছেন, কোনোটি ডিঙাচ্ছেন তবুও দেয়ালের শেষ হচ্ছে না। পলাশির যুদ্ধের আগের রাতে নবাব তার অনুগত সেনাপতিদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ করেছেন। ইংরেজদের মােট সৈন্য তিন হাজারের বেশি নয়, নবাবের পঞ্চাশ হাজার। ছােটে-বড়ো মিলিয়ে ওদের কামান দশটি, আর নবাবের পঞ্চাটিরও বেশি। তবুও নবাব চিন্তিত ছিলেন কারণ তিনি জানতেন তার বড়ো সেনাদলের সেনাপতিরাই বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তিনি এও জানতেন তার সব কামান থেকে গোলা বের হবে না। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির প্রান্তরে ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের যুদ্ধ শুরু হয়। নবাবের কাছে একের পর এক সেনাপতিদের মৃত্যুর সংবাদ আসতে থাকে। মােহনলাল আর মিরমদন নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ না করার অনুরােধ করেন, তখন তারা বিজয়ের প্রান্তে। কিন্তু এ সময় মিরজাফর ও রায়দুর্লভের পরামর্শে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করার ঘােষণা দিয়ে মুর্শিদাবাদ রওয়ানা হন। যাওয়ার পথে তিনি ধরা পড়ে বন্দি হন। পরে মিরনের আদেশে মােহাম্মদি বেগ তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসে আমানিশা যা প্রায় ২০০ বছর চলতে থাকে। সাইদ আহমদ তার শেষ নবাব নাটকে ইতিহাসের এ বাস্তবকাহিনী উজ্জ্বল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

তবে সাইদ আহমদ তার শেষ নবাব নাটকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন পরবর্তী সভ্য শয়তান ইংরেজ এবং এদেশে তাদের দোসর, দেশদ্রোহী, নির্লজ্জ দালাল কর্তৃক নবাবকে যেভাবে হেনস্তা ও নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছিলেন তার চিত্র নাট্যকর সাইদ আহমদ কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। হয়তো এটা তার পাঠকদের দেখতে দেওয়া তিনি সমীচীন মনে করেন নি।

মতিঝিল প্রাসাদ থেকে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের ঘটনা থেকে শুরু করে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ বেনিয়াদের বিজয়ের মূহুর্তে নবাব মুর্শিদাবাদে রওয়ানা হয়েছেন এবং ক্লাইভ হিপ হিপ হুররে বলার সাথে সাথে বৃটিশ কুচকাওয়াজ বলার সাথে সাথেই তার নাটকের বুদ্ধি দীপ্ত পরিসমাপ্তি টানেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কতৃক প্রকাশিত ও মঞ্চস্থ করা এ নাট্যগ্রন্থে দেশ বরেণ্য প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান এক দীর্ঘ ও মূল্যবান ভুমিকা দিয়েছেন। গ্রন্থটি দুই বাংলার তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। যদিও বাংলাভাষায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধের আরো কিছু ঐতিহাসিক নাটক ও ডকুমেন্টারী রয়েছে, তথাফি সংশ্লিষ্ট সকল প্রকাশনা ও সম্পাদনার ভীড়ে সাইদ আহমদ-এর শেষ নবাব নাটকও মর্যাদার আসনে সমাসীন থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

আবু জাফর রেহমান, শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী, সহকারী সম্পাদক ‘মাসিক ফটিকছড়ি ‘


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন