গোটা বিশ্বকে আধ্যাত্মিকতার পথ দেখিয়েছেন। আজও তিনি বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও অনুগামীদের অনুপ্রেরণা। সেবায় তাঁর জীবন উৎসর্গ। অগণিত মানুষের হৃদয় ও মননে অমলিন ছাপ রেখে গেছেন। তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। পাড়ি দিয়েছেন রামকৃষ্ণলোকে। তিনি হলেন সকলের স্মরণীয় ও বরণীয় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ষোড়শ অধ্যক্ষ স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজ। গত মঙ্গলবার পরমপূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী স্মরণানন্দজী মহারাজ অধ্যক্ষ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ২৬শে মার্চ ২০২৪ রাত ০৮.১৪ এ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে ব্রহ্মলীন হয়েছেন। বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
উল্লেখ্য, স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজের শিষ্যত্ব গ্রহন করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ফলে প্রায় পনেরো বছর ধরে তাঁর সংস্পর্শে থেকে হৃদয়শুদ্ধি ঘটানোর সুযোগ হয়েছে। শিবজ্ঞানে জীব সেবারই জীবনের মূল মন্ত্র করে বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছি। দেখেছি স্মরণানন্দ মহারাজকে যে কোনো সেবা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জীবনে সেবার আদর্শ শুধু মুখে বলা নয়, তা জীবনে কীভাবে আত্মস্থ করতে হয় তারও পাঠ দিয়েছিলেন। বেলুড়মঠ, জয়রামবাটি ও কামারপুকুরে স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজ যখনই গিয়েছেন, তখনই দর্শন পেয়েছি। বঞ্চিত করেননি কোনো ভক্ত ও অনুগামীদের। একটা কথা গুরুদেবের বারবার মনে পড়ে। তাহল যেদিন কামারপুকুর মঠ ও মিশনে স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজের কাছ থেকে দীক্ষা নিলাম। মূল মন্ত্র কানে কানে শুনিয়ে ত্রিসন্ধ্যা যপ করতে বললেন। আমি একটা কথা বলেছিলাম, সারাদিনে নির্দিষ্ট সময়ে আমার পক্ষে জপ সম্ভব নয়। উনি বলেছিলেন যখন তোর সময় হবে তখন করবি। সেভাবেই চলে আসছে। বেশ শান্তিতেই কাটছে। মঙ্গলবার রাতেই গুরুদেবের খারাপ খবর শুনলাম। সারারাত দু-চোখের পাতা ফেলতে পারিনি। সকালেই বেলুড়মঠে হাজির হয়েছিলাম। দেখি গুরুদেব শান্ত, স্নিগ্ধ নয়নে শায়িত। ভক্তদের চোখের জলে বাঁধ মানছে না। ফুল ও চোখের জলে শেষ বিদায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে একে একে ভক্তরা বেরিয়ে যাচ্ছেন।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ষোড়শ অধ্যক্ষ ছিলেন স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজ। স্বামী আত্মস্থানন্দের জীবনাবসানের পর ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই অধ্যক্ষ হিসেবে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন।
১৯২৯ সালে তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর জেলার আন্দামি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। রামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে মুম্বই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আন্দামি ভারতের তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর জেলার পাট্টুক্কোত্তাই তালুকের মাদুক্কুর ব্লকের একটি গ্রাম। এটি থানজাভুর জেলা সদর থেকে দক্ষিণ দিকে ৪৮ কিমি দূরে অবস্থিত। মাদুক্কুর থেকে ৪ কিমি। রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই থেকে ৩৪৭ কিমি দূরে এবং মুসুগুন্দান সম্প্রদায়ের ৩২টি গ্রামের মধ্যে একটি।
ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর মন ও মনন জুড়ে শুধু শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা আর স্বামী বিবেকানন্দ। রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শে তিনি এতটাই মগ্ন যে, বাস আসতে দেরি হলে স্টপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পড়তেন স্বামীজির বই। পূর্বাশ্রমের নাম জয়রাম। মুম্বই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ কুড়ি বছর বয়সে। ১৯৫২-য় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সপ্তম অধ্যক্ষ স্বামী শঙ্করানন্দের কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে যোগ দেন ওই আশ্রমেই। মা সারদার শিষ্য স্বামী সম্বুদ্ধানন্দের সান্নিধ্যে শুরু করেন কাজ। ১৯৫৪ সালে মুম্বাই আশ্রমের তৎকালীন প্রধান স্বামী সম্বুদ্ধানন্দজির সাথে প্রথম বেলুড় মঠ পরিদর্শন করেন। এই সময়ে তিনি জয়রামবাটিতে পবিত্র মায়ের জন্মশতবর্ষ ও পবিত্র মায়ের মন্দিরের পবিত্রতার সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ’৫৬ সালে স্বামী শঙ্করানন্দের কাছে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হয়ে জয়রামের নাম হয় সম্বিৎ চৈতন্য। ’৬০ সালে স্বামী শঙ্করানন্দের কাছেই সন্ন্যাস গ্রহণের পরে তিনি হন স্বামী স্মরণানন্দ।
’৫৮ সালে মুম্বই আশ্রম থেকে অদ্বৈত আশ্রমের কলকাতা শাখায় আসেন স্বামী স্মরণানন্দ। দীর্ঘ ১৮ বছর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন অদ্বৈত আশ্রমের বিভিন্ন শাখায়। বিবেকানন্দ প্রবর্তিত ইংরেজি পত্রিকা ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-এর প্রবন্ধক সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন কয়েক বছর। তাঁর হাত ধরেই উন্নত হয় আশ্রমের প্রকাশনার মান। তাঁর উদ্যোগে বিবেকানন্দের বাণী একত্র করে প্রকাশিত হয় ‘বিবেকানন্দ: হিজ কল টু দ্য নেশন’ নামক বইটি।
’৭৬-এ সারদাপীঠের সম্পাদক হয়ে টানা ১৫ বছর ধরে সেখানকার শিক্ষা ও কল্যাণকাজের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন স্বামী স্মরণানন্দ। বাংলার ভয়াবহ বন্যায় ত্রাণকাজে নেতৃত্ব দেন। তাঁর উদ্যোগেই বেলুড় মঠের সন্ধ্যারতি ক্যাসেটবন্দি হয়ে সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ে।
’৮৩-তে মঠের অছি পরিষদ ও মিশনের পরিচালন সমিতির সদস্য হন স্বামী স্মরণানন্দ। ’৯১-এর ডিসেম্বরে হন চেন্নাই রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ। তাঁরই উদ্যোগে সেখানে গড়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন রামকৃষ্ণ মন্দির। ’৯৫-এর এপ্রিলে তিনি হন মঠ ও মিশনের সহকারী সম্পাদক। দু’বছর পরে সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সময়েই দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, জার্মানিতে মিশনের সহযোগী কেন্দ্রগুলি বেলুড় মঠের অনুমোদন পায়। ২০০৭-এর মে মাসে তিনি সঙ্ঘের সহাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ভারত ও বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়ে মিশনের শাখা ও সহযোগী কেন্দ্র পরিদর্শন করে ছড়িয়ে দেন রামকৃষ্ণ ভাবপ্রবাহ। প্রবীণ সন্ন্যাসীদের কাছে তিনি সুরসিক এবং সরল মনের মানুষ।
স্বামী সুবীরানন্দ বললেন, ‘‘স্বামীজি বলেছিলেন, ভাল সন্ন্যাসী হতে হলে চতুর্যোগের সমন্বয় চাই। সেই জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম আর যোগ রয়েছে অধ্যক্ষ মহারাজের মধ্যে।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শোকবার্তায় বলেন, বেলুড়মঠের অধ্যক্ষ স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজের প্রয়াণে আমি গভীরভাবে শোকাহত। নিজের দীর্ঘ জীবনকালে স্মরণানন্দজী মহারাজ রামকৃষ্ণ চেতনার মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে আধ্যাত্মিকতার পথ দেখিয়েছেন। আজও তিনি বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও অনুগামীদের অনুপ্রেরণা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক্সহ্যান্ডেলে লিখেছেন, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজ আধ্যাত্মিকতা এবং সেবায় তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অগণিত মানুষের হৃদয় ও মননে অমলিন ছাপ রেখে গিয়েছেন। তাঁর সহানুভূতি ও গুণ আজকের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
উল্লেখ্য, স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজ অসুস্থ থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেন।
পরিশেষে গুরুদেব সম্পর্কে শ্রদ্ধাবনত স্বামী প্রেমাশানন্দ কথায় বলতে হয় ”গুরুদেবের জন্য হা-হুতাশ করিলে আমাদের যে হাসি পায় গো। গুরু মরেন না কি? চোখের দেখাই বড় কথা নয়। ধ্যানে দেখিবার জন্যই চোখের দেখা। বিশেষতঃ আজকাল ফটো তুলিবার সুবিধা থাকায়, মরণ মোটেই ক্ষতি করিতে পারে না।
ঐ দেখ তাঁহার ছবির পানে চাহিয়া — গুরুদেব করুণাঘন মূর্তিতে তোমার সম্মুখে আসীন। তুমি মঠে যাঁহাকে দেখিয়াছ, তিনিও তো শ্রীগুরুর ছবি, — তবে একটু নরেন চরেন এই তফাৎ।
ধ্যানে ডুবিয়া যাও, প্রকৃত গুরুর দেখা পাইবে। তোমরা ধ্যান করিবে বলিয়াই তিনি অন্তর্হিত হইয়াছেন।”