গেছিলাম হুগলি জেলাপরিষদের কার্যালয়ে। বিগত ৪/৫ বছর ধরে এখানে আমার যাতায়াত। ওপর থেকে নিচ তলা পর্যন্ত অনেকেই কমবেশি আমাকে চেনে। কাজ সেরে বেরবার মুখে দোতলায় সভাধিপতির ঘরের সামনের চেয়ারে গোঘাটের প্রাক্তন বিধায়ক মানস মজুমদারের সঙ্গে দেখা। মানসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বিধানসভায়। বছরটা খুব সম্ভবত ২০১৭। তখন মানস সদ্য সদ্য বিধায়ক হয়ে গোটা হুগলি জেলায় বেশ নাম করেছে। কাজও করছে চুটিয়ে। বিধানসভায় দিদির ঘরের সমানে ওকে দেখি। সেদিন মনেহয় ও কোনও ভদ্রমহিলার ট্রিটমেন্টের বিল নিয়ে এসেছিল কনসেশন করার জন্য। আমিও সেই সময় একটা কাজে গেছিলাম।
সে যাক, আমাকে দেখেই মানস হাত ধরলো। পাশের খালি চায়রটায় বসালো।
কেমন আছেন দাদা?
ভালো। তুমি কেমন আছো?
ভালো।
এতদিন জেলা পরিষদে আসছি এত লোকজন সচরাচর দেখতে পাই নি।
আজ মিটিং ছিল। তাছাড়া নমিনেটেড এমপি ক্যান্ডিডেট এসেছেন।
তাই! কোথায়?
এই তো পূর্তকর্মাধ্যক্ষের ঘরে গেছে।
এবারে আরামবাগের প্রার্থী একেবারেই অচেনা। আলাপ করা যাবে?
অবশ্যই। একটু বসুন এখুনি এসে পরবে।
ওর সঙ্গে গল্প করছিলাম। আরামবাগ মহকুমা নিয়ে। সেই এককথা, দাদা আপনি সব জানেন। মুচকি হসে বললাম, তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
সাধারন শালোয়ার-কামিজ পরা ছোটখাটো একটা মেয়ে সামনে এসে দাঁরাল।
দাদা কেমন আছো।
মানস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, দাদা আমাদের প্রার্থী মিতালি বাগ।
আমি হাত জোড় করার আগেই মেয়েটি আমার পায়ের দিকে ঝুঁকে পরলো। আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম। পাশে বসলো।
সত্যি কথা বলতে কি, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের সভা থেকে আরামবাগের জন্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রার্থীর নাম ঘোষনা করেছিল তখন একটু অবাক হয়েছিলাম, কে রে মেয়েটা! এতদিন হুগলিতে যাওয়া আসা করছি। এই নামটা তো শুনিনি। তবে কথা প্রসঙ্গে মানস জানিয়েছিল ও গোঘাটের মেয়ে। আমি যখন গোঘাট থেকে বিধায়ক পদে কনটেস্ট করি তখন ও পঞ্চায়েতের সদস্য। সেটা ২০১৬ সালের কথা। ২০২১ যখন কনটেস্ট করি মিতালি তখন পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। এখন মিতালি গোঘাট-২, ৪৬ নং জিপির সদস্য।
দেবাশিস শেঠ খানাকুলে থাকে। স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক কিন্তু আমি ওকে চিনি হুগলি জেলার গবেষক হিসাবে। ওর অগাধ পান্ডিত্য হুগলি জেলার বিষয়ে। লিখতে লিখতে কোথাও আটকেগেলে দায়ে-অদায়ে ও প্রায়ই আমার পাশে থাকে। ওকে রাতে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম। বললো, দাদা আমারও নামটা জানা ছিল নি। ও যে খুব পপুলার রাজনীতিবিদ তাও বলবো না। খুব নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে। এই কিছুক্ষণ আগে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, খুবই সাধারন। বাবা নেই। অবিবাহিত। মা আছেন। ভাই বোন আছে। নিজে আইসিডিএস-এর কর্মী। বাকিটা আপনি বুঝে নিন।
আমার হিসেবে আরামবাগ নেগেটিভ ধরে রেখেছিলাম।
খুবই খারাপ অবস্থা। চারিদিকে যা গোষ্ঠি দ্বন্দ্ব। এ বলে আমার দেখ ও বলে আমায় দেখ। তবে কি জানেন। এই মেয়েটি কোনও গোষ্ঠির নয় কোনও ছাপও এখনো লাগে নি। এই তো নাম ঘোষনার পরেপরেই শুনলাম, আরামবাগ পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান স্বপন নন্দীর অপনেন্ট লবি রাজেশ ওয়ালিং শুরু করে দিয়েছে। কাল স্বপন নন্দীও মাঠে নেমে পরবে। আপনার কথা মতো নেগেটিভ সিট। কিন্তু প্রর্থী এমনই সাধারন ঘরের মেয়ে বিরোধীদের ওর সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে দু-বার ভাবতে হবে।
মিতালিকে পাশে বসিয়ে মিনিট পাঁচেক কথা বললাম। পৈতৃক বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার আমরাপাটে। মামার বাড়ি হুগলির গোঘাটের হাজিপুর পঞ্চায়েতের দাতপুরে। বাবা এই শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। এখানেই জন্ম মিতালীর। বাবা পেশায় ছিলেন দর্জি। বর্তমানে তিনি প্রয়াত। অবিবাহিত মিতালী মা, দাদা, দিদি, ভাই সকলকে নিয়ে সংসার। মিতালীর জন্ম ১৯৭৬ সালে। মাধ্যমিক ১৯৯৩ এবং উচ্চমাধ্যমিক ১৯৯৬ সালে। বিএ অনার্স ইতিহাস। এরপর এমএ, বি এড। বর্তমান পেশা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। ২০১০ সালে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত সদস্য। ২০১৮ তে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য এবং ২০২৩-এ জেলা পরিষদের সদস্য হন।
পেজফোরনিউজের প্রতিনিধি মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জানাল, তৃণমূল কংগ্রেসের আরামবাগের লোকসভার প্রার্থী মিতালী বাগ।
দলীয় কোন্দলের ঊর্দ্ধে উঠে এতদিন রাজনীতি করেছেন। বৃহত্তর মঞ্চে প্রান্তিক এলাকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। প্রার্থী হিসেবে তাঁর নির্বাচনকে রাজনৈতিক মহল মাস্টার স্ট্রোক হিসেবে দেখছে। বিজেপিকে ভোট যুদ্ধের মাঠে অচেনা প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী চব্বিশের লোকসভা ভোটের প্রচার আরমবাগ থেকে শুরু করেন। রাতারাতি আরামবাগ প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। আরামবাগের বিজেপি প্রার্থীর নাম প্রথম দফায় ঘোষণা করা হয়নি। গত রবিবার মিতালি বাগের নাম তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রান্তিক এলাকার এক প্রতিনিধিকে প্রার্থী নির্বাচন করে তৃণমূল চমকে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই প্রার্থী নির্বাচন অপ্রত্যাশিত ছিল না।
গত উনিশের লোকসভা ভোটে সাংসদ অপরুপা পোদ্দার বিজেপির বিরুদ্ধে সামান্য ভোটে জয়লাভ করেন। গেরুয়া শিবির সেই হিসেব-নিকেশকে সামনে রেখে আরামবাগ জয়ের লক্ষ্যে অনেক আগেই মাঠে নেমে পড়েছে। বৃহত্তর রাজনৈতিক মহলের অচেনা একজনকে প্রার্থী করে তৃণমূল ভোটের আগেই মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছে। মহকুমার রাজনৈতিক মহল এমনটাই মনে করছেন। মহকুমার তৃণমূল নেতৃত্ব স্বীকার করছেন এমন প্রার্থীকে নিয়ে দলের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দের সম্ভবনা প্রায় থাকছেনা। অন্যদিকে বিজেপিকে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এই নেত্রীর মোকাবিলা করতে হবে। প্রান্তিক এলাকার এই প্রতিনিধির মোকাবিলা করতে গেলে গেরুয়া শিবিরকে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। মহকুমার এক প্রথম সারির তৃণমূল নেতা বলেন, আরামবাগের প্রার্থী নির্বাচন এক সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। অচেনা খেলোয়াড়রা অনেকসময় প্রতিপক্ষে জয় ভন্ডুল করে দেয়। কারণ সেই প্রতিপক্ষ সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা থাকেনা। উল্লেখ করা যেতে পারে আরামবাগে গত একদশক ধরে উন্নয়নের কর্মকাণ্ড চলছে। এখানকার মানুষ রেল, মেডিক্যাল কলেজ, ফোর লেনের রাস্তা পেয়েছেন। গ্ৰামীন এলাকায় পাকা রাস্তা হয়েছে। পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার গ্ৰামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন হয়েছে। লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্পের সুবিধা ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। বিরোধীরা কিন্তু এই উন্নয়নকে অস্বীকার করতে পারবে না।
Khub bhalo laaglo lekhati pore
অনেক খবর জানলাম।