চমকে উঠলেন শিরোনাম দেখে? ভাবলেন, বালখিল্যদের মতো এ আবার কি কথা? মোদিবাবুর কথা উঠলে আরএসএস-এর বা বিজেপির কথা উঠবেই। উনি সেই সব দলের সদস্য, নেতা। ঠিক ভেবেছেন। ২০১৪, ২০১৯-এ কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। যে দলের মাথা আরএসএস। বোধহয় তখনও মোদিবাবু আরএসএস ও বিজেপির কাছে নতমস্তক ছিলেন। তারপর তিনি বাড়তে লাগলেন। তাঁর আইটি শেল, তাঁর তাঁবেদার মিডিয়া হাউজ তাঁকে বাড়াতে লাগল। লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ তৈরি হতে লাগল। মোদিবাবুও ধরাকে সরা জ্ঞান করতে লাগলেন। খুব স্বাভাবিক। কেননা জনতা তখন মোদি ম্যাজিকের কথা বলতে শুরু করেছেন। মোদিবাবুও বলতে শুরু করেছেন ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’। আর তারপরে এল ‘মোদি কি গ্যারান্টি’র কথা। তখন কি আর যেখান থেকে এসেছেন, সেখানকার কথা মনে থাকে? তখন ‘গান্ধারীর আবেদনে’র দুর্যোধনের মতো বলতে হয়, ‘দুর্যোধন রাজা, দুর্যোধন বহে নিজ হস্তে নিজ নাম’।
সিঁড়িভাঙা অঙ্কটা ভালো জানেন আমাদের মোদিবাবু। জানেন, যে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা হয়, সে সিঁড়িটা সরিয়ে ফেলতে হয়, তা না হলে ক্রেডিট অন্যকে দিতে হবে যে! মোদিবাবু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের একে একে সরিয়ে দিয়েছেন নিপুণভাবে। রাম মন্দিরের পুরো ক্রেডিটটা নিচ্ছেন তিনি, কিন্তু যাঁরা গোড়া পত্তন করেছিলেন সেই আদবানি, যোশি, উমা ভারতীদের নির্বাসিত করে দিয়েছেন। এই তো সেদিন রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছবিটা মনে করুন। সেখানে সর্বত্র মোদিবাবু। আরএসএস-এর মোহন ভাগবত তাঁর পেছনে। কয়েকদিন আগের আর একটা দৃশ্য মনে করুন। আদবানিকে ‘ভারতরত্ন’ দিতে গেছেন তিনি। রাষ্ট্রপতি দাঁড়িয়ে আছেন, মোদিবাবু জমিদারি স্টাইলে বসে আছেন সোফায়। লোকে বলে যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো নয়। একটা সাক্ষাৎকারে ঘন ঘন পোশাক পরিবর্তনকে যোগী আদিত্যনাথ ‘নৌটাঙ্কি’ বলে বিদ্রূপ করেছিলেন। তামাম ভারতবর্ষে মোদিবাবু ছাড়া আর কোন নেতা ঘনঘন পোশাক পরিবর্তন করেন? লালকেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের ছবিটা মনে আছে? মোদিবাবু তাঁর স্বকীয় স্টাইলে নমস্কার করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন। বশংবদ নেতারাও সাত তাড়াতাড়ি নমস্কার করে যাচ্ছেন। মোদিবাবু নিতিন গড়কড়ির কাছে আসতে নিতিন নিস্পৃহ, হাতই তুললেন না। কারণ তিনি বুঝেছিলেন তাঁকে ছেঁটে দেবার তালে আছেন মোদিবাবু। মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহান-বাবু, রাজস্থানের বসুন্ধরার হাল কি হয়েছে সব্বাই জানেন। পুরানো নেতাদের ছেঁটে ফেলা, অন্য দল থেকে আসা নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া — এসব আরএসএস বা বিজেপির সিদ্ধান্ত?
এই যে নোটবন্দি, এটা কি বিজেপির সবাই জানতেন? আমরা তো শুনেছি যে একুশে আইনের কথা জানতেন মাত্র তিনটি প্রাণী, যার একজন মোদিবাবু। লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ তাঁর। দলকে কেন পাত্তা দেবেন? একের পর এক জুমলা করে যাচ্ছেন একেবারে স্বকীয় সিদ্ধান্তে। ব্যবহার করছেন ইডি, আইটি, সিবিআইকে। শতাধিক সাংসদকে বের করে দিচ্ছেন সংসদ থেকে। ভ্রষ্টাচার ভ্রষ্টাচার বলে চিল্লে চলেছেন তারস্বরে। নিজ হস্তে নিজ নামই বহন করে চলেছেন তিনি। বিরাট মন্ত্রীসভা তাঁর। কিন্তু সব মন্ত্রী সব সময় তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। দল বা মন্ত্রীরা বলতে পারছেন না কিছু। কারণ মোদি ম্যাজিক তাঁদের ক্ষমতার স্বাদ দিয়েছে। এই যে লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ, এই যে মোদি ম্যাজিকের প্রচার, এটাই হল স্বৈরাচারের ভ্রূণ।
২০২৪-এর নির্বাচনে মোদিবাবু যদি ক্ষমতা হারান, তখন দেখবেন আরএসএস বা বিজেপির অন্য নেতারা আঙুল তুলবেন তাঁর দিকে। সেই দস্যু রত্নাকরের গপ্পো। আত্মীয়-স্বজন বলে দিল, তোমার পাপের ভাগীদার আমরা কেন হতে যাব বাপু!
দস্যু রত্নাকর তারপর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। মোদিবাবুও কি পরাজয়ের পর প্রায়শ্চিত্ত করবেন?
না কি, আরএসএস ও বিজেপির সঙ্গে মোদিবাবুর সম্পর্ক বিষয়ে আমার ভাবনটা নিছক কাল্পনিক?