সুস্থভাবে বাঁচতে চান? তাহলে জৈব খাবার খান। রাজ্য সরকার এই জৈব খাবার যাতে নিত্য পান তার জন্য হাট বসিয়েছে। কি সেই হাট? তা হল অর্গানিক হাট। কেন আসবেন? কারণ এখানে পাবেন প্রাকৃতিক ও জৈব উপাদান থেকে সরাসরি উৎপন্ন ফসল অথবা তার থেকে তৈরি করা খাদ্যসামগ্রী। এছাড়া নানান ভোজ্য তেল, মশলা, বিভিন্ন রকমের ঘি ও মধু। এমনকি জৈব তুলোর সুতোর তৈরি কাপড়, প্রাকৃতিক বস্তু থেকে তৈরি বাসন ও হস্তশিল্প সহ একটা পরিবারের প্রয়োজনীয় সব কিছুই। এর মূল বিশেষত্ব কি? বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটা হল কৃত্রিম রাসায়নিক বা অপ্রাকৃতিক সার, কীটনাশক বিষ, রঞ্জক ইত্যাদি থাকে না, এরকম খাদ্যসামগ্রীর হাট বা কেন্দ্র।
প্রসঙ্গত, শরীর-স্বাস্থ্য-খাবার পরিবেশ নির্ভর করে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের। মনে রাখতে হবে আমরা সকলেই প্রকৃতির অংশ। শরীর স্বাস্থ্য আর খাবারের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আমাদের ভাবনা প্রাচীন দার্শনিক হিপোক্রেটিসের ভাষাতেই বলতে হয় “খাদ্য আপনার আসল ঔষধ এবং ঔষধ যেন আপনার খাদ্য থেকেই আসে”।
উল্লেখ্য, আমাদের শরীর প্রাকৃতিক খাদ্য ও পানীয়তেই সুস্থ সবল থাকে। কৃত্রিম রাসায়নিক শরীরে ঢুকলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর। আমাদের অসুস্থতার একটা বড় ও প্রধান কারণ আমাদের খাদ্যগ্রহণের ভেতরে লুকিয়ে আছে। কিভাবে? নানান ধরনের কৃত্রিম রাসায়নিক বীজ, সার, কীটনাশক, রঙ এসবের মধ্যে দিয়ে আমাদের শরীরের কোষের ভেতরে ঢুকে তার স্বাভাবিক কার্যক্রমকে উল্টে পাল্টে দিচ্ছে। ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার, কিডনির সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, হার্টের রোগ, ক্যানসার ইত্যাদি অলিখিত মহামারীর রূপ নিয়েছে। এছাড়াও কৃত্রিম রাসায়নিক নানান রূপে কৃষিকাজ ও খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার মূল পুঁজি মাটি ও জলকে নষ্ট করছে এবং দুষিতও করছে। মাটির মধ্যকার যে বিপুল প্রাণীকুল, যা ধরে রেখেছে মাটির ওপরের প্রাণ। বিরাট বিরাট অরণ্যভূমি ও তার ওপর নির্ভরশীল কীটপতঙ্গ সহ সমস্ত জীবজগৎ ও প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খল আজ ক্ষয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। মাটির নিচের আর ওপরের জলেরও একই অবস্থা আজ। কেবল আমার আপনার শরীর স্বাস্থ্যের অবনতি নয়, গোটা জীবজগৎকে অবলুপ্তির মুখে ও অনিশ্চয়তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আধুনিক কৃষির রাসায়নিক সার, কীটনাশক আর কৃত্রিম তথাকথিত “উচ্চ ফলনশীল” বীজ। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে যথেষ্ট হয়েছে, এবার আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
ঢালাও ফসল, রকমারি খাবারের রঙের ঝলকানি আর প্যাকেটের মধ্যে দিয়ে যেসব কৃত্রিম রাসায়নিক আর বিষ আমাদের শরীরের ভেতরে ঢুকছে, এবার তা বন্ধ করার সুযোগ আপনার দোরগোড়ায় হাজির। নিউটাউনের যাত্রাগাছি বাসস্টপেজে গড়ে উঠেছে জৈব হাট বা অর্গানিক হাট। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিপণন বিভাগের অধীনে ও সুফল বাংলা গ্ৰিনের ব্যবস্থাপনায় এবং পশ্চিমবঙ্গ এগ্ৰি মার্কেটিং কর্পোরেশন লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত এই হাটে জৈব খাবারের জন্য ভিড় বাড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যেসব প্রাকৃতিক ও জৈব চাষী আছেন, যেসব খাবার উৎপাদনকারী কারিগর শিল্পীরা আছেন তাদের সম্ভার নিয়ে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৭টা অবধি জৈব হাটে বেচাকেনা হচ্ছে।
প্রতিটি খাদ্যসামগ্রী ও তার উৎপাদনের পেছনে রয়েছে পারম্পরিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবনাচিন্তার প্রভাব। সেগুলো সম্পর্কে নিয়মিত চর্চার কেন্দ্র হলো এই জৈব হাট। প্রতিমাসে একদিন এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশ বিদেশের প্রখ্যাত গুণীজনদের আলোচনা ও কর্মশালা।
প্রসঙ্গত, প্রত্যেক মানুষকে ভাবতে হচ্ছে শাকসবজি খাওয়া এখন স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো? অনেকেই এসব ঝুঁকির কথা ভেবে শাকসবজি খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আর যাদের টাকা আছে তাদের অনেকেই এখন খুঁজছেন বিষমুক্ত নিরাপদ শাকসবজি। এক কথায় অধিকাংশ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ এখন দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাকসবজির দিকে। তবে মনে রাখা দরকার যে, নিরাপদ শাকসবজি মানে শুধু জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাকসবজিকে বুঝায় না। জৈব শাকসবজি ক্ষেত থেকে তোলার পর খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত নানাভাবে অনিরাপদ হতে পারে। এখন প্রশ্ন হল, কোথায় মিলবে নিরাপদ শাকসবজি, কে দেবে তার নিশ্চয়তা? আর কৃষকরা তা উৎপাদন করলেও কে দেবে তার উপযুক্ত মূল্য?এর উত্তরও মিলবে। বর্তমান রাজ্য সরকার এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে।এসব নানারকম চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এখন আমাদের দ্রুত এগিয়ে যেতে হচ্ছে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদনের দিকে। সরকারও নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদনের ওপর জোর দিয়ে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
রাজ্য সরকারের উদ্যোগে রাজ্যে এই প্রথম চালু হয়েছে অর্গানিক (জৈব) হাট। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা খাবারের সঙ্গে মানবদেহে ঢুকছে মারণ বিষ। সব্জি, মাছ, মাংস, ডিম প্রভৃতির উৎপাদন বাড়াতে প্রচুর কীটনাশক কিংবা ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। রোজকার খাবারে ক্ষতিকর ওইসব দ্রব্য এড়াতে বিশ্বজুড়ে জৈবচাষের গুরুত্ব বাড়ছে। সেই লক্ষ্যেই এবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে পুরোপুরি রাসায়নিক বর্জিত জৈবখাদ্য সামগ্রীর ভাণ্ডার তৈরি হয়েছে। এজন্য নিউটাউনে অর্গানিক হাট চালু হয়েছে জোরকদমে। নিউ টাউনের বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারের উল্টোদিকে কৃষি বিপণন দপ্তরের সদ্য নির্মিত এক বহুতলে চালু হয়েছে এই হাট। রাজ্য জুড়ে সুলভ মূল্য আম জনতাকে আনাজ সরবরাহকারী সরকারি সংস্থা ‘সুফল বাংলা’র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে বাংলায় উৎপাদিত সমস্ত ধরনের জৈব সব্জি পাওয়া যাবে। অর্গানিক (ফ্রোজেন) মাছ এবং মাংসও পাবেন ক্রেতারা। এছাড়া জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত চাল, ডাল, সরষের তেল, মধুর পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা এই হাটে হাজির হচ্ছেন।
কৃষি বিপণন দপ্তরের অফিসারদের দাবি, জৈব চাষের খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি। এতে কোনও ধরনের কীটনাশক এবং অন্য কোনও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না। ফলে ‘বিষ’ মেশানো অন্যান্য দ্রব্যের তুলনায় জৈব উপায়ে ফলানো খাদ্য সামগ্রী জনতাকে একটু বেশি দামেই কিনতে হবে। গত কয়েক বছরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বেসরকারিভাবে এই অর্গানিক চাষের ফসল বিক্রির বিজ্ঞাপন অনেকেরই চোখে পড়েছে। সরকারের দাবি,ঝ তাদের তৈরি যেসব জিনিস এই জৈব হাটে বিক্রি হবে তার গুণগত মানের সঙ্গে কোনও আপস করবে না সরকার।
সরকারি নজরদারির পাশাপাশি ইচ্ছুক উৎপাদকদের কাছ থেকে হলফনামা আদায় করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জৈব দ্রব্যগুলির ‘র্যানডাম টেস্টিং’ করা হবে। তাতে কোনও খামতি ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট চাষি কিংবা সংস্থার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার। সব মিলিয়ে চারদিক আঁটঘাট বেঁধেই জৈব হাট চালু করেছে রাজ্য। নিউ টাউনের এই জৈব হাট সফল হলে রাজ্যজুড়ে সুফল বাংলার স্টলগুলির একাংশেও এই অর্গানিক প্রোডাক্ট বিক্রির প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তে গোটা বাংলায় চলমান ও স্থায়ী মিলিয়ে ৪৭৮টি স্টল রয়েছে। জৈব হাটের এই বহুতলের ষষ্ঠতলে তৈরি হয়েছে ‘আগমার্ক টেস্টিং সেন্টার’। আগামী দিনে সেখানেই অর্গানিক টেস্টিং কেন্দ্র চালু হবে।