শোনমুড়া : মাইকি বাগিয়া থেকে বেরিয়ে হাঁটা পথে ১০ মিনিট এগোলেই (প্রায় এক কিলোমিটার) পৌঁছে যাবেন শোনমুড়া — শোন নদীর উৎসস্থলে। গঙ্গার বিশিষ্ট উপনদ শোন। প্রায় ৫০০ মাইল দীর্ঘ।স্থানীয় ভাষায় একে ‘শনেমারা’ বলে। অমরকন্টক নর্মদা ও শোন উভয়েরই উৎস। রামায়ণ, মহাভারত এবং কালিদাসের রঘুবংশমে শোনের উল্লেখ আছে। বিহারের রাজধানী পাটনার কাছে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে শোন। শোনের অপর নাম হিরণ্যবাহু।
বাঁদিকে বাধানো সিঁড়ি নেমে গেছে পাহাড়ের খাদে। এখান থেকে ৮-১০ হাত দূরত্বে আরেকটি কুণ্ড আছে যেটি ভদ্র নদের উৎপত্তিস্থল। ভদ্র নদ কয়েক হাত দূরে গিয়ে জলধারায় মিশে গেছে। উভয়ের মিলিত নাম শোনভদ্র।
অমরকন্টক থেকে নর্মদা পশ্চিমাভিমুখী কিন্তু শোনের গতি উত্তর-পূর্ব দিকে। অমরকন্টক পাহাড়ে পূর্ব প্রাচীরের কিনারা থেকে শোনভদ্র ভীমবেগে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হাজার ফুটেরও বেশি নীচে, গর্জনের শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার যো। যেখান থেকে জলধারা পাহাড়ের নিচে পড়ছে সেখানকার ভিউ পয়েন্টের নাম সুইসাইড পয়েন্ট। এখান থেকে ঘন অরণ্যের পর্বতারাজির দৃশ্য নয়নাভিরাম।
ডানদিকে একটা জলাশয় দেখা যাচ্ছে সেটা শোনের জলে ভরে রয়েছে। কথিত আছে, পুরাকালে এখানে ছিল রাজা মৈকালের রাজধানী।
রাজা মৈকালের একমাত্র কন্যার নাম ছিল নর্মদা তার দুই সখীর নাম হিমালা আর ঝিমলা। বাপের আদরের মেয়ে নর্মদা ফুল খুব ভালোবাসতেন। নর্মদা রাজাকে বলেছিলেন তাঁকে একটি সুরম্য উদ্যান বানিয়ে দিতে, তাই এই উদ্যানের ব্যবস্থা। শিবভক্ত কন্যার জন্য উদ্যানের মধ্যেই ছিল শিব মন্দির।
এদিকে নর্মদার সৌন্দর্য ও লাবণ্যের খ্যাতি অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। একদিন শোনভদ্র নামে এক রাজপুত্র সন্ন্যাসীর বেশ ধরে নর্মদার উদ্যানে উপস্থিত হন। সেই সৌম্যকান্তি তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে নর্মদা মুগ্ধ হন, ক্রমে উভয়ের মধ্যে প্রেম জন্মায়। শোনভদ্র নিজের আত্মপরিচয় দেন। শিবসাক্ষী করে উভয় উভয়কে বাগদান করলেন। উভয়ের মধ্যে কথা হয়, শোনভদ্র নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়ে তার পিতাকে বলবেন এবং যত শীঘ্র পারেন পিতাকে সঙ্গে নিয়ে এসে রাজা মৈকালের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে নর্মদার পানিপ্রার্থী হবেন। কিন্তু শোনভদ্র তার রাজ্যে ফিরে যাবার পর যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়েন। শত্রু আক্রমণে পিতা পুত্র ব্যতিব্যস্ত থাকায় দুই বছর নর্মদার কোন সংবাদ নিতে পারেন না।
নর্মদা অধীর হয়ে পড়েন। এদিকে রাজা মৈকাল কন্যার বিবাহ দেবার জন্য উদগ্রীব হন। অবশেষে পিতা-মাতার চাপে বাধ্য হয়ে নর্মদা তার পানিপ্রার্থী অপর এক রাজপুত্রকে বিবাহ করতে বাধ্য হন।
বিবাহ যেদিন হয়ে গেল তারপরের দিনই শোনভদ্র তার পিতা এবং অন্যান্য লোকজন সহ রাজসভায় উপস্থিত হলেন। সব শুনে শোনভদ্র নর্মদাকে অভিশাপ দিলেন, ‘নর্মদা তুমি আমায় প্রেমের অপমান করেছো, বিশ্বাসঘাতকতা করেছ, তোমার এই দুষ্কর্মের জন্য তুমি নদীতে পরিণত হও। তোমার দুই সখিও নিশ্চয়ই প্ররোচিত করেছে আমার বাগদানে পরেও অন্যকে বিবাহ করতে, তাই তারাও নদীতে পরিণত হোক।’
নর্মদা ক্ষুব্ধ হয়ে শোনভদ্রকে অভিসম্পাত করলেন, ‘বিনা দোষে সব না জেনে হঠাৎই আমাকে যে অভিশাপ করলে, এরজন্য তুমিও নদে পরিণত হও।’
পুরানে আছে ব্রহ্মার অশ্রু হতে এই পবিত্র শোননদের উৎপত্তি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা কাঁদবেন কেন?
দুঃখের প্রেমে পাগল শোনভদ্র নর্মদার প্রেমে একবারে দিওয়ানা হয়ে গেছিল। তারই বিরহের অশ্রু ধারা হতে এই দুঃখের নদ শোনভদ্র সৃষ্টি। আসলে বিরহ না থাকলে প্রেম পাকা হয় না। বিরহ মিলনের মাঝখানে দিয়ে দুঃখের নদী চিরকাল ধরে বয়ে চলেছে। কালের বিবর্তনে এই গল্পকথা আজও বিদ্যমান।
সোনাক্ষী দেবীর মন্দির : শোন নদের উদ্গম কুন্ডের পাশেই সোনাক্ষী দেবীর মন্দির। এই মন্দির ৫১ পীঠের অন্যতম সতীপীঠ। এই স্থানেই দেবীর বাম নিতম্ব পতিত হয়। এখানে নবরাত্রিতে ধুমধাম করে পুজো হয়।
শ্রীযন্ত্র মহামেরু মন্দির : শোনমুড়া যাওয়ার পথে পরে এই নির্মীয়মান মন্দিরটি। এই প্রাচীন মন্দিরটি যন্ত্রের উপাসনার জন্য নিবেদিত, যা একটি পবিত্র জ্যামিতিক চিত্র যা হিন্দুধর্ম অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে। এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা সবই ৫২ ফুট। মন্দিরটি ১২শতকে কলচুরি আমলে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। মন্দির কমপ্লেক্সে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে, যার মধ্যে একটি ভগবান শিবের এবং অন্যটি দেবী কালীকে উত্সর্গীকৃত। মন্দিরের কাঠামো এখনও নির্মাণাধীন যা জনসাধারণের মধ্যে রহস্যের কারণ। ৩০বছরেরও বেশি সময় পরেও শ্রীযন্ত্র মন্দিরটি সম্পূর্ণ না হওয়ার প্রাথমিক কারণ হল যে নির্মাণ প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র গুরুপুষ্য নক্ষত্রের সময় করা হয়, যা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। গুরু পুষ্য নক্ষত্র বছরে গড়ে ৪-৫ দিন হয়।
কপিলধারা : নর্মদার প্রথম জলপ্রপাত কপিলধারা। এই জলধারার গর্জন যেন বিন্ধ পর্বতের অট্টহাস্য। এখানে নর্মদা মাত্র ১০-১২ হাত চওড়া এখানে আরও দুটি জলধারা এসে নর্মদার সঙ্গে মিশেছে। তাই নর্মদা গতিবেগ প্রচন্ড বেড়ে গেছে। সেই দুটি জলধারার একটি নাম এরন্ডি অপরটির নাম কপিলা বা বিশাল্যা। কথিত আছে মহামুনি কপিল এখানে দাঁড়িয়ে শিবের তপস্যা করে ছিলেন। জলপ্রপাতের কিছু আগে কপিলমুনির প্রস্তরীভূত পায়ের ছাপ আছে।
দুধধারা : নর্মদা দ্বিতীয় জলপ্রপাত, এর জল দুধের মত সাদা, তাই এই জলপ্রপাতের নাম দুধধারা। কথিত আছে দুর্বাসা ঋষি এখানে তপস্যা করেছিলেন। এই ধারার পাশে দুর্বাসার গুহা আছে। আগে এটি দুর্বাসাধারা নামে পরিচিত ছিল, উচ্চারণের অপভ্রংশে এটি দুধধারা নামে পরিচিতি পায়। চারিদিকে অনেক ফার্ন ও বনফুল আর রাশি রাশি বনগোলাপ ফুটে আছে।
নর্মদা মন্দিরে তটে তটে বহু মন্দির, তীর্থ বিদ্যমান। স্বল্প পরিসরে সব বলা সম্ভব হলো না। অতি অবশ্যই সুযোগ হলে দর্শন করে আসুন দেবী নর্মদাকে।
নদীর দুইটি রূপ একটি তোয় অর্থাৎ জলরূপে প্রবাহ রূপে বয়ে গেছে। নদীর রূপকে আমরা সর্বদা খোলা চোখে দেখতে পাই। স্থলরূপে তার মৃত সঞ্জীবনী ধারার পরিচয় পাই যে জীবকুলকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই জল বিশাল বিশাল ভূমন্ডল কে সুফলা ও শস্য শ্যামলা করে সকলের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে অন্নদাতা রূপে।
এছাড়াও একটি দিব্যরূপও আছে। ধ্যানে একমাত্র যা বোঝা যায়, ধরা যায়, দর্শন লাভ হয়। গঙ্গা বা নর্মদা কে মোক্ষদা বলা হয় কারণ ভক্তরা ভক্তির অতিশয্যে বাড়াবাড়ি করে বলে তা নয়, যাদের চোখে নর্মদা গঙ্গার দিব্যরূপ উদ্ভাসিত হয়নি তারাও বলে। নর্মদা সমস্ত নদী কুলের মধ্যে শ্রেষ্ট।
নদীর পরিক্রমার কথা শাস্ত্রে শোনা যায় না কিন্তু চিরকালই মহাত্মারা দলে দলে নর্মদা পরিক্রমা করে চলেছেন। যাগ যজ্ঞ, ধ্যান-ধারণা, সবিকল্প নির্বিকল্প সমাধির সাধনায় মধ্যে যে দুস্কর তপস্যার ফললাভ হয় তা সহজেই নর্মদা পরিক্রমায় পরিক্রমাকারীর অধিগত হয়। শুদ্ধচিত্তে তার তট পরিক্রমা করলে সর্বসিদ্ধি করায়ত্ত হয়। মার্কন্ডেয় মুনি, কপিল মুনি, দুর্বাসা মুনি, লোকনাথ ব্রহ্মচারী বা দিগম্বরজীর মতো বহু পরিক্রমাকারীর জীবনে জীব-জীবন হতে শিব-জীবনে উত্তরণ ঘটেছে। পরিক্রমাকারীর সাধনার ভার স্বয়ং গ্রহণ করে মা নর্মদা।
নর্মদা সরিতাং শ্রেষ্ঠা রুদ্রতেজাং বিনিঃসৃতা।
তারয়েৎ সর্বভূতানি স্থাবরানি চরানি চ।।
তথ্যঋণ : তপভুমি নর্মদা- শৈলেন্দ্রনারায়ান ঘোষাল শাস্ত্রী, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় এবং নিজস্ব।