সোমবার | ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৩৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘বিকাশের বিয়ে’ গরমের সময়ে চোখের যত্ন না নিলে অন্ধত্ব এবং ক্যানসারের ঝুঁকিও থাকে : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মুলক রাজ আনন্দ-এর ছোটগল্প ‘রুপার কঙ্কণ’ অনুবাদ ড. রহমান হাবিব

মুলক রাজ আনন্দ / ৫৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪

ঝাড়ুদার মেয়ে সজনীর হাতের কব্জিতে রুপার কঙ্কণ দেখে শ্রীমতি গোপী গোয়েল ফ্যাকাশে, বিবর্ণ, ক্রুদ্ধ হলো ও ভ্রুকুটি কোঁচকালো।

রান্নাঘরে সে তার স্বামীতুষ্টির জন্য আষাঢ়ের প্রথম দিনে মিষ্টি রুটি ভাজছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে সে তার স্বামীকে পরিবেশন করছিল। তার গৃহকর্তার মধ্যে সজনীর হাতের রুপার কঙ্কণ কী প্রতিক্রিয়া আনে — তা সে দেখতে চাইল।

সজনী যখনই আসত তখনই তার স্বামীর মধ্যে একটি মুচকি হাসির প্রবাহ বইত। মাঝেমধ্যে তার মধ্যে অনিষ্টকর দৃষ্টির ঝলকও দেখেছে। একবার অথবা দুবার সে তার স্বামীকে দেখেছে এই অস্পৃশ্য বালিকাটির দিকে কামজদৃষ্টিতে তাকিয়েছে; হাতে-নাতে এ বিষয়টি সে ধরিয়ে দিতেও চেয়েছে। মাঝেমধ্যে সে নিম্নের লোকসঙ্গীতাংশটি গুনগুন করে গেয়েছে :

‘সজনী, আমি রাতে উষ্ণ ঘামে জাগ্রত হয়েছি।’ যেহেতু শ্রীমতি সন্দেহ করেছে, সে জন্য সজনীর গতিবিধি সে লক্ষ্য করছিল। মুখের হাসির ঝলক, চোখে দীপ্তি, মুখে কুঞ্চিত ভাব নিয়ে সরস ভঙ্গিতে শ্রীমতির স্বামী সজনীকে বলছে :

আস, আস, সজনীয়া, তুমি আজ সকালে আসতে দেরি করেছ।

শ্রীমতি গোপী গোয়েল হৃদকম্প অনুভব করল; সজনীর প্রতি তার স্বামীর অন্তরঙ্গ সম্ভাষণের জন্য এবং সে রমণীয় ভঙ্গিতে তাকে ‘সজনীয়া’ বলে ডেকেছে…

শ্রীমতি বুঝতে পেরেছে বালিকাটি জবাব দিয়েছে; গোপনে মাথার কাপড় দিয়ে তার মুখের এক অংশ আবৃত করে, মুখের অন্য অংশে তৃপ্তির আশ্বস্ততা নিয়ে বলেছে:

‘বৃষ্টির জন্য’।

শ্রীমতি গোপী গোয়েল এই যুবতী নারীর মুখাবয়ব উন্মোচিত করতে চাইল। কিছুটা প্রকাশিত, কিছুটা খোলা মুখের অবয়বের মধ্যে শ্রীমতি গোপী সজনীর মুখের ঔজ্জ্বল্য ও তার অন্তরঙ্গতার সুর স্পষ্টত অনুধাবন করতে পারল।

অ, মধু ‘তাদেরকে’ বল সজনীকে একটি রুটি দিতে। শ্রীরাম গোয়েল চাকর ছেলেটিকে একথা বলল, যখন ভয়ার্ত ছোট মুখের ঝাড়ুদার মেয়েটি ঝাড়ু দিতে যাচ্ছিল। ‘তাদেরকে’ সজনী সবকিছু দেবে… শ্রীমতি গোপী গোয়েল মন্তব্য করল।

‘বিবিজি, আমি গুণী নই; ক্ষমার ভঙ্গিতে সজনী বলল, ‘প্রভু গরিবদের প্রতি খুব দরদি।’

সজনী ও তার স্বামীর মধ্যকার সম্পর্কের নেতিবাচক সত্যতার ব্যাপারে শ্রীমতির স্নায়ুচাপ সৃষ্টি হলো।

তার হৃদয়ের প্রতিধ্বনি শেষ হওয়ার পর; তার মনে হলো, না, তাদের মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। তার বিয়ের পর ধর্মীয় কৃষ্টির অংশ হিসেবে শ্রীরাম তাকে লাভ করেছে; অমৃতসরে এমনটি দেয়া হতো। সজনী খুব ভীত ছিল। লজ্জায় সে শরীরের যে কোনো অংশ তো বটেই, মুখশ্রী পর্যন্ত উন্মোচিত করতে চাইত না; লজ্জায় লাল ও ঘামে সে ভিজে যেত। পরে সে শুয়ে পড়ল এবং নাক ডাকতে শুরু করল…ক্রমেই তার শরীরে ও মনে আদর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কামনার প্রবাহ গোপনে গোপনে দীপ্তিশীল হয়েছে।

এভাবে তার চোয়ালের নিচের অংশ শক্ত হয়ে যেত; ঠোঁট দ্বিবিভাজিত হতো, একটি শিহরণে তার চোখ বেমানানভাবে বেরিয়ে পড়ত। অভিযোগের সঙ্গে সে এগুলোর মুখোমুখি হতো, ‘প্রেমিকবৃন্দ।’ কিন্তু সে জানে তার স্বামী একটি কবিতার পঙ্কতির ঝাণ্ডা দিয়ে তার কোমল শব্দকে প্রতিহত করে দেবে।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে সে সজনীর শরীর গোপনে পর্যবেক্ষণ করে নিজের ভঙ্গিতে একটি গান গেয়ে উঠল :

‘আমি ও এই পাখিটির মধ্যে একটি হতাশার ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।’

‘তুমি কী নিয়ে কথা বলছ? আমি বললাম : তুমি কি অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছ, নাকি না?… নাশতা প্রস্তুত। রুটি ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও অসুবিধে নেই।

শ্রীমতির বক্তব্যের তীব্রতা স্ত্রী রামকে শান্ত হতে বাধ্য করল।

‘আমার হৃদয়ের এই আলোহীন খবর; শুধু কবিতা আছে, অফিস নয় — আমি সেই বন্দিশালাকে অগ্রাহ্য করি।

‘কবিতা আমাদের জীবিকা দেবে না।’

‘আহ! এই মুখরাকে বশীভূত করার কোনো পথ নেই।’ সে মিন মিন করে বলে কাগজটিকে গুটিয়ে সজনীর শরীরের বক্র ভাঁজের দিকে গোপনে চেয়ে তার চেতনাকে জাগ্রত করতে সে সচেষ্ট হলো এবং উঠে দাঁড়াল।

শ্রীমতি গোপী গোয়েল বিশ্বাস করত, তার স্বামী তার জন্য প্রতিমুহূর্তে তার কবি-আত্মার সংবেদনকে জমা রাখে এবং সে চায় না তার এই অনুভূতির অংশ অন্য কারো জন্য হোক, বিশেষ করে সজনীর জন্য, যার উদ্দেশে তার স্বামীর কামরঙিন অনুভব বিচ্ছুরিত হয়।

তার স্বামীর জন্য রুটি বানানোর সময় তার অনুভূতির আকাশে আলিঙ্গন, আনন্দ, কম্পন কাজ করেছে; কিন্তু এটিকে সে অন্য কারো জন্য প্রশ্রয় দিতে চায় না।

‘তুমি যে রুটি বানিয়েছ — সেগুলো পুড়ে গেছে — এগুলো ঠাণ্ডাও হয়ে গেছে’ — শ্রীমতি গোয়েল বলল :

‘আমাকে সেগুলো বানাতে দাও’ এটি সে মধুকে বলল; যদিও সে অন্য কাউকে তিরস্কারের জন্য একথা উচ্চারণ করেছে।

চাকর ছেলেটির প্রতি তার এ কটূক্তি তার স্বামীর প্রতি কাল্পনিক অনুভব আরো প্রগাঢ় করে তোলায় সে বিড় বিড় করে বলে :

‘আমি পুড়াচ্ছি’

তার স্বামীর শরীরী উষ্ণতার কারণে শ্রীমতি চুলার তাপের প্রদাহকে গ্রাহ্যই করেনি।

‘আমার জীবন’ শ্রীমতি বলল ‘তোমার পোশাক পরিধান শেষ কর। বরের মতো আজ তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছ।

‘আবারো একটি বিয়ে করলে আমি কিছু মনে করব না’

— শ্রীরাম হালকাভাবে উত্তর দিল।

‘কার সাথে?’ শ্রীমতি জিজ্ঞাসিল : তার বক্তব্যের অস্পষ্টতার মধ্য দিয়ে সে উচ্চারিল।

‘তোমার সাথে’ — শ্রীরাম উচ্চারণ করল।

এটি তাকে আশ্বস্ত করল। সে ভাজা রুটিগুলো সরিয়ে চুলার ওপর গরম রুটির অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার স্বামীর দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে চাইল, সে তার মন্তব্য তার নাকি সজনীর উদ্দেশে করেছে: সে আয়নার সামনে শ্রীরাম দাঁড়িয়ে আছে, সে দেখল সজনী সেই ঘরে ঝাড়ু দিচ্ছে।

সে গরম তৈলকে ছিদ্র-চামচ দিয়ে নাড়া দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে শোভন-সুন্দর-গভীরভাবে তার স্বামীকে উচ্চারিল, ‘ইতোমধ্যে আমরা এক, আমার জীবন…তুমি আমাকে পরিবর্তিত করেছ; আমার লজ্জা থেকে আমাকে প্রণয়ীতে… মিরার মতো: আমি আমার কৃষ্ণের গোপী।’

‘আমি যদি তুমি হতাম, তাহলে এভাবে আমি আমার প্রভুকে অনুসন্ধান করতাম না।’ সে চাতুর্যের সঙ্গে বলল : ‘এমন নিবেদিতচিত্ততা দুঃখ আনে’। ‘কিন্তু, আমার জীবন — কেন?’ সে প্রতিবাদ করল। ‘আমি তোমার…’ সে বলতে চাইল : ‘আমি তোমার সেবিকা।’

‘ওহ কেন, কেন, কেন…’ শ্রীরাম সুরের উত্থান-পতন ঘটিয়ে পরিবেশটিকে প্রতিধ্বনিময় করার জন্য এবং বিশেষ করে অফিসে যাত্রা করার আগে সজনীর আরেকবার দৃষ্টিপাতকে প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশে। যাতে দিনটি চমৎকারভাবে কাটে, কাব্যিকভাবে; বিশেষ করে এ ধরনের ভালোবাসায় পরিবেশন: যখন স্বর্গের শীতলতার প্রবাহ বইয়ে দিয়ে আকাশে মেঘ ঘুরে বেড়াবে এবং টিয়াপাখির সারি দিগন্তে আনন্দে চলমান থাকবে। ‘কিন্তু কেন?’ সে জোর দিয়ে বলল : আমার গভীর প্রণয়চেতনা কেন দুঃখ আনবে?

‘কারণ, দুজনকে একজন ভাবল, যখন একজন দূরে যায়, যেমন তুমি যখন তোমার মায়ের বাড়ি যাবে; তখন তোমার মধ্যে বিচ্ছেদ চেতনার মারাত্মকবোধ সৃষ্টি হবে। একজন প্রার্থী চলে গেলে সেই শূন্যতাকে অন্য পানীয় বা মানুষ দিয়ে ভর্তি করে নেয়া হয়।’

এই গভীরতাচ্ছন্ন ভাষ্য শ্রীমতি গোয়েলকে বিমুগ্ধ, শিহরিত ও নিশ্চিত সুন্দরতায় আবিষ্ট করল।

সে মুহূর্তে সে দেখল তার স্বামী একটি দশ পয়সার কয়েন নিয়ে সজনীর তালুর মধ্যে চাপ দিচ্ছে। আসলে সে ঝাড়ুদার মেয়েটির খোলা হাতের তালুতে তা দিল; হাতে চাপ দিচ্ছিল না। কিন্তু শ্রীমতির নিশ্চেতন কল্পনাপ্রবণতা মনে করল : এর মাধ্যমে তাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসার চূড়ান্ত সংযোগ সাধিত হয়ে যাচ্ছে। সে এও ভেবেছে যে, তারা তারকার ঔজ্জ্বল্যের মতো দৃষ্টি বিনিময়ও করেছে।

শ্রীমতির মনে হলো; জ্বলন্ত কড়াই তেলসহ এই দুই প্রেমিকের মাথার ওপর পতিত হচ্ছে। কিন্তু শ্রীরামের অবিচলিত চিত্তের প্রশান্ততা এই ধরনের বন্য কার্যক্রমকে প্রশমিত করে নেয়। তার পরিবর্তে শ্রীমতি লাজনম্র হয়ে অনুভূতিতে নিমজ্জিত হয়ে ভালোবাসার গভীর চৈতন্যে স্বামীর অন্তর্গত হলো।

‘আমি নিজের হাতে ভাজা পরোটা তোমার হাতে দেব — এগুলো মধু ভাজেনি।’…তুমি কি সেই নিচু জাতের মেয়েটির হাতে রুপার কঙ্কণ লক্ষ্য করেছ! কীভাবে সে নিজেকে পরিপাটি রাখে — একটি ঝাড়ুদার মেয়ে। আমি চাই তার মা আমাদের এখানে এসে কাজ করুক; এই চিত্রতারকা নয়।…

এই শব্দগুলোর ফলে শ্রীরাম গোয়েলের চোখের পাতা নিমজ্জিত হলো। সে গরম পরোটা খেতে খেতে তার মুখ পুড়ে যাওয়ার ভান করছিল। শ্রীরাম চোখের চাহনির এমন কারুকাজ করল, যাতে মনে হয় বিয়ের সুন্দরতম কমনীয়তা বহমান হচ্ছে — শ্রীমতি মনে করছে: সেই তার স্বামীর একমাত্র ভালোবাসা — অর্ধাঙ্গিনী।

‘তুমি যে রুপার চুড়ি পরেছ এ সম্পর্কে বলতো? তোমাকে তোমার কোন প্রেমিক এটি দিয়েছে?’ শ্রীমতি গোপী গোয়েল সজনীকে পুলিশের মতো উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করল।

‘বিবিজি; আমরা আপনাদের করুণার ওপর ভর করে বাঁচি’… সজনী বিনম্রভাবে উচ্চারিল।

‘দেবতা, তোমার হৃদয়ের মধ্যকার জ্বলন্ত চুলি্ল দেখতে পাচ্ছেন। তোমার কর্মের কারণে তিনি তোমাকে দোজখের আগুনে পুড়বেন।’ শ্রীমতি গোপী গোয়েল বালিকাটিকে চ্যালেঞ্জ করল।

‘হাম বিবিজি’ — আমি কি করেছি? — ঝাড়ুদার মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিবর্ণ হয়ে গেল।

তুমি কী করনি? তুমি তোমার হাসি দিয়ে তোমাদের সব প্রতিবেশী পুরুষকে প্ররোচিত করেছ। নোংরা নারী তুমি! এবং তুমি আমাকে নির্দোষভঙ্গিতে জিজ্ঞেস কর : ‘আমি কী করেছি?’

রান্নাঘরের আগুনের হলকা ও তাপের মতো শ্রীমতি গোপী গোয়েলের কথা সজনীর কম্পিত শরীরে আগুনের জ্বালা ধরিয়ে দিল।

‘আমার মা রুপার কঙ্কণ এনেছে — এর মাধ্যমে তারা আমার বিয়ের জন্য বাগদান করেছে।’ — অস্পৃশ্য বালিকাটি ব্যাখ্যা করল। অতঃপর সে তার মিস্ট্রেসের দিকে ঘামে ভেজা নাক ও বিস্তৃত কপাল সমেত অশ্রুভেজা চোখে নির্দোষভঙ্গিতে তাকাল।

‘তোমার মিথ্যা তোমাকে সত্যবাদী বানাবে না।’ শ্রীমতি গোপী গোয়েল প্রতিবাদ করল। ‘আমাকে দেখতে দাও, এগুলো আমার বাড়ি থেকে তুমি চুরি করেছ কিনা?’

সজনী তার হাত সামনের দিকে রাখল।

‘আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো সে আমার চরম লম্পট স্বামী যে তোমার প্রতি তার — আমার অলঙ্কার বাক্স থেকে নিয়ে তোমাকে দিয়েছে কিনা’।

‘বিবিজি’ সজনী প্রতিবাদ করল।

শ্রীমতি গোয়েল কিছু শোনা ছাড়াই উত্তর করল :

‘আমি জানি কবিতাচর্চাকারীরা আলিঙ্গন করা বাদেই অনুভূতির সংবেদনশীলতায় মানুষের সঙ্গে সংযোগ সংস্থাপিত করে।

‘আমি বাবুজির মতো এই ব্যাপারে শুনতে চাই’ বালিকাটি বলল, ‘তিনি একটি জ্ঞানী ব্যক্তি এবং চমৎকার চমৎকার শব্দ তিনি ব্যবহার করেন…।’

‘তুমি আমার সঙ্গে খাতির করতে চেয়ো না; এবং তুমি যে তার সুন্দর শব্দ শুনতে পছন্দ কর — তা বল না ! তুমি এই রুপার কঙ্কণ খুলে ফেল যেগুলো সে আমার অলঙ্কার বাক্স থেকে চুরি করে তোমাকে দিয়েছে…।

শ্রীরাম গোয়েলের শব্দের সৌগহ্য সজনীর অ-বিভ্রান্ত দৃষ্টিকে বাস্তবায়িত করল। সে ভেবেছে তার প্রভুর প্রতি সে আর কখনো শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময় প্রকাশ করতে পারবে না। তাদের চোখের একদা মিলন ঘটল। কিন্তু সজনীকে দোষী লাগল না। তার মাথা ঘুরে টাল এবং সে মূর্ছিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

‘ওঠ এবং চলে যাও এবং কখনো এই বাড়িতে আর আসবে না। তুমি তোমার মাথা উঁচু করতে চেয়েছ — নিচু জাত — এই রৌপ্য কঙ্কণ ব্যবহার করে! তুমি কি জানো না যে দক্ষিণের অস্পৃশ্যদের রুপার চুড়ি পরা নিষেধ। তুমি একটি সস্তা চিত্রতারকার ভাব দেখাও…যাও মর।’

সজনী তার বাহুর শক্তি হারিয়ে ফেললেও তার হৃদয়শক্তি হারায়নি। সে বারান্দার কোণায় বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার ফুঁপিয়ে কাঁদা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল; মূর্ছা গিয়ে হিস্টোরিয়া রোগীর মতো সে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে — অনেক বছরের বঞ্চনা ও অপমানের কষ্ট তাকে নিঃশেষিত করে দিচ্ছে।

ঝাড়ুদার মেয়েটির দুঃখবোধ শ্রীমতি গোপী গোয়েলকে আরো রাগান্বিত করে তুলল।

‘যাও, বেরিয়ে যাও এবং কখনো আর এ বাড়িতে প্রবেশ করবে না। চোর। তুমি শুধু কঙ্কণই চুরি করনি; কিন্তু আমার…’

সে তার কর্কশ বাক্যবাণী শেষ করতে সাহস করেনি; কারণ সজনীর প্রতি তার স্বামীর নিবেদন ও মনোযোগের ব্যাপারটি প্রকাশিত হলে তা সত্যের দিকে ধাবিত হতে পারে — কারণ, যদি তুমি বল ‘মৃত্যু’ — তা তখন তোমার দিকে ধাবিত হতে পারে…।

সজনী এমনভাবে তার মাথা তুলল; যেমনিভাবে একটি ঘুঘু একটি উপত্যকার মধ্যে ঝড়ো হাওয়ায় ওড়ার জন্য উদ্যত হয়।

বিশ্ববিখ্যাত লেখক ও শিল্প-সমালোচক ড. মুলক রাজ আনন্দ ১৯০৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। পাঞ্জাব ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যায়ন করেন। দর্শন শাস্ত্রে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। আনটাচেবল (১৯৩৫), কুলি (১৯৩৬) তার বিশ্বখ্যাত উপন্যাস। মুলক রাজ টিএস এলিয়টের সাহিত্যকর্মের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। লন্ডনের ব্লুমসবারি গ্রুপের যেসব বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে মুলক রাজের গল্প জমত : তাদের কয়েকজন হলেন : ইএম ফর স্টার, টিএস ইলিয়ট, অ্যালডাস হাক্সলি, ভার্জিনিয়া উল্ফ, ক্লাইভ বেল এবং হার্বাড রিড প্রমুখ। ২০০৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ৯৯ বছর বয়সে পুনার একটি হাসপাতালে ড. আনন্দ মৃত্যুবরণ করেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের পক্ষে তিনি লিখেছেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন