বৃহস্পতিবার | ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৪৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (প্রথম পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান : শৌনক দত্ত বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ত্রয়দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নন্দিনী অধিকারীর ছোটগল্প ‘শুভ মাতৃদিবস’ গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফ্লোরেন্স থেকে রাধানগর রেনেসাঁস ও রামমোহন’-এর মোড়ক উন্মোচন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১-এ কথা দিয়েও স্পেনে গেলেন না কেন রবীন্দ্রনাথ : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ : তারাপদ রায় ও তার অন্ত নাই গো নাই : প্রব্রাজিকা বেদরূপপ্রাণা পেজফোরনিউজ-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন কাশ্মীরে বিজেপির প্রার্থী নেই, মোদীর সফরও বাতিল উপত্যকা ও লাদাখে : তপন মল্লিক চৌধুরী অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে অক্ষয় হোক সম্পদ সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি : রিঙ্কি সামন্ত শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (একাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথরা কি কবিয়ালের বংশধর? : অসিত দাস নিমাই ভট্টাচার্য-এর বড়োগল্প ‘প্রাইভেট প্রাকটিশ’ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে নজর কাড়ল আরামবাগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দশম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আমার রবীন্দ্রনাথ : লুৎফর রহমান রিটন রবীন্দ্র সাহিত্যের নতুন প্রান্ত : মিল্টন বিশ্বাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কাজলদীঘি( ২৩৪ নং কিস্তি) : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় / ৩১৩৩ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০
kajaldighi

কিরে তোরা দুটোতে গাড়ির মাথায়?

ভেতরে জায়গা হবে না। বিনদ বললো।

তার মানে!

নেপলা, আবিদ এখন এই গাড়িতে ঢুকবে শ্যামদা তোমার গাড়ি চালাবে।

সেই জন্য তোরা দুটোতে মাথায় উঠেছিস।

অভিমন্যু, ঝিনুক, চিকনাদা আসবে বললো।

কেন?

অনিকা বললো তুমি ওদের গাড়িতে। ফ্রন্ট সিট পুরো বুক।

নাম। কোথায় গাছের ডালে বাড়ি খাবি আবার বিপদ ঘটবে।

ছুড়কি থাকবে।

মাথা খারাপ করিস না।

তুমি গিয়ে অনিকাদের গাড়িতে বসে পরো। অর্জুন বললো।

পাশ দিয়ে দেখলাম অনিমেষদাদের গাড়ি, বড়োমাদের গাড়ি বেরিয়ে গেল। শিবু, দারু চালাচ্ছে।

মাথায় দু-জন করে বসে।

শ্যাম এগিয়ে এলো। তানকাকে বার করি দিলি, তুই অখনো উঠুনি কেন।

এইগাড়ি তুই চালাবি?

হ।

ওই গাড়ি কে চালাবে?

আবিদ, নেপলা চালাইবে।

পাহাড়ী রাস্তা।

ধীরে ধীরে চালাইবে।

মামা। পক্কে-ঘণ্টা কাছে এসে দাঁড়াল।

কি?

আমরা দুজন গাড়ির মাথায়।

কেন!

ভেতরে জায়গা নেই।

তোরা কজন আছিস?

দিদিভাই, বোন, নম্রতাদি, বসিরভাই মাঝে। পিকুদা, অনন্য, সুন্দর, শুভ পেছনে।

তাহোক।

তুমি গেঁড়াগুলোকে নিয়ে সামনে। জায়গা কোথায় বলো।

তারপর মাঝে গাড়ি থামিয়ে ইন্টারচেঞ্জ করবি।

প্লিজ মামা।

আমি তোর ছোটোমাদের গাড়িতে গিয়ে বসছি।

পক্কে আমার হাতটা ধরে ফেললো।

সে কি গো! বোন, দিদিভাই, নম্রতাদি জ্যান্ত পুঁতে দেবে।

যা পারিস কর, শ্যাম গাড়ি স্টার্ট দে।

আমি উঠে বসলাম। পক্কেরা লাফিয়ে গাড়ির মাথায় উঠে গেল।

অনিকারা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

আঙ্কেল ক্যাডবেরি খাবে। মাম্পির মুখের দিকে তাকালাম।

কে দিল।

ওই যে আঙ্কেলটা। শ্যামের দিকে তাকাল।

শ্যাম হাসছে।

তোরটা খাব না। মিকি ভাল মিকিরটা খাব।

মিকির নেই খেয়ে নিয়েছে।

বাবান তোকে দেয় নি।

বাবান হ্যাঁ করলো। মুখের মধ্যে আছে।

আমারটা পকেটে। মিকি বললো।

গাড়ি চলতে শুরু করলো। তিনজনেই আমার ঘারে উঠে বসেছে।

কিছুটা মোরাম রাস্তা পেরবার পরই বনোপথ শুরু হলো। ধীরে ধীরে বিশাল বিশাল শাল গাছের গহীন অরণ্য আমাদের দেশলাই বাক্সের মতো গাড়িগুলোকে গ্রাস করলো। এঁকে বেঁকে বনো পথে গাড়ি চলেছে।

অনিকা অনিসা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। হাতের মোবাইল, অনবরতো কথা বলে চলেছে। চিরিক চিরিক। একমাত্র মাম্পি-মিকিরা পাখীর মতো কিচির মিচির করে চলেছে।

বাবা রাস্তাটা এরকম কেন? অনিসা বললো।

বুনের রাস্তা আবার কেমনি হবে। শ্যাম বললো।

তোমরা রাস্তাটা একটু ভাল করতে পার না।

শ্যাম হাসলো।

এউ পথে লড়ি যায়।

কিসের লড়ি।

গাছ কাটি লিয়ে যায়।

কারা?

বন বাবুরা। তার তরি এত গন্ডিগোল।

তোমরা কিছু বলতে পার না।

বলি বইলে তো মন্যে সরকারির চোখে খারাপ হইছি।

অনিসা আবার জানলার দিকে তাকিয়ে রইলো। গাড়ি চলছে।

হা সে পাশের গাছ গা দেখছু।

কোন গাছ?

হা শাল গাছের মধ্যি মধ্যি ছুট গাছ গুলান।

হ্যাঁ।

সেগুলান বিড়ি পাতার গাছ।

কেন্দু।

হ। হাজার পাতা গুড়াইলে দশ ট্যাকা পাই।

মাত্র!

তাতে চাল কিনি ভাত জোটে না, তাই বুনের ফল-পাকর, ইঁদুর, শোর, পিঁপড়ের ডিম খাই।

তোমরা চাষ-বাস করো না?

এ মাটি-এ রস লাই। ফসল কাই নু ফলাইব।

হেলতে দুলতে আমরা এবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছি।

ওরা চারদিক গোগ্রাসে গিলতে গিলতে চলেছে। কারুর মুখে কথা নেই। সবাই কম বেশি অবাক বিষ্ময়ে জানলা দিয়ে প্রকৃতির সবুজ সুরা পান করতে করতে চলেছে। মাঝে মাঝে ইঞ্জিনের প্রচন্ড গোঁ-গোঁয়ানি আওয়াজ তাল কেটে দিচ্ছে।

শ্যামের স্থির চোখ সামনের রাস্তায়।

মাম্পি, মিকি বাবানদের মুখে কেউ তালা লাগিয়ে রাখতে পারে নি। তারা তাদের মতো।

শ্যাম আঙ্কেল। অনিকা বলে উঠলো।

বইল।

তোমরা প্রজেক্টটা একচ্যুয়েলি কোথায় করার চিন্তা করেছো?

এউপাশে করতি চাইলে এউপাশে হবে। না হৈলি সেউপাশে।

কোন পাশে?

তোনকাকে লিয়ে যাব সেউ জাগায়। তোনকার পছন্দ হলি হবে।

তোমাদের কোনপাশে হলে সুবিধে?

আমানকার মতে কি হবি। তান্যে টাকা লাগায়ঠে।

তুমি বলনা শুনি।

যেউ রাস্তা নু মন্যে যাইঠি এউপাশটা করলি সুবধি। এউ পাশটা গাছ কমি আসছে। বনবাবুরা সব বেবাগ কাটি লিয়ে চলিইছে। সেউ পাশটা অখনো অনিক গাছ, কাটতি কষ্ট লাইগবে।

এখান থেকে নদী কতটা।

মাইলটাক হবি।

যদি নদীর ধার থেকে জায়গা চাই পাওয়া যাবে।

তন্যে চাইলি হয়াবে। মন্যে ব্যবস্থা করি দিব।

এ পাশে লোকজন থাকে না?

সেউপাশের থিক্যা এউ পাশটা কম।

কেন?

বনে খাবার লাই। গহীন বন হলি খাবার পাওয়া যায়। গাছ লাই, খাবার লাই।

অনিকা, অনিসা অবাক হয়ে শ্যামের দিকে তাকিয়ে। শ্যাম একবার ভিউইংগ্লাস দিয়ে ওদের দেখলো। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

বুঝিস লাই।

ঠিক ধরতে পারলাম না। বনের সঙ্গে খাওয়ার সম্পর্ক কি? অনিসা বললো।

অনিদা তুই বইলে দে।

কেন তুই বল।

আমি তুর মতো গুইছে বলতে পারব নি।

মামা একটু বলো না। অনিকা বললো।

গাছ থাকলে ফুল ফুটবে। ফুল ফুটলে মৌমাছিরা আসবে। মৌচাক তৈরি হবে। ওরা সেই সব মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে কিছুটা বিক্রী করে বাকিটা নিজেরা খাওয়ার জন্য রেখে দেয়। এটা যেমন একটা দিক তেমনি নানা রকমের পাখি, বনমরগ আসবে। খরগস, ইঁদুর, বুনোশুয়োর বাসা বাঁধবে, ওরা ওদের প্রয়োজন মতো তাদের মেরে খাবে। এছাড়া বনের ফলমূল শুকনো কাঠ। তাছাড়া এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ হচ্ছে কেন্দু পাতা। আরও অনেক ফ্যাক্টর আছে।

সবাই চুপ চাপ। হেলতে দুলতে গাড়িটা হামাগুড়ি দিতে দিতে উপরে উঠছে। এই চড়াই রাস্তাটা সত্যি খুব বিপদজনক। শালপাতায় ঢেকে আছে। তারপর বৃষ্টির জল পেয়ে পচেধসে একাকার। বেশির ভাগ সময় চাকা স্লিপ করে যায়। শ্যাম সামনের থেকে চোখ সরাচ্ছে না।

খুব ধীরে গাড়িটাকে ওপরের দিকে তুলে নিয়ে চলেছে। এইসব রাস্তা ওদের নখদর্পনে।

তোমরা এই রাস্তাটা একটু পরিষ্কার করতে পার না। অনিসা বলে উঠলো।

শ্যাম হাসল।

এউটা রাস্তা লাকি।

তাহলে?

হপ্তায় একখান গাড়ি চলে, পরিষ্কার করি কি হবে।

কেন?

বনবাবুরা যখন গাছ কাটি লিয়ে যায় ত্যাখন লড়ি ঢুকে।

তাছাড়া এই পথে কেউ যায় না?

তুর বাপ আইলে যায়। তার এউ পথে যাওয়া আসা করতি সুবধি হয়।

ঠিক আছে তোমাদের করতে হবে না। আমরা যখন এই জায়গাটা ডেভালপ করবো তখন আমরাই তৈরি করে নেব।

শ্যাম অনিসার কথা শুনে হাসছে।

দিদিভাই। শুভর গলা পেলাম।

বল।

এখানে ট্যুরিস্ট স্পট করা যায় না?

ক্যারেক্ট থিংকিং। বসির বললো।

অনিকা একবার বসিরের মুখের দিকে গম্ভীরভাবে তাকাল।

ও তুমারা পার্ট নেহি মেরা পার্ট। ম্যায় বিনদ আঙ্কেলকা সাথ বাত করুঙ্গা।

আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। সুন্দর বললো।

বসির তাকাল পেছনের দিকে।

পলিউসন এন্ড গ্রিন ফ্যক্টর।

ইয়েস।

ধীরে ধীরে আমরা ওপরে উঠে এসেছি। সেই সমতল জায়গাটা একেবারে হাতের নাগালে।

দিদিভাই একবার পেছন ফিরে নীচের দিকটা দেখ। অনিসা বলে উঠলো।

অনিকা তাকাল। চোখে মুখে বিষ্ময়ের অভিব্যক্তি।

আমাদের চার্চেও গাছ ছিল। এতগাছ আগে দেখি নি।

অনিদা এউঠি রাখি। শ্যাম বললো।

রাখ। পেছনের গাড়িগুলোকে উঠে আসার জায়গা দে।

ওউটুক জাগাতে হয়া বেশি হয়াবে।

শ্যাম গাড়ি থামাল।

সত্যি এত সবুজে চোখেরও যেন একটু শান্তি। একটা সময় এই জায়গাটা ছিল আমার দ্বিতীয় ঘর। কিছু হলেই ছুটে আসতাম। মন অশান্ত হয়ে উঠলে শান্ত করার জন্য চলে আসতাম এখানে। তখন কি পাগলামটাই না আমি করেছি। ভাবলে হাসি পায়।

এই তো কয়েকদিন আগে এখানে এসেছি। তবু কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে। সবুজ অরণ্যের শরীরে নতুন রং লেগেছে। লক লকে তন্বী শরীরটা হাওয়ার দোলায় দুলছে। সির-সির একটা আওয়াজ। চারিদিকে একটা বুনো গন্ধ ম ম করছে। গাড়ি থামতেই পক্কে-ঘণ্টা মাথা থেকে লাফিয়ে নামলো।

দিদিভাই দেখলি?

অনিকা কোন কথা বললো না। পক্কে-ঘণ্টার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

গাড়ি থামতেই মাম্পিরা চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছে।

দারু হাসতে হাসতে এগিয়ে এসেছে। দরজা খুলতেই মাম্পি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো। আজ ওদের কোন সঙ্কোচ নেই। দারু ওদের দুটোকে ধরে নামাল।

আমি দারুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

বন্ধু হইইছে।

মেয়েটা সবচেয়ে বেশি ছটফটে ওটার হাত ছাড়িস না।

আমি সেউঠি গিয়ে তানকার কাছে দে দিব।

সে দে, লক্ষ্য রাখিস।

মাম্পি, মিকি, বাবান দারুর হাত ধরে এগিয়ে গেল।

আমি নেমে দাঁড়ালাম।

পাতা ঝড়ার দিন শেষ হয়েগেছে। গাছে গাছে নতুন কচি পাতা সবুজের ঘনত্বকে আরও যেন বারিয়ে দিয়েছে। শাল গাছের ডালে ডালে থোকা থোকা রুপলি ফুল ধরেছে। চারিদিকে তার গন্ধ ম ম করছে। এ এক অদ্ভূত গন্ধ। বুনো অথচো নেশা ধরায়। এক নাম না জানা আবেশ চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। এখানে কারও খবরদারি চলবে না।

অনিসা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

তোমার বাসভূমি।

তোর পছন্দ।

এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।

আমাদের তিনটে গাড়ি ছাড়া সকলেই আগে চলে এসেছে। পেছনে আরও দুটো গাড়ি আছে। গাড়ি থেকে নেমে যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে টিলাটার চারদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। প্রত্যেকেই প্রকৃতির মোহনীয় রূপে পাগল। তার আবেশ প্রত্যেকের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

অনিমেষদা, অচিন্তবাবু, বৌদি, শুভরদাদু, ছোটোমা, সুজিতদা, টিলার একবারে ধারে দাঁড়িয়ে। ওখান থেকে সুবর্ণরেখার স্ফীত শরীরটা দেখা যায়। দু-পাশে বিস্তৃত সোনালী বালির চড়। রোদ পরে চিক চিক করছে। মাঝে সুবর্ণরেখা নিজ গর্ভের টুকরো টুকরো পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে তির তির করে বয়ে চলেছে। বৌদি মনে হয় ওদের কিছু বলছে। হয়তো বর্ষার সময় এই নদীর ভয়াল রূপের কথাই বলছে।

অনুপদা-বিধানদা মাসীমনিদের নিয়ে আর এক দিকে। সুমন্ত, অর্ক, অরিত্র, সায়ন্তন, দ্বীপায়ন সব আর একদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে।

অনিকা, অনিসা, বসির চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। চোখে মুখে বিষ্ময়ের কাজল।

মাথার ওপর ঝকে ঝকে নীল আকাশ। ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ বকের ডানার মতো ধীরে ধীরে তাদের আপন খেয়ালে উড়ে চলেছে। অলসতা ওদের চোখে মুখে। কেউ যেন জোড় করে ধাক্কা দিয়ে ওদের নিয়ে চলেছে। যেদিকে তাকাও সেদিকেই ঘন সবুজ।

মিত্রা-তনু গাড়ি থেকে নেমেই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচুখি হতেই সকলে হেসে ফেললো।

তুমি ঠিক বলতে পারো নি। তার থেকেও সুন্দর। অনিসা মায়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

মেয়ের কথা শুনে মিত্রা-তনু মুখ টিপে হাসছে।

বোন এই সেই জায়গা। সুন্দর বললো।

আজ দেখতে পাব না?

ভাগ্য ভাল থেকলে দেখবি।

অনিসা আমার মুখের দিকে তাকাল। মুচকি হসল।

বনি গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। চোখে মুখে খুশির ছোঁয়া।

মর্ভেলাস এক্সপিরিয়েন্স।

আমি হাসছি।

ইতনে সারে লম্বি লম্বি প্যের!

আমি চোখ নাচিয়ে হুঁ বললাম। এখন আগের থেকে অনেক কমে গেছে।

কিঁউ!

সরকার থেকে বনবাবুদের একটা গাছ কাটতে বললে ওরা পাঁচটা কাটে।

হুঁ। বনি চোখ নামিয়ে নিল। মুখটা সামান্য থম থমে।

অল আর ক্রুয়েল। তুম ফিকার মাত করো, ইধার কা প্রজেক্ট ম্যায় সামালুঙ্গা।

নাগেশ তোকে এই বনবাদারে একা ছারবে না।

ছোরো উসকা বাত, মেরা সাধি বারা বরষ হো চুকা।

বনি চোখ তুলে একবার চারদিকটা চেয়ে দেখলো।

এয়ি হ্যায় ভালোপাহাড়।

না। এই জায়গাটার নাম ডুলুংপোতা।

সামঝা নেহি।

তোকে আর সামঝাতে হবে না।

বোলো না, ইসকা ইনার মিনিং।

কিছু নেই।

বনি আমার মুখের দিকে ডাগর চোখে তাকাল।

সামনে একটা ঝোড়া আছে। রাতদিন ওপর থেকে নীচে ঝড়ে পরছে। ওখান থেকে এই অঞ্চলের মানুষ তৃষ্ণার জল নিয়ে যায়। সামনের এই রাস্তাটা ধরে একটু ওপরের দিকে যা দেখতে পাবি। ওই ঝোড়ার জলে একটা শীর্ণ নদী তৈরি হয়েছে এরা বলে ডুলুং নদী। তোরা নদী বলতে যা বুঝিস ঠিক তা নয়। হয়তো তার থেকেই ডুলুংপোতা।

তুম চলো।

বৌদিদের সঙ্গে যা।

মিত্রারা এগিয়ে এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

খুব জোড় পাকড়াও করেছে। মিত্রা বললো।

তা একটু-আধটু করেছে।

নাগেশ, বরুনদা-সুবীর-অংশুকে নিয়ে পড়েছে।

সাচ। বনি ঘুরে তাকাল।

মিত্রা হাসছে।

ওদিকে বিনদ-অর্জুন এলাকা মাপছে। ছুড়কি বোঝাচ্ছে রতন মিডিয়েটর।

ম্যাডাম কালকের গল্পটা অনেক ফিল্টার করে বলেছেন। অর্ক চেঁচিয়ে উঠলো।

দেখলাম অর্করা পায়ে পায়ে সব এদিকে এগিয়ে এলো। সুমন্ত, সন্দীপ, দ্বীপায়ন তখনো দাঁড়িয়ে।

আমি তোমার অনিদার মতো বলতে পারি না।

আজ ঘণ্টা দুয়েক দাদাকে একা পেতে চাই।

আমাদের কি হবে?

মাত্র একশো কুড়ি মিনিট।

মিত্রা হাসছে।

অর্ক আমার দিকে তাকাল। সায়ন্তনের খিদে মিটছে না।

তোমায় আর দাঁত কেলাতে হবে না। সায়ন্তন খিঁচিয়ে উঠলো। আমার দিকে তাকাল।

ভাল জিনিস রয়েসয়ে খেতে হয় কি বলো অনিদা? না হলে আমাশা হয়ে যাবে।

এই হাসাহাসি শুরু হলো।

আমিও হাসছি।

সুমন্তরা কাছে এগিয়ে এলো।

এই দেখো আবার দাঁত বার করে। সায়ন্তন বৃষ্টির দিকে তাকাল।

অনিদাকে বলবো। বৃষ্টি বললো।

কেনো, তোমারও আমাশা হয়েছে নাকি?

তোমার কতো বছর বয়সে এই তল্লাটে প্রথম আসো। সুমন্ত গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকাল।

অর্ক, অধ্যাপক শুরু করলেন। অরিত্র বললো।

সুমন্ত হেসেফেললো।

স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়ার পর মাঝে যে তিন মাস গ্যাপ ছিল ওই সময়ে।

কতদিন ছিলে।

দিন কুড়ি।

অরিত্রদা নোট করিস।

পারবনা যা।

সুমন্ত অরিত্রর কথা গায়েই মাখলো না। আমার দিকে তাকাল।

তখনকার দেখা ভালপাহাড়ের সঙ্গে এখনকার দেখা ভালপাহাড়ের মিল।

ষাট ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে।

এই মুহূর্তে এখানে একটা উৎসব চলছে। এরা বলছে সরহুল বা বাহা পরব। ডিটেলসটা চাই।

ভাগ। আমি ম্যাডামের কাছে পার্মিসন নিয়ে আগে ইঁট পেতেছি। অর্ক চেঁচিয়ে উঠলো।

সুমন্ত হেসে ফেললো। তুই হাফ, আমি হাফ।

কোন ভাগাভাগি নেই। কবিগান তুই, এটা আমি।

প্লিজ অর্কদা, কবিগান তুই নিয়ে নে।

আমি কি পাব কলা চুষবো। অরিত্র বললো।

ইঁট পাত। অর্ক বললো।

হাসাহাসি চলছে।

তোরা কথা বল।

আমি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে এলাম। ওরা আমার কেউ পেছনে কেউ পাশে।

মিত্রা, বড়োমা কোথায়?

এখানে কোথায় একটা ঝোড়া আছে সেখানে গেছে। বৃষ্টি বললো।

আর কে কে গেছে?

দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারবাবু, আন্টি।

সঙ্গে কেউ যায় নি।

এখানকার তিন-চারজন ছেলে গেছে।

কাছাকাছি আসতে অনিমেষদা আমার দিকে তাকাল। হাসছে।

কেমন দেখছো?

আমার কথা বলবো, না আফতাবের কথা বলবো।

তোমার কথাটা আফতাবভাই-এর মুখ দিয়ে বলবে।

তোর বৌদিকে জিজ্ঞাসা কর। দু-জনেই দিদিকে নিয়ে ওই ঝোড়াটা দেখতে গেছে।

তোমরা গেলে না?

এবার যাব।

কি বলছে?

এখানে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি করবে। এত সবুজ ওর নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না। নাজমা ম্যাডামও তাই বললো। তাতে অন্ততঃ পরিবেশ ঠিক রেখে ব্যাবসাটা ভাল করা যাবে। প্রয়োজনে আরও গাছ লাগাবে। এখানকার মানুষও কাজ পাবে।

তোমাদের বন দপ্তরের গাছ কাটার কি হবে?

তোর সব কথাতে খোঁচা। সব বন্ধ করেদেব।

পারবে?

চেষ্টা করতে ক্ষতি কি। ইচ্ছেটা তো মনের মধ্যে পুষে রাখি।

এখানে কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি নেই।

নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে।

দ্যাখো। মানুষগুলো দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে পরে সুস্থভাবে বাঁচতে পারলেই হলো।

তোকে কথা দিলাম, এক বছরের মধ্যে তুই দেখতে পাবি।

ও অনিমেষ ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করলে হবে না। আগে খেয়ে নাও। বড়োমার গলা।

পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম ইসলামভাই, ইকবালভাই, রূপায়ণদা সঙ্গে রয়েছে।

আফতাবভাই দিদির চোখ-মুখ চকচক করছে। দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

সবাই কাছে এগিয়ে এসেছে।

বড়োমা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সকাল থেকে কিছু খেলি না। চল খেয়ে নে।

কি নিয়ে এসেছো?

দেখলাম মিত্রা-তনু বড়োমার পেছনে দাঁড়িয়ে ফিক ফিক করে হাসছে।

বড়োমা আমার কথার ধরন দেখে হেসে ফেললো।

ওই দুটো তোকে লাগিয়েছে?

মিত্রারা ইশারা করছে না না। আর সকলে মুচকি মুচকি হাসছে।

কেন?

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তুই তো কখনো জিজ্ঞাসা করিস না।

আমাকে একটা প্যাকেট এক্সট্রাদিও, অনেক প্যাকেট নিয়ে এসেছে শুনলাম।

বড়োমা পেছন ফিরে মিত্রাদের দিকে তাকাল।

বজ্জাতের হাঁড়ি। দাঁতে দাঁত চিপে বললো।

তখন তোদের দুটোকে মিষ্টি দিই নি।

আমি কি না বলেছি।

আমি বিষ্ময় চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে। মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে বলেছে বড়োমা মিষ্টি দেয় নি।

অনেক ভাগীদার, তাই আগে থেকে বুক করেছি।

বড়োমা হেসেফেললো।

ডাক্তার, শুভরদাদু, তোরা সব এক গোয়ালের গরু।

না দিদি এ কথা বললে মানব না। পাহাড়ী জলে আয়রন বেশি। ঘন ঘন খিদে পেয়ে যায়। না খেলেই পিত্তি পরে শরীর খারাপ। তখন আবার এক নতুন বিপত্তি। তুমি জেদ ধরলে তাই এলাম। পরিপূর্ণ খাওয়া দাওয়া না পেলে শরীরটা টিঁকবে না।

শুভর দাদু বলতে বলতে কাছে এগিয়ে এলো।

ঠিক কথা। ডাক্তারদাদা শায় দিল।

বড়োমা অদ্ভূত একটা মুখ করে ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।

তাকালে হবে না বান্ধবী। সিনিয়ার মুখার্জী সত্যি কথাটা বলে ফেলেছেন।

বড়োমা ফিতে কাটি। নেপলা দূর থেকে চেঁচাল।

কথা শেষ হল না। ভিড়টা ধীরে ধীরে নেপলাদের গাড়ির কাছে চলে গেল।

কেমন দেখছেন?

শুভর দাদুর দিকে তাকালাম।

অনেক দিন আগে এই জায়গাটার ওপর একটা কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম। তখন এতটা ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয় নি। ডেন্স ফরেস্ট ছিল। তবে অভিজ্ঞতা দিয়ে যা বুঝছি, তখন যা ছিল এখনও সেইরকম রয়েছে।

আমি মাথা নীচু করলাম।

তোমার সাগরেদরা কিন্তু এই জায়গাটা দেখে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।

আমি মাথা তুলে হাসলাম।

ওরা কিছু করবে না।

বিশ্বাস নেই। ওরা অন্যভাবে রি-এ্যাক্ট করে। তোমার আমার মতো নয়। কোনখানকার ঝাল কোনখানে গিয়ে পরবে বোঝা মুস্কিল।

রতন সামনে এসে দাঁড়াল।

বড়োমা এখানে নিয়ে আসি।

ফিরে তাকালাম। দেখলাম অর্জুন-বিনদও সকলের হাতে হাতে প্যাকেট এগিয়ে দিচ্ছে। প্রচুর জলের বোতলও এসেছে। প্যাকেট হাতে নিয়ে যে যার ইচ্ছে মতো যেখানে সেখানে বসে যাচ্ছে। দারুরাও ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে।

সকলের কুলিয়ে যাবে?

হয়ে বেশি হয়ে যাবে।

বড়োমা আফতাবভাই-এর মুখের দিকে তাকাল।

এখানে বসবে, না ওখানে গিয়ে বসবে।

উধার কিঁউ, ইতনা সারি জাগা….। রতন।

রতন আফতাবভাই-এর মুখের দিকে তাকাল।

তেরা পাস ওয়াটার বটল হ্যায় না।

হ্যাঁ।

লে কে আ।

আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকাল।

ও যো ঝোড়াকা ওয়াটার গিড়তা হ্যায় না।

আমি আফতাবভাই-এর মুখের দিকে তাকিয়ে।

কাঁহা সে গিড়তা হ্যায়।

উঃ, উপার সে….। দিদি বলে উঠলো।

দিদি কো পুছো।

শালে মারেগা এক থাপ্পর। আফতাবভাই হাত তুলেছে।

কিঁউ। দিদি বললো।

ম্যায় তো তুমহারা শালেই হোতা হ্যায়, ইসি লিয়ে তুম মেরা জিজাজী। মারনা চাহে তো মার দো।

আফতাবভাই হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরলো। দিদিও হাসছে।

শ্যাম একটা ভাঁজ করা চেয়ার নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। বুঝলাম এটা মাসীমনির জন্য। আমরা সবাই ঘাসের বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে বসলাম। মাসীমনি চেয়ারে।

মিত্রা-তনু দাঁড়িয়ে রইলো।

কিরে তুই এখানে বসলি।

কেন! তোরাও বোস।

না। ওখানে চল। মিত্রা হাত তুলে কনিষ্কদের দিকে দেখাল। ওরা সকলে গোল হয়ে বসে পড়েছে।

বিধানদা হাসল। ওরা বলছে যখন যা।

ছোটোমা ফিক করে হেসে ফেললো।

ওর ভাগেরটা নিয়ে যদি কামড়া-কামড়ি করেছিস মজা দেখাব। বড়োমা তরপে উঠলো।

তুমিও না সত্যি….। দাদা বলে উঠলো।

দাদার কথা শেষ হল না। বড়োমা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।

সকাল থেকে তো এক পেট খাওয়া হয়েগেছে। ও খেয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করেছো?

ওর জন্য তুমি আছো।

সকলে হাসছে।

কেন, ও কি না খেয়ে বেঁচে আছে। ডাক্তারদাদা বলে উঠলো।

তোমাকে সাউকিরি করতে বলেছি।

আমি হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালাম।

রতন, অর্জুন, বিনদ খাবার প্যাকেট জলের বোতল নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে।

মিত্রাদের সঙ্গে কনিষ্করা যেখানে বসে আছে সেখানে এলাম। সকলে হৈ হৈ করে উঠলো।

ম্যাডাম, আমি অর্ক দাদার দু-পাশে একটু শেল্টার নিচ্ছি। অরিত্র বলে উঠলো।

নিতে পারিস, খাবার প্যাকেটে হাত মারতে পারবি না। মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।

আমি বসে পরলাম। নেপলা, চাঁদ, চিনা সার্ভিস করছে। শ্যামেদেরও প্যাকেট দিয়েছে। সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে।

নেপলা তোমার দাদার ভাগে দুটো প্যাকেট, বড়োমা বলেছে। মিত্রা বলে উঠলো।

কেন!

সকাল থেকে কিছু খায় নি।

নেপলা শরীরে ঢেউ তুলে হেসে উঠলো।

অরিত্র, অর্ক নিজেদের প্যাকেট হাতে করে উঠে এসে আমার পাশে বসেছে।

অর্কদা ভাগ কিন্তু আমি ছাড়ছি না। সুমন্ত বলে উঠলো।

তোর মালটা আগে বাগিয়ে নে তারপর আমাদেরটা।

ওটা কলকাতায় গিয়ে টেপাটিপি করলে বেরবে। এখানকার মালটা পরিবেশ পরিস্থিতি না দেখলে বেরবে না।

সত্যি সত্যি নেপলা দুটো প্যাকেট নিয়ে আমার সামনে নিয়ে এসে রাখলো।

এটা কি?

ম্যাডাম বললো।

ম্যাডামদের দে।

স্টকে আছে তোমাকে ভাবতে হবে না।

কয়েকটা প্যাকেট একটু সরিয়ে রাখিস, চূড়াদের দিতে হবে।

ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সেই ভাবেই প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে নিয়ে আসা হয়েছে। বিনদভাই, হানিফভাই টোটাল ব্যাপারটা কো-অর্ডিনেট করছে।

মিলি উঠে এসে সামনে বসলো।

মরা তুই একলা খাবি না। টিনা চেঁচিয়ে উঠলো।

আরে তোমরা করছোটা কি? কনিষ্ক বলে উঠলো।

তোমার ভাগে হাত দিয়েছি। মিলি পেছন দিকে তাকিয়ে বললো।

কনিষ্করা হাসছে।

অনি নীরু দুটো মারছে। অনিকেত চেঁচাল।

খেতে দে, তবে যদি ভুলভাল কম করে। আমি বললাম।

দেখলি। নীরু অনিকেতের দিকে তাকাল।

কি?

বুঝলি না।

না।

ছাগল। তখন আমার বিয়ে করা বউ রসিয়ে রসিয়ে বললো।

অনিকেত হ্যা হ্যা করে হেসে উঠলো। সবাই হাসছে।

খাওয়া শুরু হলো।

অনিদা শুরু করো। অর্ক বলে উঠলো।

কি?

বাহা পরব।

এ-সব কি ইনস্ট্যান্ট বেরয়।

তোমার বেরয়।

মিলি আমার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল। গাল ফুলে গোবিন্দর মা।

মাম্পি, মিকি কোথায়?

ছুড়কি নিয়ে গেছে পাখি দেখাতে।

আর দুটো?

দেখলাম তো ঢ্যাঁস কুমড়ো বলে দু-টোকে পিঠে তুলে নিয়ে গামছা দিয়ে বেঁধে নিল। আর একটাকে কোলে। আর দুটোকে দু’ হাতে। সেই দেখে ভজুদা, ভেঁদোদা নাচতে নাচতে পেছন পেছন গেল।

ব্রেক বুঝলে মিলি, একটা ছোট্ট ব্রেক দেখবে তোমার আইসিইউতে চলে যাওয়া মনটা আবার প্রান ফিরে পেয়েছে।

মিলি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল।

তোমরা তো কয়েকদিন আগে এসেছিলে, সেই দিনের থেকে আজকের এই দিনে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছো।

না!

একবারে কোন পরিবর্তন তোমাদের চোখে পরছে না।

মিলি একবার মুখ তুলে চারদিক তাকিয়ে দেখলো। সবাই প্যাকেট হাতে সামনা সামনি উঠে আসছে।

বিশ্বাস করো অনিদা। টিনা তোর কোন পরিবর্তন চোখে পরছে? মিলি টিনার দিকে তাকাল।

যেমন দেখেছিলাম তেমনি তো আছে দেখছি। এতো গাছের মধ্যে দু-চারটে গাছ কেটে নিয়ে গেলে আমাদের পক্ষে ধরা মুস্কিল।

শ্যাম হাসলো।

শ্যামদা তুমি হাসলে। টিনা বললো।

হা সেউ শালগাছগার মাথার দিকে ত্যাকাও। ফুল ফুটছে।

এবার সবাই মুখ তুলে এদিক সেদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

সত্যিতো এটা খেয়াল করি নি মিলি। টিনা বললো।

মিলি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

তোমরা শহুরে সভ্যতার যুবক-যুবতীরা ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করো। এই সময়টা বিশেষ করে ফাল্গুনী পূর্নিমার দিনটা সাঁওতালদের ভ্যালেন্টাইন ডে। প্রেমের দিবস।

ওদের চোখে বিষ্ময়।

যাঃ। মিত্রা বললো।

ছাত্রাবস্থায় আমরা সকলে সরস্বতী পুজোর আগে কেউ কুল খেতাম না। কারন সরস্বতী ঠাকুর পাপ দেবে। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারবো না।

ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এই সরস্বতী পূজোর দিনটা ভ্যালেনটাইন ডে। কুল খাওয়ার দিন।

সেই ছোট বয়সে চোখ তুলে না তাকালেও অনেক মেয়ের দিকে মাথা নীচু করে টেরিয়ে দেখেছি। এক অন্যরকম ভালোলাগা। এক নাম না জানা অনুভূতি। কেউ যদি সেই তাকানোতে ফিক করে হেসেফেলতো বুকটা ধড়ফর ধড়ফর করে উঠতো।

আদিবাসী সমাজেও এই অলিখিত নিষেধ এখনো ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। সরহুলের আগে বনের ফলমূল-জড়িবুটিতে কেউ হাত দেবে না। দেওয়া নিষেধ।

তোদের আগের বারের উৎসব দেখিয়েছি। ওই উৎসব যুবক-যুবতীদের প্রতিষ্ঠার উৎসব এটা পছন্দের উৎসব।

শীতের শুষ্কতা বিদায় নিয়েছে। হেমন্তের পাতাঝড়া শেষ। এখন বসন্ত।

অনূঢ়া ধরিত্রী কন্যা এই সময় ফলে-ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে। ধরিত্রী কন্যার ফলবতী হওয়ার উদযাপনও বটে। তাই নতুন ফুল-পাতায় রূপসী তরুণী পৃথিবীকে সূর্যেরসঙ্গে ঘটা করে বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ। বাহা বা সরহুল উৎসবটা সূর্যের সঙ্গে প্রকৃতির মিলন। বলতে পারো বিবাহ।

মিলিরা সকলে আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

কনিষ্করা কখন একে একে উঠে এসে সামনে বসেছে খেয়াল করি নি।

নীরুকে জিজ্ঞাসা করবে, দেখবে জানুয়ারী থেকে আগস্ট পর্যন্ত যত শিশু জন্মায় তার তিনগুন জন্মায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। একটু হিসেব করে পেছনে ফিরে যাও দেখবে সময়টা ঠিক এই সময়। বিবাহও দেখবে এই ফাল্গুন মাসে বেশি হয়।

নীরু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

সবাই নীরুর মুখের দিকে তাকিয়েছে।

নীরুদা, একটা সিটিং চাই। আগে থেকে বুক করলাম। অর্ক বললো।

একটু ভাল করে ভেবে দেখো আমাদের সবার ছেলে মেয়েই কম-বেশি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জন্মেছে। তুমি দশজনেরটা হিসাব করো। দেখবে সাতজনের মিলে যাবে। এবার রেশিও করো।

একচ্যুয়েলি এই সময়টা প্রাণী জগতের মতো মানুষেরও ব্রিদিং-টাইম।

কেন কি বৃত্তান্ত নীরুকে চেপে ধরলে তোমরা এর সবিস্তার ব্যাখ্যা পেয়ে যাবে। এই বিষয়ে নীরুর সঙ্গে আমার শত সহস্র ঘণ্টা কথা হয়েছে।

আমরা শিক্ষিত মানুষ আমাদের ঘড়ি আছে, ক্যালেন্ডার আছে। এদের আছে প্রকৃতি। সূর্যঘড়ি। পাহাড়টার মাথায় এই সময় সূর্যের আলো পড়েছে অতএব এইটা এই সময়। ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত ওরা এই মতে বিশ্বাসী নয়। ওরা আন্তরিক ভাবে এইসব মানে। আমরা শিক্ষিতরা কেউ মানি না। আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ওদের বিশ্বাসটাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি।

এই অঞ্চলের আদিবাসীরা ফাল্গুন মাস পরলেই নতুন বর্ষের আগমনকে সাদরে সম্ভাষণ করে। বলতে পারো বর্ষ গণনা শুরু। বাহা পরব বা ফুলের উৎসব। বাহা কথার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ফুল। বাহা পরব শুরু হয় ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা কেন বিখ্যাত জান?

(আবার আগামীকাল)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন