বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।
কলকাতার মধ্যে আস্ত একটা জেলেপাড়া আছে জেনে আধুনিক কলকাতার নব্যযুবারা অবাক হবে। বস্তুত মাছধরার জেলেদের অস্তিত্বই নেই প্রপার কলকাতায়। লবণহ্রদের দিকে সরে গেছে মৎস্যশিকারীদের ডেরা।
কলকাতা শহরের জেলেপাড়া বলতে বোঝাত বউবাজার এবং ক্রিক রো-র মধ্যবর্তী পল্লি অঞ্চল৷ পরবর্তীকালে জেলে সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার ফলে যে-যে এলাকা দিয়ে জেলেপাড়ার সঙ-এর মিছিল ঘুরত, সেইসব অঞ্চলেরও ‘জেলেপাড়া’ নামকরণ হয়েছিল৷ ঐতিহাসিক উপেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন — ‘‘প্রাচীন কলিকাতার একটি ক্রীক বা খাল হইতে এই রাস্তার নাম ক্রীক রো হইয়াছে৷ ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পূর্ব হইতে আরম্ভ হইয়া এই রাস্তা পূর্বদিকে সার্কুলার রোড পর্যন্ত গিয়াছে৷ বহু পূর্বে একটি খাল ক্রীক রো, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট প্রভৃতি স্থান দিয়া গঙ্গায় পড়িত৷ শহরের আবর্জনা দিয়ে এই খাল ভরাট করিয়া এই রাস্তা তৈয়ারী করা হইয়াছে৷ ক্রীক রো-র নিকটের অঞ্চলকে ডিঙ্গা-ভাঙ্গা বলা হয়৷ ইহা হইতে মনে হয় বর্ষাকালে এই খালে স্রোত খুব প্রবল হইত এবং তাহাতে কখনো-কখনো নৌকা ভাঙ্গিয়া বা ডুবিয়া যাইত৷ ক্রীক রো-র উত্তরে জালিয়াপাড়া লেন এবং এই অঞ্চলে অনেক জেলে পরিবার বহুদিন হইতে বাস করিতেন৷ ইংরেজিতে একটি কথা আছে — ‘The fish follows the water and the fisherman follows the fish — অর্থাৎনদী, খাল, বিল ইত্যাদি যেদিকে যায়, মাছও সেদিকে যায় এবং মাছ যেদিকে যায়, জেলেরা সেইদিকে যায়৷ ক্রীক রো-র উত্তরে জেলেদের বসতি হইতে মনে হয়, ক্রীক রো-র খালটি একসময়ে মৎস্যে পরিপূর্ণ ছিল…৷’’
হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইয়েও এই খালটির বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়৷ উপরন্তু বেলেঘাটা দিয়ে এই খাল যে ধাপা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাও তিনি জানিয়েছেন৷ শুধু নৌকাই নয়, এই খালে জাহাজও চলত এককালে৷ ডিঙা-ভাঙায় জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও মাস্তুল প্রভৃতির চিহ্ণ পাওয়া গিয়েছিল৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, জেলেপাড়ার ধীবররা মাছ ধরতে নৌকো বা ডিঙি করে গঙ্গায় যেতেনই, জাহাজে করে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত যেতে অভ্যস্ত ছিলেন৷ অর্থাৎ জেলে পাড়ার অনেক জেলেই সারেঙ তথা জাহজের কাপ্তেন বা ব্যপকার্থে নাবিক ছিলেন৷ ‘সারেঙ’ শব্দটি আসছে ফারসি ‘সরহংগ’ শব্দ থেকে৷ সরহংগ ও সঙ শুনতে খুব কাছাকাছি৷ আমর মনে হয়, সরহংগ-সহংগ-সংগ্-সঙ—এই পথেই এসেছিল জেলেপাড়ার সঙ৷ সংসৃকত শব্দ ‘গড্ডর’ থেকে বাংলা ‘গড়ের’ ও ‘গাড়ল’ শব্দ দুটি পাওয়া যায়৷ মুখে কালিঝুলি মাখা সঙ আসছে সংস্কৃতজ ‘সাংগ’ শব্দটি থেকে৷ রগড় করার জন্য এই সঙ জোকারের সমগোত্রীয়৷ বাঙালি এই দুই সঙ-কে গুলিয়ে ফেলে কয়েকশো বছর ধরে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ সরহংগ তথা সারেঙ তথা সঙ-রা মৎস্য শিকারের অভিলাষে গঙ্গা দিয়ে সমুদ্রযাত্রার পর ফিরে এসে তাদের অভিজ্ঞতার কাহিনি গান বা বীরগাথার মধ্যে দিয়ে পাড়া ঘুরে-ঘুরে লোককে জানাতেন৷ এর সঙ্গে কিছু নৈতিকতা, ভালোমন্দের ব্যাখ্যা,কিছু বিদ্রোহী বুলি ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কিছু সাংগীতিক শ্লোগান তাঁরা দিয়ে থাকেন এবং এখনও দেন৷ মাছধরার জন্য সমুদ্রযাত্রার শেষে ঘরে ফিরে চৈত্রসংক্রান্তিতে সরহংগ তথা সঙ-রা জেলেপাড়া থেকে তথাকথিত সংযাত্রা বার করতেন৷ কালের বিবর্তনে সমুদ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়, তবু জেলেপাড়ার সঙ-এর পথ-পরিক্রমার রেশ যুগ যুগ ধরে থেকে যায়৷ সঙ-রা পণপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন৷ অর্থহীন লোকলৌকিকতার নিন্দা করেছেন, নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য এখনও সমাজে কাজ করে চলেছেন৷ সঙ-সম্প্রদায়ের হাসির গান যেমন সকলকে আনন্দ দিত, তেমনি তারা সমাজের অবিচার ও দুনীর্তির বিরুদ্ধে কশাঘাত করে দায়িত্বশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত৷ শিক্ষিত ও নিরক্ষর জনগণ সঙ-এর ছড়া, গান ও পথনাটিকার মাধ্যমে সমাজের চলচ্ছবি দেখতে পেতেন৷ ইংরেজের কুশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সঙ-সমাজ গর্জে উঠেছে৷ এখন যেটা জিজ্ঞাসা, জেলেপাড়ার সঙ কি কোনো সমুদ্রসংগীত বাsea-ballad -এর উত্তরাধিকার বহন করছে? কোনো বীররসসিক্ত জয়যাত্রার বিবরণ কি নিহিত আছে জেলেপাড়ার সঙ-এর হাসির হুল্লোড় ও জ্ঞানের গার্জেনির মধ্যে?
আপাতত যে কয়েকটি সঙ-ছড়ার দেখা পাচ্ছি, তার মধ্যে কিন্তু সঙ-এর সাগরযাত্রার চিহ্ণ স্পষ্টতই প্রতীয়মান৷
এক
সাগরপারের নাগর-ধরা
স্বেচ্ছাচারিণী
তারাই হল ভারতনারীর
কেচ্ছাকারিণী৷
পবিত্র তীর্থস্থানে লম্পট ও নেশাখোরের বিরুদ্ধেও গর্জে ওঠে জেলেপাড়ার সঙ৷ তরঙ্গমথিত সমুদ্রের দেখা মিলবে এই ছড়াতেও—
আগুলের জ্বালা ধরে অঙ্গে
দেখে দেখে পূণ্যভূমি সাধের বঙ্গে
রঙ্গিনী ভঙ্গিনী সঙ্গিনী সঙ্গে
ভদ্দর মদ্দরা যান সাগরসঙ্গম স্থানে৷
দুই
১৯১৭ সালে চৈত্রসংক্রান্তির দিন জেলেপাড়ার সঙের পালা, গান ও ছড়া ছাড়াও আর-একটি বিশেষ গান রচিত হয়েছিল৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত গানটির নাম ‘বিদ্যার মন্দিরে সিঁদ’৷ ভারতচন্দ্র রায়গুণাকারের অন্নদামঙ্গল কাব্যের অন্তর্গত ‘বিদ্যাসুন্দর’ উপাখ্যান জানা থাকলে তবেই এই ছড়ার রসগ্রহণ সম্ভব৷ বলা বাহুল্য, এই ছড়াতেও এসে গেছে সমুদ্রচিহ্ণ৷
প্রাসঙ্গিক পঙ্ক্তিটি উল্লেখ্য—
জয়ী হতে প্রবেশ পরীক্ষায়
পড়ুয়াবেশে এসেছিল হায়
গুণসিন্ধুসুত নব যুব রায় এই শহরে
মশান ভাসে নয়ন ঝোরে৷
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে জেলেপাড়ার সঙের ছড়ায় ও গানে ঘুরে-ফিরে আসছে সমুদ্রের জলকল্লোল৷ জেলেপাড়ার সঙরা আসলে জেলেপাড়ার সরহংগ৷ কালের বির্বতনে লোকমুখের অপভ্রংশে তারা সঙ (সং) বনে গেছে৷ সঙের মুখের ছাইপাঁশ ও কালিঝুলি ভেদ করে জাহাজের কাপ্তেন তথা নাবিকের চিহ্ণ স্পষ্টই ধরা পড়ে যাচ্ছে৷
জেলেপাড়ার ধীবর সম্প্রদায়ের সাংকেতিক একটা ভাষা ছিল। জেলেপাড়ার চৌহদ্দির বাইরের কলকাতাবাসী এর মর্মার্থ ভেদ করতে পারেননি। সমুদ্রযাত্রার সময় পর্তুগিজ ও ওলন্দাজ জলদস্যুদের মুখের ভাষাও হয়তো ভর করে ছিল জেলেপাড়ার সরহংদের তথা সঙদের উপরে।