ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলির মধ্যেই আসন নিয়ে সব জায়গায় সমঝোতা হয়নি, সেই মতপার্থক্য সরিয়ে রেখেও রবিবার দিল্লির একই মঞ্চে পাশাপাশি দেখা গেল কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খাড়্গে, রাহুল গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী, এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার, ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লাহ, শিবসেনা (উদ্ধব ঠাকরে)-র প্রধান উদ্ধব ঠাকরে, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, আরজেডি-র তেজস্বী যাদব, এসপি-র অখিলেশ সিংহ যাদব, তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন-সহ ইন্ডিয়া জোটে সামিল শরিক দলের নেতাদের। সেই সঙ্গে দেখা গেল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনীতা কেজরিওয়াল এবং হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা সোরেনকেও। লোকসভা ভোটের আগে এই প্রথম কোনও বড় সমাবেশে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সমবেত হওয়ার কারণ হল অরবিন্দ কেজরিওয়াল, হেমন্ত সোরেন এবং অন্যান্য দলের বড় বড় নেতাদের গ্রেফতার, কংগ্রেসেকে আয়কর নোটিস পাঠানো, দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারি, ইডি নোটিস ইত্যাদি, যা ঠিক লোকসভা ভোটের আগেই ঘটছে।
প্রশ্ন, একই মঞ্চে শরিক দলের নেতাদের দেখা গেলেও আসন সমঝোতা নিয়ে কি মতপার্থক্য মিটবে? তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসাবে ইন্ডিয়া জোটের সভা-মঞ্চে ডেরেক ও’ব্রায়ানকে দেখা গেলেও জাতীয় স্তর এবং আঞ্চলিক স্তরে ছবিটা যে আলাদা সে কথা তৃণমূল স্পষ্ট করে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। তারা জানায়, বাংলায় আসন নিয়ে তারা কোনও মতেই সমঝোতাতে যাবে না। তাছাড়া নদীয়ার ধুবুলিয়া সমাবেশে মমতা আরও স্পষ্ট করে বলেন, “সর্বভারতীয় স্তরে ইন্ডিয়া জোট আমি তৈরি করেছি, ইন্ডিয়া নামও আমার দেওয়া। ভোটের পর আমি (জোট) দেখে নেব। লড়ছি একলা। বাংলায় সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। মনে রাখবেন সিপিএমকে ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে ভোট দেওয়া। কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে ভোট দেওয়া।” এবার প্রশ্ন হল দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারি, ইডি নোটিস-এর মতো সমস্যায় পড়ে জেরবার হয়ে বিরোধী দলগুলি যে রামলীলা ময়দানে নিজেদের পার্থক্য সরিয়ে সমবেত হলেন লোকসভা নির্বাচন লড়াইতে তারা বিজেপির বিরুদ্ধে সেই একতা দেখাতে পারবে? পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন এসে পড়ে, এই ‘একতার’ প্রতিফলন কী ভোটব্যাঙ্কে কি প্রতিফলিত হবে?
উল্লেখ্য, গত রবিবারের বিরোধী জোটকেই আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশের মিরাটের জনসভা মঞ্চ থেকে ‘দুর্নীতিগ্রস্তরা একত্রিত হয়েছে’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তার আগে বিজেপির সঙ্গে সমবেত ভাবে লড়ার উদ্দেশ্যে তৈরি ‘ইন্ডিয়া জোট’-এর টালমাটাল অবস্থা নিয়েও বিদ্রুপ করতে ছাড়েনি বিজেপি। তার কারণ, ১৭ মার্চ মুম্বইয়ে কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ কর্মসূচিতে তৃণমূল এবং বাম দলগুলি সামিল ছিল না। এরও প্রধান কারণ বলে মনে করা যায় যে, বিভিন্ন রাজ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলির মধ্যে মতপার্থক্য। সেদিক থেকে এই প্রথম লোকসভা ভোটের আগে এই প্রথম বিরোধীরা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বড় সমাবেশে ঐক্যবদ্ধভাবে সমবেত হয়ে সরব হয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা গত রবিবার দিল্লির ঐক্যমঞ্চকে অর্থবহ বলেই মনে করছেন। তাদের মত, লোকসভা ভোটের ঠিক আগে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আবগারি দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার, কংগ্রেসের মতো শতাব্দী প্রাচীন দলকে আয়কর বিভাগের বকেয়া টাকা দেওয়ার নোটিস পাঠিয়ে বিজেপি আসলে ‘নির্বাচনী ময়দানকে বিরোধীশূন্য করাতে চাইছে’। অন্যদিকে আসন সমঝোতা নিয়ে ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলির মধ্যে মতপার্থক্য হওয়া স্বত্বেও যে বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনীতা কেজরিওয়াল এবং হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা সোরেন এদিন মোদী সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে অভিযোগ করেন যে মিথ্যা অভিযোগে বিজেপি তাঁদের স্বামীদের জেলে পাঠিয়েছে। এমনকি তৃণমূলের ডেরেক ও ব্রায়ানও জানান, এটা বিজেপির সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্রের লড়াই। রাহুল গান্ধী মোদীর ৪০০ আসন পার করার স্লোগানকে ইভিএম-এ কারচুপি এবং ম্যাচ ফিক্সিং ছাড়া অসম্ভব নয় বলেন। তিনি এও বলেন, মোদী সরকার কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের আর্থিকভাবে পঙ্গু করতে সচেষ্ট। অথচ তারা নিজেরাই নির্বাচনী বন্ড থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরেছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপি যখন কংগ্রেসের মতো একটি দলের বিরুদ্ধে আয়করের নোটিস পাঠিয়েছে তখন অন্যান্য দলগুলিও যে তাদের নিশানায় রয়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কারণ, এটা উদ্দেশ্যমূলক আক্রমণ। অন্যদিকে প্রশ্ন, ভোটে লড়তে গেলে টাকা লাগেঠিকই কিন্তু বিজেপি নির্বাচনী বন্ড মারফত কী ভাবে এই বিপুল অর্থ পেল। ইডির কর্মকর্তারা তো একাধিক অভিযান চালালো তারপরও কয়েকটি সংস্থার কেনা বিপুল পরিমাণ নির্বাচনী বন্ডগুলি বিজেপির ঝুলিতেই রয়ে গেল কিভাবে?
এখন দেখার বিষয়, ইন্ডিয়া জোটে যে দলগুলি আন্তরিক ভাবে সামিল তাদের সঙ্গে জোট ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে (বিহার, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে) কিন্তু কয়েকটি দলের মধ্যে জোট সম্ভব হয়নি, হবেও না, সেখানে এই প্রশ্নটি রয়ে যায় যে তারা কি আদৌ বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই দিতে চায়, নাকি নিজেদের অস্তিত্বটুকুই বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইন্ডিয়া জোট-এ সামিল থাকতে চায়? রবিবার দিল্লির তৃণমূল নেত্রী সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সামিল ছিলেন না। যদিও তাদের প্রতিনিধি ছিলেন, প্রশ্ন তারা কি এই ইন্ডিয়া জোটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন? একই সঙ্গে প্রশ্ন, বিরোধী ভোট কি ভাগ হয়ে যাবে? এই প্রশ্নটি কিন্তু প্রতিটি রাজ্যেই একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোটের মূল উদ্দেশ্য তো আসদলে বিজেপি বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না হয়। যেসব রাজ্যে আসন সমঝোতা হয়নি, সেখানে আঞ্চলিক দলগুলির একরকম অঙ্ক, অন্যদিকে জাতীয় স্তরের দলগুলির হিসাব আরেক রকম। এখন দেখার বিষয় লাভ কোথায়, বিরোধী জোট শক্ত হওয়ার নাকি বিজেপির?