পাহাড়ের নান্দনিকতা, সবুজের নিবিড়তা, ভারী বৃষ্টিপাত, রোদেলা দিন আর পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ঝিরিঝিরি ঝরনার আলয় হলো মেঘালয়। উত্তর পূর্ব ভারতের সপ্তকন্যার এক কন্যা মেঘালয় — পাহাড়, জলপ্রপাত, গুহা মেশানো রাজ্যটি যেন সৌন্দর্য্যের স্বর্গভূমি যেখান থেকে হাত বাড়ালেই মেঘকে স্পর্শ করে মনকে শীতল করা যায়। এই মেঘালয়ের রাজধানী শিলং যাকে সৌন্দর্যের বিচারে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আর এখানেই অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং।
মেঘালয়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর ও আকর্ষণীয় জিনিস হল নিবিড় অরণ্যের মাঝে প্রকৃতির অনবদ্য কারিগরি নিদর্শন ‘লিভিং রুট ব্রিজ’ বা গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি জীবন্ত সেতু। যে সেতু দিয়ে মানুষ অনায়াসেই পারাপার করতে পারে। মেঘালয়ের বিভিন্ন গ্রাম জুড়ে প্রায় ১০০টি জীবন্ত রুট ব্রিজ রয়েছে। এই জীবন্ত রুট ব্রিজগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু হল নংরিয়াট, চেরাপুঞ্জি, নংবারেহ (Nongriat, Cherrapunji, Nongbareh) এবং অন্যান্য কাছাকাছি স্থানে। সেতুগুলি ১৮৪৪ সাল থেকে মেঘালয়ে বিদ্যমান। এই সেতুগুলি প্রায়শই বাতাসে ৫০ থেকে ১০০ ফুট উপরে উঠে। এই ব্রিজগুলি দিয়ে একসঙ্গে ৫০-৬০ জন লোক যাতায়াত করতে পারে।
প্রকৃতির আপন খেয়ালে কিন্তু এই ধরনের অদ্ভুত ব্রিজ গড়ে ওঠেনি। মেঘালয়বাসীরা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে এই ধরনের সেতু নির্মাণ করেন খরস্রোতা নদী অথবা গভীর পার্বত্য খাদ সহজে পার হয়ে চলাচলের পথকে অহেতুক দীর্ঘায়িত না করার জন্য।
যে গাছের শিকড় দিয়ে এই সেতুর নির্মিত — সেটি ভারতীয় রবার গাছের একটি বিশেষ প্রজাতি, জন্মায় শুধু এই অঞ্চলেই। বোটানিক্যাল নাম ফাইকাস ইলাস্টিকা (Ficus elastica)। তাই এই বিশেষ ধরনের সেতু পৃথিবীতে একমাত্র মেঘালয় দেখা যায়।
এই রবার গাছের জন্ম হয় জলের কাছাকাছি পাথরের ফাটল থেকে। আঞ্চলিক আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য (প্রবল বৃষ্টিপাত, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি) সহ্য করার ক্ষমতা থাকে এদের। প্রথম অবস্থায় গাছগুলি সাধারণত অন্য গাছের গায়ে জন্মায় আর অপ্রধান শিকড়গুলিকে মেলে দেয় আলোর দিকে। এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়েছেন মেঘালয়বাসীরা।
কোন খরস্রোতা নদীর দুই প্রান্তের দুই বা ততোধিকগাছকে এরা বেছে নেন। অপ্রধান যেসব শিকর আলোর দিকে বেড়ে ওঠে, সেগুলিকে ফাঁপা সুপুরি কান্ডের মধ্যে দিয়ে চালনা করিয়ে দেন ভূমির সঙ্গে সামান্তরালে বিপরীতে প্রান্তের দিকে। কখনো কখনো বাঁশ অথবা লাঠির সাহায্যও নেওয়া হয়। প্রতি দুই বছর পর, তারা বাঁশের ভারা পরিবর্তন করে কারণ আর্দ্রতা এটির ক্ষতি করতে পারে। শিকড়গুলি শেষ পর্যন্ত মোটা হয়ে যায় এবং অন্য দিকের একটি ভিন্ন গাছের সাথে মিশে যায় ও সেতুটি পাকাপোক্ত হয়।
এইভাবে ধীরে ধীরে দৃঢ় বন্ধন হয়। এক একটি সেতু নির্মাণে সময় লাগে মোটামুটি কুড়ি থেকে ২৫ বছর। সেই হিসেবে এই সেতু বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এক অপূর্ব নিদর্শন।
সারা মেঘালয় জুড়ে এই ধরনের সেতু ছড়ানো আছে, ৫০ ৭০ আবার ১০০ ফুটও লম্বা হয় কেউ কেউ। গ্রামবাসীদের প্রতিদিনের ব্যবহার্য এসব সেতুর বয়স কয়েকশো বছর।।
এই নিয়ে প্রথম লেখালেখি হয়েছিল ১৮৪৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে, লেখেন লেফটেন্যান্ট এইচ ইউল। এরপর বহুদিন সব চুপচাপ থাকার পর ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিওগ্রাফিক্যাল ম্যাগাজিনে এ বিষয়ে আলোকপাত করেন লরেন্স মিশেল। আর এই পত্র লেখক কে অভিহিত করেছিলেন যিনি, তিনি এক তামিল অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ডেনিস পি রাইন। এ ভদ্রলোক স্থানীয় এক মেঘালয়বাসিনীকে বিবাহ করে চেরাপুঞ্জিতেই গড়ে তোলেন এক অনবদ্য হলিডে হোম ।এ কথা সত্যি যে সেই সময় চেরাপুঞ্জিতে থাকার বিশেষ জায়গা ছিল না।
ভারতের দীর্ঘতম রুট ব্রিজটি মেঘালয়ের নংরিয়াট গ্রামের (Nongriat village) লিভিং রুট ব্রিজ বলে মনে করা হয়। দীর্ঘতম রুট ব্রিজের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হতে পারে কারণ সেগুলি ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, তবে কিছু অনুমান অনুসারে নোংরিয়াটের দীর্ঘতম রুট সেতুটি প্রায় ১৭৫ ফুট দৈর্ঘ্যে বিস্তৃত।
চেরাপুঞ্জির বিস্ময়কর ডবলডেকার লিভিং রুট ব্রিজটি ১০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন বলে মনে করা হয়। ত্যারণা গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে সিড়িপথে হেঁটে ২৪০০ ফুট নিচে নামতে হবে উমশিয়াং নদীর উপর সেতুটি দেখতে। চেরাপুঞ্জির অন্যান্য জনপ্রিয় লিভিং রুট ব্রিজ হল উমুনোই রুট ব্রিজ, রিটিমেন রুট ব্রিজ, উমকার রুট ব্রিজ, মাওসাও রুট ব্রিজ।
শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নোংবারেহ লিভিং রুট ব্রিজটি তার মুগ্ধকর সৌন্দর্যের জন্য স্বীকৃত। এই সেতুটির একটি ডবল-স্প্যান কাঠামো রয়েছে যা অমায়ালি নদী এবং উমঙ্গোট নদীতে যাওয়ার একটি রাস্তাকে দ্বিখণ্ডিত করে। পূর্ব জয়ন্তীয়া পাহাড়ের লিভিং রুট ব্রিজ বিখ্যাত।
আমলারেম থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে অবস্থিত পাডু সেতুটি মেঘালয়ের স্বল্প পরিচিত জীবন্ত-মূল সেতুগুলির মধ্যে একটি হলেও সবচেয়ে সুন্দর। সেতুর অস্বাভাবিক বায়বীয় শিকড় ও সেতুর ডানদিকে কংক্রিটের কলাম এটির প্রধান সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। এই গ্রামে বিভিন্ন অরেঞ্জ গ্রোভস এবং জলপ্রপাতও রয়েছে যা দর্শনীয় স্থান,দেখার জন্য সুন্দর ল্যান্ডমার্ক।নিকটতম শহর: নংতালাং গ্রাম।
মেঘালয়ের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলির মধ্যে একটি কুডেং থিম্মাই এবং কুদেং রিম ব্রিজ থেকে পাওয়া যায়। তাদের উভয়ই একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অফার করে। সেতুগুলো বেশ লম্বা এবং উভয় সেতুই যে নদীর ওপরে নির্মিত হয়েছিল তার থেকে বেশ দূরত্বে স্থাপন করা হয়েছে। এই অত্যাশ্চর্য সুন্দর ব্রিজগুলি স্ফটিক স্বচ্ছ নীল জলের জলপ্রপাত সহ বেশ কয়েকটি শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যের আবাসস্থল।
পুরো অঞ্চলে বছরের বেশিরভাগ সময়ই বৃষ্টিপাত হয় এবং তাই, এখানকার আবহাওয়া সবসময়ের মতোই শীতল, কুয়াশাচ্ছন্ন এবং বাতাসযুক্ত থাকে। যাইহোক, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের এই অংশে যাওয়া এড়িয়ে চলাই ভাল কারণ এই সময়ে এই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হয় যার ফলে রাস্তার অবস্থা পিচ্ছিল এবং ক্ষতিগ্রস্ত থাকে। তবে সবচেয়ে ভালো সময় হলো নভেম্বর থেকে মার্চ মাস অব্দি। তাহলে আর দেরি কেন, এবারের ছুটিতে ঘুরে আসুন মেঘালয়ের আশ্চর্য লিভিং রুট ব্রিজ দেখতে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মেঘালয় ট্যুরিজম
Bhalo hoyechhe
থ্যাঙ্ক ইউ