মঙ্গলবার | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:৩৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (প্রথম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে তাঁর স্পেনযাত্রা বাতিলের অজুহাত : অসিত দাস ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

হাতিবাগানের থিয়েটার : সন্দীপন বিশ্বাস

সন্দীপন বিশ্বাস / ৭১ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দিনকয়েক আগে উত্তর কলকাতার রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে গিয়ে থমকে গেলাম। অনেকেই রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট নামটা শুনে বুঝতে পারবেন না। কিন্তু যদি বলি একসময় এখানেই ছিল বিশ্বরূপা, রঙ্গনা, বিজন থিয়েটার, সারকারিনা থিয়েটার হল, তাহলে হয়তো সবাই বুঝতে পারবেন। সেই গলি থেকে বেরলেই বিধান সরণি। একদিকে স্টার থিয়েটার, অন্যদিকে রংমহল। এইসব নিয়ে জমজমাট ছিল হাতিবাগানের থিয়েটার।

সেই জগৎ আজ কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। একসময় বিশ্বরূপার মঞ্চ কাঁপিয়ে ছিলেন শিশির ভাদুড়ী, যিনি বাংলা মঞ্চ অভিনয়ের ক্ষেত্রে আধুনিকতার স্রষ্টা, সেই তীর্থস্থানকে সরিয়ে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বি আবাসন। আগে অবশ্য বিশ্বরূপার নাম ছিল শ্রীরঙ্গম। সেই আবাসনের বাইরে কাঙালের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে শিশির ভাদুড়ীর মূর্তি। হাইরাইজের উৎপাত মুছে দিয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক বৈভব, নির্মাণ শিল্প গুঁড়িয়ে দিয়েছে আমাদের নাট্যশিল্পের নান্দনিক কাঠামো। তবু বাঙালিরা স্বাজাত্য ও শিল্পবোধ নিয়ে ভেসে যায় মেকি আহ্লাদে! আজকের প্রজন্ম হয়তো জানে না, কেমন ছিল হাতিবাগানের থিয়েটার পাড়া? আজকের প্রজন্ম সিরিয়ালে ৪০০-৫০০ এপিসোডে মজে থাকে। কিন্তু তাঁরা জানে না, কেমন করে একটা নাটক অনায়াসে চারশো-পাঁচশোতম অভিনয় অতিক্রম করে ইতিহাস গড়ে তুলত। সুপারহিট এক একটা নাটক চলত তিন-চার বছর ধরে। থিয়েটার হলের বাইরে থিকথিকে ভিড়, ঝোলানো হাউসফুল বোর্ড, টিকিটের জন্য হাহাকার। সব যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়।

স্টার থিয়েটার

সত্যিই সে ছিল যেন এক স্বপ্নের জগৎ। মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করছেন শিশির ভাদুড়ী, প্রভা দেবী, ছবি বিশ্বাস, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, সরযূ দেবী, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, জহর রায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, দিলীপ রায়, লিলি চক্রবর্তী, সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া চৌধুরী সহ অনেকেই।

উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে ছিল অনেকগুলি সিনেমা হল এবং থিয়েটার হল। সেখানে সিনেমাকে টক্কর দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল থিয়েটার। তাই হাতিবাগানকে বলা হতো থিয়েটার পাড়া। বাংলা চলচ্চিত্রের এমন কোনও স্টার নেই, যিনি হাতিবাগান থিয়েটার পাড়ার কোনও না কোনও মঞ্চে অভিনয় করেননি। শিশির ভাদুড়ীর সময়ে শ্রীরঙ্গম ছিল নাট্যমোদীদের কাছে তীর্থস্থান। সে তো সেই চল্লিশের দশকের কথা। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের অবিসংবাদী নায়ক শিশিরবাবু। সেই প্রথম তিনি মুখোমুখি হলেন এক চ্যালেঞ্জের। শহর কলকাতায় সেই নাটকের পাশাপাশি জন্ম নিল অন্য ধারার এক নাটক। ‘নবান্ন’ দিয়ে তার যাত্রা শুরু। ‘সীতা’য় ডুবে থাকা শিশিরবাবু তার মাহাত্ম্য ঠিক বুঝতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, এই ধারার নাটকের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। থিয়েটার মূলত বিনোদন। সেখানে এই সব ‘আঁস্তাকুড়ের গল্প’ মানুষ নেবে না। মানুষের জীবনের প্রেম, হাসি-কান্না এসবই মানুষ দেখতে চান। সেই সঙ্গে নাচ, গান। সিনেমা ধারার যে গল্প, তারই মঞ্চায়নে তিনি বিশ্বাস করতেন। সেই সঙ্গে বিশ্বাস করতেন স্টারডমে। একথা ঠিক, শুধু শিশিরবাবুর নামেই ‘হাউসফুল’ হয়ে যেত। কিন্তু চল্লিশের কলকাতা তখন অন্য জীবনের দিকে পথ হাঁটতে শুরু করেছে। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, স্বাধীনতা, দেশভাগ, দারিদ্র্য পরপর অভিঘাত বুঝিয়ে দিয়েছিল জীবনের সঙ্কট। সময়ের বদলে মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, জীবনের নিশ্চিন্ততা বলে যেন কিছুই থাকছে না।

সারকারিনা

এর মধ্যে কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন বিনোদনই থিয়েটারের শেষ কথা। আবার অন্য একপক্ষ ভাবতে লাগলেন, বিনোদন শেষ কথা হতে পারে না, দায়বদ্ধতা আজ সব থেকে বড় কথা।

একটা সময় পর্যন্ত বাংলা পেশাদারি মঞ্চের প্রবল রমরমা ছিল। গণনাট্য, নবনাট্য ধারাকে পাশে রেখেও দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছে পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ। তারপর এক সময় সে একবারেই হারিয়ে গেল। সে এক মর্মান্তিক ট্রাজেডি। সে ট্রাজেডি কিন্তু গ্রিক ট্রাজেডির মতো নিয়তি নির্ধারিত নয়, সেই ট্রাজেডির উদ্ভব শেক্সপিয়রের ট্রাজেডির মতো আপন কৃতকর্মের ফল থেকেই। একদা নবনাট্য কিংবা পরে গ্রুপ থিয়েটারের নাটকে যে ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল, পেশাদারি রঙ্গমঞ্চেও তার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে উৎপল দত্ত কিংবা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পেশাদারি মঞ্চের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃহস্পতি, শনি, রবি ও ছুটির দিনে একটি নির্দিষ্ট মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন।

শিশিরবাবু ছিলেন বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে একটা যুগ। তাঁর হাত ধরেই বাংলা নাটকে আধুনিক অভিনয়ের ধারা এসেছিল। ‘প্রফুল্ল’ নাটকে শেষ অভিনয়ের সময় তাঁর সংলাপ ছিল, ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’! কী মর্মস্পর্শী বেদনাহত ছিল সেই উচ্চারণ। এ যেন এক সাম্রাজ্যের ভেঙে পড়ার আর্তনাদ।

বিজন থিয়েটার

তারপরে মঞ্চের বিষয়ে এল পরিবর্তন। সিনেমাকেন্দ্রিক গল্পের অভিনয় মঞ্চকে সেই সময় আলোড়িত করেছিল। ১৯৫৩ সালের জুন মাসে রংমহলে শুরু হয় ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই বছরের পুজোর সময় স্টার থিয়েটার সিদ্ধান্ত নিল, একটা এমন নাটক মঞ্চস্থ করবে, যাতে দর্শকমহলে সাড়া পড়ে যায়। স্টার তুলে আনল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। নাটক হবে ‘শ্যামলী’। নিরুপমা দেবীর গল্প। নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। কিন্তু স্টার অভিনেতা কে হবেন? সাবিত্রী কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিলেন, উত্তমকুমারকে নিয়ে আসুন। মনে রাখা দরকার, তখন উত্তমকুমারের মাত্র দু’টি ছবি সুপারহিট করেছে। ‘বসু পরিবার’ ও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। উত্তমকুমারকে রাজি করানোর দায়িত্ব নিলেন সাবিত্রী। ওদিকে স্টার ছেড়ে ছবি বিশ্বাস চলে গিয়েছেন মিনার্ভায়। সেখানে শুরু হয়েছে ‘ঝিন্দের বন্দি’। ‘শ্যামলী’ নাটকটি চলেছিল চার বছর। নাটকের ভাষায় ‘৪৮৪ রজনী’। উত্তমকুমার অসুস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আর শেষের কয়েকটি শোয়ে অভিনয় করতে পারেননি। অবশ্য উত্তমকুমার সরে যেতেই টিকিট বিক্রি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সেই নাটকে উত্তমকুমারের চরিত্রটির নাম ছিল অনিল। একদিন নাটক দেখতে গিয়েছেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। তিনি নাটক দেখে উচ্ছ্বসিত। উত্তমকুমারকে বললেন, ‘এখন থেকে আমি তোমাকে অনিল বলেই ডাকব।’

‘শ্যামলী’ নাটকের কোনও শো একমাস আগেই হাউসফুল হয়ে যেত। রাস্তা জুড়ে ভিড়। টিকিটের জন্য হাহাকার। পুলিসকে প্রতি শোয়ের দিন যান নিয়ন্ত্রণ করতে হতো। আজ সেই সোনালি দিনের গল্পগুলোকে কেমন রূপকথার মতো মনে হয়।

আর এক শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন ছবি বিশ্বাস। সেই সময় তিনি অসংখ্য মঞ্চসফল নাটকে অভিনয় করেছিলেন। ‘দুই পুরুষ’, ‘ডাক বাংলো’, ‘ধাত্রীপান্না‘, ‘কাশীনাথ’, ‘চন্দ্রনাথ’। হাঁপানির জন্য পরের দিকে তিনি আর মঞ্চের ধকল সহ্য করতে পারেননি।

হাতিবাগানের থিয়েটার পাড়ার বাইরে সেই বিডন স্টিটের মিনার্ভা মঞ্চে নাটক করে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন উত্পল দত্ত। নাটকের নাম ‘অঙ্গার’। কয়লা খনির শ্রমিকদের জীবনকাহিনি নিয়ে লেখা সেই নাটক দেখতে মানুষ হাতিবাগান থেকে ছুটতেন বিডন স্ট্রিটে। কয়লা খনির ভিতরে জল ঢুকছে, বাঁচার জন্য আকুল আর্তনাদ করছেন শ্রমিকরা। জল বাড়ছে ধীরে ধীরে। তাপস সেনের সেই আলো আর নির্মল গুহ রায়ের মঞ্চ নির্মাণের সেই মেল বন্ধন মানুষকে চমকে দিয়েছিল। মঞ্চে বা খনিতে জল বাড়ার দৃশ্য দেখে প্রথম সারির বহু দর্শক উঠে পিছনে চলে আসতেন। তাঁদের ভ্রম হতো, এই বুঝি মঞ্চের জল ছাপিয়ে এসে প্রেক্ষাগৃহকে ভাসিয়ে দেবে। সেই নির্মল গুহ রায়কেই দেখেছি সাতের দশকের শেষের দিকে বন্ধ মিনার্ভা থিয়েটারের বাইরে বসে প্রায় ভিক্ষুকের জীবনযাপন করতে।

বিনোদিনীর বাড়ি।

জলের কথায় উল্লেখ করতে হয় শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’এর কথা। নাটকটি ১৯৫৭ সালে হয়েছিল স্টার থিয়েটারে। এখানে মঞ্চে দেখানো হয়েছিল নদীতে নৌকা চালানো। কুকুরের ডাক শুনে ইন্দ্রনাথ যখন নদীতে ঝাঁপ দিত, সেটাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য কিছুটা জল ছিটকে এসে পড়ত দর্শকদের মধ্যে। পরের দৃশ্যে ইন্দ্রনাথ ঢুকত চান করা ভিজে পোশাকে।

১৯৫৯ সালে আর একটি বিখ্যাত নাটক বিশ্বরূপায় অভিনীত ‘সেতু’। আলোয় তাপস সেনের অনবদ্য কাজ দেখতে দর্শকরা ছুটে আসতেন। আলোর সাহায্যে মঞ্চে উপস্থাপিত করা হয়েছিল ছুটন্ত ট্রেন। নাটকের সিগনেচার ছিল সেই অনবদ্য দৃশ্যটি।

উৎপল দত্তের আর একটি মাস্টার স্ট্রোক ছিল মিনার্ভায় অভিনীত ‘কল্লোল’ নাটকটি। তৎকালীন বোম্বাইয়ের নৌ বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত নাটকটি। মঞ্চের উপর বিশাল জাহাজ দেখতে ভিড় করতেন দর্শকরা। বাংলা পেশাদারি নাটক অভিনয়ের ক্ষেত্রে উৎপল দত্ত একটা মাইল স্টোন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর নিজস্বতার সেই স্বাক্ষর যাত্রাজগতে এসে রেখেছিলেন।

সেই সময় রঙ্গনায় নিয়মিত অভিনয় করত নান্দীকার। অজিতেশ আর কেয়া চক্রবর্তীর যুগলবন্দিতে হিট হয়ে গেল ‘শের আফগান’, ‘ভালো মানুষ’, ‘তিন পয়সার পালা’, ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’। এছাড়া তাদের ‘নটী বিনোদিনী’ও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

একদিকে মঞ্চ নাটকের পেশাদারিত্ব, অন্যদিকে গ্রুপ থিয়েটারের অন্যধারার নাটক, এই দুই ধারাই যেন মিশেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকে ও অভিনয়ে। তাঁকে মঞ্চে নিয়ে আসেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। ১৯৬৩ সালে স্টারে সৌমিত্র অভিনয় করলেন ‘তাপসী’ নাটকটি। বিপরীতে ছিলেন মঞ্জু দে, বাসবী নন্দী। সেই নাটকটির ৪৬৭ বার শো হয়েছিল। তাঁর ‘নামজীবন’, ‘রাজকুমার’, ‘ফেরা’, ‘নীলকণ্ঠ’, ‘ঘটকবিদায়’, ‘টিকটিকি’ নাটকগুলি মঞ্চ নাটকের ইতিহাসের এক একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো।

তারপরে স্টার থিয়েটার পরপর কয়েকটি সুপারহিট নাটক পরিবেশন করেছে। বিমল মিত্রের ‘একক দশক শতক’, দেবনারায়ণ গুপ্তের ‘দাবি’, ‘শর্মিলা’, ‘সীমা’। ১৯৭১ সালে স্টার থিয়েটারের মালিকানা বদল হল। দীর্ঘদিনের মালিকানা সলিলকুমার মিত্রের হাত থেকে গেল রঞ্জিতমল কাঙ্কারিয়ার হাতে। তিনি বেশ কয়েকটি নাটক প্রযোজনা করেছিলেন ‘চন্দ্রনাথ’, ‘সমাধান’, ’পাশের বাড়ি’, ‘বালুচরী’ ইত্যাদি। এরপর স্টার ভাড়া দেওয়া শুরু করল। অভিনীত হল সত্য বন্দ্যপাধ্যায়ের ‘নহবত’। পরে সেটি দক্ষিণ কলকাতার তপন থিয়েটারে চলে যায়। হইহই করে চলল সেই নাটক।

বাংলা পেশাদারি মঞ্চে অমর হয়ে যাওয়া নাটকগুলি হল ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘মায়ামৃগ’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘সম্রাট ও সুন্দরী’, ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’, ‘আমি মন্ত্রী হব’, ‘অমরকণ্টক’, ‘প্রজাপতি’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘বর্ধমানের বর বরিশালের কনে’, ‘ভোলা ময়রা’, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘অঘটন’, ‘মল্লিকা’ সহ আরও অসংখ্য নাটক।

গত শতাব্দীর সাতের দশকের শুরু থেকেই কলকাতায় যেন নব ঢেউ এল। অনেকগুলি নতুন নাটকের হল তৈরি হল। রঙ্গনা, তপন থিয়েটার, সারকারিনা, বিজন থিয়েটার, শ্যামাপ্রসাদ মঞ্চ, বাসুদেব মঞ্চ, অহীন্দ্র মঞ্চ, সুজাতা সদন প্রভৃতি। কিন্তু ১০-১৫ বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে এল থিয়েটার পাড়ায়।

হাতিবাগান থিয়েটার পাড়ায় অভিনীত হয়নি, অথচ কলকাতাজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল আর একটি নাটক। সেটি হল প্রতাপ মঞ্চে অভিনীত ‘ভালবাসার ব্লো হট’ নাটক ‘বারবধূ’। কথাটা তখন কলকাতার মানুষের মুখে মুখে ফিরত। হয়তো নাটকটা ততটা হিট করত না। প্রকারান্তরে বলা যায়, নাটকটাকে হিট করে দিয়েছিলেন বামফ্রন্টের তৎকালীন তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দলের যুব কর্মীরা তাঁর প্রশ্রয়ে হলে গিয়েছিলেন নাটকটি বন্ধ করার জন্য। বুদ্ধদেববাবুর যুক্তি ছিল, এটি একটি অপসংস্কৃতিমূলক নাটক। ব্যস, দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। হলের টিকিট কাউন্টরে লেগে গেল বিশাল লাইন। সারাজীবন যে মানুষটা নাটককে ভলোবেসে সেবা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন, জীবনের শেষ নাটকটা তাঁকে অর্থ, সম্মান দিয়ে গেল। তিনি হলেন অসীম চক্রবর্তী। সেই নাটকে দুই পর্যায়ে অভিনয় করেছিলেন কেতকী দত্ত এবং মঞ্জু চক্রবর্তী।

‘বারবধূ’ কোনও অশ্লীল নাটক ছিল না। কিন্তু সেই নাটকটিই বাজার ধরার জন্য খুলে দিয়ে গেল বাংলা রঙ্গমঞ্চে আরও ‘ব্লোহট’ নাটকের দুয়ার। মঞ্চের নাটককে বাঁচাতে একে একে আনা হতে লাগল মিস শেফালি, মিস জে, মিস অমুক তমুককে। শরীরী বিভঙ্গে দর্শক টানার খেলা যে খুব একটা শুভ হয়নি, তা কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল। একে একে নিভিল দেউটি। মঞ্চজুড়ে তখন কাঁচা গল্পের অভিনয়, সঙ্গে দু’টো ক্যাবারে নাচ। তাতে সাময়িক মন ভরলেও মনের তৃপ্তি আসে না। ধীরে ধীরে দর্শক কমতে লাগল। ততদিনে ঘরে ঘরে এসে গিয়েছে নতুন বিনোদন। টেলিভিশন। সুপার ডুপার হিট হচ্ছে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘হামলোগ’, ‘বুনিয়াদ’। বাঙালি ঘরে বসে সান্ধ্য আসরে সপরিবারে হাসি-কান্নার ড্রামায় মজে গেল সোপ অপেরার মধ্য দিয়ে। অন্ধকারের গর্ভে হারিয়ে গেল বাংলা পেশাদারি মঞ্চ। কেউ বন্ধ হয়ে গেল, কেউ হয়ে গেল আগুনে ভস্মীভূত,

কোথাও মঞ্চ ভেঙে গড়ে উঠল হাইরাইজ বিল্ডিং, কোথাও সুপার মার্কেট, আবার কোথাও গোডাউন। সারকারিনার দিকে লোলুপ দৃষ্টি প্রমোটারদের। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিজন থিয়েটারও। ধ্বংসের দৃশ্যগুলি একে একে অভিনীত হচ্ছে।

শিশির ভাদুড়ী তাঁর অভিনয় জীবনের শেষের দিকে বুঝতে পেরেছিলেন, পুরো থিয়েটার শিল্পটা চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে এবং সত্যদ্রষ্টা শিল্পী বুঝেছিলেন, এর মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি যেন দৈববাণীর মতোই নিদান হেঁকেছিলেন, ‘নাট্যশালা উঠে গেলে বুঝতে হবে, জাতির জীবনী শক্তি ও জাতির সৃজনী শক্তি লুপ্ত হয়েছে।’ হাতিবাগানের থিয়েটারহীন পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে ট্রাজেডির আখরে বোনা সেই অন্ধকারকেই যেন প্রত্যক্ষ করলাম।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন