প্রাচীন তক্ষশিলা নগরীতে জীবক কুমারভট্টের চিকিৎসাবিদ্যা প্রায় শেষের পথে। ভেষজবিদ্যার শিক্ষক, জীবকের গুরু আত্রেয় বলেছিলেন, বন থেকে এমন এক উদ্ভিদ সংগ্রহ করে আনো বৎস, যার কোনো ভেষজগুণ নেই। কুমার ভট্ট সারা অরণ্য খুঁজেও কোনো নির্গুণ উদ্ভিদ খুঁজে না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে এলেন। গুরু আত্রেয় খুশি হয়ে শিষ্যকে আশীর্বাদ করেছিলেন, এতদিনে তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল। জীবক নিজগুণে চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী হলেন। ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের তিনি চিকিৎসক ছিলেন।
কালিম্পং জেলার পাশাবং গ্রামের বি আর রাইকে কোনো উদ্ভিদবিদ্যার ক্লাসে যেতে হয়নি। যে সবুজ-শ্যামল জগতটায় তার দিনযাপন, সেখানেই তার জন্মজাত শিক্ষা এবং অধিকার। বনপাহাড়ের এই মানুষগুলো প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে বেঁচে আছে। বৃক্ষ তাদের কাছে দেবতাসমান। গাছপালা তাদের পিতার মত নিশ্চিন্ত আশ্রয় দেয়। মায়ের মত আহার্য যোগায়। যুগ যুগ ধরে তাদের এই পার্বত্য জমি, পাহাড়কে রক্ষা করছে অরণ্য।
সেই অরণ্যকে দুধারে নিয়ে ছোটোবড় নুড়ি পাথরের মধ্যে দিয়ে তিরতির করে বয়ে যায় গীতখোলা নদী। পাহাড়ের ফাঁকফোকর থেকে বেরিয়ে এসেছে আরো কত ছোট্ট ছোট্ট ঝোরা। নুড়ি, পাথর, বালিতে ছেঁকে সে জল স্বচ্ছ, পরিষ্কার। ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন ছাড়াই তাতে খনিজ উপাদান ভরপুর। সে জলেই পাহাড়ি প্রাণীকুলের তৃষ্ণার শান্তি। সেই জলেই অবগাহন। জলকে তাই নানা উপায়ে যতটা পারছে ধরে রাখছে এখানকার পরিশ্রমী মানুষ। পাহাড়ের মতই জলেরও যে এখানে ঘনঘন মুড স্যুইং। কখনো সে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবার কখনো বড় কৃপণ হয়ে পড়ে। শীতে জমে যায় জল শুদ্ধু পাইপ। কখনো কখনো তা ফেটে গিয়ে পাহাড়ে জলের হাহাকার।
আমরা সমতলের মানুষ গীতখোলার জলে পায়ের পাতা ভেজাই। নদীর পাশে বসে দোলের আবীর মেখে হুল্লোড় করি। ছবি তুলি। কাঠকুড়ুনি কিশোরী অবাক চোখে আমাদের রঙ্গ দেখে। পর্বতের মেয়ে পার্বতী কৈলাসে যেতে গিয়ে তার ছেলেমেয়ে নিয়ে আটকে পড়ে নদীর পাথরে। বিসর্জনের বাজনা বেজে গেছে সেই কবেই! তবু তাঁর প্রকৃত নিরঞ্জন হয়নি। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে দেবী পরিবার নিয়ে অপেক্ষা করেন বর্ষার খরস্রোতের। তখনি হবে তার সত্যিকারের বিসর্জন!
আমরা পায়ে পায়ে পথ চলি। আমাদের মুগ্ধ বিস্ময় ঘিরে থাকে পাথরের খাঁজেখোঁজে রঙ ছড়ানো ফুলসজ্জায়। লম্বা বড় গাছটায় ফুটে থাকে অজস্র থোকা থোকা সাদা ফুল। তার নাম চার। সে গাছের কাঠ দিয়ে ফার্ণিচার তৈরি হয়।
পথের ধারে একটা দীর্ঘ বাঁশগাছ অহংকার ভুলে ঝুঁকে আলিঙ্গন করে আছে অন্যদিকের ছোটো বাঁশগাছটিকে। গাছেরাও বুঝি বেঁধেবেঁধে থাকতে চায়! মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের শকুন্তলায় তিনসখি মিলে আমগাছ আর মল্লিকালতার বিয়ে দিয়েছিল। কাঠ মিস্ত্রি রাই আমাদের চেনায়, এই কাশ ফুলের মত ফুটে ওঠা ফুল দিয়ে আমরা ঝাড়ু বানাই। ওর নামই ঝাড়ু গাছ। এই দ্যাখো এর নাম লালমন, এটা দিয়ে ফার্ণিচার হয়। নীলচে বেগুনি রঙের ফুলগাছগুলোর নাম নিশ্চিন্দা। এই গাছ আমরা বাড়ির আশেপাশে রাখি। পোকামাকড় আসে না। নিশ্চিন্দা পাতার রসে বাতের ব্যথার উপশম হয়। ঐ যে গাছটা দেখছ, ওর নাম সীল টিম্বুর। ওর তাজা ফল দিয়ে আমরা আচার বানাই। এই ফল শুকিয়ে গ্যাসট্রিকের ওষুধ তৈরি হয়।
আমাদের ইস্কুলে পড়া ভূগোলের জ্ঞান মনে করায় এই অঞ্চলে সিঙ্কোনার চাষ হয়। পাইন, ফার, দেবদারুর মুক্ত বনাঞ্চল হিমালয়ের এই পার্বত্যভূমি। প্রত্যেকটা গাছ স্বগুণ স্বরূপে অনন্য।
যেন ডেকে বলে আমাকে দ্যাখো। চিনে রাখো। কোনো না কোনোভাবে আমি তোমাদের কাজে লাগবোই। কবি বললেন, “একটি দেবদারুর মধ্যে যে শ্যামল শক্তির প্রকাশ, সমস্ত পর্বতের চেয়ে তা বড়ো। ঐ দেবদারুকে দেখা গেল হিমালয়ের তপস্যার সিদ্ধিরূপে। মহাকালের চরণপাতে হিমালয়ের প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে, কিন্তু দেবদারুর মধ্যে যে প্রাণ, নব নব তরুদেহের মধ্যে দিয়ে যুগে যুগে তা এগিয়ে চলবে।”
কবি শুনিয়ে গেলেন আমাদের আশার কথা। তবে প্রাণহীন গাছও যেতেযেতে আমাদের দিয়ে যায় কতকিছুই। ঐ যে আমাদের হোমস্টের পূর্ণা তার নিজের ওজনের তিনগুণ ভারী শুকনো কাঠের গুঁড়ি জঙ্গল থেকে একাই টেনে আনে! সেটাই জ্বালিয়ে আমাদের স্নানের জন্যে জল গরম হবে যে।
দূরের নাম না জানা গাছটারও এখন পাতা ঝরার পালা। সেই জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় ইঙ্গিত দেয় মায়া ত্যাগ করতে শেখো! সেকি অতই সহজ! যেদিকে তাকাই মায়ালতা যে জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে!
পাহাড়ী পথে ভিজে মাটির বনজ গন্ধ অদ্ভুত আবেশে ঘিরে ধরে। আমরা আরো একটু পাকদন্ডী বেয়ে ওপরে উঠি। পথের ধারে এক পূর্ণযৌবনা জংলী গাছে বসন্তের দোলা লেগেছে। সেজেগুজে সে তৈরি। পাতায় পাতায় তার ইশারা। পাহাড়ের ধাপে ধাপে যত্নে আর পরিশ্রমে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে ভুট্টার খেত। টুকটুকে লাল, গোল লঙ্কা ডল্লে খোরেসানি ফ’লে আছে ছোটো গাছে। যার ঝাল খেলে ব্রহ্মতালু অবধি ঝাঁ ঝাঁ করে। সে লঙ্কার ঝালে আজকাল মজেছে মধ্যপ্রাচ্য। কালিম্পঙের লঙ্কা যাচ্ছে আরব দুনিয়ায়।
ভুট্টা-লঙ্কার খেত, মুরগী-শুয়োরের খামারের পাশে পাশে ছোট্ট বাড়িগুলো এখন ফুলের সাজে রঙিন। সিনেরেরিয়া, পিটোনিয়া, অ্যাজেলিয়া, অর্কিড আর স্যাকুলেন্টে সাজানো বাড়িগুলোর পাশে দুদন্ড থামি। বাড়ির গিন্নি হাসিমুখে দরজায় এসে দাঁড়ায়। আমাদের বিকেলের চায়ের অফার করে। গল্পগাছা হয়। এবছর নাকি নাছোড়বান্দা শীত যেতে যেতেও যেতে চাইছে না। পাহাড়ি সুন্দরী নিজের সংগ্রহ থেকে গাছ দিতে চাইলেও লোভ সংবরণ করি। দেখেছি পাহাড়ের গাছ সমতলে এসে বড়ই মুষড়ে পড়ে। কেউ কেউ বাঁচেই না। কথা বলতে বলতেই পাহাড়ে সন্ধ্যে নামে। সঙ্গে মেঘবৃষ্টি। টিনের চালে কড়কড় আওয়াজ।
বৃষ্টিধোয়া রাতের পর সকালের রোদ ঝকঝকে। ভোরবেলা থেকেই লাল, হলুদ, নীল পাখিরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ছিল বসছিল। উড়ন্ত পোকা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারছিল। গাছই যে পাখিদের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। তাদের উড়ানের বিশ্রাম। বিশ্রম্ভালাপের অনাবিল কাকলিস্থল।
কালো টুপি পরা টুকটুকে লাল পাখিটি পুরুষ। ইংরিজি নাম fiery minivet. বাংলায় সিঁদুরে সহেলি। হলুদটি তার সখি, scarlet minivet। আদরের বাংলা নাম সোনাপাখি। অত সকালেই অষ্টাদশী হিয়া ক্যামেরা তাক করে ওদের ছবি তুলল। একটু বেলা বাড়তেই গোটা গেস্ট হাউস জেগে উঠল। ওরা উড়ে গেল আরো গভীর জঙ্গলে। ঐ চঞ্চলপ্রাণ, উজ্জ্বল রঙ চিরদিনের জন্যে মনের মধ্যে ছবি এঁকে গেল।
জীবনের অভিযানে গাছপালা এভাবেই শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে যোগদান করে। আমরা তাকে ব্যবহার করি কতভাবে। কত রূপে। তাকে ঘিরে গল্প তৈরি হয়। গড়ে ওঠে কত বিশ্বাসের লোককথা। দোল পূর্ণিমার রাতে এখানকার মেয়েরা সেজে উঠেছিল রঙিন পোশাকে, গয়নায়। মাথায় বেঁধে নিয়েছিল চা তোলার ঝুড়ি। সঙ্গে ছিল তাদের পুরুষ সঙ্গীরা। তারা গান গায়। ধামসা-মাদল-বাঁশি বাজে। কোমল হাতে উঠে আসে চাঁদের আলোমাখা দুটি পাতা, একটি কুঁড়ি। বিদেশের বাজারে চড়াদামে বিকোয় প্যাকেটজাত মুনলাইট টী।
গাছপালাকে এইভাবে বাস্তবে সমাজে, কল্পনায়, রূপকথায় ব্যবহার করার অনন্ত প্রয়োগভূমি এই ভারতবর্ষ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বৃক্ষের সম্পর্কের গভীরতর বাঁধনগুলি মাটির নিচে লুকানো ও দৃঢ়বদ্ধ আছে। এই হল নিশ্চেষ্টগুণ যা প্রকৃতির প্রাণসঞ্চারের, লালনের, সৃজনের মূলমন্ত্র।
যুগযুগ ধরে আমাদের মুনি ঋষিরা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন এই গুণকে। মানুষকে এই প্রকৃতির উপাদান শিখতে বলেছেন গাছের কাছে থেকে।
আমাদের জীবনের মঙ্গল যে গাছপালার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে, সেকথা ভুলতে বসেছিলাম। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করার পর এতদিনে বুঝতে পেরেছি সবুজ জগতের করুণ অবস্থা। দেশেবিদেশে প্রকৃতি সংরক্ষণের শপথ নেওয়া হচ্ছে। হয়তো এইজন্যেই উত্তরাখন্ডের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের কিছু অঞ্চলে মানুষের প্রবেশ নিষেধ এমনকি গবেষণার জন্যেও নয়। বাল্মীকির রামায়ণে বর্ণিত কিষ্কিন্ধ্যার সপ্তজন অরণ্য ছিল এরকম একটি স্থান। সাতজন মহর্ষির তপস্যার ফল।
প্রকৃতির এক বিচিত্র গ্রহজৈবভান্ডার (biosphere reserve)। এখনকার প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা যা সংরক্ষণের কথা নতুন করে আবার ভাবছেন। শুধু বিজ্ঞানীরা নন, আমরা যেন সবাই একথা ভাবি। সচেষ্ট হই। আমাদের মহর্ষিদের অনন্তকালের সাধনার ধন, এই অরণ্যধর্মী আদিবাস, বৃক্ষদেবতাদের শেষ চিহ্নটুকু সভ্যতার নিষ্ঠুরহাতে যেন নিঃশেষ না হয়ে যায়!
Took me to olden Indian History of science and medicines, which reminds our pride.
My high regards to the author for presenting such a research-oriented article to the people of world.
Thank you very much sir.Your words mean a lot to me 🙏
পার্বত্য যাপনের অনবদ্য কথন।
নন্দিনী দি,তোমার সুনন্দিত অসাধারণ বর্ণনা আমাকে নিবিড় ভাবে ডাকছে গো।
ভালবাসা।
কি সুন্দর বললে। ভালো থেকো। আবার কখনো কোনো সময় একসঙ্গে বেড়াতে যাব।
প্রকৃতি জুড়ে গল্পকথা, গল্প জুড়ে প্রকৃতির রূপকথা। মুগ্ধ হলাম।
আমিও আপ্লুত হলাম এমন পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে। ♥️🌹
তুমি প্রাণ মন উজাড় করে প্রকৃতিকে ভালবেসেছ, সে তোমার লেখার প্রতিটি বাঁকে ফুটে উঠেছে। নিজে নাইবা গেলাম, তোমার লেখনীর সঙ্গে এই স্বপ্ন ভ্রমণ মন্দ নয়। ছবিগুলি অসামান্য।
ভালোবাসা আর আদর জেনো মন্দিরা।