তিন বছর আগে কৃষকদের একটানা বিক্ষোভ আন্দোলনে গোটা দেশ তোলপাড় হয়েছিল। লোকসভা ভোটের আগে ফের আন্দোলনের পথে নেমেছে কৃষকেরা। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এবং কিষাণ মজদুর মোর্চা দিল্লি চলোর ডাক দিয়েছে। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে প্রায় ২০০টি কৃষক সংগঠন। সেই লক্ষ্যে শনিবার থেকে রাজধানীর পথে এগোতে শুরু করেছে কৃষক সংগঠনগুলি। উল্লেখ্য, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে মোদী সরকারের কৃষি নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ কৃষকদের বিক্ষোভ আন্দোলনের জেরে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কৃষকদের আপোষহীন আন্দোলনের কাছে মোদী সরকার হার মানতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের সরকার কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এবারও লোকসভা ভোট দরজার সামনে, ঠিক তার আগে দেশে ফের কৃষক বিক্ষোভের আঁচ দেখা দিয়েছে। এবারও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে সেই পাঞ্জাব এবং হরিয়ানাতেই। তবে কৃষক বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে — পাঞ্জাব থেকে শুরু হয়ে উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা পর্যন্ত।
কৃষকদের বিক্ষোভ সামাল দিতে পঞ্চকুলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। হরিয়ানার সাত জেলায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। পরিস্থিতি যে কোনো সময়েই উত্তেজনা পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কায় আগে থেকেই সতর্ক পুলিশ প্রশাসন। সেই কারণে দিল্লি ঢোকার আগেই যাতে কৃষকদের রুখে দেওয়া যায় সেরকমই পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাঞ্জাব হরিয়ানা সীমান্ত সিল করে আম্বালা জিন্দ, ফতেহবাদ সীমানায় নাকা তল্লাশি চলছে। হরিয়ানা পুলিশ ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই রাস্তার পরিবর্তে বিকল্প রাস্তায় পাঞ্চাব এবং হরিয়ানায় যাতায়াত করার পরামর্শ দিয়েছে। অন্যদিকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের কৃষকেরা ফসলের ন্যূনতম দাম-সহ একাধিক দাবিতে দিল্লি ঘিরতে শুরু করেছে। জানা গিয়েছে শুক্রবার রাত থেকেই নয়ডা, গাজিয়াবাদে কয়েক হাজার কৃষক রাস্তা আটকে বসে পড়েছেন। কিন্তু দিল্লি ও উত্তর প্রদেশ পুলিশ তাদের আটকে দিয়েছে। রাজধানীগামী সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করেছে পুলিশ।
প্রশ্ন আবার কি ফিরবে তিন বছর আগের সেই ছবি? যদিও কৃষকদের আপসহীন আন্দোলনের কাছে নরেন্দ্র মোদী হার মেনেছিলেন, সরকার বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারও করেছিলেন কিন্তু তাদের মূল দাবি পূরণ হয়নি। এবার সেই পুরোনো দাবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কৃষক ও ক্ষেত মজুরদের পেনশন প্রদান-সহ কৃষি বিজ্ঞানী এমএস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকর। তাই আরও একটি জরুরি প্রশ্ন সামনে এসে পড়ছে — কৃষকদের দিল্লি অভিযান লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলকে কতটা প্রভাবিত করতে পারবে? মোদী সরকারের তিন কালা কানুনের বিরুদ্ধে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টির দাবিতে উত্তর ভারতের কৃষকদের একাংশ আন্দোলনে নেমেছিলেন। সেখানে পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং পূর্ব রাজস্থানের কৃষকেরাও সামিল হয়েছিলেন। কৃষকদের সেই বিক্ষোভ আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছিল কী ভাবে অনেকগুলি কৃষক সংগঠন একটা ন্যূনতম কর্মসূচিতে একমত হয়ে টানা পনেরো মাস ধরে আপোশহীন আন্দোলন চালাতে পারে, মহিলারাও মুখ্য ভূমিকায় উঠে আসতে পারেন, প্রবল শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে, ঘরছাড়া হয়ে তাঁরা আন্দোলন চালাতে পারেন এবং প্রায় হাজার মৃত্যু শোক মুখ বুজে সহ্য করে নরেন্দ্র মোদীর দম্ভ ঘুচিয়ে দিতে পারেন।
কিন্তু তার পরেও কৃষিতে বরাদ্দ তলানিতে এসে ঠেকেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কারণে সারে ব্যাপক হারে ভর্তুকি কমেছে, অথচ বিরাট কর্পোরেট সংস্থাকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ ও তার সুদ ছাড় দেওয়া হচ্ছে, কৃষিকে বড় বড় কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া চলছে, দেশের বীজ, সার, কীটনাশক, বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে, তার ফলেই সার, বীজ, কীটনাশকের দাম বেড়েই চলেছে, অন্যদিকে কৃষি ক্ষেত্র থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, বিদেশ থেকে ইউরিয়া সহ অন্যান্য সারের আমদানি বাড়ছে, ফলে সারের দাম বাড়ছে, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৯০ লক্ষ কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। কৃষি প্রধান দেশে কৃষকদের ফসলের কোন নিরাপত্তা নেই। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণতান্ত্রিক রাজনীতির যতটুকু প্রসার মানতে হবে তা যতখানি শ্রমিক আর ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে, ততটাই কৃষক আন্দোলনের কারণে। বলা হয় দেশের চাষিদের ৭৮ ভাগ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষি, তা হলে তাঁদের আন্দোলনের প্রভাব তো সাধারণ নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। সারা ভারতের কৃষক সাধারণ নির্বাচনে তাদের বঞ্চনার বোধ থেকেই সাড়া দেবেন।