কোথায় গেল বাঙালিদের শত শত বাড়ি?
ধুলো ওড়া রাস্তায় কংক্রিটের ঠাসা দোকানগুচ্ছের মাথার উপর দিয়ে একটা লাল রঙের বাড়ির মাথা উঁচিয়ে আছে। আমার রিকশাওয়ালাকে বললাম, একটু দাঁড়াও, বাড়িটা দেখে আসি।
কিন্তু, না। সেখানে কাছ ঘেষতে পারলাম না। চারদিক থেকে নতুন কংক্রিটের বস্তি এমনভাবে ঘিরে ধরেছে, শুধু ওই ভেঙে পড়া বাড়িটির লাল চূড়া দেখেই ফিরে আসতে হলো।
স্মৃতি-বিস্মৃতির মধুপুর
মধুপুরের রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে একটা বড় দোতলা বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়ালাম। বাড়িটির গেটের স্তম্ভে মার্বেল ফলক-এ বাংলা অক্ষরে লেখা আছে ‘রাজেন্দ্র ভবন’। সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। আর রাস্তার উপরে দুটি পৃথুল স্তম্ভ ও গ্রিলের গেট।
গেটের কাছে যেতেই একটি তরুণী এগিয়ে এলো, আমাদেরকে বললো সে বাংলা জানে না। তারপর আমাদের প্রশ্নের উত্তরে বললো, তার “পরদাদা” অর্থাৎ প্রপিতামহ এই বাড়িটা কোনও বাঙালির কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। কিন্তু নেহাতই সৌজন্যবশত ওই বাংলা অক্ষরের ফলকটি সরানো হয়নি।
কতোই পুরনো ভগ্ন ও অর্ধ ভগ্ন বাড়ি দেখলাম, যেখানে মার্বেল ফলক স্পষ্টতই খুঁড়ে তুলে ফেলা হয়েছে। কোথাও বাংলা অক্ষরের মার্বেলের উপরে ধ্যাবড়া করে কালি দিয়ে বর্তমান বাসিন্দার নাম লিখে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিটি বাড়ির প্যাটার্ন একই রকম। প্রতিটি বাড়ির সামনে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা। গেটে দুটি বড় বড় থাম। আমার রিকশাওয়ালা ‘জাহাজবাড়ি’ নামক বিশাল এক প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলায় বললো, দেখছেন এই এক-একটা থাম বানাতেই এক লক্ষ টাকা খরচ হয়ে যাবে।
মধুপুরের বাহান্ন বিঘা, শেখপুরা ও পাথরচাপটি এলাকায় বাঙালিদের প্রচুর বাড়ি — হয় জবরদখল হয়ে গেছে, কিংবা বাহুবলীদের দাপটে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয়ে গেছে। কোথাও কেয়ারটেকার ভক্ষক হয়েছে। শুধু এখনও বাংলা অক্ষরে ম্লান স্মৃতির একটুকরো আলো লেগে আছে, ‘তারা কুটীর’, ‘স্মৃতিকণা’, ‘চলতিপথ’, ‘অন্নপূর্ণা আশ্রম’, “সাধুসঙ্ঘ’, ‘প্রিয়কানন’, ‘অর্চ্চনা’, ‘আরতি’ ‘অঞ্জলি’, ‘সোনার বাংলা’, ‘সিন্ধু বিশ্রাম’ নামক বাড়িগুলির গায়ে।
একটি মার্বেল ফলক-এ ইংরেজিতে লেখা আছে ‘River view’ — কার বাড়ি এটা? সামনের গেটে তালা লাগানো আছে। গেটের পরেই বিশাল ফাঁকা জায়গা— ঝরাপাতার স্তূপ ও ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি। গেট থেকে অনেকটা দূরে একেবারে শেষপ্রান্তে একতলা একটি বাড়ি, জঙ্গলে ঢাকা। গেটে লেখা আছে — Not for sale.
এই বাড়িটি ছিলো দন্তচিকিৎসার প্রবাদপুরুষ ‘পদ্মভূষণ’ ডা. আর আহমেদের বাড়ি।
একটি বাড়ির গেটের স্তম্ভে লেখা আছে — যূথিকা ঘোষ, পি-৬১ সুন্দরীমোহন এভিনিউ, কলকাতা ১৪ — অন্য পাশে লেখা ‘সোনার বাংলা’। বাড়িটিতে ঢুকে দেখলাম, একজন কেয়ারটেকার আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, এই বাড়িটির মালিক কে ?
তিনি বললেন, এই বাড়িটি আশুতোষ ঘোষের। নাম শুনেছেন? ‘আশু ঘোষ’ বললেই সবাই চিনতে পারবে। পশ্চিমবাংলার কংগ্রেস আমলের মন্ত্রী।
— উনি তো বহুকাল আগেই মারা গেছেন।
— ওই দেখুন আশুবাবু ও তাঁর স্ত্রীর সমাধি।
— এখন কেউ কি আসেন এখানে ?
— আশুবাবুর ছেলে মারা গেছেন, আশুবাবুর পৌত্রী সপরিবারে মাঝেমধ্যেই আসেন।
‘প্রিয়কানন’ নামে একটি বাড়ি দেখে রিকশা থেকে নেমে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। বাড়িটির মাথায় লেখা আছে — Not for sale. মার্বেল ফলক দেখে জানা গেল, বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ১৯১৭ সালে। আমাদেরকে দেখে একজন পরিচারিকা বেরিয়ে এলেন, তিনিই কেয়ারটেকার, বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, প্রিয়গোপাল বিষয়ীর নাম শুনেছেন?
— হ্যাঁ, শুনেছি। বড়বাজারে কাপড়ের দোকান?
— ঠিক। এই বাড়িটা তাঁরই।
— তাঁর বংশধরেরা কেউ কি আসেন এখন?
— হ্যাঁ, প্রায়ই আসেন তাঁরা।
হিন্দিতে নাম লেখা দুটি পুরনো বাড়ি দেখলাম — চম্পা ভবন ও সীতারাম ভবন। মনে হলো, এদুটোও একদা বাঙালিদের বাড়ি ছিলো। কারণ, সেই একই ডিজাইন, একই ছাঁচে ঢালা বাড়ি।
আমি দুটোদিন ঘোরাঘুরি করেও সব পুরনো বাড়ির অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। ‘ব্রজ ধাম’ ‘গিরি কুটির’, ‘মহেন্দ্র স্মৃতি’, ‘শৈল নিবাস, ‘ননী ভিলা’ — সর্বোপরি ‘দ্বিজাশ্রম’ এগুলো এখনও আছে — না, নেই— আমি জানি না।
— ‘মধুপুর রাজবাড়ি’ দেখবেন? বললো আমার রিকশাওয়ালা। সে দিব্যি বাংলা বলতে পারে।
— চলো যাওয়া যাক।
একটা সাদা রঙের বিশাল বাড়ি, তার সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। বাড়ির এক পাশে ৮০ ফুট উঁচু টাওয়ার। এই বাড়িটিকেই স্থানীয় লোকেরা ‘রাজবাড়ি’ বলে।
বাঙালিরা যাওয়ার আগেই সেখানে ব্রিটিশ ও এ্যাংলো সাহেবেরা বাড়ি তৈরি শুরু করেছিলেন। ১৮৮৮ সালে লেফটেন্যান্ট আলফ্রেড বেঞ্জামিন নামে এক ব্রিটিশ অফিসার মধুপুরে এই ‘রাজবাড়ি’ বানিয়েছিলেন।
১৯০১ সালে বেঞ্জামিন তাঁর বাড়িটা বিক্রি করে দিলেন পাথুরিয়াঘাটার রাজা যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এঁরা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অন্য একটি শাখা।
যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িটার খোলনলচে পালটে দিয়ে রি-মডেলিং করলেন, তখনই ওই টাওয়ার বানিয়েছিলেন। বাড়িটির নতুন নাম দিলেন ‘টেগোর কট’।
‘টেগোর কট’-এ এখন টুরিস্টেরা থাকতে পারে। বাড়ির মালিক হলেন ঝাড়খণ্ডের এক বিধায়ক।
ইটাচুনার কন্ট্রাক্টার ‘রায়বাহাদুর’ বিজয়নারায়ণ কুণ্ডু যেখানে বাঙালিবাবুদের জন্য অনেক বাংলোবাড়ি বানিয়ে রেখেছিলেন, সেই এলাকার আজকের নাম “কুণ্ডু বাংলো” এলাকা। বয়স্ক লোকেরা বলেন, এই এলাকাটি বাগানে ঢাকা ছিলো — আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, বাতাবি লেবুর গাছ ছিলো অজস্র। এত গাছ ছিলো যে গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ ঢুকতে পারত না সেসময়। … এখন এই এলাকার চরিত্র পাল্টে গেছে। মানুষজনও আলাদা। ফলের গাছগুলো কাটা পড়েছে। রাস্তার দু-পাশে অজস্র দোকান। রাস্তায় চলছে অটোরিকশার সারি। যে কোনও ছোট শহরের ধুলো, নোংরা, অবিন্যস্ত দোকানপাট, সেটাই আজকের মধুপুর।
এখন বেড়াতে যাওয়ার মতো কোনও আকর্ষণই সেখানে টিকে নেই। শুধু ঝাড়খণ্ডের দু’একজন মানুষ ‘কলকাতা’ শব্দটি মনে রেখেছেন বৈ কি — তাই দোকানের সাইনবোর্ডে দেখতে পেলাম — “Kolkata Ply & Glass” এবং “Kolkata Ayurvedic” !!!!
কিন্তু শুধুই কি বাঙালির স্মৃতি এই মধুপুরে?
ইংল্যাণ্ড থেকে জনৈক এলিয়ট আব্রাহাম ইন্টারনেটে লিখছেন —
“এখন ইংল্যান্ডে বসবাস করছি, আমরা ১৯৫০-এর দশকে ‘ক্যালকাটা’য় থাকতাম (তখন এটাই বলা হত) এবং আমরা প্রতি বছর মধ্য-ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি স্কুল ছুটির সময় ৪ সপ্তাহের জন্য মধুপুরে বেড়াতে যেতাম। আমরা ক্যালকাটা থেকে ট্রেনে উঠে মধুপুরে একটা ভিলা ভাড়া করতাম। আমরা সাধারণত ‘ইলিয়াস লজ’ বা ‘ফিল্ড ভিউ’ নামে একটি বাড়িতে থাকতাম। রেলস্টেশন থেকে একটি বড় খোলা জায়গা পেরিয়ে — যাকে আমরা ডাক বাংলো বলি, তারপরে দুপাশে বাড়ি এবং বাংলো সহ একটি সরু গলি, তারপর আরেকটি খোলা মাঠ পেরিয়ে— পৌঁছে যেতাম। খোলা মাঠের পাশে দুটি বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকত। আমার কিছু আনন্দের সময় সেখানে অতিবাহিত হয়েছে এবং আমাদের ছুটির দিনগুলোর এমন সুন্দর স্মৃতি আছে। যদি কেউ সম্প্রতি মধুপুরে গিয়ে থাকেন, তবে তাঁরা কি আমাকে বলতে পারবেন যে ‘ইলিয়াস লজ’, ‘ফিল্ড ভিউ’ এখনও টিকে আছে কি না ? আমার স্মৃতির মধুপুর কি এখনও সেই মনোহর গ্রামীণ পরিবেশ ধরে রেখেছে?” [সমাপ্ত]