সুপাঠ্য ও সুপাচ্য গবেষণাগ্রন্থ শুধু বাংলায় কেন, ইংরিজিতেও এখন দুর্লভ। সমসময়ের গবেষণাগ্রন্থরা হয় অতি-অতি-বিশেষজ্ঞভোগ্য (for super-specialized academia) নয় সাধারণ পাঠকের জন্য তেড়ে জল, ঢেলে নুন আর ঠেসে লঙ্কা দিয়ে এমনভাবে পরিবেশিত যাতে ভাতের অর্থাৎ মূল তথ্য, তত্ব, উপাত্ত (data) আর বিতর্কের অভাব ঢাকা পড়ে যায়। রঞ্জনা বিশ্বাস কবিতা, ফোকলোর এবং বেদে জনগোষ্ঠী নিয়ে শুধু শুষ্কং-কাষ্ঠং নৃতাত্বিক গবেষণাই করেন না, সাথে তিনি পদ্যগদ্যরসপ্রেমী এবং ঔপন্যাসিক-ও। তাই ৩৬০ পাতার একটি বইতে (বহু নবীন, প্রাচীন ফটোসম্বলিত) তিনি বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর মত একটি বিশাল-দুরূহ বিষয়ের ইতিহাস, বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং সবচেয়ে জরুরি— নিজে বেদেদের সাথে মিশে বহু বছরব্যাপী গবেষণার মাধ্যমে লব্ধ— নানা চিন্তা আর পূর্বমতের খন্ডন থালাভরা সুস্বাদে বেড়ে দিতে পেরেছেন— গণমোহিনী চাট মশলার ভেজাল বা নৈর্ব্যক্তিক গঞ্জিকাধূমের ওড়না দিতে হয়নি।
এই বইয়ের আঠেরোটি অধ্যায়ের শিরোনাম দেখা যাক — (১) মানুষের জাত, (২) বাংলাদেশের বেদেদের অবস্থান ও জনসংখ্যা এবং বেদে সম্পর্কে গবেষকদের মতামত, (৩) বেদে জনগোষ্ঠীর নৃতাত্বিক পরিচয়, (৪) প্রাচীন বাংলার আদিবাসী সংস্কৃতি ও বেদে, (৫) বেদে জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সংস্কৃতি, (৬) বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা : উৎস ও তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, (৭) ঠার ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ব ও বাক্যতত্ব, (৮) ঠার ভাষার শব্দ পরিচয়, (৯) বেদে জনগোষ্ঠীর ধর্ম, (১০) বেদে জনগোষ্ঠীর পেশা ও শ্রেনিবিভাগ, (১১) বেদে জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, (১২) লোকচিকিৎসায় বেদে, (১৩) বেদে জনগোষ্ঠীর সংগীত ও তাদের লোককাহিনি, (১৪) বেদে জনগোষ্ঠীর বিচিত্র উৎসব বেড়া ভাসানো ও ঝাপান, (১৫) প্রাচীন বৈদিক ও সংস্কৃত সাহিত্যে বঙ্গজনপদবাসী ও বেদে, (১৬) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বেদেদের সমাজ পরিচয়, (১৭) আধুনিক যুগের সাহিত্যে বেদে প্রসঙ্গ, (১৮) সরকারের উন্নয়ন ভাবনা ও বেদে জনগোষ্ঠী, পরিশিষ্ট: জিপসি ও বেদে। যেকোনো অভিজ্ঞ পাঠক বা সম্পাদক-ই ধরতে পারবেন যে রাই-কুড়িয়ে-বেল গবেষণাগ্রন্থের জগতে এই রসদ থেকে ১৮টি বই বা ১০৮টি পেপার তয়ের হ’তে পারে, আর তথাকথিত ফেবু মোহিত বঙ্গপাঠক সমাজের জন্যে হয়তো (১৭) তম অধ্যায়ের বাইরে আমপ্রকাশকরা কিছুই ছাপতে চাইবেন না।
এখানে কিন্তু লেখক রঞ্জনা বিশ্বাস গবেষক আর আমপাঠক, দু-পক্ষের জন্যই অকৃপণভাবে নৃবিজ্ঞানের সমস্ত মূল তত্ব, গোষ্ঠীগবেষণার জ্ঞানধারা আর নিজের অর্জিত জ্ঞানের সর্বাঙ্গ চুম্বক আকারে সাজিয়ে দিয়েছেন। নিজে সাহিত্যরসপ্রেমী বলে বেদেদের কল্পিত সাহিত্যরূপের প্রতি আমাদের আকর্ষণকে খাটো না করেও, সবিনয়ে তার বিষাক্ত রোমান্স আর নৃতাত্বিক ভুল ধরিয়ে দিয়েও, সেই দৃষ্টিকোণকে সংস্কৃতিগবেষকের (Cultural Studies scholar) জ্ঞানাঞ্জনশলাকা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। বেদেদের উদ্ভব, তাদের ভাষার জাত, তাদের লিঙ্গসাম্য আর নিয়মরীতি নিয়ে পন্ডিতি ভুল আর সাধারণ প্রমাদের যে শতাব্দীব্যাপী ভুলভুলাইয়া, তাকে সযুক্তি আর সবিনয় খণ্ডন করেছেন, কোনো ভদ্রবিত্ত প্রগতিশীল দায় থেকে বেদেদের অপদেবতা থেকে উপদেবতা বানিয়ে নয়, তাদের রক্তমাংসের মানুষ রেখেই।
আর সর্বোপরি শুধু নতুন তথ্য বা নতুন মতের সমাহার নয়, নানা নতুন ভাবনারও মাটি উস্কে দেয় ‘বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী’ (আমার ক্ষেত্রে পটুয়া আর বেদেদের যোগাযোগ নিয়ে)। তাই অনেক বানান ভুল আর সম্পাদনার খামতি থাকা সত্বেও এই বই, এই আঙ্গিকে ছেপে কলাবতী মুদ্রা আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন।
বই :বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী, কলাবতী মুদ্রা, ৩৬০ পাতা (সচিত্র), ৫৩০ টাকা